কাণ্ডারি বলো পুড়িছে মানুষ সন্তান মোর মা’র

ফেসবুক খুলে হঠাৎ মনে হল, বাঙালিরা আজ নতুন কোন যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে । আমার ফেসবুক ওয়ালে বাঙালি বন্ধুরা, দরজা বন্ধ করে ১০জন বিহারি নারী-শিশুকে আগুনে পুড়িয়ে মারার মধ্যে একাত্তর এর প্রতিশোধ দেখতে পেয়ে আনন্দে শীৎকার দিচ্ছেন। আরো অনেককে পুড়িয়ে মারার ডাক দিচ্ছেন।

যারা এসব পোস্ট করেছেন, কমেন্ট করেছেন তাদের মধ্যে আছেন শিল্পী, কবি, ইন্টেলেকচুয়াল ও অন্যান্য ফেসবুক সেলেব্রিটিরা।

সকালে একাত্তর টিভির সংবাদ পাঠিকারে শুনলাম জিজ্ঞেস করতে, “আপনি জিজ্ঞেস করেন, কেন তারা পুলিশের নিষেধ সত্ত্বেও বাজি ফোটালো?” আর এই প্রশ্ন করার কালে সময় টিভির লাইভে দেখাচ্ছে, একটা ৩ বছরের বাচ্চা মেয়ের পোড়া লাশ কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে একটা বাপ, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

একজন লিখছেন, “মানবতা মানুষদের দেখাতে হয় ভাইয়া, জানোয়ারদের না। আর এটা উগ্র জাতীয়তাবাদ নয়। এরা নিজেরা নিজেদের পুড়িয়ে মেরেছে।”

আমরা যাদের বিহারি বলি, তাদের অনেকেই আসলে বিহারি না— গুজরাটি। এই বিহারি, গুজরাটি, অবাঙালিদের আমরা বিহারি বলে ডাকি। পাকিস্তান এদেরকে নেয়নি বা এরা পাকিস্তানে যায়নি, কারণ তাদের পাকিস্তানে কোনো আবাস নেই

একজন লিখেছেন, “তবে বিহারি মারলে কেন জানি ভালো লাগে । পাকি কুত্তা মরার খবরে কেমন জানি শান্তি শান্তি ভাব আছে ।”

আমাদের জাতিসত্তার ভেতরে বিহারিদেরকে নিয়ে একটা ক্ষোভ আছে। কারণ, আমরা জানি তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। অনেকে বাঙালিদের নির্যাতনে পাকিস্তানি বাহিনিকে সমর্থন দিয়েছিল। সেই মনোস্তত্ত্ব থেকে এখনো অনেকেই ১০জন নিরীহ নারী ও শিশুকে আগুনে পুড়িয়ে মারার সমর্থন দিচ্ছেন।

বিষয়টাকে আরো একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।

আমরা যাদের বিহারি বলি, তাদের অনেকেই আসলে বিহারি না— গুজরাটি। এই বিহারি, গুজরাটি, অবাঙালিদের আমরা বিহারি বলে ডাকি। পাকিস্তান এদেরকে নেয়নি বা এরা পাকিস্তানে যায়নি, কারণ তাদের পাকিস্তানে কোনো আবাস নেই।

বাংলাদেশের সীমান্তের ওপাশে আছে পশ্চিমবাংলা, তারপরে বিহার। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিকে ৪৭-এর দেশভাগের পরে হিন্দু এবং মুসলমানরা যখন মাস স্কেলে মাইগ্রেট করল— সে সময় এই বিহারি বা গুজরাটিদের বড় একটা অংশ তৎকালিন পূর্ব-পাকিস্তান বা আমাদের এখনকার বাংলাদেশের দিকে মাইগ্রেট করে।

গুজরাটিরা রয়ে যায়। তার কারণ, তাদের এখানে প্রচুর ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। আর বিহারিরা অনেকেই মাইগ্রেট করে আসে, কারণ তাদের অঞ্চলে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল।

১৯৪৭ সালে এই দেশের মূল ব্যবসা ছিল ট্রেডিং। এই ট্রেডিংটা সম্পূর্ণভাবে গুজরাটিদের হাতে ছিল। যাদেরকে আমরা বাংলায় মাড়োয়ারি বলে থাকি। মাড়োয়ারি ব্যবসার কাজে লাগাতো বিহারিদেরকে।

আমরা জানি ১৯৭১ সালের যুদ্ধের আগে এই বাংলায় ২২ জন কোটিপতি ছিল, যার মধ্যে মাত্র ২জন ছিল বাঙালি। তাহলে ১৯৭১ সালে ২জন থাকলে, ১৯৪৭ সালে কয়জন ছিল ?

একটা ৩ বছরে মেয়ে যার পুরে যাওয়া লাশ নিয়ে, তার ৩০ বছরের পিতাকে কাঁদতে কাঁদতে হেঁটে যেতে দেখলাম, ৩০ বছর বয়েসি সেই বাবাও ৭১-এর গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল নাকি? আমাদের বাঙালি জিঘাংসায় কিন্তু শুধু এই বিহারি না, পাহারের অনেক আদিবাসীও পুড়ে মরেছে, এরাও গণহত্যার সহযোগী হয়েছিল নাকি

এই উদাহরণটা দেয়ার উদ্দেশ্য হল, দেখানো যে ১৯৪৭ সালে আমাদের দেশের বাঙালিদের মধ্যে হাতেগোনা ব্যবসায়ী ছিল। তার মানে সেই সময়, পুঁজির রূপান্তর ঠিকমতো হয়নি। ব্যবসা ছিল এই মেমন বা গুজরাটিদের হাতে। এই মেমনরা আবার কাজ করাতো বিহারিদেরকে নিয়ে। ৬০-এর দশকে, আদমজি জুট মিলে দুবার দাঙ্গা হয়েছে, বাঙালি শ্রমিক এবং বিহারি শ্রমিকদের নিয়ে।

বিহারি, গুজরাটি, মেমন— এই পুরো গ্রুপটা সম্পর্কে, অনেক ভুল ধারণা আছে। এরা যদি বিহারি হয়ে থাকে, তাহলে এরা বিহারি। বিহার থেকে আসা মুসলমান জনগোষ্ঠী, পাকিস্তান থেকে আসা আটকে পড়া পাকিস্তানি না। এরা বিহার থেকে আসা মাইগ্রেটেড মুসলিম।

১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের দায় এই দেশকে নিতে হবে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এবং তারপরেও, এই অঞ্চল থেকে হিন্দুদের একটা মাইগ্রেশন হয়েছে। (এটি অন্য রাজনৈতিক বিতর্ক, এই আলোচনার বিষয় নয়)। ঠিক তেমনি পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এবং অন্য অঞ্চল থেকে বিহারি বা গুজরাটিরা এই অঞ্চলের দিকে মাইগ্রেট করছে।

শত্রু-সম্পত্তি আইনের নাম দিয়ে, বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়া হিন্দুদের সম্পদ দখল করে কোটিপতি হয়েছে অনেকেই। এবং ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্বের আইনের মাধ্যমে ১০০ বিঘার উপরে ভূমির দখল, নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে হিন্দু জমিদারিত্বের উপরে বাঙালি মুসলমানদের দখল নিশ্চিত করা হয়। যার ফলে, বাংলাদেশে মধ্যবিত্তশ্রেণির উত্থান ঘটে।

এসব সুবিধা পাওয়ার দায় হল, ঔপনিবেশিক সময়ের বিহার থেকে আসা ২-৩ লাখ মুসলমানকে এই অঞ্চলে নিতে হবে। এটি ইন্ডিয়া নিয়েছে, পাকিস্তান নিয়েছে। কিন্তু মাত্র ২-৩ লাখ বিহারিকে নিতে, যে কার্পণ্য আমরা দেখাচ্ছি, সেটি আমাদের বাঙালি মানসের পরিচয় বহন করে না।

এখানে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাদের ভূমিকার প্রসঙ্গটা নিয়ে জিঘাংসা টেনে আনাটা অপ্রাসঙ্গিক। ইতিহাসে অনেক নির্যাতিত এবং ভূমিহীন, বঞ্চিত জনগোষ্ঠী আছে। ইউরোপে আছে জিপসিরা, পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে রয়েছে ফিলিস্তিনিরা, মিয়ানমারে আছে রোহিঙ্গারা, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই জনগোষ্ঠীকে, অনেক দেশে ছোট ছোট ক্যাম্প করে, মূল জনগোষ্ঠীর থেকে আলাদা করে রাখা হয়। অভিযোগ আছে, এই ক্যাম্পগুলো হয় মাদকের আড্ডাখানা, অপরাধীদের অভয়ারণ্য।

এসব হতেই পারে। এই অভিযোগ মিয়ানমারের আরাকানেরাও বাঙালিদেরকে নিয়ে করে। এখানের মূল সমস্যা হল, একটা শিক্ষাবঞ্চিত, সুবিধাবঞ্চিত, চাকরির সুযোগ বঞ্চিত, সামাজিকভাবে নিগৃহীত এবং অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে ক্যাম্পে আটকে রাখলে, সেখানকার পরিবেশ ধীরে ধীরে অন্যায় সহনীয় হয়।

এটি লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেলের সমর্থ বাঙালি জনগোষ্ঠীর জন্যেও প্রযোজ্য। বাকি সাদা চামড়ার লোকেরা এই এলাকার অপরাধপ্রবণতা, মাদক এবং শিক্ষার অভাব নিয়ে আহাজারি করে। অথচ এদেরকে অনেক অনেক সুযোগ দেয়া হয়েছে।

এই জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্ম, এই দেশের মাটিতে যাদের জন্ম তাদেরকে মাতৃভূমে পরবাসী করে রাখলে, আমরা কি বৈধতা দেই জানেন? আমরা রোহিঙ্গাদের আগুনে পুড়িয়ে মারার আরাকানি ভাবনাকে বৈধতা দেই। আমরা বিজেপির ভারত থেকে বাংলাদেশে বাঙালিদের পুশইন করার ভাবনাকে বৈধতা দেই। প্রশ্ন মানবিকতার না। আমি আমার জাতির কাছ থেকে মানবিকতা আশাও করি না। প্রশ্নটা দায় মেটানোর। প্রশ্নটা ইতিহাসের

কিন্তু এই আটকে পড়া বিহারিরা তো এমন এক দেশে আসছে যেখানে, সবাইকে লুটপাট করে খেতে হয়। তাই এরা হোয়াইট চ্যাপেলের আটকে পড়া বাঙালিদের মতো এত সুযোগ পায়নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই এখানে মাদক এবং অন্য অপরাধের চারণ ভূমি।

এ ধরনের, ভূমিবঞ্চিত মানুষ সব সময় তার অস্তিত্বের সংকটে ভোগে। কারণ, মূল জনগোষ্ঠী তাকে গ্রহণ করে না। সে শিক্ষা পায় না, চাকরির সুযোগ পায় না।

এই মানসিকতা থেকেই এই বিহারি জনগোষ্ঠী পাকিস্তানের বিভাজন চায়নি। যেমনটি বাংলাদেশের মুষ্টিমেয় কিছু বাঙালিও চায়নি। এমনকি পুরান ঢাকার নবাব পরিবারের বংশধররাও চাননি। অনেক পুরানপন্থী মানুষই তা চাননি। আমাদের ১৯৭১ সালের যে ন্যারেটিভ (বয়ান) দাঁড়াচ্ছে, তাতে সেই সব না চাওয়াকে গণহত্যার অপরাধের সমতুল্য করা হচ্ছে। এই বিহারিরা যে পাকিস্তান ভাগ চায়নি, তার শাস্তি হিসেবে এখন বলা হচ্ছে তাদেরকে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে এই সব পক্ষ বিপক্ষ, থাকবে। তাতে অপরাধ হয় না; অপরাধ হয় গণহত্যার সহযোগী হওয়াতে। কিন্তু যারা বিহারি নিধনে উল্লসিত, তারা কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন, সকল বিহারি গণহত্যায় সহযোগী হয়েছিল ?

একটা ৩ বছরে মেয়ে যার পুরে যাওয়া লাশ নিয়ে, তার ৩০ বছরের পিতাকে কাঁদতে কাঁদতে হেঁটে যেতে দেখলাম, ৩০ বছর বয়েসি সেই বাবাও ৭১-এর গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল নাকি? আমাদের বাঙালি জিঘাংসায় কিন্তু শুধু এই বিহারি না, পাহারের অনেক আদিবাসীও পুড়ে মরেছে, এরাও গণহত্যার সহযোগী হয়েছিল নাকি?

আমরা একটা সুস্থ সমাজ নির্মাণ করতে পারিনি, সুস্থ বিচার বিভাগ নির্মাণ করতে পারিনি, রাজনীতি করে করে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারিনি; বরং যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে ক্ষমতা দখলের অস্ত্র বানিয়েছি। এর দায় এই বিহারিদের নয়। এদের মধ্যে, কেউ যদি অপরাধী হয়ে থাকে, তবে তাদের শাস্তি ১৯৭১ সালের পরপরই হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। সেটি আমরা করিনি। আমরা রাজনীতি করেছি। আমরা এখনও প্রতিষ্ঠা করতে পারি নাই শহিদদের নাম। প্রধান অপরাধী যে ১৯৬ জন পাকিস্তানি সেনা, আমরা তাদের কোনো খোঁজখবর রাখিনি।

কিন্তু এখন প্রতিশোধ নিচ্ছি সবচেয়ে দুর্বল, সবচেয়ে রুগ্ন, সবচেয়ে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মা-বোনদের উপরে, যাদের সামান্যতম সহায়-সম্বল নাই ? সামান্যতম প্রতিরোধের ক্ষমতা যাদের নেই।

ছি, উগ্র-জাতীয়তাবাদ। তোমাদের এমন বিচারে লজ্জায় মরে যাচ্ছি।

আবারও বলছি, এরা আটকে পড়া পাকিস্তানি না। এরা ঔপনিবেশিকতার গর্ভ থেকে আসা জন্মের দায়। সে গর্ভ থেকে বের হয়ে আসা আমাদেরই আরেক ভাই এই বিহারিরা।

এই ধরনের ৫ সাত কোটি মাইগ্রেটদের দায় ভারত নিছে, পাকিস্তান নিছে। কিন্তু, আমরা বাঙালি জাত এমন নাখাস্তা জাত, আমরা মাত্র ২-৩ লাখ মাইগ্রেটদের দায় নিতে পারিনি। আমরা তাদের নাম দিয়েছি আটকে পরা পাকিস্তানি। অথচ, এরা আসে এমন এক অঞ্চল থেকে, আমরা নিজেরাই দাবি করি যার শাসক ছিলেন নবাব সিরাজুদ্দৌল্লাহ।

এদেরকে নিয়ে এত দ্বিধায় থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। এটি ৪৭-এর দায়। জানা কথা পাকিস্তান এদেরকে নেবে না। কেন নিবে? বিহার তো পাকিস্তানে না? বিহার হইল বিহারে। আমরা নিজেরাই তো বলি বাংলার সীমানা একসময় বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

এই জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্ম, এই দেশের মাটিতে যাদের জন্ম তাদেরকে মাতৃভূমে পরবাসী করে রাখলে, আমরা কি বৈধতা দেই জানেন? আমরা রোহিঙ্গাদের আগুনে পুড়িয়ে মারার আরাকানি ভাবনাকে বৈধতা দেই। আমরা বিজেপির ভারত থেকে বাংলাদেশে বাঙালিদের পুশইন করার ভাবনাকে বৈধতা দেই। প্রশ্ন মানবিকতার না। আমি আমার জাতির কাছ থেকে মানবিকতা আশাও করি না। প্রশ্নটা দায় মেটানোর। প্রশ্নটা ইতিহাসের।

আমরা ইতিহাসের সন্তান। সেটি হতে যদি আমরা অস্বীকার করি, তাহলে, পৃথিবীর সবদেশ থেকে আমাদেরকে পিটিয়ে বের করে, বাংলাদেশে পুশ ইন করে দেয়াও বৈধ।

পূর্ব প্রকাশিত: বাংলা ট্রিবিউন

Loading

জিয়া হাসান

About জিয়া হাসান

লেখক: প্রাবন্ধিক। প্রকাশিত গ্রন্থ : শাহবাগ থেকে হেফাজত: রাজসাক্ষীর জবানবন্দি -

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *