পক্ষ-বিপক্ষ বনাম বাস্তবতা

উদ্বেগজনকহারে যখন কর্তৃত্ব হারাচ্ছে পশ্চিম, কর্তৃত্ববাদী পররাষ্ট্রনীতি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে পূর্বে। মোদির একক কর্তৃত্ববাদের সমালোচনা করল ‘ইকনোমিস্ট’। কাউকে সাথে নেন না তিনি। ‘শেখ হাসিনা এখন মাহাথির হওয়ার পথে।’ মোহাম্মদ নাসিমের ঘোষণাটির অর্থ গভীর। সম্প্রতি জ্ঞানীগুণীদের মন্তব্য শুনলে মনে হওয়ার কারণ নেই, অধিকাংশই ভাজা মাছটি পর্যন্ত উল্টে খেতে জানে না। ভারতের কাছে বকেয়া পাওনায় যে নতুনত্ব নেই, এ সত্য বলার মতো একজন লোকও নেই। ৬৭ বছর ধরেই লাগাতার যুদ্ধ-দাঙ্গায় রক্তক্ষয় করেও ক্লান্তিহীন আমরা। সুপথে চালানোর কেউ নেই। এই দফায় পক্ষ-বিপক্ষের যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে একক কর্তৃত্ববাদ সম্প্রসারিত করা হয়েছে। ট্রায়াল ল’ইয়ারদের প্রধান কৌশল যখন সত্য মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়, তখন মেসেঞ্জারের চরিত্র হননে লিপ্ত। এই সরকারের দুইটার্মে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ধামাচাপা দিতে গিয়ে জিয়া পরিবারের চরিত্রহনন এমন পর্যায়ে, গণতন্ত্রের আর কোনো প্রয়োজন নেই। অবশেষে সেটাই সাফ জানিয়ে দিলেন জনাব নাসিম।
ক. ইতিহাস বলে, প্রাচীন মিসরে অত্যাচারী রাজাদের অন্যতম কৌশল ছিল ক্রীতদাসদের মধ্যে সার্বক্ষণিক ঝগড়া বাধিয়ে রাখা যেন অত্যাচারের কথা মনে না করতে পারে। ফলে ক্রীতদাসেরাও নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ে ব্যস্ত থাকত, যেমন এখন আমরা আছি। যতদূর মনে পড়ে, নিকট অতীতেও পক্ষ-বিপক্ষ দরজা ছিল না, এমন রক্তক্ষয় কখনোই দেখিনি। বড় হয়েছিÑ শৃঙ্খলা, শ্রদ্ধাবোধ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ভারসামের মধ্য দিয়ে। ইসরাইল-ফিলিস্তিনের মতো পশ্চিমতীর নেই কিন্তু ২০০৯ সন থেকে তাদের মতোই রক্তক্ষয়ে লিপ্ত। স্বদেশীদের একপক্ষকে বানানো হয়েছে বিপক্ষের শক্তি, অন্যেরা পক্ষের; অথচ ওই দেশ দু’টি ভিন্ন ভূখণ্ড এবং ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির; কিন্তু আমরা তা নই। কৌশলটি হলোÑ ইতিহাসের একটি ঘটনাকে জিম্মি করে পক্ষ-বিপক্ষের অবাস্তব থিওরি। বিষয়টি যদিও ’৭৩ সালেই দালিলিকভাবে শেষ করেছিলেন শেখ মুজিব এবং ’৭৫-এর পর সদ্যমুক্ত বহুদলীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে সব দলের জন্য সমান সুযোগ, এমনকি বাকশালীদেরও। যে কথা ইতিহাসবিদরাও অস্বীকার করবেন না, ’৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারিতে মাত্র ১৩ মিনিটে আওয়ামী লীগ নিজেকে নিজেই নিষিদ্ধ করে একদলীয় শাসন ঘোষণা করে, যা কয়েক মাস কার্যকরও ছিল। ‘বাকশাল’ মানেই সব দল বিলুপ্ত করে একটি মাত্র দল, আজীবন রাষ্ট্রপতির ব্যবস্থা এবং চারখানা সরকারি মুখপত্র। তখন বাহিনীগুলোকে শায়েস্তা করতে এতই ব্যস্ত থাকতেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের উন্নয়নে বেশি কাজ করতে পারেননি নেতা। বরং কোন পরিস্থিতিতে বাকশালের আবির্ভাব হলো, সবাই জানলেও মুখে কুলুপ। পরবর্তী সময়ে ব্যাপক উন্নতির শুরুটা অধিকাংশই কথিত বিপক্ষের শক্তির টার্মে।
যা সত্য, দেশ বিভাগের মাত্র ২৪ বছর পর, ব্রিটিশ শাসন অবসানের সাথে যুক্ত বাঙালিদের অনেকেই চাননি অন্য কোনো পরিবর্তনের দিকে যেতে। তার মানে নয়, কোনোভাবেই তারা জুইশ-ফিলিস্তিন কিংবা নাৎসিদের মতো। বরং স্বাধীনতার পরেই স্রোতের সাথে মিশে গিয়ে দেশের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছিল সবপক্ষ। ফলে ’৭২-৭৩-এর ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির অবসান। তখনকার শাসকেরা বিপদের মাত্রা অনুধাবন করার কারণেই সাধারণ ক্ষমা এবং পরে বহুদলীয় গণতন্ত্রের যাত্রা। রাজাকারেরা স্বেচ্ছায় আসেনি, বরং ‘মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স, রাওয়ালপিন্ডি, সেপ্টেম্বর ৭, ১৯৭১, অর্ডার নম্বর-৪৮৫২/৫৪৩/পিএস-১এ/৩৬৫৯/বি-২এ, নামে গেজেটের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত। তাদের যারা নিয়োগ দিলো, সে কর্তাদের অব্যাহতি দিয়ে ১৫০ টাকা বেতনের চাকরবাকরদের বিচারটাই এই দফায় আন্তর্জাতিক তোড়জোড়ের শেকড়। এখন পর্যন্ত রাওফরমান আলীর সাথে বিশেষ পরিবারের ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি মানুষের সামনে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ কথিত বিপক্ষের শক্তি। তা ছাড়া সরকারিভাবে শহীদের তালিকা বানাতে দারুণ অনীহা, উক্ত সময়ে ওই শক্তির সাংগঠনিক কাঠামো ও ক্ষমতা না থাকারই প্রমাণ। গণহত্যার বিষয়ও কারো কারো রাজনৈতিক এজেন্ডাভুক্ত।
এ দফায় আবারো বাকশালী এজেন্ডা নিয়ে মাঠ দখলে রেখেছে আওয়ামী লীগ। ব্লুপ্রিন্টের অংশ এই মাঠ, সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে পুনরুদ্ধারকে অসম্ভব করে ফেলা হয়েছে। কথায় কথায় নাৎসিদের সাথে একমাত্র বড় বিরোধী দলকে তুলনা করা সহজ, প্রমাণ করা কঠিন। বরং মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কাউকে দাঁড় করালে, ইতিহাসমোতাবেক ওদেরই পঞ্জিকা ভারী। মুক্তিযুদ্ধের সময় শীর্ষস্থানীয়দের অনেকেই দেশে ও ভারতে দুধে ভাতেই ছিলেন। এখন সব দোষ নন্দ ঘোষ। বিরোধী দল নিশ্চিহ্ন করার আলামতগুলো দিবালোকের মতো স্পষ্ট। যারা ইতিহাস জানেন, স্বীকার করবেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে তাদের অস্তিত্বই ছিল না, পার্টিও নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের বেলায় তা নয়, যা বাস্তব, জনস্রোতে মিশে গেছে সবাই। ফলে ২০ দল বিপক্ষের শক্তি হলে আওয়ামী লীগের মধ্যেও ভূরিভূরি কোলাবেটর ও বংশধরেরা বিস্তার লাভ করেছে। উভয়পক্ষের বিয়ে-শাদিও হচ্ছে; একসাথে সংসদে ও বাইরে। তাহলে কোনটা ফেলব, কোনটা রাখব! আইনের নামে যা করছে, গোয়েবলসও লজ্জা পেত। যারাই ’৭১-এর প্রশ্নে দ্বিমত করে ছিল, হাতেগোনা দুই-একজন ছাড়া কেউই দেশ ছাড়েনি, নিষিদ্ধও হয়নি, আত্মগোপনেও যায়নি বরং দেশে থেকেই দেশের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। এমনকি কালো তালিকাভুক্তদেরও অনেকেই মুক্তি পেয়ে জনস্রোতে। অতএব, পক্ষ-বিপক্ষের লড়াইটি সুনিশ্চিতভাবেই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক এজেন্ডা। বরাবরই আওয়ামী লীগ পাবলিককে ভুল বুঝিয়েছে, অনেকেই জীবনের ভয়ে মুখ বন্ধ রেখেছে। আমি সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্য হওয়ায় দুর্বলতার কারণ জানি। ৪৪ বছরেও মেরুদণ্ডহীনরা কূপমণ্ডূকতা থেকে বের হয়নি, এর অন্যতম দৃষ্টান্ত উখিয়া-রামুর মন্দির ধ্বংস। মন্দির জ্বালিয়ে দিয়েও টাকা দিয়ে কেনা যায়, ভোটের সময়ও প্রথম সারিতে। পক্ষ-বিপক্ষের বিষয়টি বিক্রি করে সবচেয়ে সুবিধা লাভ করেছে আওয়ামী লীগ, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সংখ্যালঘুরা। বিশেষ করে সুবিধাবাদী সমাজের পক্ষ থেকে লড়াইটি জাগিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সুড়সুড়ি, অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ।
২৫ বছর ক্ষমতায় ছিল না আওয়ামী লীগ, প্রথম দফায় কোনো কাজই করতে পারেনি। সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতি একপক্ষের দাবি, অসত্য ও বানোয়াট। যাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের এত অভিযোগ, তারাই কিন্তু বড় একটি সময় ধরে ক্ষমতায় বিধায় উন্নয়নের প্রথম চালিকাশক্তিও। ঢাকার জমির মূল্য ম্যানহাটানের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ সবার চেষ্টায় এগিয়েছে বাংলাদেশ। শুধু বিএনপিই নয়, আওয়ামী লীগও একাধিকবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংসদে এবং রাজপথে মুজাহিদ-নিজামীদের সাথে। তখন তাদের মধ্যে ঐতিহাসিক সমঝোতা আর ১০ম সংসদের দৃশ্য এক। সংসদ থেকে একসাথে পদত্যাগও করেছিল। গোলাম আযমের দোয়া পেতে আওয়ামী লীগের বাসনা এবং নিজামীদের সাথে নেতানেত্রীদের বৈঠকের ছবি দাপিয়ে বেড়ায় সোস্যাল মিডিয়া। তাহলে এখন কেন ফাঁসিতে ঝুলতে হলো, প্রশ্ন সেটাই। সোস্যাল মিডিয়া মিথ্যা বলে না, বলে আনসোস্যাল মিডিয়া। ’৭৩ নয়, ’৯৬তেও নয়, এবারই শুধু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসামাত্র হয় স্বাধীনতার পক্ষে নয় বিপক্ষে, মাঝামাঝি কিছু নেই। এর ব্যাখ্যাও আছে। বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তোলার কারণ, মাহাথির হওয়ার স্বপ্ন গণতন্ত্রের জন্য ভয়ানক দুঃসংবাদ। একই সারিতে ব্রাহ্মণ ও নমশূদ্র, দিবা স্বপ্নের মতো; যা বাস্তব, যারা আজ বিচারের কাঠগড়ায়, একমাত্র তারাই কার্যকর বিরোধীদল ছিল। একেবারে নিশ্চিহ্ন করতে, শীর্ষ ও মধ্যম সারির নেতাদের বেআইনের গিট্টুতে বেঁধে ফেলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের ভয়ে মাঠকর্মীরা লেজ গুটিয়েছে। ‘কম গণতন্ত্র বেশি উন্নতি’র ধুয়া তুলে বিরোধী দল নামে কিছুই রাখা হবে না, এটাই সঙ্কটের গোড়া। সব কিছুই আওয়ামী প্রচার প্রপাগান্ডার মধ্যে সীমাবদ্ধ। বলছি, একাই আওয়ামী লীগ সব করলে, ২৫ বছর অনুপস্থিতির হিসাব দেবে কে? আর ধোয়া তুলসিপাতা হলে, ওই অভিযোগগুলো খণ্ডাবে কে!
শ্রদ্ধা নিবেদন করতে সব পক্ষই স্মৃতিসৌধে যাওয়ার মানে একটাই, সবপক্ষই স্বাধীনতার পক্ষে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রে যা নয়। নিজামীদের গাড়িতে পতাকা দেখে আমিও প্রশ্ন তুলেছিলাম, এখন মনে করি, আওয়ামী লীগ মানেই পক্ষের শক্তি, কথাটি ভুল। মানুষ পরিস্থিতি ও পরিবেশের শিকার। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৪৮ সালে মোদির দল আরএসএস হত্যা করেছিল গান্ধীকে। কংগ্রেসকে স্থলসীমা চুক্তি করতে দেয়নি একমাত্র বিজেপি। অখণ্ড ভারতের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে মোদির দল। বাবরি মসজিদ ভাঙার তিন কারিগরের একজন মোদি। গুজরাটে দাঙ্গার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রেরও জঙ্গি তালিকায় ছিলেন। বিশ্ব কত দ্রুত ভুলে গেল, কে এই মোদি। এখন হিসাব পাল্টে গেছে।
পক্ষ-বিপক্ষের লড়াইয়ে শান্তিতে ঘুমাতে পারে না কেউ। মধ্য রাতে সাদা পোশাকের ভয়, এটা কোনো বেঁচে থাকা নয়। পশ্চিমতীর নয় কিন্তু অশান্তিও কম নয়। তাদের যুদ্ধবিরতি হলেও, আমরা বিরতিহীন যুদ্ধে লিপ্ত। ৪৪ বছর পর বুড়ো থুড়থুড়েদের ধরে বিচারের নামে অহেতুক পশ্চিমতীরের মতো উত্তেজনা সৃষ্টির প্রয়োজন আদৌ ছিল কি? স্বাধীনতার পর মাঠে কিংবা রাজনীতিতে তাদের কর্মকাণ্ড কি ফেলে দিতে হবে! প্রধান উদাহরণ প্রাইভেট সেক্টর। ’৭১ শেষ হতেই প্রবৃদ্ধির দুই-তৃতীয়াংশই গার্মেন্ট এবং ১৫ ভাগ প্রবাসী রেমিট্যান্সের মূল কারণ প্রাইভেট সেক্টরের সাফল্য। আমাদের দৃষ্টান্ত ভারতেও নেই। তাদের উন্নতির মূল চালিকাশক্তিÑ রাষ্ট্র ও ৪৭ সন থেকেই ধারাবাহিকভাবে মোদি পর্যন্ত চলমান। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যবসায় চালানো যে কত কঠিন, হাড়ে হাড়ে টের পান ব্যবসায়ীরা। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রাইভেট সেক্টরের অসামান্য সাফল্য, এমনকি নোবেল পর্যন্ত পেয়েছে। নিশ্চয়ই প্রতিষ্ঠানটির সাথে জড়িতরা সবাই একপক্ষের লোক নয়। তা ছাড়াও ৮০’র দশকে শুরু হওয়া গ্লোবাল প্রেক্ষাপটে, দেশে-বিদেশে যেখানেই বাঙালিরা গেছে, গড়ে তুলেছে ‘লিটল বাংলাদেশ’। রেগ্যান দিয়েছিলেন ব্যাপক অ্যামনেস্টি ও মুক্তবাজার অর্থনীতির সুযোগ যা লুফে নিতে এক মুহূর্ত দেরি করেনি বাংলাদেশীরা। ওই পুরোটা সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগ, ৩০৩ দিন হরতালসহ অবরোধ, অসহযোগ, জনতারমঞ্চ বানিয়ে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে, পিটিয়ে বহু মানুষ হত্যা করেছিল, যা এখন ইতিহাসেরই অংশ। এসব হত্যা, জ্বালাও-পোড়াওয়ের অপরাধ থেকে মুক্তি নেই। বিচার হলে বরং খালেদার আমলে তাদের হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু কেন হয়নি সেটাই প্রশ্ন। ওই সময়কালে বিভিন্ন দেশ হয়ে বৈধ-অবৈধরা নানান দেশে ব্যাপকহারে বসতি স্থাপন করে অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত রেখেছে। পরিশ্রম ও দেশপ্রেমে পক্ষ-বিপক্ষের সবার বাংলাদেশী ছাড়া আর কোনো পরিচয় নেই। বরং এই অশুভ থিওরিটি আওয়ামী গর্ভে জন্ম নেয়া একটি ভয়ঙ্কর চেহারার সন্তান। বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের সব পণ্যই পাওয়া যায়, হরতালেও মাল পৌঁছে যাচ্ছে পশ্চিমাদের হাতে, বিষয়টি সহজ কথা নয়। ভারতের তুলনায় কি আছে আমাদের? বিদ্যুৎ নেই, পারিশ্রমিক নেই, উচ্চহারে সুদ, সর্বত্রই প্রশাসনিক জটিলতা। বরং প্রাইভেট সেক্টরই রাষ্ট্রের ভরণপোষণের প্রায় ৮৫ ভাগ এবং এখানেই সব অভিযোগের উত্তর। রাষ্ট্্েরর নিজস্ব তেমন কোনো আয় নেই বরং অকাজে এত ব্যস্ত যে, ঠিকমতো করটুকু পর্যন্ত আদায় করে না। বিশ্বাসযোগ্য জরিপ হয় না, পরিসংখ্যান নেই, মন্ত্রীরা মনে করলেই আইন। আইনের শাসনের প্রশ্নে তিন টার্মেই দৃষ্টান্তগুলো একই রকম নৈরাজ্যকর। বাস্তবতা থেকে অনেক দূরত্বে আওয়ামী লীগ। দেশ শাসনের যোগ্যতা আছে কি না, জনমত সাপেক্ষে সেটাও বিচারযোগ্য।
’৭১ শেষ হতেই বিধ্বস্ত দেশটাকে গড়ে তোলার জন্য কৃতিত্ব সবার। প্রবাসী শ্রমিক, আবাসন, বিশ্বরোড়, গার্মেন্ট, বড়বড় সেতু, ব্যাংক, মিডিয়া… সবার কাজ। এসব বাস্তবতা সত্ত্বেও এই দফায় কেন ইস্রায়েল-ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা? ফলক উন্মোচনই সব নয়। ২৫ বছর আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল না, উন্নয়ন কাজগুলো শুরু হয়েছিল জিয়ার আমলে, এগিয়ে নিয়েছেন এরশাদ, শেষ করেছেন খালেদা। যদি বিশাল গার্মেন্ট শিল্প আওয়ামী কৃতিত্ব হয়ে থাকে, ধরে নিতে হয় জিয়া-এরশাদের আমলে কারখানার হাজার হাজার মালিক ও লাখ লাখ শ্রমিকের সবাই আওয়ামী লীগার। ৮০-এর দশকে তারবিহীন মোবাইল কমিউনিকেশনের যাত্রা যে কোনোক্রমেই আওয়ামী লীগ শুরু করেনি, এ কথা তারাও জানে। সাবমেরিন ক্যাবলের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব চারদলীয় জোটের। আর ৭৫ পরবর্তী ও ৯৬ পূর্ববর্তী সময়ে ব্যাপকহারে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ধরনের শিল্পের কৃতিত্ব যদি আওয়ামী লীগ দাবি করে, বলতেই হয়Ñ জিয়াউর রহমান থেকে খালেদা পর্যন্ত সবাই বেছে বেছে শুধু আওয়ামী লীগকেই নিয়োগ দিয়েছিলেন। তাহলে কী পরিমাণ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা উচিত? নিন্দুকও বলবে, কৃষির অভাবনীয় উন্নতির অগ্রপথিক জিয়া। সরকারের যে মুরোদ নেই, তার প্রমাণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভের পাহাড়। এর মানে, বিনিয়োগ নেই। উন্নতিশীল অর্থনীতিতে এটা খুব খারাপ লক্ষণ। জবরদখল ক্ষমতার কারণে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থুবড়ে পড়েছে। ঋণ নিয়ে মানুষ করবেটা কি? অর্থনীতির ভরাডুবিতে অর্থমন্ত্রী সুদের হার কমিয়ে দিলেন। কিন্তু পক্ষ-বিপক্ষের লড়াই না থামালে এসব করে যেকোনো কাজ হবে না, বুঝবে আরো পরে, যখন কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না। অর্থনীতির চালিকাশক্তি প্রাইভেট সেক্টর না হলে মাথাপিছু আয় পাঁচ ভাগের এক ভাগেই পড়ে থাকত। বাস্তবতা উপলব্ধি করে এখন শান্তির পথে আসা উচিত।
খ. স্বাধীনতা-উত্তর নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সমাধানের বিষয়টি ’৭৩ সালেই মুজিব মোটাদাগে বুঝে ফেলেছিলেন। তা ছাড়া উপায়ও ছিল না কারণ ১৯৪২ সালে থেকে যাদের নিয়ে রাজনীতি, ’৭১কে কেন্দ্র করে তাদের অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেন। খাজা খয়েরউদ্দিন, শাহ আজিজুর রহমান, খান এ সবুর খান, পীর মোহসেনউদ্দিন দুদু মিয়া… ’৭৩-এর ৩০ নভেম্বরের পর শেখ মুজিব নিজেই অনেককে মুক্তি দেন। এসবই পাবলিক দলিল বিধায় কারো বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করা যাবে না।
বরং সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ। প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে আসছে বাইরের অকুপেশন। এই তাণ্ডব ঠেকাতে পক্ষ-বিপক্ষ ভুলে একসাথে ঝাঁপিয়ে না পড়লে সর্বনাশ হবে। অমীমাংসিত যুদ্ধ জিইয়ে রেখে ৪৪ বছর ধরে কারা ফায়দা লুটছে, তাদের চিনি। কারা স্থায়ী অকুপেশন চায়, তাদেরও চিনি। কিন্তু পাঁচ ভাগ মানুষের ঔদ্ধত্যে ৯৫ ভাগ মানুষ অসহায়। ঈশ্বর অনুভূতিলব্ধ এরা নিজেদের ইচ্ছা জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছে ১৭ কোটি মানুষের ওপর। নিকট অতীতেও যা ছিল না, দৃশ্যত এখন জায়ন-মুসলমানদের মতো রক্তারক্তি বাধিয়ে রেখে একক ফায়দা লুটছে আওয়ামী লীগ। কিছু মানুষের জন্য দেশ ভয়ানক বিপজ্জনক, প্রবাসীদের দেশে যাওয়া কমেছে। এয়ারপোর্ট থেকে বেডরুম পর্যন্ত লাগিয়ে রাখা হয়েছে সাদা পোশাকের গেস্ট। কিন্তু আমাদের দেশে সিরিয়া-লিবিয়ার মতো যুদ্ধ হচ্ছে না, ফিলিস্তিনের অবস্থাও নেই, তাহলে হচ্ছেটা কী? যদি নেলসন ম্যান্ডেলার মতো দীর্ঘ অত্যাচারিত মানুষটিও দেশের স্বার্থে শত্র“দের সাথে হাত মেলাতে পারেন, বাংলাদেশের বেলায়ও সম্ভব। যারাই দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিটিশ অকুপেশনের কথা জানেন, স্বীকার করবেন, যৌবনের পুরোটা সময় স্বাধীনতাকামী ম্যান্ডেলা জেলে, সন্তানের শেষ কৃত্যে পর্যন্ত যেতে দেয়নি, ইট ভাঙতে হয়েছে ২৭ বছর। প্রায় ১০০ বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় কি পরিমাণ অত্যাচার করেছিল শ্বেতাঙ্গরা, সেটাও কি অস্বীকার করবেন পক্ষের ইতিহাসবিদেরা? ক্ষুব্ধ আফ্রিকানদের প্রতি ম্যান্ডেলার বক্তব্যÑ তোমরা কি শান্তি চাও, নাকি রক্তক্ষয়? জানি ওরা অত্যাচার করেছে, কিন্তু ২০% জনগোষ্ঠী শ্বেতাঙ্গ, এরা দেশেই থাকবে। সুতরাং গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে রাখলে দক্ষিণ আফ্রিকা কখনোই স্বাধীনতার সুফল ভোগ করবে না। ফলে আফ্রিকানদের সম্মতিতেই শত্র“দের নিয়ে দুইটার্ম রাষ্ট্রপতি ম্যান্ডেলা, ইতিহাসের অন্যতম সফল রাষ্ট্রনায়ক। আফ্রিকাকে গড়েছেন উন্নতি এবং সম্মৃদ্ধির পথে। ম্যান্ডেলা মডেল সারা বিশ্বে প্রশংসিত এবং এই কাজটিই মুজিব করেছিলেন ১৯৭৩ সালে, কিন্তু পাল্টে দিলেন কন্যা। যেভাবে দেশ চলছে ৯৫ ভাগ মানুষই ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট। মধ্যরাতে বেডরুমে সাদা পোশাকের গেস্ট কেউই দেখতে চায় না, চায়নি, হাসিনা আহমেদও কিন্তু সেটা হয়নি।
গ. ৫%-এর সরকার দিয়ে উন্নতি হয় না, লাগে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী। বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার হরণ করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী হয়নি কারোই। হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো বিশাল শক্তির পতন অসম্ভব। আয়ের প্রায় ৮৫ ভাগই প্রাইভেট সেক্টরের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কৃতিত্ব। স্বাধীনতার পর থেকেই সরকারগুলোর যা মুরোদ, ১৭ কোটি মানুষের মাথাপিছু আয় হতো বড়জোর ১৫০ থেকে ২০০ ডলার। রাষ্ট্রের দাবি ১৩১৫ ডলার। ১৭ কোটি মানুষ এক প্লাটফরমে না দাঁড়ালে মাথাপিছু আয় ২০০ ডলার অতিক্রম করতে কত বছর লাগতো কেউ জানে না। বাস্তবতার আলোকে ম্যান্ডেলার বহু আগেই বিষয়টির মীমাংসা সত্ত্বেও পুরুজ্জীবিত করা কতটুকু উচিত, বিচার করার মতো মানুষের অভাব। বরং পক্ষের শক্তির নামে এখন ইতিহাস সুবিধাবাদীদের পকেটে। অথচ মুজিবের বাস্তবতার কারণেই সংসদে তারা, বাইরেও তারা। যুদ্ধাপরাধের কৌশলে ২০ দলীয় জোটকে নির্মূল করার প্রক্রিয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক, এতে গণতন্ত্রের ভিত নড়ে গেছে। আওয়ামী লীগ এর নাম দিয়েছেÑ ‘কম গণতন্ত্র বেশি উন্নতি।’ মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে কার্যকর গণতন্ত্র নেই। এখন ঘরে কেন, বনে গিয়েও রক্ষা নেই। বরং সংগ্রাম চলছে ১০ টাকা সের চালের। উন্নতির প্রপাগান্ডায় চাপা পড়ে যাচ্ছে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান একটি সোনার হরিণ। সাগরে ভাসা ৬০-৭০ ভাগ মানুষই দেশত্যাগী বাংলাদেশী, অনেকেই নারী ও শিশু। ওদের কথা সারাবিশ্ব জানে, সরকার জানে না। অথচ এরাই ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের দাবিদার। কোটি কোটি চাকরি দেয়ারও দাবিদার। সাগরের এই দৃশ্য যদি এমডিজিসহ ঝোলাভর্তি ডক্টরেট আর পুরস্কারের চেহারা, তাহলে পশ্চিমকে আবারো জাগতে হবে, ব্যবস্থা নিতে হবে। লিবিয়ার মতো বর্বর দেশে মানবসম্পদ পাঠানোর জন্য নতজানু মন্ত্রণালয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় মানবসম্পদ পাঠাতে উদগ্রীব। কিন্তু তারা স্বাধীন হয়েছে আমাদের ২০ বছর পরে। মধ্যপ্রাচ্যে লাখ লাখ শ্রমিক পাঠিয়ে কতই না উন্নতির ঢোল বাজাই। কিন্তু বছরে আসছে প্রায় তিনহাজার শ্রমিকের লাশ, যাদের প্রায় সবই অপমৃত্যু। বিদেশের জেলে, ক্রীতদাস মালিকের হাতে, বনে-জঙ্গলে, গণকবরে… অন্ন, বস্ত্রের আশায় হাজার হাজার বাংলাদেশীর ঠিকানা। এ দিকে গৃহকর্মীর নামে ৫০ হাজার মাবোনের মর্যাদা নিয়ে কথা। অতএব, মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদকে প্রশ্ন, এত উন্নতি হলেÑ এই হারে কেন দেশ ত্যাগ করছে মানুষ? দেশেই ভাত-কাপড় থাকলে কে চায় পরিবার ফেলে বিদেশীদের ঘানি টানতে? লীগ অস্বীকার করুক, সবারই বুদ্ধি-বিবেক পচেনি। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দাবিÑ ‘সাগরে ভাসা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই বাংলাদেশী, তারা শরণার্থী নয়, চাকরি প্রত্যাশী।’ (সূত্র: তাজা খবর, ২৩ মে)। তার এই বক্তব্য প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা বলা যায়। প্রধানমন্ত্রীর নিষ্ঠুর বক্তব্যে তোলপাড় আন্তর্জাতিক মিডিয়া।
এসব মানবেতর পরিস্থিতি সত্ত্বেও কিছু কথিত পক্ষের সুবিধাবাদীদের সুপারিশ, পশ্চিম তীরের উত্তেজনাকেই বাড়াবে। ৭৩, ৯৬তে বিচার হয়নি। এখন প্রয়োজন; কারণ, বিরোধীদলকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। হয়েছেও তাই। মাহাথির হওয়া সহজ, না হওয়াটাই কঠিন। হিটলারও জার্মানিকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ করতে চেয়েছিলেন। আমেরিকার আগেই অ্যাটোম বোমা তৈরি করেছিলাজার্মানি। আইনস্টাইন ও মেরি কিউরির মতো বিশ্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী তৈরির মূলে হিটলারের দূরদর্শিতা। যত দ্রুত মাহাথির হওয়ার স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশ, তত দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।
আমার অভিজ্ঞতায় রক্ষীবাহিনীর যুগ শেষে ২৫ বছর যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল না, তখন সাদা পোশাকের গেস্টদের নিয়ে কারোই দুঃশ্চিন্তা ছিল না। ‘অপারেশন ক্লিনহার্টের’ও ব্যাখ্যা করতে পারি কিন্তু সাদা পোশাকের গেস্টদের নয়। বিধাতা না হয়েও অসীম ক্ষমতাধর ওরা, ভয়ঙ্কর অদৃশ্য শক্তি।
নাৎসি কিংবা পশ্চিমতীরের থিওরি, উভয়ই আমাদের প্রেক্ষাপটে অবাস্তব। যত দ্রুত উপলব্ধি করব, ততই মঙ্গল। অবশ্যই মানুষ আইনের শাসন চায় কিন্তু পক্ষ-বিপক্ষের যুদ্ধে বৃহত্তর জনমত অগ্রাহ্য করায় রক্তক্ষয় বেড়েই চলেছে। আমরা আর মেপে মেপে বাঁচতে চাই না, স্বাভাবিক জীবন ফিরে চাই। বাকস্বাধীনতা ও ভোটের অধিকার ফিরিয়ে চাই। ৪৪ বছরের আলোকে ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জনমত যাচাই করাই এখন একমাত্র সমাধান। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যা রায় দেবে, ট্রাইব্যুনালের ভাগ্য সেটাই হওয়া উচিত। কর্তৃত্ববাদী শাসন সংসদীয় গণতন্ত্রে আংশিক নয় বরং সার্বিক অর্থেই অবৈধ।
ইমেইল: [email protected]

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *