”কোরআন অনলি”- কেন সম্ভব নয়? ( ২য় পর্ব)

(প্রথম পর্ব এখনে দেখুন)

প্রথম পর্বের শেষে প্রশ্ন রেখেছিলাম মুসলিম হিসাবে আমরা কতটুকু হেদায়েত প্রাপ্ত হয়েছি তা ভাবতে হবে। সঠিক হেদায়েত বা দিক নির্দেশনার পথ পেতে হলে ইসলামের সঠিক ও স্বচ্ছ ধারনা অর্জন পূর্ব শর্ত। তা না হলে ভুল পথে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। সে জ্ঞান অর্জন কখনও সম্ভব হবে না যদি আমরা রাসুলের জীবন ও তাঁর সাথীরা যারা সরাসরি শিক্ষা অর্জন করেছেন নবীর কাছ থেকে তাদের জীবন ইতিহাস এবং ইসলামকে তারা কীভাবে পালন করেছেন ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন না করি।
এ প্রসঙ্গে প্রথমেই আলোচনায় আসা যাক মুসলিম মানে কি। ইংরেজি ভাষায় কোন কিছু যে চালায় বা ড্রাইভ করে তাকে বলা হয় “ড্রাইভার”, তেমনি যে দৌড়ায় বা রান করে তাকে বলা হয় রানার অর্থাৎ ক্রিয়ার শেষে ই আর (সাফিক্স) যুগ করলেই কর্মকারীকে বোঝায়। আরবিতে অনেক ক্রিয়ার আগে মু ব্যবহার করে কর্মকারীকে বুঝাতে হয়। যেমন, আজান শব্দের পূর্বে মু ব্যবহার করে হয় ” মুয়াজ্জিন” (যে আজান দেয়), ছফর শব্দের পূর্বে “মু” ব্যবহার করে হয় “মুসাফির” তেমনি ইসলাম শব্দের পূর্বে “মু” ব্যবহার করে হয় “মুসলিম” অর্থাৎ যে ইসলাম ধর্ম পালন করে তাকে মুসলিম বলে। এখন সবাই যে একই কাজ একইভাবে করতে পারবে তেমন নয়। কেউ দৌড়াতে পারে পারদর্শিতার সাথে, আবার কারো দৌড় দেখলে হাসি পায় তাই বলে এতে “দৌড়” কোরীয়টির কোন দোষ নেই। তবে আশ্চর্য হল কোন মুসলিম ইসলাম পালনে ভুল করলে ইসলাম ধর্মকেই দুষ দেয়ার লোকের অভাব হয়না এ পৃথিবীতে!
সে যাক, ইসলাম এর অর্থ হচ্ছে আত্মসমর্পণ করা আল্লাহর কাছে তারই দেয়া শর্তানুসারে। আর সে শর্ত কি? তা জানা যায় আল্লাহর ওহি শুনে যা হল কোরআন এবং সে ওহি অনুসরণের পারফেক্ট উদাহরণ রাসুলের জীবন ইতিহাস জেনে যা পাওয়া যায় হাদিস থেকে।
কোরআন অনলিরা বলে তারা হাদিস মানে না কিন্তু কোরআন মানে অথচ তাদের কোরআন মানার অবস্থা দেখলে দেখা যায় তারা কোরআনকে তো সঠিকভাবে মানেই-না বরং কোরআনকে অবমাননা করে।
নবীর সুন্নাহ বা হাদিস ছাড়া যে ইসলামের কোন কিছুই সঠিকভাবে পালন করা বা বুঝা সম্ভব না তা কয়েক পর্বে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করব ইনশাল্লাহ।
হাদিস ছাড়া কোরআনের সবকিছু বুঝা সম্ভব নয়:
হাদিস ছাড়া সব সময় কোরআন বুঝার প্রচেষ্টা অন্ধের হাতী দেখার মত অবস্থা হবে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় কোরআনের অনেক আয়াতে বাহ্যত কন্ট্রাডিকশন মনে হয় যেমন কখনও কোরআনে দেখা যায় মুসলিমদেরকে বলা হচ্ছে কাফিরদেরকে হত্যা করতে (সুরা: ৯-৩) কখনও মুসলিমদেরকে হুকুম দেয়া হচ্ছে অবিশ্বাসী তথা কাফিরদেরকে তাদের পৌত্তলিক ধর্ম পালনে তথা মূর্তি পূজায় বাঁধা না দিতে (সুরা ১০৯: ১-৬)
হাদিস ছাড়া এ সবের মর্ম বুঝতে গিয়ে দেখা যাবে যে পেসিফিস্ট সে শুধু শান্তির কথাগুলাই মানতে চাইবে আর যে জঙ্গি মানসিকতার ব্যক্তি তার কাছে শুধু আক্রমণের আয়াতগুলারই গুরুত্ব পাবে। অতএব হাদিস ছাড়া কোরআন বুঝতে গিয়ে মুসলিমদের পক্ষে ব্যালেন্স জীবন যাপন সম্ভব নয়। কোরআনে একজন মুমিন তার ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কীভাবে চলবে তার নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ আর নবীর জীবন হচ্ছে তারই প্র্যাকটিকেল বা বাস্তব প্রদর্শন যা অনুসরণ করতে কোরআনে হুকুম করা হয়েছে মুসলিমদেরকে। আর সে জন্য নবীকে বলা হয় জীবন্ত কোরআন। আর যারা অবিশ্বাসী তাদের জন্য বলা হয়েছে রাসুল একজন বার্তাবাহক।
কোরআন অনলিদের কাছে রাসুল (স:) শুধুমাত্র একজন বার্তাবাহক ছাড়া কিছু নয়! তারা নবীকে বা তাঁর সুন্নাহকে অনুসরণের প্রয়োজন মনে করে না। তারা কোরআন থেকেই ইসলামের সব এবাদত পালন সম্ভব বলে! কোরআনের এক আয়াত দেখে অন্ধের হাতী দেখার মত ওরা বলে কোরআনে যেহেতু রাসুলকে একজন বার্তাবাহক বলা হয়েছে তাই রাসুলের সুন্নাহ মানার দরকার নাই! আসলে কোরআনের কোন আয়াতের প্রসঙ্গবহির্ভুতভাবে (out of context) (শানে নাজুল) ছাড়া বুঝতে গেলে তো এরকম ভুল অর্থ বাহির হওয়ারই কথা!
কোরআন সম্পর্কে যার সামান্যতম জ্ঞান আছে সেও জানে যে কোরআনে রাসুলকে “বার্তা বাহকের” এরকম কথা যখন বলা হয়েছে তা এসেছে কাফিরদের সাথে রাসুলের দাওয়াতি কাজের প্রেক্ষাপটে অর্থাৎ অবিশ্বাসীদের উদ্দেশ্যে রাসুল (স:) কে বলা হচ্ছে যে তাদের প্রতি রাসুলের দায়িত্ব শুধু বার্তা পোঁছানো। তারা তাঁর আহ্বান গ্রহণ করুক বা না করুক রাসুলের দায়িত্ব হচ্ছে হতাশাগ্রস্ত না হয়ে শুধু বার্তা বাহকের দায়িত্ব পালন করা। আসলে এ কথা সকল যুগে ইসলামের দায়ীদের (প্রচারকদের) বেলা প্রযোজ্য। অন্য অর্থে অবিশ্বাসীদেরকে শক্তি দিয়ে বাধ্য করার কোন দরকার নাই। “লা ইক্রা ফিদ দীন”
এবার দেখেন যারা রাসুলকে নবী মেনেছে বা তার সুন্নত পালনে ব্যকুল তারাই হচ্ছে মুসলিম। তাই মুসলিমদের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ বলেন:

“যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রাসূলিল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা (উসুওয়াতুল হাসানা) রয়েছে। (৩৩:২১)

এখন রাসুলের চরিত্র যে উসুওয়াতুল হাসানা (উত্তম নমুনা ) তা জানতে হলে হাদিসের দরকার। যারা রাসুলকে শুধু বার্তাবাহক হিসাবে পাঠান হয়েছে বলে এবং সে বাহানায় হাদিস মানতে চায়না তারা কতটুকু মুসলিম তা চিন্তার বিষয়। আসলে “কোরআন অনলিরা” রাসুলকে নবী হিসাবেই মানতে চায়না সে ধৃষ্টতা লক্ষ্য করা যায় তাদের মন্তব্যে।
রাসুলের হুকুম পালনের গুরুত্ব কোরআনে কিভাবে বলা হয়েছে দেখুন:

مَّنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللّهَ وَمَن تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا 80
যে লোক রসূলের হুকুম মান্য করবে সে আল্লাহরই হুকুম মান্য করল। আর যে ব্যক্তি বিমুখতা অবলম্বন করল, আমি আপনাকে (হে মুহাম্মদ), তাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি।

বিক্ষিপ্তভাবে এখান সেখান থেকে কিছু হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে যারা যেভাবে হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা অস্বীকার করার প্রচেষ্টা করে তা নিতান্তই শয়তানী অশুভ প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। “কোরআন অনলিদের” কথা হল হাদিসে বর্ণনাকারীদেরকে বিশ্বাস করা যায় না এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোরআনকে যারা প্রাথমিক অবস্থায় লিখিত আকারে মুখস্থ করে রেখেছিলেন তাদের কাছ থকেই তো হাদিসের সূত্র এসেছে। কোরআনের ব্যাপারে তাদেরকে বিশ্বাস করলে হাদিসের ব্যপারে কেন সন্দেহ হবে?
যারা হাদিস প্রত্যাখ্যান করে তারা মূলত কোরআনকেই মানে না, রাসুলকে মানে না, ইসলামের শ্রেষ্ঠ ইমামদেরকে অস্বীকার করে। তাদের কাছে ইসলামের ইতিহাসে ঐতিহ্যবাহী প্রসিদ্ধ শত শত বিজ্ঞ ইসলামী স্কলারদের সারা জীবনের কর্মতৎপরতা, নি:স্বার্থ-ভাবে ইসলামী জ্ঞান অন্বেষণ, ইসলামের জন্য তাদের নিবেদিত প্রাণ, তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা হাদিস সংগ্রহে (যেমন; বুখারি, মুসলিম, আবুদাইদ প্রমুখ) এবং তাফসির লেখক (যেমন; ইবনে কা’তির, ইবনে আব্বাস, আল জালায়ান, সাইয়েদ কুতুব, আশরাফ আলী থানবি, মওদুদী প্রমুখের) ও ইতিহাস লেখক (আল তাবারি, ইবনে সা’দ,আল ওয়াকিদি, ইবনে ইসহাক প্রমুখ) রচিত মূল্যবান বই পুস্তক, রিসার্চ ওয়ার্ক এবং জ্ঞান লব্ধ তথ্যাদি সবকিছুকে সাগরে ফেলে দিতে হবে। তখন কোরআন পৃথিবীর আরো দশটি ইতিহাস গ্রন্থের মত একটি পুরানা গ্রন্থ ছাড়া এর কোন গুরুত্ব থাকবে না আর এক দিন আসবে যখন তারা কোরআনকেও বলবে এটি মানুষের একটি খামখেয়ালী রচনা যার কোন দরকার নাই । কিছু দিন আগে ব্রিটিশ একটি টিভি চ্যানেলে একটি ডকুমেন্টারি প্রচার করা হয়েছিল সে হিডেন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে!
সদালাপের পাঠকরা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন মাজবাশারের শীর্ষ “কোরআন অনলির” জনৈক কট্টর সমর্থক এখন “কোরআনের তাফসির” শুরু করেছেন! যেন তিনি আরবি ভাষার উস্তাদ আর ইসলামী পণ্ডিত তার লিখিত কোরআনের প্রতিটি কথার আয়াতকে কোরআনের পাতা থেকে মিলাবার চেষ্টা করে দেখবেন কি ধূর্ততার সাথে শব্দের হেরফের করে বিশেষ করে আক্ষরিক অর্থের ব্যবহার করে তার পর মনগড়া একটা ব্যাখ্যা দিয়ে নিজের কথার কুযুক্তিতে ফেলবে। ওনার সাম্প্রতিক আবিষ্কার হচ্ছে কোরআনে রাসুলের অনুসরণের কথার অর্থ নবীকে অনুসরণ করা নয় বরং কোরআনে “রাসুল” শব্দের ভাষা-গত মিনিং হচ্ছে কোরআনের অনুসরণ! তিনি লিখেছেন

“কোরানের বানীকেও রসূল বলা হইয়াছে” !!

“হুজুরের বয়ান” শুনেন! আরবি ভাষায় তার সামান্যতম জ্ঞান থাকলে বা ইসলাম সম্পর্কে সুস্থ মানসিকতা থাকলে এরকম ফালতু কথা বলতে পারেনা।

নিচের আয়াতটা অনেকেই জানেন তবু উল্লেখ করলাম এজন্য যে এখানে “রাসুল” এবং “রসুল” উভয় শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং কেন করা হয়েছে তাও পরিষ্কার। রসুল শব্দ হচ্ছে রাসুলের বহুবচন। মোহাম্মদ (স:) কে বুঝাতে চাওয়ার ক্ষেত্রে রাসুল শব্দ ব্যবহার করেছেন আল্লাহ আর যেখানে একাধিক রাসুল বা সকল পয়গাম্বরদের কথা এসেছ সেখানে রসুলে-হ ব্যবহার করেছেন। সুরা বাকারার শেষ আয়াত:

آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مِن رَّبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آمَنَ بِاللّهِ وَمَلآئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لاَ نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّن رُّسُلِهِ وَقَالُواْ سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ (২৮৫)
রাসুল (মোহাম্মদ) বিশ্বাস রাখেন ঐ সমস্ত বিষয় সম্পর্কে যা তাঁর পালনকর্তার পক্ষ থেকে তাঁর কাছে অবতীর্ণ হয়েছে এবং মুমিনরাও সবাই বিশ্বাস রাখে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর পুস্তকের প্রতি এবং তাঁর রসুলদের প্রতি। তারা বলে আমরা তাঁর রসুলদের (পয়গম্বরদের) মধ্যে কোন তারতম্য করিনা। তারা বলে, আমরা শুনেছি এবং কবুল করেছি। আমরা তোমার ক্ষমা চাই, হে আমাদের পালনকর্তা। তোমারই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

এবার বুঝেন মজাবাসারের মুরিদ কীভাবে বলেন “কোরানের বানীকেও রসূল বলা হইয়াছে”?

১.২ বিলিয়ন মানুষের ধর্মকে নিয়ে তারা ঠাট্টা করে, কোরআনকে অবমাননা করে এবং আল্লাহর হাবিব তাদের প্রাণ প্রিয় রাসুল (স:) কে অপমান করার জন্য পোষ্ট করে এদেরকে আপনি কি বলবেন? সম্মানিত পাঠকদের কাছেই এ বিচার রাখলাম।

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ
কোরআন অনলি দিয়ে ইসলামের যে পাঁচটি স্তম্ভ বিশ্ব জুড়ে মুসলিমরা অনুসরণ করে এবং তাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রচেষ্টা করে তার কোন একটাই করা সম্ভব হবেনা।

১) শাহাদা (কলেমা)
রাসুল বলেন, ইসলামের ভিত্তি (বুনিয়াল আল্ ইসলাম) হচ্ছে পাঁচটি স্তম্ভ (আরকান):
এক: সাক্ষী দেয়া যে এক আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নাই এবং মোহাম্মদ (স:) আল্লাহর নবী (বোখারী ১:২৭) লিংক এখানে।
প্রশ্ন হচ্ছে রাসুলের দেয়া শাহাদার এরকম সংজ্ঞা কি এভাবে কোরআনে আছে? রাসুল যদি ইসলামী কালেমার “শাহাদার” এরকম নিদিষ্ট কোন সংজ্ঞা বা ডেফিনিশন যদি না দিতেন তা হলে শুধু কোরআন বুঝে যে যার মত কলেমা তৈরি করত। তাহলে “কোরআন অনলিদের” কথামত ইসলামের শুরু থেকে মুসলিমরা ইসলামের প্রথম স্তম্ভ হিসাবে যা পরিচিত বা অনুসরণ করে তা অর্থহীন!
(চলবে)

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *