কাশ্মির আসল সমস্যা নয়

* লিখেছেন: হামিদ মীর : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক *

উভয় দিকে একই গালি দেয়া হচ্ছে। ভারত ও পাকিস্তানে প্রাত্যহিক জীবনের কথাবার্তার মধ্যে একে অন্যকে দেয়া অশ্লীল গালিগুলো মা, বোন, কন্যা ও ভাগ্নি-ভাতিজাকে পর্যন্ত আঘাত করে। গালিগুলোতে বাপ-ভাইয়ের উল্লেখ একেবারে বিরল। আপনি যে গালি লাহোরের অলিগলিতে ও বাজার-হাটে শুনবেন, ঠিক ওই গালিই দিল্লিতেও শুনতে পাবেন। যে গালি করাচিতে দেয়া হচ্ছে, ওই গালি কিছুটা ভিন্ন ভঙিতে মুম্বাই থেকে লাহোর পর্যন্ত শুনতে পাবেন। যখনই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, তখনই উভয় দেশের মানুষ একে অপরকে একই ধরনের গালি দিতে থাকে। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেক ভারতীয় ও পাকিস্তানি একে অপরকে একই রকমের গালি দিচ্ছে। এসব গালি পড়ে অধম ভাবছে, উভয়ের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে পার্থক্য আর উভয়ের শত্র“তার কারণ অনুসন্ধান এক হৃদয়গ্রাহী অধ্যয়ন। একনজর চোখ বুলালে দেখতে পাবেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ততটুকু পার্থক্য, যতটুকু পার্থক্য বিরিয়ানি ও পোলাওয়ের মধ্যে দেখা যায়। দুটোই প্রস্তুত হয় আতপ চাল দিয়ে, কিন্তু এগুলোর রন্ধনপ্রণালী ও উপকরণ ভিন্ন রকমের। হিন্দি ও উর্দুর মাঝেও ততটুকু পার্থক্য পরিলতি হয়, যতটুকু পার্থক্য ‘বালাই’ ও ‘মালাই’ শব্দের মধ্যে রয়েছে। (বালাই হিন্দি শব্দ ও মালাই উর্দু, উভয়ের অর্থ আইসক্রিম)। উভয় দেশের জনগণ উভয় ভাষাই বোঝেন। তবে ভারতের বেশির ভাগ মানুষ উর্দু পড়তে পারেন না, আর পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য অংশ হিন্দি পড়তে পারেন না। উভয়পরে মওসুম এক, পাখি এক, ফল ও শাকসবজিও অভিন্ন। মিষ্টান্ন দ্রব্য, আচার, চাটনি ও মসলাও এক। লোককথা, পরিভাষা ও উপমা-উদাহরণও এক। অমৃতসর বা জলন্ধরের অধিবাসীরা যখন শিয়ালকোট বা ফয়সালাবাদের অধিবাসীদের সাথে পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলেন, তখন ভাষা একই মনে হয়, অথচ লেখার পদ্ধতি ভিন্ন। তারা তাকে গুরুমুখী বলেন, আমরা বলি পাঞ্জাবি। কিছু মানুষ এই পার্থক্যটা মানে না। ভারতের এমন লোকের সংখ্যা কম নয়, যারা মির্জা গালিব ও মীর তকী মীরকে পাক-ভারত উপমহাদেশের যৌথ সম্পদ হিসেবে অভিহিত করেন। যারা পার্থক্য মানে না, তারা ১৮৫৭ সালে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে হিন্দু ও মুসলমানের যৌথ বিদ্রোহের উদাহরণ টেনে আনেন। কিন্তু তারা এটা বলেন না যে, হিন্দু ও মুসলমানের বিদ্রোহের মূল কারণ একেবারেই ভিন্ন ছিল। ব্রিটিশ বাহিনীর মুসলমান সিপাহিদের বন্দুকের জন্য যে কার্তুজ দেয়া হয়েছিল, তারা মনে করেছিলেন, ওই কার্তুজে শূকরের চর্বি ব্যবহার করা হয়েছে। পান্তরে হিন্দু সিপাহিরা মনে করেছিলেন, কার্তুজে গরুর চর্বি ব্যবহার করা হয়েছে। শূকর ও গরু দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রাণী। আর এটাই ভারত ও পাকিস্তানের পার্থক্য। কিছু ভালোবাসা যেমন সম্মিলিত, তেমনি অনেক বিদ্বেষও রয়েছে।
এমন অনেক দৃষ্টান্ত আমাদের নজরে পড়ে, যেগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবলে দেখা যাবে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। লতা মঙ্গেশকর, কিশোর কুমার, মোহাম্মদ রফি ও মুকেশ পাকিস্তানে বেশ জনপ্রিয়। অপর দিকে, মেহদী হাসান, গুলাম আলী, নূরজাহান ও রাহাত ফতেহ আলী খান ভারতে বেশ জনপ্রিয়। তার পরও এসব কণ্ঠশিল্পীর সুন্দর গান উভয় দেশের মাঝে বিদ্যমান বিদ্বেষ কমাতে পারেনি। আজো গুলাম আলী ও রাহাত ফতেহ আলী খান তাদের মধুর সঙ্গীত গাইতে ভারত গেলে কিছু মানুষ তাদের গালি দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেবে। একটু ভাবুন, যুদ্ধের পরিবেশে লতা মঙ্গেশকর পাকিস্তান এলে আমরা কি তাকে অপদস্থ করে ফেরত পাঠাব? আমার দৃঢ়বিশ্বাস, এমনটি হবে না। এটা কি ভারত ও পাকিস্তানের পার্থক্য নয়? এর অর্থ একেবারে এটা নয় যে, পাকিস্তানের সব ভালো এবং ভারতের সবই খারাপ। উভয় দেশের শিাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভুল ইতিহাস পড়ানো হয়। উভয় দেশে মিথ্যাবাদী গ্রহণযোগ্য এবং সত্যবাদী তিরস্কৃত। ভারত কাশ্মির সমস্যা নিয়ে গোটা বিশ্বের সাথে মিথ্যা বলে মিথ্যাকে নিজেদের রাষ্ট্রীয় নীতি বানিয়ে নিয়েছে। ভারত কাশ্মির সমস্যাকে জাতিসঙ্ঘ পর্যন্ত নিয়ে গেছে এবং আজ পর্যন্ত জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবগুলোকে বাস্তবায়ন করতে গড়িমসি করে চলেছে। পাকিস্তানও ভুল করেছে। ১৯৯৯ সালে কারগিলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী লড়াই করেছিল। তবে রাষ্ট্র দাবি করেছে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নয়, বরং কাশ্মিরের মুজাহিদরা ভারতীয় বাহিনীর সাথে লড়াই করেছে। ওই ভুল দাবি কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের অপূরণীয় তি করেছে। ভারত মিথ্যার ব্যাপারে দশ কদম আগে চলে গেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ২০১৬ সালে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের নামে এক বিস্ময়কর মিথ্যা কথা বলল। রাতের অন্ধকারে নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে পাকিস্তানের বাহিনীকে ল্য করে গুলিবর্ষণ ও মর্টার শেল নিপে করে দাবি করে বসল, ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের এলাকায় অনুপ্রবেশ করে বহু অস্ত্রধারী জঙ্গি মেরেছে এবং সম্পূর্ণ নিরাপদে ফিরেও এসেছে। এই মিথ্যা কথা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পার্থক্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা ঠিক যে, দুর্নীতি ভারতেও হয়, পাকিস্তানেও হয়। ভারতেও জনগণের কাছে বারবার মিথ্যা বলে রাজনীতিবিদেরা ভোট পেয়ে যান। পাকিস্তানেও মিথ্যাবাদীরা সিনা টান করে বিরোধীদের চোর-ডাকাত আখ্যায়িত করেন। ভারতে সেকুলার সংবিধানের ছায়াতলে গরুর গোশত ভণকারীদের হত্যা করা হয়। পাকিস্তানে ইসলামের নামে ইসলামি শিক্ষাকে অপদস্থ করা হয় এবং অনার কিলিং করা হয়। ভারতে মহাত্মা গান্ধীকে একজন হিন্দু এবং ইন্দিরা গান্ধীকে একজন শিখ হত্যা করেছে। অপর দিকে, পাকিস্তানে লিয়াকত আলী খান ও বেনজির ভুট্টোর হত্যাকারী ছিল মুসলমান। উভয় দেশে বড় বড় নেতাকে হত্যা করা হয়েছে এবং ছোট ছোট নেতাকে মাথার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ভারতে রাজনৈতিক শাসক মিথ্যা বলেন। পাকিস্তানে সেনা স্বৈরশাসক জাতীয় স্বার্থ নিয়ে দরকষাকষি করেন।
ভারত ও পাকিস্তানে একটি কথা বেশ চালু আছে, শেয়ালের যখন মৃত্যু ঘনিয়ে আসে, তখন সে শহরের দিকে ছুটে যায়। আজকাল যার দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে আসে, সে আমেরিকার দিকে ছুটে যায়। পাকিস্তান আমেরিকার যুদ্ধে শরিক হয়ে যুদ্ধ করেছে, আমেরিকাকে সেনাঘাঁটি দিয়েছে এবং মারাত্মক তিগ্রস্ত হয়েছে। এখন ভারত ছুটে গিয়ে আমেরিকার সাথে আলিঙ্গন করছে। তাকে সেনাঘাঁটি দিচ্ছে এবং চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে প্রস্তুত হয়েছে। পার্থক্য এটাই যে, পাকিস্তান আগে হয়েছে, ভারতে এটা পরে হচ্ছে। পাকিস্তান যখন আমেরিকার মিত্র ছিল, তখন ভারত রাশিয়ার সাথে মিলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। ভারতের ধারণা ছিল, পাকিস্তান দুর্বল হয়ে গেছে। তাই এখন আর কোনো সমস্যা থাকবে না। পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিধর হয়েছে। যদি ভারত অ্যাটম বোমা না বানাত, তাহলে পাকিস্তানেরও অ্যাটম বানানোর প্রয়োজন হতো না। বেশি বিদ্বেষ কোথায়? ভারতে না পাকিস্তানে? ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো, পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভারতকে মেনে নিয়েছে, কিন্তু ভারতের অধিকাংশ মানুষ পাকিস্তানকে মেনে নেয়নি। এ কথার সাথে একমত নই যে, ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে বিবাদের মূল কারণ কাশ্মির সমস্যা; এবং যতণ পর্যন্ত এ সমস্যার সমাধান না হবে, উভয়ের সম্পর্ক ভালো হবে না। ভারতের আসল সমস্যা কাশ্মির নয়, বরং পাকিস্তান তার আসল সমস্যা। কাশ্মির সমস্যার সমাধান হলেও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্বেষ হ্রাস পাবে না। এ বিদ্বেষ বহাল থাকবে, বরং আরো বাড়বে। অখণ্ড ভারত ভাগ কাশ্মিরের কারণে হয়নি। গান্ধী ও নেহরুর ওই দ্বিমুখী দর্শনের কারণে হয়েছে, যার বিরুদ্ধে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো প্রগতিশীল মানুষ বিদ্রোহ করেছিলেন। ওই দ্বিমুখী নীতি ও বিদ্বেষের আসল কারণ ছিল অজ্ঞতা। অজ্ঞ ভারতেও আছে, পাকিস্তানেও আছে। তবে ভারতে বেশি রয়েছে। উভয় দেশের আসল সমস্যা হলো, অজ্ঞতা। উভয় দিকের শিতি মানুষ অজ্ঞ লোকের হাতে বন্দী হয়ে আছেন। উভয় দেশকে একে অপরের বিরুদ্ধে নয়, অজ্ঞতার বিরুদ্ধে লড়তে হবে।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ৩ অক্টোবর, ২০১৬

উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব

* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *

পুর্ব প্রকাশিত : নয়া দিগন্ত

উড়ন্ত পাখি

About উড়ন্ত পাখি

আমি কোন লেখক বা সাংবাদিক নই। অর্ন্তজালে ঘুরে বেড়াই আর যখন যা ভাল লাগে তা সবার সাথে শেয়ার করতে চাই।

Comments are closed.