তুরস্কের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ কী?

তুরস্কের রাজনৈতিক অস্থিরতার ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে যদিও গত দুই দিনের কোনো কোনো অশান্ত শহরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ শহর ইস্তাম্বুলে একটি প্রসিদ্ধ পার্কের পুরোনো গাছ কেটে সেখানে আধুনিক ‘শপিংমল’সহ একটি নতুন স্থাপনা তৈরির প্রতিবাদে যে প্রতিবাদের সূচনা হয়, সেটাই ধীরে ধীরে একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে বড় বড় শহর এবং এর মাঝে ইস্তাম্বুল ছাড়াও রাজধানী আঙ্কারা এবং খ্যাতনামা শহর ইজমিরও আছে। শুরুতে সরকার গ্রেপ্তার এবং পুলিশের কার্যক্রমের মধ্যদিয়ে কিছুটা কঠোরভাবেই পরিস্থিতির সামাল দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু ফল হয় ঠিক উল্টো এবং প্রতিক্রিয়ায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ আরো ছড়িয়ে পড়ে। সর্বশেষ অবস্থায় মনে হচ্ছে যে সরকার নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করছে এবং এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া পরিস্থিতির জন্য মৃদুভাবে হলেও দুঃখ প্রকাশ করেছে। তবে সেই পার্কে বিতর্কিত নতুন স্থাপনার পরিকল্পনা বাদ দেয়নি। অবশ্য বলেছে এই নতুন ‘কমপ্লেক্সে’ শেষ পর্যন্ত হয়তো ‘শপিংমল’ থাকবে না। এতে বিপজ্জনক পরিস্থিতি কিছুটা স্থিমিত হচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তবে একই সঙ্গে এই আন্দোলনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্কেত দেখা যাচ্ছে। আগামী কয়েকদিনে সামগ্রিক অবস্থা পরিষ্কার হতে পারে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।

তবে এটা অনস্বীকার্যভাবে সত্য যে তুরস্কের ঘটনাপ্রবাহ শুধুমাত্র একটি পার্কের ইস্যুকে কেন্দ্র করেই সীমাবদ্ধ নয়। এর মাঝে প্রোথিত রয়েছে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়াদি। অথচ এটাও স্বীকার করতে হবে যে তুরস্ক বর্তমানে আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশের মতো রাজতন্ত্র কিংবা অগণতান্ত্রিক দেশ নয়। সেখানে গণতন্ত্র আছে এবং চার বছর পরপর নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকার গঠিত হয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রী রিশেফ তারিফ এরদোয়ানের ‘জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট’ পার্টি গত দশ বছর যাবৎই ক্ষমতায় আছে। দুই বছরের বেশি সময় পূর্বের নির্বাচনে ভালোভাবেই জয়ী হয়েছে সরকারি দল।

তা সত্ত্বেও অনেকেই তুরস্কের ঘটনাবলীকে মিসরের ‘তাহরির স্কোয়ার’র সঙ্গে তুলনা করেছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন যে তুরস্কের বিক্ষোভ হচ্ছে ‘আরব বসন্তের’ মতো গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবিতে গণবিক্ষোভ। অবশ্যই যা তুরস্কে ঘটছে. তা হলো জনতারই আন্দোলন। তবে সেটা আরব মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতো হতে হবে কেন? সেই সব দেশে স্বৈরশাসকরা দীর্ঘদিন শাসন করার কারণেই গণতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবি উঠেছে।

তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া ও ইয়েমেনে দীর্ঘদিনের একনায়করা ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন প্রচ- গণআন্দোলনে এবং সেসব দেশে নির্বাচিত সরকাররা ক্ষমতায় এসেছে কিংবা সেই প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আরো কয়েকটি আরব দেশÑ যেমন সিরিয়া এবং বাহরাইনে এমনি ‘আরব বসন্তের’ সংগ্রাম চলছে। সিরিয়ায় সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধে এ পর্যন্ত প্রায় ৮৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে এবং ১৫ লাখ লোক প্রাণ বাঁচাতে অন্যান্য দেশ বিশেষ করে তুরস্ক এবং জর্ডানে আশ্রয় নিয়েছে। গৃহযুদ্ধ বন্ধ হওয়ার কোনো সুস্পষ্ট লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বাহরাইনে গণবিক্ষোভ এক সময় বেশ উত্তাল হয়ে উঠলেও খুব বেশি দূর যেতে পারেনি। এর প্রধান কারণ মনে হয় দেশটির রাজা আমেরিকার ঘনিষ্ঠ এবং বাহরাইনে মার্কিন নৌ-ঘাঁটি থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্র গণবিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু তুরস্কে গণতন্ত্র বিরাজ করছে এবং দেশটির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও বেশ প্রশংসনীয়। একটি উন্নত দেশ হিসেবেই তুরস্ক পরিচিত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার প্রতীক্ষায় রয়েছে আঙ্কারা। বিশ্বের চালচিত্রেও দেশটি বেশ সক্রিয় এবং প্রধানমন্ত্রী রিসেফ তারিফ একজন বেশ দক্ষ ও বলিষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মোটামুটিভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছেন। অভ্যন্তরীণভাবেও তার সরকার তুরস্কে দীর্ঘদিনের সামরিক বাহিনীর দেশ শাসন ও পরোক্ষভাবে রাজনীতিতে প্রাধান্যকে অনেকটা খর্ব করেছেন। এটা অবশ্যই দেশটির গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য শুভ ও সহায়ক। তাছাড়া, অন্যান্য ক্ষেত্রেও তুলনামূূলকভাবে সরকারের সাফল্যই বেশি বলে মনে করা হয়ে থাকে।

তা সত্ত্বেও কেন এই গণবিক্ষোভ? এটাও হওয়ার তেমন কথা ছিল না। তথাপি তুরস্কে এই অস্থিরতার কারণ কী? অবশ্য তুরস্কে পরিস্থিতি এমন হয়নি যে সেখানে সরকারের পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এটা সত্য যে দেশটিতে গণবিক্ষোভের কারণে বেশ অস্থির পরিস্থিতি বিদ্যমান।

প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ানের সরকার এমনি একটি দৃষ্টান্ত যে গণতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করা সত্ত্বেও একটি দেশে জনগণ অধিক সংখ্যায় অসন্তুষ্ট হয়ে উঠতে পারে। তুরস্কের সরকারের বেশ কিছু কার্যক্রম থেকে এটাই বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে নির্বাচনের পর জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে সরকারি সিদ্ধান্তের সামঞ্জস্যহীনতা অনেক ক্ষেত্রেই নেই বললেই চলে। সরকার অনেক স্পর্শকাতর ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেনÑ যা তাদের নির্বাচনী ‘মেনিফেস্টোতে’ ছিল না। সে কারণে দেশের অনেকেই মনে করেন যে গণতান্ত্রিক আবরণে প্রধানমন্ত্রী অতি মাত্রায় ক্ষমতাবান হয়ে সত্যিকার অর্থে স্বৈরাচারী হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে এই সরকারকে রক্ষণশীল বলেই মনে করা হচ্ছে যদিও প্রধানমন্ত্রী তুরুস্ককে ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্য দিয়ে একটি আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেটা কী হচ্ছে? নারীদের অবস্থান দুর্বল হচ্ছে এবং সরকার ঘরে সময় কাটিয়ে অধিক সংখ্যায় সন্তান উপহার দিতে উৎসাহ দিচ্ছেন। বলা বাহুল্য, ‘জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ ইসলামপন্থী একটি দল এবং এক সময় তুরস্কে নিষিদ্ধ ছল।

পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে রাজনীতিতে উদ্ভব হয়ে বেশ সাফল্য দেখায়। অবশ্য, প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল এবং প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ান আধুনিকতার ওপর জোর দিচ্ছেন। কিন্তু, বিক্ষোভকারীরা তুরস্কের জনপ্রিয় নেতা ও আধুনিক তুরস্কের স্থপতি কামাল আতাতুর্কের নাম নিয়ে এখন সেøাগান দিচ্ছে। পররাষ্ট্র ক্ষেত্রেও সিরীয় গৃহযুদ্ধে অতি মাত্রায় বিদ্রোহীদের পক্ষালম্বনের কারণে তুরস্কে বিরাট সংখ্যক সিরীয় উদ্বাস্তু এবং আমেরিকার প্রতি খুব ঘনিষ্ঠতার কারণে সরকারের জনপ্রিয়তা কমছে। তাই একটি পার্কের পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে গণবিক্ষোভের কারণ গভীরে প্রোথিত। সরকারেরই দায়িত্ব হলো বাস্তবতার আলোকে পরিস্থিতির সামাল দেয়া। তা না হলে, পরিস্থিতির অবনতি অনিবার্য।

Loading


Comments

তুরস্কের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ কী? — 1 Comment

  1. ২৬ বছর বয়সী নিহান ডিঙ্ক নামে আরেক তরুণ নারী গণমাধ্যমকর্মী জানান, একে পার্টির অধীনে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন।

    তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে এসেছি আমাদের স্বাধীনতার জন্য। শ্বাস ফেলার একটা জায়গা খুঁজে নেয়ার জন্য। আমরা এখানে এসেছি প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া, মদ খাওয়া এবং কোনো বিধিনিষেধ ছাড়াই যে কোনো কিছু করতে পারার অধিকারের জন্য।’

    অনেকের মতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রী স্বৈরশাসকের মতো আচরণ করছেন বলেই তারা রাস্তায় নেমে এসেছে।

    ইয়েসিম পোলাত নামে ২২ বছর বয়সী এক ছাত্র বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এরদোগান নিজেকে একজন সুলতান মনে করছেন। তিনি কারো কথা শুনছেন না এবং কারো সাথে কোনো পরামর্শও করছেন না। তিনি মনে করেছেন- যা খুশি তাই করতে পারেন তিনি।’

    Those views are shared by most protesters. A recent poll by Istanbul Bilgi University researchers who talked to 3,000 activists revealed that the demonstrators’ anger is directed strictly towards Erdogan, not his aides nor his political party; 92.4 percent of the participants said that they have taken to the streets because of Erdogan’s authoritarian” attitude.”

    http://www.aljazeera.com/indepth/features/2013/06/20136513414495277.html

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *