ফেলানীকে হত্যা করেছে কারা?

২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভোরবেলায় বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম সীমান্তে ভারতের কোচবিহার জেলার অন্তর্গত চৌধুরীহাট সীমান্ত চৌকির কাছে কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় ১৫ বছর বয়স্ক ফেলানী খাতুন বিএসএফের কনস্টেবল অমিয় ঘোষের গুলিতে নিহত হয়। মৃত্যুর পর বেশ কিছু সময় ফেলানীর দেহ কাঁটাতারের বেড়ার ওপরই ঝুলে ছিল। এ ঘটনার বিষয় পত্রপত্রিকাসহ অন্যান্য মাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর বাংলাদেশ, ভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনগণের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এভাবে ঝুলন্ত মৃতদেহের ছবি দেখে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হলেও ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীর হাতে বাংলাদেশিদের নিহত হওয়ার ঘটনা সেটাই প্রথম ছিল না। তার আগে এবং পরেও নিয়মিতভাবে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা দুই দেশের সীমান্তে বাংলাদেশিদের নির্বিচারে হত্যা করে আসছে। এর রিপোর্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে কিছু লোকে এর বিরুদ্ধে বলে, কোনো কোনো সংবাদপত্রে এ নিয়ে সামান্য কিছু লেখালেখি হয়। কিন্তু তার দ্বারা বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড ও বাংলাদেশ সরকারের কোনো কার্যকর প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। এই নিয়মিত হত্যাকাণ্ড বন্ধের কোনো উদ্যোগ তাদের দিক থেকে দেখা যায় না। অবস্থা দেখে মনে হয়, বাংলাদেশ সরকার ও তাদের বর্ডার গার্ডের এই নির্লিপ্ততা দেখে ভারতের বিএসএফ বা সীমান্ত রক্ষীরা বেশ বেপরোয়াভাবেই তাদের হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যায়।
ফেলানীর মৃত্যুর দুই বছরের বেশি সময়ের পর সেই হত্যার বিচারের জন্য ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে কোচবিহারে জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস নামে বিএসএফের একটি আদালত বসানো হয়। তাতে কনস্টেবল অমিয় ঘোষের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় ‘অনিচ্ছাকৃত খুন’ (পঁষঢ়ধনষব যড়সরপরফব হড়ঃ ধসড়ঁহঃরহম ঃড় সঁৎফবৎ) এবং বিএসএফ আইনের ১৪৬ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। ৩০৪ ধারায় অভিযোগ আনার সময় ধরেই নেওয়া হয় যে, অমিয় ঘোষ কর্তৃক ফেলানী হত্যা একটি অনিচ্ছাকৃত ব্যাপার। কাজেই তাকে প্রকৃতপক্ষে হত্যা বলা যায় না! যা-ই হোক, এই বিচারের সময় ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলামকে সাক্ষী দেওয়ার জন্য ডাকা হয়। সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তিনি কুড়িগ্রাম থেকে কোচবিহার যান এবং সাক্ষ্য প্রদান করেন। সেখানে সাক্ষ্যদানকালে তিনি তার চোখের সামনে তার মেয়েকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তার বিশদ বিবরণ দেন এবং মেয়ের হত্যাকারীর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করেন। বিএসএফ ছাউনিতে যে পাঁচজন বিচারক বিচার প্রক্রিয়া পরিচালনা করেন, তারা নিজেদের বিচার কাজ সমাধা করে রায় দেন যে, অমিয় ঘোষ নির্দোষ! বিএসএফের কর্মকর্তারা জানান যে, বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য রায়টি বিএসএফ মহাপরিচালকের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, এই তথাকথিত চূড়ান্ত অনুমোদনের আগেই আটক অমিয় ঘোষকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যে বিচারকরা এভাবে অমিয় ঘোষকে ছেড়ে দেওয়ার রায় দিয়েছেন তারা তাদের রায়ে বলেছেন যে, আসামি অমিয় ঘোষের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ তারা পাননি! অর্থাৎ ফেলানীর বাবার সাক্ষ্য তাদের কাছে বিবেচ্য বলে একেবারেই মনে হয়নি! ঝুলন্ত ফেলানীকে গ্রেফতার করার যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও সে চেষ্টা না করে তাকে পাখির মতো হত্যা করা কোনো অপরাধ বলে বিএসএফ আদালতের কাছে মনে হয়নি। না হওয়ারই কথা। পুলিশের হত্যার বিচার যেমন পুলিশের তদন্তের ওপর নির্ভর করে হয় না, তেমনি বিএসএফের মতো বাহিনীর লোকের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচারও যে বিএসএফের আদালতে হওয়ার নয়, এটাই ফেলানী হত্যা বিচারের রায়ে ভালোভাবে দেখা গেল। বিএসএফ কর্তৃক ফেলানী হত্যার বিষয়ে কোনো সংশয় কারও নেই। কাজেই অমিয় ঘোষ যদি হত্যাকারী না হয়, তাহলে হত্যাকারী কেথ সে বিষয়ে তদন্তের কোনো প্রয়োজনই বিএসএফের আদালত মনে করেনি। এ ক্ষেত্রে হাস্যকর হলেও নির্মম কাণ্ড হলো বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনের। এই বিচারের রায় দেখে বিচলিত না হয়ে তারা সকলকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়েছেন!
ফেলানীর বাবাসহ তার সমগ্র পরিবার বিএসএফ আদালতের এই রায় প্রত্যাখ্যান করে এই মামলার পুনর্বিচার দাবি করেছেন। তারা দাবি করেছেন অমিয় ঘোষের প্রাণদণ্ডের। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন মানবধিকার সংগঠন এই রায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে একে তারা প্রত্যাখ্যান করেছেন। কলকাতার মানবাধিকার সংস্থা সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) সেক্রেটারি কিরীটী রায় বলেন, ‘বিএসএফ সীমান্তে কেবল ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেনি, বিচারের নামে নাটকও সাজিয়েছে।’ নাটক সাজানোর কথা ফেলানীর বাবা এবং পরিবারের অন্যরাও বলেছেন।
আজ পর্যন্ত সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে শত শত বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও তার কোনোটিরই কোনো বিচার হয়নি। এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের কাছে কোনো নির্দিষ্ট অভিযোগও কোনো সময় উত্থাপন করেনি। প্রকৃতপক্ষে তারা বিএসএফকে তাদের হত্যাকাণ্ডের জন্য বরাবর ছাড় দিয়েই এসেছেন। বাংলাদেশ সরকারের এই নির্লিপ্ততা এবং সীমান্তে নিজেদের নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে অক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই বিএসএফের সৈন্যদের বেপরোয়া করেছে। তারা বাংলাদেশের কোনো প্রতিক্রিয়ার তোয়াক্কা না করে নিয়মিতভাবে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা করে চলেছে। দুই দেশের সরকারের মধ্যে অনেক গালভরা চুক্তি হলেও এ নিয়ে কোনো আলোচনা ও চুক্তির কোনো ব্যাপার কখনও দেখা যায়নি। বলা দরকার যে, সীমান্তে যারা বিএসএফের হাতে নিহত হচ্ছে তারা গরিব লোক, জীবিকার তাড়নায় তারা এপার-ওপার করতে গিয়েই মারা পড়ছে। গরিব লোকদের এভাবে নিহত হওয়ার জন্য বাংলাদেশে বড়লোকদের সরকারের কোনো মাথাব্যথা না থাকা কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। বিএসএফের আচরণ ও নিয়মিত হত্যাকাণ্ডের ফলে কীভাবে বাংলাদেশের বেইজ্জতি হচ্ছে সেটাও বাংলাদেশ সরকারের কোনো বিবেচনার বিষয় নয়!
২০০১ সালে বাংলাদেশের সিলেট জেলার পদুয়া এবং কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারীতে বিএসএফের জওয়ানরা অবৈধভাবে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ড দখল করার চেষ্টার সময় জনগণ ও বিডিআরের জওয়ানদের সঙ্গে সংঘর্ষে কয়েকজন বিএসএফ জওয়ানের মৃত্যু হয়। সে ঘটনা নিয়ে ভারত সরকার জোর প্রতিবাদ করে এবং দাবি করে বিডিআরের প্রধান মেজর জেনারেল ফজলুর রহমানের অপসারণ। ভারতের দাবি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার সে কাজ করে। শুধু তা-ই নয়, পরবর্তী পর্যায়ে বিডিআরের বিলুপ্তি ঘটিয়ে বাংলাদেশ সরকার সীমান্ত রক্ষার জন্য গঠন করে ‘বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড’। এই হলো ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চরিত্র। এই অধীনতামূলক সম্পর্ক বজায় রেখেই বাংলাদেশ সরকার কাজ করছে। কাজেই ভারত বাংলাদেশকে তিস্তার পানি না দিলেও এবং ছিটমহল সমস্যার সমাধান না করলেও বাংলাদেশ ভারতকে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সব রকম সাহায্যই করে এসেছে। উলফা নেতা অরবিন্দ রাজখোয়াসহ অনেককে তারা ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ করে। ত্রিপুরায় গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশ নিজের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে ভীষণ ভারী ও বিশাল আকারের জেনারেটর নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে, যা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি ও সংকীর্ণ পথে কিছুতেই সম্ভব হতো না। ভারতের ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক তার পত্রিকায় এক প্রবন্ধে বলেছেন যে, ভারতের প্রতি শুভেচ্ছা প্রদর্শনের জন্য বাংলাদেশ সরকার বিডিআর বিলুপ্ত করেছে (ডেইলি স্টার, ২.৯.২০১৩)! এসব থেকে অসম্মানজনক ব্যাপার বাংলাদেশের জন্য আর কী হতে পারে? বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের নিয়মিত হত্যাকাণ্ড এবং ফেলানীর মতো গরিবের হত্যাকাণ্ডের বিচারের নামে প্রহসন নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে যে কোনো বোঝাপড়ায় যাওয়ার মধ্যে যাচ্ছে নাথ এসবই সরকারের পূর্ববর্তী সব আচরণের মতো ভারতের প্রতি তাদের নতজানু অবস্থানেরই প্রমাণ ছাড়া আর কী?

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *