অনাবশ্যক সৃষ্টির অনিবার্য বিলুপ্তি

কয়েকদিন আগে গ্রামের বাড়ি এলাকার এক স্বজনের একটি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় করতে পূর্বপরিচিত এক মন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলাম। টেবিলের ওপার আর এপার- তবু তার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। জাঁ পল সার্ত্র ভেতর থেকে কথা কয়ে উঠলেন এভাবে- ‘আমি স্বাধীন; কিন্তু অন্যের দৃষ্টি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার মতো স্বাধীন নই। যে মুহূর্তে কেউ আমার চোখের দিকে তাকায়, লজ্জার সঙ্গে আমি উপলব্ধি করি যে, আমি পরাধীন হয়ে গেছি।’
কথা হচ্ছিল এবারের ১৫ আগস্ট উদযাপনের বিভিন্ন দিক নিয়ে। মন্ত্রী মহোদয় এক পর্যায়ে বললেন, আপনারা জাসদওয়ালারা দেশের অনেক ক্ষতি করেছেন। বললাম, জাসদ যদি দেশের ক্ষতিই করে থাকে, তাহলে তাদের ক্ষমতার পার্টনার করেছেন কেন? বলতে পারেন, এটা তো রবের জাসদ নয়, ইনুর জাসদ। সেক্ষেত্রে বলব, আপনারা রবের জাসদকেও পাশে বসিয়েছিলেন ’৯৬ সালে। দ্বিতীয় কথা, একসময় জাসদ-রাজনীতি করেছি বটে, তবে অতীত নিয়ে আমার কোনো গ্লানি নেই। ও ধিং ধ হধশবফ নড়ু যিবহ ও ধিং নড়ৎহ – এখন তো প্যান্ট-শার্ট পরছি। নিজেকে শোধরাতে পেরেছি কি-না, সেটাই বড় কথা।
নিজেকে শুধরেছি শুনে তিনি বিজয়ীর হাসি হেসে বলেন, বঙ্গবন্ধুর আমলের জাসদ নিয়ে কিছু লেখেন না কেন? বললাম, লিখেছি, সেগুলো আপনি পড়েননি। আপনাদের পড়ার সময় কই? সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখেন ওয়েটিং রুমে শ’খানেক লোক, রাতে ঘরে ফিরেও একই অবস্থা চোখের সামনে। আপনারা তাই পত্রিকার হেডিং পড়েন শুধু। সামান্য ব্যঙ্গ করে বলি, আপনারা আধুনিক মানুষ তো, তা-ই। ক্যামু বলেছিলেন- আধুনিক মানুষ শুধু পত্রিকার হেডিং পড়ে আর রমণ করে। অবশ্য আগের দিন প্রধানমন্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য খালেদাকে যে গালিগালাজ করেছেন, তা ঠিকমতো ছাপা হয়েছে কি-না, সকালে উঠে আগ্রহ নিয়ে সেটাই খোঁজেন পত্রিকার পাতায়। একটা কথা জিজ্ঞেস করি, আপনারা মানে মন্ত্রীরা সেলফ-রিফ্লেক্স করেন কখন? মাঝে মাঝে নিজের দিকে তাকিয়ে ‘আমি কে’, ‘কী আমার অর্জন’, ‘আমার গন্তব্য কোথায়’- এসব প্রশ্নের উত্তর না খুঁজলে জীবনের উৎকর্ষ বাড়ে কি? যাহোক, উঠে আসার সময় মন্ত্রীকে বললাম, আপনি যুগান্তরের পাতা উল্টাতে থাকেন, শিগগিরই জাসদ নিয়ে একটা লেখা পাবেন।
২.
দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় শুরু থেকেই তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একটি অংশ (অপেক্ষাকৃত মেধাবী অংশ) শাসক দল আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর নিরবচ্ছিন্ন বিরোধিতা অব্যাহত রাখে এবং এর একপর্যায়ে ’৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, সংক্ষেপে জাসদের জন্ম দেয়। স্বাধীনতা প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা দেখে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, ছাত্রলীগের সেই অংশটি আগে থেকেই তেতে ছিল এবং অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের। তাদের বঙ্গবন্ধু-বিরোধিতা দেখতে না দেখতে এমন এক রূপ ধারণ করেছিল, যা শুধু অগণতান্ত্রিকই নয়, অশ্লীলও বটে। জাসদ সৃষ্টির আগেই পল্টন ময়দানে আসম রব (তিনি জাসদের প্রথম সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন) যেসব বক্তৃতা করেছিলেন, সেগুলোর অংশ বিশেষ দেখুন। ‘বঙ্গবন্ধ’ উপাধি প্রত্যাহার করে তিনি তাকে উদ্দেশ করে বলছেন, ‘শেখ মুজিব, বাচ্চা দিয়েছিস, দুধ দিবি না? তোর বাণ টেনে ছিঁঁড়ে দুধ বের করব।’ যাহোক, ছাত্রলীগের বিদ্রোহী অংশটি এবং তাদের মেন্টর সিরাজুল আলম খান, মার্শাল মনি, কাজী আরেফ প্রমুখ যে বঙ্গবন্ধুকে কোনো সময় না দিয়ে স্বাধীনতার পরপরই তার বিরোধিতা শুরু করলেন, তা নিশ্চয়ই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের ফল নয়। ব্যাপারটা এমন নয় যে, দেশ তো স্বাধীন হল, এখন কী করা? ঠিক আছে, চলো এবার আওয়ামী লীগ হঠাই। আসলে সিদ্ধান্তটি অনেক আগের অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অথবা তারও আগের। ষাট দশকের মধ্যভাগে উপরের ব্যক্তিবর্গ একটি নিউক্লিয়াস গঠন করেছিলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের এ অঞ্চলে একসময় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। সে আরেকটি বড় অধ্যায়। আমরা আজ সেদিকে যাব না।
প্রথমেই বলে নেয়া ভালো, ছাত্রলীগের তরুণ নেতৃত্ব ও তাদের মেন্টরদের দ্বারা জাসদ গঠন সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেনি। না, এটা এ কারণে নয় যে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মপ্রিয় বলে তারা ধর্মবিরোধী কমিউনিস্ট আদর্শকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। মূলত দুটি কারণে সাধারণ মানুষ জাসদকে তার জন্মলগ্নেই পছন্দ করেনি। এক. তারা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের এত দ্রুত বিরোধিতা আশা করেনি। বঙ্গবন্ধুকে তারা আরও সময় দিতে চেয়েছিল। তারা যে বঙ্গবন্ধুকে আরও সময় দিতে চেয়েছে, তার বড় প্রমাণ ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাসদ ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র দুটিতে জয়ী হতে পেরেছিল আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল সম্ভবত ২৯৩টি আসন। দুই. জাসদের তরুণ নেতৃত্বকে মানুষ গ্রহণ করতে পারেনি। তারা ভেবেছে, তারুণ্য যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয়, রাজনীতির জন্য নয়। তাই সঙ্গত কারণেই তারা আশা করেছিল, যুদ্ধজয়ের পর দেশের ছাত্র ও তরুণ সমাজ অস্ত্র জমা দিয়ে যার যার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে। ঔপনিবেশিক শক্তিই যেখানে আর নেই, সেখানে তারুণ্য-শক্তির কী এমন প্রয়োজন। বিরোধী দলের ভূমিকার জন্য? সেটা পূরণের জন্য তো ভাসানী, মোজাফফর, মনি সিংরা রয়েছেনই। বাংলাদেশের মানুষের এটা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাই বলব, তারা অন্যের বিবেচনাশক্তিকে তার বয়সের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে। এদেশে যে যত বয়সী, সে তত জ্ঞানী। আশ্চর্যই বলতে হয়, এদেশের নির্বাচনে চলৎশক্তিহীন আড়ষ্ট বৃদ্ধটিও ভোট পায়, কর্মোদ্যমী ও বেশি অবদান রাখতে সক্ষম যুবক অথবা মধ্যবয়সীরা খুব কম ক্ষেত্রেই নির্বাচিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ আমরা দেখছি, জাসদ তার প্রথম পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এ তো গেল সাধারণ মানুষের কাছে নবগঠিত জাসদের ভাবমূর্তি। জাসদ সমাজের সচেতন অংশের কাছেও গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা মনে করেনি যে, জাসদ এই রাষ্ট্রে মার্কসীয় দর্শন প্রয়োগ করতে সক্ষম একটি দল। বস্তুত, জাসদ রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে মার্কসবাদকে গ্রহণ করেছিল, তবে দলটির নেতৃত্ব এই মতবাদকে আত্মস্থ করতে পারেননি। ষাট ও সত্তর দশকে মার্কসীয় দর্শন ছিল দুনিয়াজুড়ে বিশেষত যুবশ্রেণীর মধ্যে এক অসম্ভব জনপ্রিয় মতবাদ। এটা একটা রাজনৈতিক ফ্যাশনও ছিল বটে। আই অ্যাম অ্যা মার্কসিস্ট- এমন একটি আপ্তবাক্য চালু ছিল তখন ব্যাপক যুবসমাজের মধ্যে। জাসদ নেতৃত্ব মার্কসীয় দর্শনকে না বুঝেই এর চমৎকারিত্বের জন্য একে বেছে নিয়েছিল এই ভেবে যে, তাতে দেশের তরুণ-যুবসমাজকে সহজেই বশে আনা যাবে। মার্কস ও লেনিনের মতবাদের যে বিশালত্ব, তার ধারেকাছেই যেতে পারেননি তারা। এখান থেকে-সেখান থেকে কিছু উদ্ধৃতি তুলে নিয়ে তা যত্রতত্র ব্যবহার করাই ছিল তাদের মার্কসীয় জ্ঞানের দৌড়। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা সহজ হবে। ১৯৭৩ সালে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের সম্মেলনে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আফম মাহবুবুল হক তার বার্ষিক যে রিপোর্ট পাঠ করেছিলেন, তার শুরুর লাইনটি ছিল লেনিনের একটি কথার উদ্ধৃতি- Red flag to oppose red flag- অর্থাৎ লাল পতাকাকে প্রতিরোধ করার জন্য লাল পতাকা। পাঠক লক্ষ করুন, কী অসম্ভব এক মূর্খতা লুকিয়ে আছে এই উদ্ধৃতি ব্যবহারের মধ্যে। সালটা ১৯৭৩। জাসদ তাহলে কাকে লাল পতাকা দেখাচ্ছিল? অথবা জাসদকে দেখাচ্ছিল কে? বঙ্গবন্ধু কিংবা আওয়ামী লীগ তো লাল পতাকাধারী নেতা বা সংগঠন ছিল না। অর্থাৎ এক্ষেত্রে প্রশ্নটি অবান্তর। হ্যাঁ, তখন লাল পতাকাধারী ছিল ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি, ইপিসিপিসহ (ইস্ট পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি) কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড মার্কসবাদী দল। জাসদ কি তাদের লাল পতাকা দেখাচ্ছিল অথবা তারা জাসদকে? তাহলে তখন রাষ্ট্রের প্রধান দ্বন্দ্ব ছিল- জাসদ বনাম ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি? সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ আর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এত টানাটানি হচ্ছিল কেন? মার্কসবাদ তো হোমিওপ্যাথি নয় যে, হঠাৎ বাড়ে হঠাৎ কমে বললেই বেলাডোনা প্রেসক্রাইব করব! লেনিন কী প্রসঙ্গে কথাটি বলেছিলেন, তা খেয়াল না করে একটা চটকদার কথা পেলাম যখন, সেটাকে ব্যবহার করে কর্মীদের মুগ্ধ করার চেষ্টার নাম মার্কসবাদ?
জাসদ নেতৃত্ব সম্ভবত দল গঠনের পরপরই তাদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দুর্বলতাগুলো টের পেয়েছিলেন। আর তাই ঘাটতি মেটানোর লক্ষ্যে তারা দুটি বাজে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। এর একটি- সিরাজুল আলম খানকে প্রচার-প্রাপাগান্ডার মাধ্যমে লিজেন্ডারি ফিগার বা কিংবদন্তি হিসেবে জাতির কাছে উপস্থাপন করা। অপরটি, গণকণ্ঠ নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করে জাসদের পক্ষে সেনসেশনাল জার্নালিজম চালু করা। সিরাজুল আলম খান সম্পর্কে পরিকল্পিত উপায়ে যেসব মিথ ছড়ানো হয়েছিল, সেগুলো ছিল বিচিত্র। তিনি অর্থাৎ দাদা কর্মী সম্প্রদায় ও জনগণের কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন বলে মিথগুলো যাচাই করারও তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। কী না ছড়ানো হয়েছে তার সম্পর্কে! তিনি সাত দিন না ঘুমিয়ে, এমনকি না খেয়ে থাকতে পারেন। ৭ মার্চের ভাষণ তিনিই লিখে দিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু তার কথার বাইরে এক পা-ও ফেলতেন না, ভারতের প্ল্যানিং কমিশন প্রধান পিএন হাকছারকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় টেবিল-টকে আউট করেছিলেন, ভারতের জেনারেল ওবান তার সম্পর্কে অসাধারণ সব মন্তব্য করেছিলেন- এমন অসংখ্য মিথ সৃষ্টি করে তাকে অতিমানবের স্তরে তোলা হয়েছিল। জাসদের সাধারণ কর্মীদের তখন একটা বড় স্বপ্ন ছিল- দাদাভাইয়ের মুখটা একটু দর্শন করা। কিন্তু বিপুলাকার কর্মী সম্প্রদায়ের অতি সামান্য সংখ্যকের ভাগ্যে জুটেছিল সেই সুযোগ। সাধারণ মানুষের মধ্যেও সিরাজুল আলম খানের রহস্যময়তা নিয়ে যথেষ্ট কৌতূহল ছিল এবং তিনি এখন রাজনীতিতে জীবন্মত অবস্থায় থাকলেও তার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কৌতূহল এখনও আগের মতোই রয়েছে বলে অনুমান করি। বস্তুত পর্দার আড়ালের শ্মশ্র“মণ্ডিত এই ব্যক্তিটি এদেশের রাজনীতিতে এক ধরনের পীরতন্ত্র চালু করতে চেয়েছিলেন এবং কোনো কোনো ধর্মীয় পীরের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়, ভণ্ডামি বেশি দিন গোপন রাখতে পারেননি। আমি মাঝে মাঝে বিস্মিত হই এই ভেবে যে, এই লোকটি এতটা সম্মোহনী শক্তির অধিকারী হয়েছিলেন কিভাবে? তার না আছে লেখাপড়া, না সহজাত বিচক্ষণতা। দুষ্টুবুদ্ধি মানুষকে এতটা উপরে তুলতে পারে?
সেনসেশনাল জার্নালিজম বলি আর ইয়েলো জার্নালিজম কিংবা প্যারা-জার্নালিজম যাই বলি, বাংলাদেশে এর শুরুটা করেছিল গণকণ্ঠ এবং হক কথা। জাতে ওঠার জন্য একসময় কবি আল মাহমুদকে গণকণ্ঠের সম্পাদকও বানানো হয়েছিল। বেচারা! শেষ পর্যন্ত জেলে গেলেন এবং জেল থেকে মুক্তি পেয়ে নিজ কৃতকর্মের অনুশোচনামূলক দীর্ঘ এক কবিতাও লিখেছিলেন। জাসদ-রাজনীতিকে বেগবান করতে গণকণ্ঠের সে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা! পত্রিকাটির তখনকার অপসাংবাদিকতার একটা নমুনা দেয়া যেতে পারে। একসময় সেখানে লেখা শুরু হল, রক্ষীবাহিনীর হাতে হাজার হাজার জাসদ কর্মী নিহত হয়েছে। এ ধরনের সংবাদ পড়ার পর আমি একটু হিসাব মেলানোর চেষ্টা করলাম। নাম আর খুঁজে পাই না। নিহতদের মধ্যে সিদ্দিক মাস্টার, নরসিংদীর মুকুল, খুলনা বেল্টের নান্টু, রংপুরের মোস্তফা, জব্বার, ’৭৪-এর ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওয়ের কর্মসূচি পালনের সময় বরিশালের ছাত্রনেতা জাফর ও তার সঙ্গে হয়তো আরও দু’একজন- এ ছাড়া আমি আর কারও খোঁজ পাই না। বাংলাদেশ ছোট দেশ বলে কোনো রাজনৈতিক কর্মী নিহত হলে তার খবর অবশ্যই জানা যাবে। তবে হ্যাঁ, আমার জানার বাইরেও কেউ কেউ নিহত হয়ে থাকতে পারেন; কিন্তু সেই সংখ্যা কোনোভাবেই হাজার হাজার নয়। আরও কথা আছে, নিহতদের সবাই আবার রক্ষীবাহিনীর হাতে প্রাণ হারাননি। ’৭২-’৭৫ সালে জাসদের কর্মীবাহিনী প্রতিদিন সকালে একবার করে উত্তেজিত হতো গণকণ্ঠ পড়ে আর স্বপ্ন দেখত রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের। বস্তুত, গণকণ্ঠ পত্রিকাটি তখন একটি সংবাদপত্র না হয়ে জাসদের লিফলেটে পরিণত হয়েছিল।
জাসদ তার জন্মলগ্নে থিম স্লোগান ঠিক করেছিল- আমরা লড়ছি শ্রেণী সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। তাদের এই স্লে­াগান সাধারণ মানুষের কাছে এতই খেলো হয়ে পড়ে যে, তারা জাসদ কর্মীদের ঠাট্টা করে বলত- ‘কী বৈজ্ঞানিক, কেমন আছো?’ মার্কস-লেনিন নির্দেশিত পথে বিপ্লবের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী একটি বিপ্লবী পার্টি। জাসদ নেতৃত্ব সেটা গড়ে তোলার চেষ্টা না করে যেনতেন উপায়ে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাতের নেশায় মেতে উঠছিলেন। চরিত্রের দিক থেকে অতি নিুমানের পেটি-বুর্জোয়া এই নেতৃত্ব এক দুর্বোধ্য আকাক্সক্ষায় আচ্ছন্ন হয়ে একের পর এক যেসব কর্মসূচি দিতে থাকলেন, দেশের অবজেকটিভ কন্ডিশন সেগুলোর সঙ্গে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। সত্য কথা, ’৭৪ সালের শুরু থেকে সাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রতি আস্থা হারাতে শুরু করে, কিন্তু জাসদকে তারা কখনোই বিকল্প শক্তি হিসেবে চিন্তা করেনি। জাসদকে তারা কিছু ক্রুদ্ধ, সাহসী যুবকের সমাহার ছাড়া অতিরিক্ত কিছু ভাবতে পারেনি। হ্যাঁ, জাসদ একটা আদর্শের জন্য লড়ছে এমন একটা ভাবনা ছিল মানুষের, কিন্তু সেই আদর্শ তাদের কাছে মনে হতো এক ধরনের প্রহেলিকা, যার আগামাথা তারা কিছুই বুঝত না। বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতি অসন্তুষ্টরা পল্টনে জাসদের জনসভায় যেত বটে, তবে তারা বাড়ি ফিরত আসম রব ও শ্রমিক জোটের সভাপতি মোহাম্মদ শাজাহানের গালাগাল শুনে। এমন এক পরিস্থিতিতে ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ জাসদ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাড়ি ঘেরাওয়ের কর্মসূচি পালন করে। সাধারণ মানুষের সমর্থনবর্জিত এ কর্মসূচিটি ছিল এক বড় রাজনৈতিক অ্যাডভেঞ্চার, চমক সৃষ্টিই ছিল যার একমাত্র উদ্দেশ্য। ওই কর্মসূচি চলাকালে মেজর জলিল, আসম রবসহ বেশকিছু জাসদ নেতৃত্ব গ্রেফতার হন। গুলিতে নিহত হন একাধিক জাসদকর্মী। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে তার স্নেহভাজন নেতৃত্বের প্রতি এত বড় আঘাত আসতে পারে, জাসদ নেতারা সম্ভবত তা ভাবতেও পারেননি। এতদিন তারা বঙ্গবন্ধুর উদারতার সুযোগ নিয়েছিলেন, এখন কী করবেন? জাসদের একটা বড় অংশকে পাঠিয়ে দেয়া হল আন্ডারগ্রাউন্ডে। তত্ত্ব জাহির হল, আন্দোলনের গণতান্ত্রিক ধারার ছেদ ঘটিয়ে বিপ্লবী ধারার সূচনা করতে হবে। তৈরি হল গণবাহিনী। বলাবাহুল্য, জাসদের নৈরাজ্যজনক রাজনীতির মাত্রা ও পরিমাণ বাড়ল তাতে। বিপদ বাড়ল বঙ্গবন্ধু সরকারের। এ সময় বগুড়ার এবিএম শাজাহানের মতো আঞ্চলিক পর্যায়ে বেশকিছু নেতা সম্পূর্ণরূপে বিপ্লবী (!) চরিত্র ধারণ করে অস্ত্রের খেলা শুরু করলেন। চাঁদা দিতে অক্ষম অথবা অনিচ্ছুককে শ্রেণীশত্র“ আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হল। একদিকে পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি, অন্যদিকে জাসদের গণবাহিনীর চরম নৈরাজ্য বঙ্গবন্ধুর সরকারকে অতিষ্ঠ করে তুলল। এই নৈরাজ্যই ’৭৫-এর জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের পটভূমি।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে অনেকে বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করে কিছুদিনের জন্য হলেও দেশ পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছিলেন। গণতন্ত্রের পক্ষে আজন্ম সংগ্রামী তিনি তাদের কথা শোনেননি, দেশে গণতান্ত্রিক ধারাই চালু করেছিলেন। অথচ তার শুভ চেতনার মূল্য দেয়নি জাসদ। চালু করেছিল অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক, অস্ত্রের রাজনীতি। সদ্য স্বাধীন দেশে সুস্থ ধারার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা গেলে আমরা হয়তো আরও অন্তত ৩০ বছর বঙ্গবন্ধুকে আমাদের সঙ্গে ধরে রাখতে পারতাম।
বঙ্গবন্ধু হত্যা ও ’৮০ সালে জাসদ ভেঙে যাওয়ার মধ্যবর্তী সময়টি ছিল জাসদের হঠকারিতার দ্বিতীয় অধ্যায়। সেটা আরেকদিন হবে। সেই লেখায় কর্নেল আবু তাহেরকে নিয়ে সম্প্রতি সে বিতর্ক উঠেছে, তা নিরসনেরও চেষ্টা করব। তবে কথা শেষই হতে চায় না। জাসদের জন্ম কোনো ঐতিহাসিক প্রয়োজনে হয়নি। তাই স্বাভাবিক নিয়মেই ’৮০ সাল থেকে জীববিজ্ঞানের মাইটোসিস প্রক্রিয়ার কোষ-বিভাজনের মতো জাসদের ভাঙন প্রক্রিয়া শুরু হয়। হাইকমান্ডের যারা সিঙ্গল অথরিটি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তারা নিজ অনুসারীদের নিয়ে উপদল তৈরি করে একের পর এক ভেঙেছেন দল। অজুহাত দিয়েছেন আদর্শগত অনৈক্যের। এই ভাঙন প্রক্রিয়া এমন রূপ পরিগ্রহ করেছিল যে, পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির একটি দেয়াল লিখনের কথা মনে পড়ে। ’৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের দেয়ালে পড়েছিলাম- পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির রানা-হায়দার গ্র“পের অবশিষ্টাংশের চক্রান্ত থেকে সাবধান। লক্ষ করুন, পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি, তার রানা-হায়দার গ্র“প, তারও অবশিষ্টাংশ, তার আবার চক্রান্ত! সেই চক্রান্ত থেকে আবার সাবধান থাকতে বলা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকেই যারা সমগ্র বাংলাদেশ ভাবেন, তাদের পক্ষেই এতটা নাদান হওয়া সম্ভব। যাহোক, জাসদের ভাঙন প্রক্রিয়ার সময় এক নেতাকে বলেছিলাম- আপনারা তাহলে মার্কসীয় নয়, নিউক্লিয়ার থিওরি অফ রেভ্যুলুশন চর্চা করছেন? ম্যাটারকে যত ভাঙা যাবে ততই শক্তিশালী হবে? জাসদের সৃষ্টি ঐতিহাসিক প্রয়োজনে না হলেও এর বিলুপ্তি এখন এক বড় ঐতিহাসিক প্রয়োজন। ইতিমধ্যেই কিছু ভগ্নাংশ বিলুপ্ত হয়েছে, অন্য দলে বিলীন হওয়া যদি বিলুপ্তি হয়ে থাকে, তাহলে ইনু ভাইয়ের জাসদও বিলুপ্ত হয়েছে। বাকিগুলোর পরিণতি দেখার অপেক্ষায় রয়েছি আমরা।
পুনশ্চ : একটা প্রাক্টিক্যাল জোকস। জাসদের আর্মস ব্যান্ড গণবাহিনী গঠনের তাত্ত্বিক ভিত্তিটি ছিল খুবই ফানি। জাসদ নেতৃত্ব লেনিনের ‘কালেকটেড ওয়ার্কস’ ঘেঁটে দেখলেন, সেই সময় বাংলাদেশের অবজেকটিভ কনডিশন যা, তাতে একটি militant force গড়ে তুলতে হবে। militant শব্দের অর্থ মেজাজে সামরিক, কিন্তু সশস্ত্র নয়। জাসদ নেতৃত্ব militant ও military শব্দদ্বয়ের পার্থক্য না বুঝে ভুল অনুবাদে militant-এর অর্থ করলেন সামরিক। ব্যস, গঠন করে ফেললেন সশস্ত্র গণবাহিনী। হা ঈশ্বর! পাঠক, অনুবাদক সম্পর্কে কিছু না জেনে ভিন্ন ভাষার বাংলা অনুবাদ পড়বেন না।

সুত্র: যুগান্তর বাতায়ন। ২৬ আগষ্ট ২০১৪ মঙ্গলবার

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *