আরব বসন্তের পোষ্ট মর্টেম করলেন ডা: তারেক সুয়েইদান!

আধুনিক মুসলিম বিশ্বের এক জন প্রখ্যাত ইসলামী স্কলার ড: তারেক সুয়েইদান। ফেইস বুক ও টুইটার মিলিয়ে ৯ মিলিয়নের ঊর্ধ্বে তাঁর অনুসারী। গত বছর অক্টোবর ১৮ , ২০১৪ তারিখে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে এক সেমিনারে মুসলিম বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতির উপর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বক্তৃতার করেন। বক্তৃতার বিষয়ের শিরোনাম ছিল ইসলাম, গণতন্ত্র এবং আইসিস (Islam, Democracy & ISIS) । তার সুদীর্ঘ আলোচনায় যে সব বিষয়ের আলোকপাত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ছিল আরব বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি এবং আরব বসন্তের সেই গণজাগরণের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তির পর্যালোচনা, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, ইসলামী সভ্যতার ইতিহাস ও পুনর্জাগরণের সম্ভাবনার বিভিন্ন দিক।
ইসলাম ও মুসলিম বিশ্ব নিয়ে যারা আগ্রহী ও গম্ভীরভাবে চিন্তাভাবনা করেন তাঁদের জন্য পুরা ভাষণটি অবশ্যই শুনা খুবই দরকার। আর যারা দৌড়ের উপর আছেন তাদের জন্য কিছু পয়েন্ট তুলে ধরলাম। তবে বিস্তারিত জানতে হলে পুরা বক্তব্য শুনতে হবে সময়ের অভাবে সব পয়েন্ট আমার পক্ষে উল্লেখ করা সম্ভব হয় নাই ।

১) একটি জন গুষ্টি যখন কোন এক অত্যাচারী সমাজ ব্যবস্থার দাসত্বে বা ঔপনিবেশিক শাসনে দীর্ঘদিন নিপীড়িত থাকে তখন স্বভাবতই তাদের মাঝেও শাসক শ্রেণীর প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতি ও জীবন দর্শন গড়ে উঠে। ফলে কলুষিত সমাজের সকল কুপ্রথা ও আচার আচরণে তারাও অভ্যস্ত হয়ে অনেকটা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বিষয়টি ইতিহাসের সাথে সংযোগ করলে দেখা যায় মুসা (আ:) যখন ফেরআউনের দাসত্ব থেকে মুক্তি করতে বনী ইসরাইলদেরকে নিয়ে প্যলেষ্টাইন অভিমুখে রওয়ানা হন তখন পথিমধ্যে মহান আল্লাহর প্রদত্ত একাধিক অলৌকিক ঘটনা চোখের সামনে পর্যবেক্ষণ করা স্বত্বেও বনী ইসরাইলরা নবী মুসা (আ:) এর প্রদত্ত আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে তথা আল্লাহকে ভুলে তাদের পুরানা অভ্যাস মূর্তি পূজায়, পৌত্তলিকতায় বার বার ফিরে যেত যার বর্ণনা আল্লাহ পাক কোরআনে দিয়েছেন। তাই যে কোন জন গুষ্টিতে কোন আদর্শের বিপ্লব সফল করতে হলে সে সমাজে মাঝে পরিস্রাবণ দরকার হয় তথা ফিল্টারিং প্রয়োজন এবং তা তখনই সম্ভব হয় যখন কোন আন্দোলনে বাধা বিপত্তি বা সাময়িক বিপর্যয় আসে। তখন মুনাফিকদেরকে চিনতে সহজ হয়। কেননা সুখের সময় সবাইকে পাওয়া যায় কিন্তু দু:খের সময় কেবল মাত্র নিবেদিত প্রাণ ও সাহসী লোকেরাই অবিচল থাকতে পারে। আর তারাই পারে সফলতার বিজয় ছিনিয়ে আনতে। ইতিহাস তার প্রমাণ। তবে এ জন্য সময়ের প্রয়োজন।

২) মুসলিম বিশ্বের নতুন প্রজন্ম যারা ঔপনিবেশিক প্রভাব বা সে মানসিকতার বাহিরে বড় হয়েছে তাদের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে আরব বসন্তের গণজাগরণ শুরু করা। এ বিপ্লব যুব সমাজের সম্পূর্ণ আভ্যন্তরীণ প্রচেষ্টায় শুরু হয়েছে। এ আন্দোলনের শুরুতে বিদেশী কোন মহলের হাত ছিল বলা ভুল হবে। এ গণজাগরণ অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল। তবে ডিসেম্বর ২০১০ থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় যে গণ বিদ্রোহ ও বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। আসলে আরব বসন্তের গণ বিপ্লবের জন্য আরব বিশ্বের স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার মধ্যে সরকারি দুর্নীতি, স্বৈরতন্ত্র, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বেকারত্ব এবং চরম দারিদ্র্যের অভিযোগের পাশাপাশি বিশাল যুব সমাজের অংশগ্রহণও অনুঘটক রূপে কাজ করেছে । যার সহায়ক ছিল ফেইস বুক এবং টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক মিডিয়া । মাত্র ১৭ দিনে পতন হয় মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের ৩০ বছরের প্রতাপশালী শাসন। আরব বসন্তের গণজাগরণ মুসলিম দেশগুলার স্বৈরাচারী শাসকদের সিংহাসনে কম্পন দেখা দেয়।

ড: তারেকের মতে আরব বসন্তের বিপ্লবকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, এক) পরিপূর্ণ বিপ্লব ( Full revolution), দুই) অর্ধেক বিপ্লব (Half revolution), তিন) এক চতুর্থাংশ বা সিকি বিপ্লব (Quarter revolution)
তিনি বলেন, “লিবিয়ার বিপ্লবকে বলা যায় পরিপূর্ণ বিপ্লব কেননা সেখানে বিপ্লবের পরে এমন কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব রাখা হয়নি যা গাদ্দাফির অনুসারীদের দখলে বা তার গড়া লোকদের কবলে। ফলে লিবিয়ার সকল পাবলিক প্রতিষ্ঠান চলে আসে বিপ্লবীদের অধীনে। অবশ্য সে জন্য এক লাখের বেশী মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং এখনও সংগ্রাম চলছে প্রতিবিপ্লবীদের সঙ্গে । তবে প্রতিবিপ্লবীদের জনসমর্থন নাই এবং তারা সেখানে শক্তিশালী নয়। যদিও বিদেশী কিছু মহল বিশেষ করে তেল সমৃদ্ধ গালফ রাষ্ট্রের (Gulf States) অর্থায়নে চেষ্টা করা হচ্ছে বিমান হামলা চালিয়ে বিপ্লবকে ব্যর্থ করতে।

লিবিয়ার তুলনায় মিশরের বিপ্লব ছিল অর্ধেক বিপ্লব (Half revolution) কেননা সেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে প্রতিবিপ্লবী শক্তির অস্তিত্ব ছিল অটুট। সেনাবাহিনীর পুরা প্রতিষ্ঠান সহ প্রশাসন যন্ত্র হচ্ছে মোবারক আমলের কায়েমি স্বার্থ-বাদীদের আস্তানা। তাই গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসীকে সরিয়ে শীঘ্রই সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়েছে। বৃহত্তর জনতা প্রেসিডেন্ট মুরসির পক্ষে থাকলেও শক্তি দিয়ে প্রতিবিপ্লবীরা আপাতত ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। তবে মিশরের বর্তমান ক্ষমতাসীনরা খুব শান্তিতে নাই। পুরা মিশর এখনও অস্থিরতা ও অশান্তিতে ডুবে আছে। প্রতি নিয়ত বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ, মিছিল আন্দোলন লেগেই আছে যদিও মিডিয়াতে তা প্রকাশ করতে দেয়া হচ্ছে না। মিশরের অর্থনৈতিক অবস্থাও অত্যন্ত খারাপের দিকে দাবিত হচ্ছে।

মিশরের ব্রাদারহুডের ভুল
ড: তারেকের মতে অর্ধেক বিপ্লবের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া মিশরের ব্রাদারহুডের ভুল হয়েছে। তিনি বলেন প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পতনের পর যদিও তিনি মিশরের ব্রাদারহুড নেতৃবৃন্দকে পরামর্শ দিয়েছিলেন সরাসরি ক্ষমতায় না যাওয়ার কৌশল অবলম্বন করতে কিন্তু তাঁরা তা না শুনে ক্ষমতায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তী ইতিহাস অনেকেরই জানা। এদিকে মিশরের সামরিক শক্তির ক্ষমতা দখলের প্রতিবাদ করায় ড: তারেকের এখন সৌদি আরবে প্রবেশ নিষেধ! এমনকি একজন মুসলিম হিসাবে হজ, ওমরা করতে যেতেও ভিসা দেয়া নিষেধ।

ইয়েমেনের বিপ্লব
ড: তারেকের ইয়েমেনের বিপ্লবকে এক চতুর্থাংশ বা সিকি বিপ্লব বলেন কেননা সেখানে প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ সালেহকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলেও তার বিশাল অর্থ ভাণ্ডার নিয়ে মুক্ত ছেড়ে দেয়া হয়। জানা যায় প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ সালেহের টাকার পরিমাণ কয়েক বিলিয়ন ডলার। এত টাকার মালিক হয়ে তার পক্ষে ইয়েমেনের রাজনীতিতে আবার ফিরে আসার চেষ্টা বা ষড়যন্ত্র করাই স্বাভাবিক। যার কৌশল হিসাবে হুতিকে দিয়ে বিদ্রোহ করার হঠকারী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত করা হয়। হুতি বিদ্রোহিরা শিয়া এবং ইরানও তাদেরকে মদদ দিচ্ছে। হুতিরা ইরানের পক্ষের শক্তি হওয়ায় সৌদি আরবের জন্য দেখা দেয় নিরাপত্তার হুমকি। সে জন্য ইদানীং সৌদি আরব ইয়েমেনের উপর বিমান হামলা চালিয়ে হুতির সামরিক আস্তানা ধ্বংস করার চেষ্টা করছে।

সিরিয়ার অবস্থা
ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট বাশার সরকারের বিরোদ্ধে রাজনৈতিক সংস্কারের দাবী নিয়ে সিরিয়ার গণআন্দোলন মিশরের মত শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হলেও প্রেসিডেন্ট বাশারের নির্মম অত্যাচারে সে আন্দোন সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপ নিতি বাধ্য হয়। এবং মাত্র দুই বছরের মধ্যে বিদ্রোহীদের দখলে পুরা সিরিয়ার আসার পর দামেস্কের দিকে যখন বিদ্রোহিরা অগ্রসর হতে শুরু করে এবং প্রেসিডেন্ট বাশারের সরকারে পতন যখন প্রায় অত্যাসন্ন ঠিক সে সময় হঠাৎ ইরান প্রায় ৪০ হাজারের ঊর্ধ্বে সৈন্য পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট বাশারের স্বার্থ রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের সাথে তখন যোগ দেয় লেবাননের হিজবুল্লাহ মিলিশিয়ারাও ফলে অসংখ্য সুন্নি বিদ্রোহিরা প্রাণ হারায় এবং প্রেসিডেন্ট বাশারের সরকার ঠিকে থাকে। আজ পাঁচ বছর ধরে যুদ্ধে প্রায় লাখো লাখো মানুষ প্রাণ হারায়। মিলিয়নের ঊর্ধ্বে মানুষ গৃহহীন হয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র সমুহে মানবত্বর জীবন যাপন করছে। প্রেসিডেন্ট বাশার নিজে আলাওয়ী ধর্মে বিশ্বাসী যাদেরকে ধর্মীয়ভাবে পথ ভ্রষ্ট মনে করে শিয়ারাও অমুসলিম বলে আখ্যায়িত করে। কিন্তু তা স্বত্বেও আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার রাজনীতি ও সিরিয়ার বিদ্রোহিরা সুন্নি হওয়ায় কারণে ইরান বাশারের মত একজন চরম স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষ নেয়! এদিকে ইরাকেও ইরানিরা শিয়া সমর্থিত সরকারের পক্ষে থেকে ইরাকের সুন্নিদের প্রতি বৈষম্য ও অত্যাচার চালিয়ে যেতে সাহায্য করে। যার ফলে আইসিসের মত এক চরমপন্থি তথাকথিত জেহাদি দলের উত্তান ঘটে।
তবে আইসিসের বাড়াবাড়ি, জঙ্গি কার্য্যকলাপ ও উগ্র মানসিকতার বিস্তারিত তথ্য জানা যায় তার ভাষণে। সংক্ষেপে, তিনি বলেন, আইসিসের চরমপন্থি মতাদর্শ ও নির্মম আচরণ কেবল ইসলামের ইতিহাসের বিপথগামী খাওয়ারিজদের সাথে তুলনা করা যায় তাই তাদেরকে সমর্থন করা যায় না। ইসলামের খলিফা হজরত আলি (রা:) যেভাবে এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন ঠিক সেভাবে আজও এধরণের ধরনের উগ্র মানসিকতার সন্ত্রাসীদেরকে যে কোন মূল্যে রুখতে হবে।

পরিশেষে, আধুনিক বিশ্বে মুসলিম লিডারশীপের কি বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার ও কিভাবে তাদের যোগ্যতা বৃদ্ধি করা যায় সে ব্যাপারে চমৎকার কিছু প্রস্তাব রেখেছেন যা অনুসরণ করা উচিত ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি কর্মীকে।

https://www.youtube.com/watch?feature=player_detailpage&v=IlLPIMJ0rZg

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *