কিশোর রিকশাওয়ালা

সুন্দর মিয়া বহুদিন যাবত কঠিন রোগে ভুগছেন। ঠিকমত রিকশার প্যাডেলে পা দিতে পারেন না তিনি। থাকেন ফুলপুর বস্তিতে, এক ভাঙ্গা ঘরে। বৃষ্টি হলে দরদর করে পানি পড়ে। চৌকিখানি ভিজে একাকার হয়ে যায়। এমনই এক বৃষ্টির রাতে মাটিতে শুয়ে রাত কাটাতে হয় রাজুর পরিবারের সবাইকে। রাজু হল সুন্দর মিয়ার একমাত্র ছেলে। সে পড়ে ক্লাস টেনে, পাশেরই এক সরকারি স্কুলে। ক্লাসে রোল এক। খুবই মেধাবী ছাত্র সে। তবে তারা খুবই গরীব। ঘরে বাবা অসুস্থ, খাবারের জোগারও নেই। তাই অনেক কষ্টে তাদের দিন অতিবাহিত হচ্ছে।

রাজু এবছর এসএসসি পরিক্ষা দিবে। নতুন গাইড বই কিনতে না পেয়ে গতবছর এসএসসি পরিক্ষা দিয়েছে এমন একজনের কাছ থেকে একখানা পুরনো গাইড ও কিছু নোট সংগ্রহ করে সে। স্কুলের হেডমাস্টার রফিক সাহেব খুবই ভাল মানুষ। তিনি রাজুকে বিনা ফি’তে প্রাইভেট পড়ান। কিন্তু মুশকিল হল যে, রাজু ঠিকমত স্কুলে হাজির হতে পারে না। সপ্তাহে মাত্র চারদিন স্কুলে যায় সে। বাকি তিনদিন বাবার রিকশাটা চালায়। রিকশা চালানোর সামান্য উপার্জন থেকে নিজের খাতা-কলম কেনাসহ পরিবারের খরচ চালানোর চেষ্টা করে। রাজু খুবই ভদ্র, শান্ত, লাজুকপ্রকৃতির ছেলে। পাড়ার লোকের এজন্য আদর করে তাকে। অনেকে তার পরিশ্রমের প্রশংসা করে। এসএসসি পরিক্ষার আর মাত্র ৭দিন বাকি। পরিক্ষার ফিস দেয়ার জন্য কিছু টাকা জমা করে রেখেছিল রাজু। কিন্তু এর মধ্যে রাজুর বাবা একদিন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয় তাকে। যার কারণে জমানো ফিসের প্রায় পুরোটাই খরচ হয়ে যায় রাজুর। পরশু পরিক্ষা, অথচ ফিস দেয়ার টাকা নেই। মাথায় বাজ পড়ে রাজুর। অনেক কান্নাকাটি করল সে। হেডমাস্টার সবকিছু জানতে পারলেন। তিনি বললেন, “তোমার ফিসের টাকাটা আমি দিয়ে দেব, তুমি কোন চিন্তা করোনা”। তারপর আবার বললেন, বিপদে কাঁদতে নেই, বরং সবসময় আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া উচিত।

আজ এসএসসি পরিক্ষা, সবার কাছে দোয়া চেয়ে পরিক্ষা দিতে যায় রাজু। খুব ভাল পরিক্ষা দেয় সে। তাই হল থেকে বেরিয়ে খুশিমনে বাড়ি যাচ্ছিল রাজু। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ভাল কলেজে পড়ার ইচ্ছা তার। বড় হয়ে ডাক্তার হতে চায় রাজু, তার ইচ্ছা, গরীব-দু:খী যারা টাকার অভাবে চিকিৎসা পায়না তাদের সেবা করবে। দেখতে দেখতে পরিক্ষা শেষ হয়। রিকশাটা বিক্রি করে দিয়ে বাবার জন্য নতুন জামা-কাপড়, ছোট-বোনের জন্য খেলনা কেনে রাজু। নিজের জন্য কেনে কিছু বই। এর মধ্যেই এসএসসির রেজাল্ট দেয়ার সময় হয়ে যায়। সেদিন সকালে রাজুর বাবা আবারও ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরদিন রেজাল্ট, রাজু ও তার শিক্ষকদের আশা সে খুব ভাল ফল করবে। নিয়তির নির্মম পরিহাস, রেজাল্ট দেয়ার আগে রাতেই মারা যান রাজুর বাবা। বাবা তার মেধাবী ছেলের ফল দেখে যেতে পারলেন না। খুব ভেঙ্গে পড়ে রাজু। তার মা নেই, বাবাও মারা গেছেন, সংসারের হাল এখন তাকেই ধরতে হবে, বোনটার দেখা-শোনা করতে হবে। বড় কওে বিয়ে দিতে হবে। কলেজে পড়ার জন্য নিজের কেনা বইগুলো সেদিনই বিক্রি করে দেয় সে। ছোটবোনকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে রওনা হয় রাজু, নদী পথে যাওয়ার সময় রাতে প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়। ঝড়ের তান্ডবে ডুবে যায় লঞ্চটি। লঞ্চের সাথে তলিয়ে যায় রাজু ও তার বোন। পরদিন রেজাল্ট বের হয়, জেলার মধ্যে প্রথম হয় রাজু! কেউ জানতে পারল না, রাজু এখন কোথায়। লঞ্চডুবির পর উদ্ধারকাজে রাজুর সেই ছোট বোনটিকে অচেতন অবস্থায় নদীর পাড়ে খুজে পাওয়া যায়, কিন্তু রাজুকে আর কোথাও খুজে পাওয়া যায়নি।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *