তুরস্কের সাম্প্রতিক ঘটনা -কিছু কথা

ভূমিকা:

সময়ের আবর্তে আজ মুসলিম বিশ্ব এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে সারা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রে স্বৈরাচারী শক্তির কাছে সবাই বন্দী এবং তাদের কাছে মুসলিম দেশের জনতার শক্তি পরাজিত। বলতে গেলে প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের চর্চা, জনতার সেবা অর্থাৎ জনকল্যাণ সমৃদ্ধ কোন আদর্শ নাই। জনগণের সাথে শাসক গুষ্টির সম্পর্ক ক্রীতদাস বনাম প্রভু মানসিকতা যা ইলিট সমাজের মন মগজে এমন ভাবে গ্রোথিত হয়েছে যে সরকারী অফিসারকে স্যার বলে সম্বোধন না করলে তারা অপমান বোধ করেন। বাংলাদেশে এই মানসিকতা প্রচণ্ড আকারে প্রশাসনের সকল স্তরে লক্ষ্য করা যায়। ঔপনিবেশিক প্রভুদের গড়া মুসলিম দেশগুলোর সব দেশেই দেখি এই চেহারা! সরকারি চাকুরীর বড় পদে আছেন মানে আপনি জনগণের শাসক/প্রভু, আপনার হুকুমে অনেক কিছু হয়, আপনি জনতার সেবক হবেন কেন? আপনি জনগণের মাষ্টার আর তাদের কোন কাজ আপনার দফতরে হতে হলে আপনাকে কদর করা উচিৎ এবং সে কাজ দ্রুত করার জন্য স্পীড-মানি বা সোজা কথায় ঘুষ দেয়া উচিৎ কেননা এটা আপনার প্রাপ্য! যারা এটাকে দুর্নীতি বলে, ওরা অপরাধী, ওদেরকে শায়েস্তা করতে হবে। এটাই হচ্ছে প্রচলিত নর্ম, বর্তমান বাংলাদেশে যা আবার অনেক মন্ত্রীকেও বৈধতা দিতে শুনা যায়!  কিন্তু পশ্চিমা দেশে তো তা দেখা যায় না।
আপনি কাকে দোষ দেবেন? বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ তাই -ইসলামকে? ইসলামে তো দেখতে পাই ভৃত্যকে উটের পিঠে চড়ায়ে খলিফা নিচে হাঁটতে! ইসলাম তো শিক্ষা দেয় সরকারী পদে বসা মানে জনগণের আমানত ও সেবার দায়িত্বে বসা। এখানে নিজেকে প্রভু ভাবার চিন্তা আসে কিভাবে?

তুরস্কের সাম্প্রতিক ঘটনা ও বাংলাদেশ।

তুরস্ক সম্পর্কে অনেকবার বিভিন্ন ব্লগপোষ্টে কথা বলেছি। তবে আজকে আবার লিখার উদ্দেশ্য হচ্ছে গত দু/তিন দিনের তুরস্কের ঘটনার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জনতার জন্য কী শিক্ষণীয় হতে পারে সে বিষয়ে কয়েকটি কথা আলোচনা করা।

১) তুরস্কের জনগণের শক্তি দেখে পশ্চিমা মিডিয়া অবাক হলেও বাঙ্গালিদের চেতনা উত্তেজিত হতে আমরা সামাজিক মিডিয়াতে দেখেছি। তবে আমাদের এ চেতনা কিন্তু বেশী সময় থাকবে না কেননা আমরা অন্যের জন্য হলেও নিজেদের দেশের জন্য কী ভাল হবে বা কী চাইব সেটা জানতে চাই না, তাই আমার এক বন্ধুকে লিখতে দেখেছি "তুরস্কের জনতার সাহস দেখে বাঙ্গালির চ্যাতনা-দণ্ড উত্তেজিত হয়েছে!" তবে কথা হচ্ছে হঠাৎ চ্যাতনা-দণ্ড উত্তেজিত হয়েই বা কি লাভ এটা অস্থায়ী, কারণ তো আগেই বলেছি।

২) যারা ইতিহাস চর্চা করেন তারা জানেন গৌরব উজ্জ্বল ইসলামী সভ্যতায় তুরস্কের ভূমিকা কী ছিল। তুরস্কের সাম্প্রতিক সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে এরদোগান ফেসটাইমে ভাষণে জনগণকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান এবং তার আহ্বানে হাজার হাজার মানুষ অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসেন। তুরস্কের জনগণ আবারো দেখিয়ে দিলো অস্ত্রের চেয়ে জনতার শক্তি বেশি। সেই সাথে ষড়যন্ত্রকারীরা আবারো দেখল এরদোগানকে জনগণ কী পরিমাণ ভালবাসে।

অবশ্য এ রকম কিছু বাংলাদেশে হলে দেখা যেত যে সর্বাগ্রে খালেদা হাসিনার ফটো নিয়ে মিছিল হচ্ছে। কিন্তু তুরস্কের জনগণ জানে এরদোগানেরও ভুল থাকতে পারে, তাই বলে গণতন্ত্রের বিকল্প সামরিক শাসন নয়। এরদোগানের ফটো নিয়ে কেউ মিছিল করে নাই, তাদের হাতে ছিল তুরস্কের পতাকা, বক্তব্যে ছিল গণতন্ত্র। এখানেই হচ্ছে মূল তফাৎ।

কিভাবে জাতীয় আন্দোলন তথা গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করতে হয় বাঙ্গালীদের সেই বুদ্ধি ও দূরদৃষ্টি নাই আর হবে বলেও মনে হয় না। আজ বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও ল্যাভেল প্ল্যেইং ফিল্ড তৈরি করা বড় দরকার,  না কোন বিশেষ ব্যক্তিকে ক্ষমতায় বসানো দরকার? আগে খেলার মাঠ তৈরি করতে হবে, তারপর খেলতে কে আসে তা দেখা যাবে। এজন্য বলেছি নিজের দেশের জন্য কী ভাল হবে, সেটা জানতে না পারলে পরিবর্তন কিভাবে আসবে? তুরস্কের জনতা সফলকাম হয়েছে কারণ তাদের লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট। তারা জানে একবার মিলিটারিকে বসতে দিলে তাদের ভোটের অধিকার চলে যাবে এবং গণতন্ত্র চির বিদায় নেবে। জনগণ যখন মিলিটারিকে রুখতে পারে, দরকার হলে এরদোগানেরও ভুল দেখলে তাকেও সরানো যাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে। তুরস্ক ইউরোপের একটি মুসলিম দেশ । দেশটির ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশী, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশের জন্য। কেননা তুরস্ক এমন এক ভৌগলিক অবস্থান যা এশিয়া এবং ইউরোপ, পশ্চিম ও পূর্ব ব্লক, ইউরোপীয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং মুসলিম ও খ্রিস্টান সংস্কৃতির মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া, তুরস্কের সীমান্ত এশিয়া এবং ইউরোপ (জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, Nakhichevan, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, গ্রীস ও বুলগেরিয়া) আটটি দেশের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে। পশ্চিমা খ্রিস্টান সভ্যতার কাছে তুরস্কের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশী তাই তুরস্কের রাজনীতির উপর তাদের কড়া নজর সব সময়ই থাকবে। একটি মুসলিম দেশের রাষ্ট্র নায়ক নিজেকে মুসলিম হিসাবে প্রকাশ করে বিশ্বের মুসলিম দেশের সমস্যা, অন্যায় অত্যাচার তথা মুসলিম স্বার্থের পক্ষে কথা বললে ও তার দেশকে সঠিকভাবে আর্থিক সমস্যার মোকাবেলা করতে দেখলে অনেক মহল আছে যারা এটা সহ্য করতে পারে না। এরদোগানের নেতৃত্বে তুরস্কের ইসলামন্থী এ.কে. পার্টির সরকারের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সফলতা হল তারা তাদের দেশকে IMF – আন্তর্জাতিক মনিটারি ফান্ড থেকে দেশকে ঋণ মুক্ত করেছে। বলেন তো বিশ্বে ২য় কোন মুসলিম দেশ আছে কি যারা নিজেদেরকে IMF এর ঋণের জাল থেকে মুক্ত করতে পেরেছে? এটা অবশ্যই বিশ্ব পুঁজিবাদী মোড়লদের ভাল লাগার কথা নয়। Turkey debt Free Organisation for Economic Co-operation and Development এর সমীক্ষায় তুরস্কের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বর্ণনা দেখা যায়।

সারাংশে একথা বলা যায় যে দেশ শাসনে এরদোগানেরও সমস্যা থাকতে পারে এবং আছেও।   আভ্যন্তারীন দিক দিকেও সমস্যা আছে। মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বিছিন্নতাবাদী কুর্দিপন্থী রাজনীতি ও সন্ত্রাসী হামলার মোকাবেলা করা। এরদোগান বুদ্ধিমত্তার সহিত তা মোকাবেলা করে যাচ্ছেন। তার দেশ ইউরোপে হলেও বাকি ইউরোপিয়ানরা তুর্কিদেরকে আপন ভাবে না, তুরষ্ক ন্যাটোর সদস্য হলেও এরদোগানকে তাদের তেমন পছন্দ নয় বুঝা যায়। কেননা সুযোগ পেলেই পশ্চিমা মিডিয়া এরদোগানের বারোটা বাজাতে নেমে পড়ে। আমেরিকার প্রখ্যাত ইসলামী স্কলারের শেখ হামজা ইউসুফের কয়েক সেকেন্ডের এই  ভিডিওটা লিংকটা শুনলে বুঝা যায় এরদোগানকে কেন তাদের অপছন্দ! https://www.youtube.com/watch?v=AuccsedIoB0


ইতিপূর্বে তুরস্কের পার্লামেন্টে এ.কে. পার্টি ও কুর্দিপন্থী বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। শরণার্থী ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একটি চুক্তি পাস করা নিয়ে এই ঘটনা ঘটে।

 

রেফারেন্স:

10 Shameful Examples of Western Media “Reporting” On Turkey Coup

Turkey – Economic forecast summary (June 2016)

সামাজিক মিডিয়ায জনৈক বাংলাদেশীর সরাসরি ইস্তাবুল থেকে রেকর্ড করা একটি ভিডিও 

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *