গণতন্ত্র শুধু বক্তৃতা, ভাষণ ও স্লোগ্যান নয়।

ঢাকা শহরের মেয়র নির্বাচনের পরে বেগম খালেদা জিয়া আবারো ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, বাংলাদেশে কোনো গণতন্ত্র নেই! কিন্তু এটা কি কোন নতুন খবর? বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কি অবস্থা তা দেশের মানুষ অনেক আগে থেকেই দেখে আসছে। বিশেষকরে ১/১১ পর থেকে এবার আওয়ামী লীগের শাসন আমলে তা তো সবাই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
খালেদা জিয়া তার বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্র নির্বাসিত, গণতান্ত্রিক প্রথা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। কাজেই কোন শ্রেণী-পেশার মানুষের অধিকারই আজ আর নিশ্চিত নয়। এই অবস্থার অবসানের জন্য, সাম্য ও সামজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অংশ নেয়ার জন্য এই মহান মে দিবসে আমি দেশের শ্রমজীবী ভাই-বোনদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।

প্রশ্ন হচ্ছে গণতন্ত্র কীভাবে ফিরিয়ে আসতে পারে?

যারা বিএনপি করেন তারা বলবেন,”আমার তো অনেকদিন থেকে সে আন্দোলনই করে যাচ্ছি”। তাদের এ দাবী একেবারে ফেলে দেয়া যায় না। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ যারা টকশো দেখেন বা কোন দলের অন্ধ সমর্থক নন তারা বলতেই পারেন,”খালেদা জিয়া দেশের মানুষকে বর্তমান সরকারের পতন ঘটাতে তার সঙ্গে যোগ দিতে রাস্তায় নেমে আসতে বলছেন শুধু ক্ষমতায় ফিরে যেতে। তিনি ৩ বার প্রধান মন্ত্রী হওয়া স্বত্বেও আরো একবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য বা তার ছেলেকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসাবার জন্যই এসব করছেন।”এর জবাব কীভাবে দেবেন বিএনপি সমর্থকেরা আমি  জানিনা।
তবে খালেদা জিয়া তার বর্তমান অবস্থানে থেকে যদি ঘোষণা দেন যে আন্দোলন সফল হলে এবং দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসলে তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেননা কিংবা জিয়া পরিবারের কেউ সে পদের জন্য লড়বে না। কেননা এ আন্দোলনের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের আন্দোলন নয়। তাহলে দেশে বিদেশে মানুষের কাছে এটা প্রমাণিত হত যে জিয়া পরিবার ক্ষমতা লোভি নয় এবং ক্ষমতা দখলের আন্দোলন করে না যেমন করেছেন সেই একাত্তরের সময় শেখ মুজিব নিজে ও এখন তার পরিবারের সদস্যরা। স্বাধীনতা উত্তর শেখ মুজিবের বাকশালী শাসন ব্যবস্থা আর বর্তমান শেখ হাসিনার শাসন তার প্রমাণ বহন করে।

আসলে গণতন্ত্র মানে মানুষকে উত্তেজিত করে রাস্তায় নেমে বা সংবাদ সম্মেলনে শুধু বক্তৃতা, ভাষণ ও স্লোগ্যান নয়। বাংলাদেশের আজ যে অবস্থা এটা শুধু আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি নয় বরং সত্যিকার সমস্যা এদেশের মানুষের সুস্থ চিন্তা বনাম অসুস্থ চিন্তা, ন্যায়পরতা বনাম স্বার্থপরতা, উদারতা বনাম সংকীর্ণতা, ভদ্রতা বনাম নৈরাজ্যতা ও মস্তানি, পরমতসহিষ্ণুতা বনাম অসহনশীলতা, সত্য বনাম মিথ্যাচার ইত্যাদি যাবতীয় অশুভকর প্রতারণার পরিচর্যা। আর এসব কারা করছে তা এখন সচেতন মানুষের কাছে পরিষ্কার।

অতএব এই দুরবস্থা থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করে একটি সুস্থ ও গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ফিরে আনতে প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতৃত্ত্বের প্রচুর ত্যাগ স্বীকারের। শেখ হাসিনা ইচ্ছা করলেও তা করতে পারবেন না তার কারণ অনেক। সে বিষয় পরে কোন একদিন না হয় আলোচনা করা যাবে।

তবে খালেদা জিয়ার জন্য তা সম্ভব। কিন্তু সে জন্য তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে এবং তাঁর আন্দোলনের লক্ষ্য ও কাহিনী (narrative)বদলাতে হবে যার ইঙ্গিত উপরে দেয়া হয়েছে। আর তা অবশ্যই করা দরকার খালেদা যদি প্রমাণ করতে চান মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে তিনি আন্তরিক এবং ইতিহাসের পাতায় নিজেকে  সত্যিই একজন দেশ প্রেমিক হিসাবে স্থান দিতে চান। তাঁকে প্রমাণ করতে হবে সবাইকে নিয়ে আন্দোলন করতে চান দেশের বর্তমান একদলীয় বাকশালী স্টাইলের ফ্যসিষ্ট শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন করে গণতন্ত্র ফিরে আনতে এবং নিজে ক্ষমতায় যাওযার জন্য নয়। তাঁর এ আন্দোলনের ফসল হবে প্রতিভাবান নতুন নেতৃত্বকে এগিয়ে আসার সুযোগ প্রদান । সেখানে থাকবে না  পরিবারতন্ত্র। আর তা নাহলে বেগম খালেদার পক্ষে দেশের বর্তমান অবস্থার কোন পরিবর্তন আশা করা ভুল হবে। দেশে যে অশুভ শক্তি ক্ষমতায় জেঁকে বসেছে তাদেরকে সরানো সম্ভব নয়। আরব বসন্তের মত কিছু বাংলাদেশে হবে না কারন এদেশের যুব সমাজ সে জন্য প্রস্তুত নয় বরং চরমপন্থিরা যাতে মাথা ছাড়া দিয়ে উঠে সে দিকেই ক্ষমতাসীনরা দেশকে নিয়ে যাচ্ছেন তাদের ফ্যসিষ্ট আচরণে। সম্প্রতি আমেরিকান সিনেট কমিটির শুনানির প্রারম্ভিক আলোচনায় এ আশঙ্কাই প্রকাশ পেয়েছে

প্রশ্ন হতে পারে আমেরিকা বাংলাদেশের ব্যপারে শুধু বিবৃতি দিয়েই সন্তুষ্ট থাকছে সরাসরি কোন পদক্ষেপ নিতে কেন সরকারকে বাধ্য করে না। আসলে আমেরিকা বিদেশ নীতি পরিচালিত হয় মুলত তিনটি লক্ষ্যে ১) তাদের দেশের নিরাপত্তার হুমকি দেখা দিলে ২) তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতিগ্রস্তের আশঙ্কা দেখা দিলে যেমন মধ্যপ্রাচ্যের জালানি স্বার্থে আঘাত আসলে ৩) ইসরাইলের নিরাপত্তার হুমকি দেখা দিলে।
তাছাড়া আমেরিকা কোন দেশের ব্যপারে হস্তক্ষেপ করতে এগিয়ে আসবে যদি তাদের স্ট্রেটিজিক স্বার্থে কাজে লাগে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাস্ট্র ভারত বাংলাদেশের আকারে অনেক গুন বড় হওয়ায় ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক করতেই আমেরিকা প্রধান্য দিবে এবং বাংলাদেশকে ভারতের আধিপত্যে থাকলেও তাদের তেমন কোন আপত্তি হবে না।
অতএব বাংলাদেশের ব্যপারে কুটনৈতিক কিছু কথা বার্তা ছাড়া আমেরিকা খুব সিরিয়াস কিছু বাংলাদেশের মানুষের জন্য করবে বলে আশা কম। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে বাংলাদেশের মানুষকেই প্রচেষ্টা করতে হবে।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *