ইবনে বতুতা – পরিব্রাজক ও চিন্তাবিদ :: ইতিহাসের পাতায় চির অম্লান

ইবনে বতুতা, এই বিখ্যাত পর্যটকের নাম উপমহাদেশের ইতিহাসের সাথে উতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। কিন্তু কেন?

বেশ কিছু কারনের মধ্যে একটি উল্ল্যেখযোগ্য কারন হল তার বর্ননা থেকে এই উপমহাদেশের কিছুটা নিরপেক্ষ চিত্র উঠে আসে। তৎকালিন ইতিহাসবিদরা ছিলেন সুলতান কিংবা বাদশাদের নিয়োজিত। তাই তাদের লেখায় পক্ষপাতিত্ব লক্ষ্য করা যায়। সংগত কারনেই বর্তমান সময়ের ঐতিহাসিকরা প্রকৃত ইতিহাস বিবেচনায় সমসাময়িক কালের পরিব্রাজদের ভ্রমন কাহিনির উপর নির্ভরশীল। ইবনে বতুতা এমনি করেই আমাদের পরিচিত হয়ে আসেন।

১৩০৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মরক্কোর তানজিয়ারে জন্মগ্রহণ করেন এই প্রখ্যাত পরিব্রাজক। একজন সুন্নি মুসলিম চিন্তাবিদ, বিচারক ধর্মতাত্ত্বিক হিসাবে সারাজীবনই দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। আফ্রিকা থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য, ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং চীন পর্যন্ত বিস্তির্ন এলাকা তিনি ভ্রমন করেছেন। প্রায় ৩০ বছরের ভ্রমণ জীবনে পাড়ি দিয়েছেন ৭৩ হাজার মাইল । আইন বিষয়ে পড়াশোনা করলেও ভ্রমণের প্রতি তার ছি্ল অদম্য স্পৃহা। এই ভ্রমণপিপাসা তাকে মাত্র একুশ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পথে নামায়।

ঘঠনার শুরু এইখান থেকে। মাথার ওপর তারাভরা আকাশ। একদিন বাড়ির ছাদে ঘুমিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখলেন, বিশাল এক পাখির পিঠে চেপে এশিয়ার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছেন। ঘুম ভাঙলে ঠিক করলেন পরিব্রাজক হবেন, আর প্রতিজ্ঞা করলেন, এক রাস্তায় কখনো দ্বিতীয় পা রাখবেন না। ভিড়ে গেলেন এক হজযাত্রী দলের সঙ্গে। তারাও মক্কায় যাচ্ছিল। পায়ে হেঁটে ২০০০ মাইল পাড়ি দেয়ার পর আলেকজান্দ্রা পৌঁছেন। সেখান থেকে কায়রো গমন করেন। এরপর একে একে দামেস্ক, হেবরন, জেরুজালেম ভ্রমণ করেন। সেখান থেকে মক্কা। মক্কায় গিয়ে দেখেন, যতদূর চোখ যায় খালি মানুষ আর মানুষ, সেলাইবিহিন সাদা কাপড় পরা। ভিড়ের মধ্যে সঙ্গীদের হারিয়ে ফেললেন। হজের পর অন্য একটি দলের সঙ্গে ভিড়ে গেলেন। মরুভূমির ভিতর দিয়ে যাত্রা হলো শুরু। পৌছলেন মদিনায়। পরবর্তি তিন বছরের মধ্যে তিনি উত্তর আফ্রিকা, আরব, পারস্য, ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল ও কনসল্টান্টিনাপোল ভ্রমণ করেন।

১৩২৮ সালে তিনি পূর্ব আফ্রিকা ভ্রমণ শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে জেদ্দা, ইয়েমেন, সানা, এডেন, মুগাদিসু, জানজাবির, ওমান ভ্রমণ সমাপ্ত করে আবার ১৩৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় হজের জন্য ফিরে আসেন। এর এক বছর পর দিল্লির তৎকালীন সুলতান মুহাম্মদ তুগলক ( পরে যাকে ইবনে বতুতা বলেছিলেন সাইকোপ্যাথ) এর নিমন্ত্রনে তুরস্ক থেকে দিল্লি পৌঁছেন। মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে ধনি রাজ্য তখন দিল্লী। সুলতানের জন্যে নিয়ে গেলেন উট, আরবি ঘোড়া, এবং সাদা ক্রিতদাস। সুলতান মুহাম্মদ ইবনে বতুতার শিক্ষা আর পান্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে সেখানকার কাজী হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। আট বছর তিনি এই পদে নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। কিন্তু ভ্রমণপিয়াসী অনুসন্ধানি মন কোনো বন্ধনেই আবদ্ধ হতে চায় না। সুলতানের কাছে হজ্বের অনুমতি চাইলে সুলতান তা প্রত্যাখান করেন। বরং তাকে চীনের রাষ্ট্রদূত করে চীনে পাঠান। ইবনে বতুতা কিছুদুর আগ্রসর হয়ে ফিরে আসেন এবং কাজ থেকে ইস্তফা দিয়ে পুনরায় ভ্রমনে বেড়িয়ে যেতে চাইলেন। এই ঘঠনায় সুলতান তাঁকে আটক করেন। পরে অবশ্য অনেক অনেক উপহার দিয়ে ছেড়ে দেন। নতুন দেশ ভ্রমণে দিল্লির রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পথে নামলেন। পথে ডাকাত দল হামলা করে, সুলতানের সব উপহার ডাকাতেরা লুট করে নিয়ে যায়। অনেক আগে মরক্কোতে ইবনে বতুতা রদেভুর (দরবেশ) দেখা পেয়েছিলেন, যে তাকে বলেছিল তুমি এরকম বিপদে পরবে আর তোমাকে উদ্ধার করবে দিলশাহ বলে একজন। সত্যি সত্যি আহত ইবনে বতুতা যখন পরে ছিলেন এক লম্বা ভারতীয় এগিয়ে এলেন, নিজের নাম বল্লো দিলশাহ। উনাকে ঘাড়ে করে নিরাপদ আশ্রয় এ নিয়ে এলেন। এরপরে ইবন বতুতা অনেক খুজলেন কিন্তু এলাকা বাসী জানাল এখানে দিলশাহ বলে কেউ থাকেনা।

দক্ষিন এশিয়া ভ্রমন কালে প্রথমই গেলেন মালদ্বীপ। সেখান থেকে চীন, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, বার্মা হয়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এসে পৌঁছেন। সংগত বলে রাখা যায় চীনের তৈরি তৈজস্ব পত্রের ব্যাপক প্রশংসা করলেও দেশের মানুষজন তার কাছে ভাল লাগেনি। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া তিনি ঘর থেকেই বের হতেন না। যাই হোক, বাংলাদেশে এসেই তিনি, চট্টগ্রাম থেকে নদীপথে পনের দিনে পৌঁছেন সোনারগাঁয়ে। এই সফরের বিস্তারিত বিবরণ তার রেহলা ও তুহফাত উন নুজ্জামার ফি ধরাইব-ইন-আসসার ওয়া আজাইন ইল আসফার গ্রন্থদ্বয় থেকে পাওয়া যায়। ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ইবনে বতুতা বাংলার রাজধানী সোনারগাঁও, সিলেট এবং কিশোরগঞ্জের এগারসিন্দুর পরিভ্রমণ করেন। তার বিবরণীতে শাহজালালের জীবনধারা সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। তাছাড়া তখনকার মুসলিম ও অমুসলিমদের উপর সুফি-দরবেশদের প্রভাব, চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সহজলভ্যতা ইত্যাদি এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়। বিখ্যাত ভূ-পর্যটক ইবনে বতুতা কিশোরগঞ্জের এগারসিন্দুরও এসেছিলেন। ব্রহ্মপুত্রের পূর্বপাড় থেকে কামরুপ রাজ্য পর্যন্ত ভূ-ভাগটি তখন প্রাগ জৌতিষপুর নামে পরিচিত ছিল। তার বর্ননা থেকেই আমরা জানতে পারি, অঞ্চলের বনজঙ্গলে প্রচুর হাতি ও গন্ডারের বিচরণ ছিল। ইবনে বতুতা তাঁর গ্রন্থে শুধু জেলা কিশোরগঞ্জের এগার সিন্দুরসম্পর্কে তিনি সুন্দর একটি আলোচনা লিখে গেছেন। সে আলোচনায় উল্লেখ আছে এগারসিন্দুর সহ এর আশে পাশের এলাকায় প্রচুর সুক্ষ মসলিন কাপড় তৈরী হত এবং এ মসলিন কাপড় সহ অন্যান্য দ্রব্যাদি এখান থেকে বিদেশে রপ্তানী হত। সেই সময় সোনারগাঁও এলাকার শাসন কর্তা ছিলেন সুলতান ফকরুদ্দীন মোবারক শাহ।

জুলাই-আগষ্ট, ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্ধ এই দুমাস বা তারও কম সময় তিনি বাংলাদেশ সফর করেন। পরে সোনারগাঁও থেকে একটি চীনা বাণিজ্যিক জাহাজে করে চলে যান জাভায়। ১৩৪৮ সালে মরক্কো ফিরার পথে আরব থেকে ইউরোপ পর্যন্ত্য দেশে দেশে ব্ল্যাক ডেথ লক্ষ্য করেন। গড়ে প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা হাজারের উপর ছিল। বর্তমান ইতিহাস থেকে জানা যায় ইদুর থেকে এই প্লেগ হয়েছিল এবং তা চীন পর্যন্ত্য ছড়িয়ে পরেছিল। খাদ্যশস্যের এক জাহাজে করে ইদুরেরা চীন পর্যন্ত্য পৌছেছিল।

এই মহামারি দেখার পর থেকেই বন্ধু-বান্ধব, আত্নিয়-স্বজন্দের সানিন্দ্য পাবার জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠে। ২৯ বছরের দীর্ঘ পরিভ্রমণ শেষে ১৩৪৯ সালে তিউনেশিয়া থেকে যাত্রা করেন মরক্কোর উদ্দ্যেশে।

পথে পরে মালে রাজ্য। সুলতান সোলায়মান তাঁর এই হঠাৎ আগমনে খুবই খুশি হন। ঘোসনা দেন তার জন্ম দিনে উপহার দিয়ে তাঁকে চমকে দিবেন। ১৩৫২ সালে মালেতে ৪৮ তম জন্মদিনে সুলতান তাকে সারপ্রাইজ উপঢৌকন হিসাবে রুটি, মাংস আর দুধ প্রেরন করেন। বতুতা ভেবেছিলেন রাজা তাকে স্বর্নমুদ্রা উপহার হিসাবে পাঠিয়েছেন। সুলতানের এই রসিকতায় তিনি খুবই মজা পয়েছিলেন।

১৩৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জন্মভুমি মরক্কোর মাটিতে পা রাখেন। ততদিনে তার বাবা-মা দুজনই মৃত্যুবরণ করেছেন।

একই বছর তিনি কবি বিন যোজাইয়াকে নিয়োগ করেন তার বিখ্যাত ভ্রমন কাহিনি ‘Rihla’ লিখার জন্য। এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ পায় ১৯৫৮ সালে। যদিও রাহলা তার অন্যতম জনপ্রিয় বই, কিন্তু Tuhfat al-Nuzzar fi Ghara’ib al-Amsar wa-‘Aja’ib al-Asfar [A Gift to Those Who Contemplate the Wonders of Cities and the Marvels of Traveling). বই থেকেই তার ভ্রমন কাহিনি বেশি পাওয়া যায়।

৭৫০০০ মাইল পরিভ্রমণকারী এই মুসলিম মনীষী ১৩৬৮ খ্রিষ্টাব্দে বা ১৩৬৯ খ্রিষ্টাব্দে মরক্কোতে মৃত্যুবরণ করেন।

মার্কো পোলোর সাথে তুলনা করে তার ভ্রমন বৃত্তান্তের মানচিত্র

মানচিত্রটি বড় করে দেখতে
এইখানে ক্লিক করুন

***************************************************************************

তথ্যসুত্রের ( ) জন্য ইন্টারনেটের কাছে কৃতজ্ঞ।

রেফারেন্স হিসাবে পড়তে পারেন এইচ এ আর গিব-এর “ট্রাভেলস অব ইবনে বতুতা”

এ লিখাটি পূর্ব প্রকাশিত তারিখঃ রবিবার, ৩০/০১/২০১১ হয়েছিল এখানে)

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *