ঈমানের দুর্বলতা

আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে অধিকাংশেরই সঠিক জ্ঞান নেই। ঈমান কি, ইসলাম কি, মুসলিম শব্দের অর্থ কি জানা নেই। নামায, যাকাত, রোজা, হজ্জ্ব ইত্যাদি ইবাদতের প্রয়োজনীয় মাসলা- মাসায়েল জানা নেই। অন্যান্য ধর্মের মত ইসলাম যে নিছক একটি ধর্ম নয়, শুধু ইবাদত বন্দেগীতেই ইসলাম সীমিত নয় বরং ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে প্রযোয্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, তা জানা নেই।

বাংলাদেশে প্রচলিত স্কুল-কলেজে যে শিক্ষা বিদ্যমান তা পড়ে এসবতো জানা যায়ই না বরং ইসলাম সম্পর্কে বিরূপ ধারনা সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কথা। যিনি একবার ক্লাসে বলেছিলেন, “ধর্ম বলছে মানুষ আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন আর বিজ্ঞান বলছে মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি হয়েছে। মুসলিম হিসাবে কোরানের কথা আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হয় আর বিজ্ঞান যেহেতু প্রমাণিত তাও মানতে হয়।” দুটো একসাথে কিভাবে মানা সম্ভব?

ধর্ম নিয়ে কয়েকটি বছর আমারও সংশয়ে কেটেছে। পৃথিবীতে এত ধর্ম, কোনটি সঠিক? ধর্ম বলছে একরকম আর বিজ্ঞান বলছে অন্যরকম, কোনটি সঠিক? মৃত্যুর মাধ্যমেই যদি জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে তাহলে এজীবনের অর্থ কি? পৃথিবীর এত জুলুম-অত্যাচারের কি কোন বিচার নেই? এরকম প্রশ্ন প্রতিটি মানুষের অন্তরে জাগ্রত হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হল কেউ উত্তরগুলো জানতে পারে আর কেউ পারে না। দ্বিধা-দ্বন্দ নিয়ে কেউ মাঝেমধ্যে ইবাদত করে, কেউ ধর্মের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়ে, কেউ আবার ধর্ম বিদ্বেষী বা নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এসব কিছুর প্রধান কারণ হলো ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা।

একজন মুসলিমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হল ঈমান। ঈমান খাঁটি হলে আমল করে শান্তি পাওয়া যায়। ঈমানে যদি দুর্বলতা থাকে তাহলে ইবাদতে আগ্রহ থাকে না। চাকুরীজীবীরা সারা মাস সময়জ্ঞান বজায় রেখে কাজ করে যায় কারণ তার দৃঢ় বিশ্বাস আছে মাস শেষে বেতন পাওয়া যাবে। অনেক মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়েও উন্নত দেশে পাড়ি জমায় কারণ তার দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে সেখানে গেলে বাকি জীবন সুখে-শান্তিতে কাটাতে পারবে। কিন্তু মৃত্যুর পর যে অনন্ত জীবন রয়েছে এবং সে জীবনে সূখী হতে হলে কিছু করা প্রয়োজন সে ব্যাপারে এত উদাসীন বা কোন প্রচেষ্টা নেই কেন? এর প্রধান কারণ হলো দৃঢ় বিশ্বাসের অভাব। আল্লাহতা’লা বলেন,

“তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর এবং নিশ্চয় উহা কঠিন কাজ। তবে তাদের জন্য সহজ যারা ধারনা রাখে যে, একদিন তাদের রবের সাথে নিশ্চিত সাক্ষাত ঘটবে এবং তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে।” (বাক্বারাঃ ৪৫, ৪৬)

সুতরাং একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বেনামাযী এবং আমলহীন মুসলিমদের ঈমানে দুর্বলতা আছে। কারণ, আল্লাহ ও পরকাল অর্থাৎ জান্নাত- জাহান্নামের প্রতি যদি তাদের দৃঢ় বিশ্বাস থাকত তাহলে তারা জাহান্নামের কঠিন আযাব থেকে বাঁচার চেষ্টা করত এবং জান্নাতের অনন্ত সুখের জীবন লাভের জন্য পাঁচওয়াক্ত নামাযসহ অন্যান্য ধর্মীয় আমল করত তা যত কষ্টেরই হোক না কেন।

ঈমানের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আল্লাহর উপর বিশ্বাস। মহাবিশ্বসহ পৃথিবীর সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা এবং ইবাদতের একমাত্র হকদ্বার হিসেবে আল্লাহকে স্বীকার করা। আল্লাহ যে সত্যি আছেন তার প্রমাণ কি? অবিশ্বাসীদের দাবি, বিশ্বাসেরতো একটা ভিত্তি থাকতে হবে!

সমগ্র সৃষ্টি জগতই স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করে, এর জন্য বাড়তি প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। তথাপি আল্লাহতা’লা তাঁর উপস্থিতির প্রমাণস্বরূপ যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁদেরকে দিয়েছেন আসমানি কিতাব এবং মুযেযা বা অলৌকিক ক্ষমতা, যার দ্বারা মানুষ তাঁদেরকে আল্লাহর প্রেরিত বলে বুঝতে পারত এবং তাঁদের অনুসরণ করত। তাঁদের মুযেযা মৃত্যুর সাথেই শেষ হয়ে যেত কিন্তু শেষ রাসূল মুহাম্মদ (সাঃ) এর মুযেযা তাঁর মৃত্যুর পরও বিদ্যমান আছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। তা হল “আল কোরআন”।

আল কোরআনের মুযেযা হওয়ার কারণঃ

১। কোরআন শরীফে পূর্ববর্তী উম্মত, শরীয়ত ও তাদের ইতিহাস এমন পরিস্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সে যুগের ইহুদী- খ্রীস্টানদের পন্ডিতগন যাদেরকে পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবসমূহের বিজ্ঞ লোক মনে করা হতো, তারাও এতটা অবগত ছিলেন না। রাসূল (সাঃ) এর কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, কোন শিক্ষিত লোকের সাহায্যও তিনি গ্রহণ করেন নি। এতদসত্ত্বেহ পৃথিবীর প্রথম থেকে তাঁর যুগ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ববাসীর ঐতিহাসিক অবস্থা এবং তাদের শরীয়ত সম্পর্কে অতি নিখুঁতভাবে বিস্তারিত আলোচনা করা আল্লাহর কালাম ব্যতীত কিছুতেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহতা’লাই যে তাঁকে এ সংবাদ দিয়েছেন এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই আল্লাহতা’লা এরশাদ করেনঃ

“এরা কি লক্ষ্য করে না কোরানের প্রতি? এটা যদি আল্লাহ ব্যতীত অপর কারো পক্ষ থেকে হতো, তবে এতে অবশ্যই বহু বৈপরীত্য দেখতে পেত।” (নিসাঃ ৮২)

২। বড়, ছোট এবং মাঝারি আকারের ১১৪ টি সূরা কোরআনে রয়েছে। সূরা বাক্বারা- ২৮৬ টি, আল ইমরান- ২০০ টি, আন নিসা- ১৭৬ টি, মায়িদা- ১২০ টি, আনআম- ১৬৫ টি আয়াত বিশিষ্ট, এছাড়া বড় অনেক সূরা রয়েছে। এসব সূরাগুলি পর্যায়ক্রমে একটির পর একটি নাযিল হয়নি। দীর্ঘ তেইশ বছরে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে কয়েক আয়াত করে নাযিল হয় এবং বিভিন্ন সূরার সাথে জুড়ে দেয়া হয়। কয়েক আয়াত করে মুখে-মুখে একসাথে সূরাগুলি রচনা করা, প্রতিটি সূরার বিষয়বস্তু ঠিক রেখে আয়াতগুলো জোড়া লাগিয়ে সূরাগুলোকে অর্থপূর্ণ করে তোলা, প্রতিটি আয়াতে অন্তর্মিল রাখা এবং প্রতিটি সূরাকে মুখস্ত রাখা কি মুহাম্মদ (সাঃ) এর মত নিরক্ষর মানুষের পক্ষে বা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব? কখনও সম্ভব নয়। তাই আল্লাহতা’লা অবিশ্বাসীদেরকে কোরানের মত কোন কিতাব বা সূরা রচনা করার জন্য বারংবার চ্যালেঞ্জ করেছেন।

“এতদসম্পর্কে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, তাহলে এর মত একটি সূরা রচনা করে নিয়ে এসো। অবশ্য তা তোমরা কখনও পারবে না।” (বাক্বারাঃ ২৪)

“যদি মানব ও জ্বীন এই কোরআনের অনুরূপ রচনা করার জন্য জড়ো হয় এবং তারা পরস্পর সাহায্যকারী হয়; তবুও তারা কখনও এর অনুরূপ রচনা করে আনতে পারবে না।” (বনী ইসরাঈলঃ ৮৮)

মুহাম্মদ (সাঃ) যদি নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কোরআন রচনা করতেন তাহলে তিনি ভোগ বিলাসী জীবন যাপন করতেন। কিন্তু তা না করে তিনি দরিদ্র জীবন যাপন করতেন, বেশিরভাগ দিন রোজা রাখতেন, রাত জেগে ইবাদত করতেন, ক্ষুধার জ্বালায় পেটে পাথর বেঁধে থাকতেন। যৌবনের পুরুটা সময় নিয়ে পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত একজন বিগত যৌবনা মহিলার সাথে কেন কাটালেন? তিনি যদি স্বার্থসিদ্ধির জন্য কোরআন রচনা করতেন তাহলে শুধু তাঁর সমসাময়িক লোকদেরকে কোরআন রচনা করার জন্য চ্যালেঞ্জ করাটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তা না করে সারা বিশ্ববাসীকে চ্যালেঞ্জ করার কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে?

সুতরাং কোরআন যে মানব রচিত কোন গ্রন্থ নয় বরং তা আল্লাহরই বানী এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

Loading

Comments are closed.