জামায়াতের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের তিন নেতা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, কর্মপরিষদ সদস্য ও সাবেক এমপি ড. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এবং অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান গত ৭ জুলাই রোববার সন্ধ্যায় ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের চায়ের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন। একই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীও সে চায়ের মজলিসে আমন্ত্রিত ছিলেন। স্বভাবতই এই চায়ের আসর নিয়ে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। বলাবলি হচ্ছে, জামায়াতের সঙ্গে নতুন একটা আঁতাত করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। সেসব জল্পনা আরও গভীর হয়েছে এ কারণে যে পরের দিন সাবেক সামরিক ডিক্টেটর এবং বর্তমানে জাতীয় পার্টির মূল অংশের নেতা লে জে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নৈশভোজে আপ্যায়িত করেছেন ওই মার্কিন কূটনীতিক। কূটনীতিকরা স্বাগতিক দেশের রাজনীতিক থেকে শুরু করে সে সমাজের বহু স্তরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। এটা প্রচলিত এবং স্বীকৃত রীতি। রাজনীতিকরাও নিজেদের নীতি ও কর্মপন্থা সম্বন্ধে কূটনীতিকদের অবহিত করতে চান। এটাও স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হচ্ছে এ দুটো মজলিস হয়েছে এমন সময় যখন বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্কট এবং আসন্ন সাধারণ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় আছে এবং প্রশ্ন উঠেছে, আমেরিকা কি বিএনপিকে পাশ কাটিয়ে সাধারণ নির্বাচন করার প্রস্তুতি হিসেবে জামায়াতকে ১৮ দলীয় জোট থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে? আরও কিছু কারণ ঘটেছে এই শিশু রাষ্ট্রটির স্বল্পদৈর্ঘ্য ইতিহাসে। সাত বছর আগে তত্কালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে উত্খাত করার জন্যে লাগাতার সন্ত্রাসী আন্দোলন সৃষ্টি করে, যদিও সে পদ্ধতি চালু হয়েছিল ১৯৯৫-৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের সম্মিলিত আন্দোলনের জের ধরে। ২০০৬ সালের আন্দোলনের পরিকল্পনা অনেক আগেই করা হয়েছিল কিনা বলা কঠিন। কিন্তু তার কয়েক মাস আগে থেকেই ভারতের হাইকমিশনার বীণা সিক্রি এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টম্যাস অস্বাভাবিক এবং সন্দেহজনক রকমভাবে ঘন ঘন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা ওয়াজেদের সঙ্গে বৈঠক এবং শলাপরামর্শ করছিলেন। বীণা সিক্রি এত ঘন ঘন সুধা সদনে যাতায়াত করছিলেন যে তিনি সে ভবনটির ভাড়াটে বলে ভুল হতে পারত। এই দুই রাষ্ট্রদূত, ঢাকার প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান ও ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনাম এবং তত্কালীন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের যোগসাজশে এমন একটা জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলেন যে বাংলাদেশের রাজনীতি এখনও তিক্ততা ও ১৯ এপ্রিল প্রতিহিংসার বিষবাষ্পে ভারী হয়ে আছে। শেখ হাসিনা সে ষড়যন্ত্রকে তার ‘আন্দোলনের ফল’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বর্তমান সঙ্কট ও অনিশ্চয়তার কারণগুলো তখনই সৃষ্টি হয়েছিল। ওই দুই দেশের রাষ্ট্রদূতরা কোনো বাংলাদেশী রাজনীতিকের সঙ্গে সাক্ষাত্ করলে সে কারণেই অনেকের বুকে আতঙ্ক হয়। সুবিধাবাদী সেকুলারিজম দ্বিতীয় কারণটি হলো আওয়ামী লীগ সব সময় সেকুলার রাজনীতির কথা বলে। কিন্তু শেখ হাসিনা প্রায়ই কোনো না কোনোভাবে ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনে ব্যবহার করেছেন। সব সময়ই তিনি সংখ্যালঘু হিন্দুদের ভোট ধরে রাখার জন্যে তাদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন। তা সত্ত্বেও সাময়িক রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে ধর্মভিত্তিক মুসলিম দলগুলোর সঙ্গে জোট বাঁধতে আওয়ামী লীগ কার্পণ্য করেনি। লে. জে. এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানকে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা স্বাগত করেছিলেন। বিশ্বের চোখে বৈধতা পাওয়ার লক্ষ্যে এরশাদ ১৯৮৬ সালের ৬ মে সংসদ নির্বাচন দেন। বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতসহ সব রাজনৈতিক দল ১৯ এপ্রিল এক যৌথ বৈঠকে সে নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। কিন্তু দু’দিন পরে হঠাত্ করে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত ঘোষণা করে, তারা সে নির্বাচনে অংশ নেবে। তখন জানা গিয়েছিল যে শেখ হাসিনার প্ররোচনাতেই জামায়াত ঐকমত্য থেকে সরে এসেছিল। ১৯৯৫-৯৬ সালে যখন খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকারকে পরাজিত করা সম্ভব মনে হচ্ছিল না, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি চালু করার দাবিতে জামায়াতের সঙ্গে জোট বেঁধে আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ। তেমনি ২০০৬ সালে সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে মহাজোট গঠনের লক্ষ্যে খেলাফত মজলিসের সঙ্গেও সমঝোতা চুক্তি করেছিল আওয়ামী লীগ। অবশ্যি লক্ষণীয়, নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার পর শেখ হাসিনার ইসলাম-প্রীতি ছুটে যায়। ১৯৯৬ সালে জামায়াত-আওয়ামী লীগের ধ্বংসাত্মক আন্দোলনে দেশ অচল হয়ে গেলে খালেদা জিয়ার সরকার সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালু করে। সে বছরের জুন মাসে সে পদ্ধতির অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংসদে একক গরিষ্ঠতা পেলেও নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পায়নি। জামায়াতের এমপিদের সমর্থনে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। সংরক্ষিত আসনগুলো মহিলা সংসদ সদস্যদের সমর্থন লাভের পর আর জামায়াতের প্রয়োজন রইল না। শেখ হাসিনা তখন আবারও জামায়াতবিরোধী হয়ে ওঠেন, তার সেকুলারিজম-প্রীতি আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বহু প্রশ্নের ভিড় অনেকগুলো প্রশ্ন ভিড় করে দেখা দিচ্ছে মার্কিন কূটনীতিকের বাসায় শেখ হাসিনার বিতর্কিত উপদেষ্টার সঙ্গে সঙ্কটাপন্ন জামায়াতের তিন শীর্ষ নেতার চা-পান প্রসঙ্গে। আমেরিকা কি আরও একবার বাংলাদেশে রাজনৈতিক এঞ্জিনিয়ারিংয়ের চেষ্টা চালাচ্ছে? অন্য রাষ্ট্রের রাজনীতিকে নিজেদের স্বার্থের উপযোগী করে ঢেলে সাজানো মার্কিন কূটনীতি এবং তাদের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ের পুরনো বদ অভ্যেস। গোয়েন্দাগিরি আর কূটনীতির ব্যবধান এখানে স্পষ্ট নয়। কূটনীতির ছদ্মাবরণে সিআইয়ের তত্পরতা এখন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে স্বাধীনতার উদ্গাতা এবং গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক বলে দাবি করে। কিন্তু অন্য দেশে রাজনৈতিক এঞ্জিনিয়ারিং করার সময় সে কথা তার মনে থাকে না। সুতরাং উপরোক্ত চায়ের মজলিস অবশ্যই সন্দেহের উদ্রেক করতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ কিংবা সে দলের নেত্রীকে কি ওয়াশিংটন নিজেদের স্বার্থের অনুকূল বিবেচনা করে? এটা এখন সর্বজনস্বীকৃত যে ইন্দো-মার্কিন চক্রান্তের ফলেই ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছিল এবং শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু গদি পাওয়ার পর থেকে বর্তমান সরকার, বিশেষ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আপাত দৃষ্টিতে বারবার মার্কিন সরকারকে অপমানই করেছেন। নোবেল শান্তি পুরস্কারবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অপমান বন্ধ করা এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকে হস্তক্ষেপ না করার জন্যে মার্কিন প্রশাসন দফায় দফায় শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেছে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এ ব্যাপারে কয়েক দফায় শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করেছেন, স্বয়ং ঢাকাতেও এসেছিলেন। হাসিনা সেসব অনুরোধ-উপরোধে কর্ণপাত করেননি। হিলারি এখনও মার্কিন প্রশাসনে সম্মানিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। ২০১৬ সালের তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন বলে আশা করা যায়। সুতরাং অতীতের অপমানগুলোর কথা ওয়াশিংটন ভুলে গেছে মনে করা যায় না। গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে সরকারের ব্যর্থতা, এ শিল্পের শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠনের অধিকার দান এবং সাধারণভাবেই গার্মেন্ট শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ ও শর্ত উন্নত করার জন্য মার্কিন সরকারের অনুরোধ শেখ হাসিনার সরকার উপেক্ষা করে চলেছে। জনৈক মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী দর্শন দান করেননি, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে প্রায় চার মাস ধরে অপেক্ষা করছেন। সম্প্রতি আবার যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীনের পরিবর্তে রাশিয়া থেকে সমরাস্ত্র এবং বেলারুশ থেকে সমরোপকরণ ক্রয় করে শেখ হাসিনা প্রকারান্তরে ওয়াশিংটনের প্রতি বিদ্রূপই করেছেন। এসব ব্যাপার থেকে মনে করা স্বাভাবিক হবে যে শেখ হাসিনা গদিচ্যুত হলেই বরং ওয়াশিংটনের হাড় জুড়ায়। রাজনৈতিক প্রয়োজন এবং মান-মর্যাদা কিন্তু কূটনীতিতে বৃহত্তর স্বার্থের প্রয়োজনে ক্ষুদ্রতর বিবেচনাগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াই নিয়ম। মার্কিন কূটনীতির বৃহত্তর স্বার্থ বর্তমানে এশিয়ায় চীনের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র খুবই শঙ্কিত। শুধু তাই নয়। তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং সমরাষ্ট্র নির্মাণশিল্পের প্রসারও ওয়াশিংটনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবাই এখন স্বীকার করে অতি শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে চীন বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি হতে চলেছে। ল্যাতিন আমেরিকা এবং আফ্রিকা মহাদেশের অর্থনৈতিক বিবর্তনের বেইজিংয়ের ভূমিকাকে ওয়াশিংটন ভালো দেখছে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড়ো উদ্বেগের কারণ ঘটছে পূর্ব এশিয়ায়। এসব দেশে চীনের রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক প্রভাব বিস্তার প্রতিরোধ করাই এখন ওয়াশিংটনের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা বিবেচনা। এতদঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে ওয়াশিংটন যে এশিয়া-প্যাসিফিক বাণিজ্যিক জোট করেছে, বলতে গেলে ঢাকঢোল পিটিয়েই চীনকে সে জোট থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। চীনের প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যূহ তৈরির লক্ষ্যে চীন সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন নৌশক্তি কয়েক গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ফিলিপাইনকে উন্নতর মার্কিন সমরাস্ত্র দেয়া হয়েছে। ওয়াশিংটনের সঙ্গে উন্নততর সম্পর্কের কারণে এই দেশগুলো এরই মধ্যে অনেক বেশি সাহসী ও উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেছে। এতদঞ্চলের বিতর্কিত কয়েকটি দ্বীপের ওপর নিজেদের দাবি ঘোষণা করে তারা প্রকারান্তরে চীনকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে। ভারতের সঙ্গে অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বিশেষ ভালো ছিল না। সোভিয়েত কমিউনিস্ট সাম্রাজ্যের প্রতিপত্তি রোধের জন্যে যুক্তরাষ্ট্র যখন তুরস্ক পকিস্তান প্রভৃতি কতগুলো দেশকে নিয়ে সেন্টো ও সিটো সামরিক জোট গঠন করেছিল ভারত তখন জোট বেঁধেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে। অধিকাংশ সমরাস্ত্র ভারত এখনও রাশিয়া থেকেই ক্রয় করে। পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভারত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছে ওয়াশিংটনের বহু অনুরোধ-উপরোধ, এমনকি হুমকি অগ্রাহ্য করে। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন হয়েছে। এশিয়ার এক নম্বর পরাশক্তি হওয়ার ব্যাপারে চীনের সঙ্গে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। তার ওপর অরুণাচল অঞ্চলে হিমালয়ের বিশাল এলাকার মালিকানা নিয়ে দু’দেশের ঐতিহাসিক বিরোধের জের ধরে ১৯৬২ সালে দু’দেশের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছিল। কোনো রকম মীমাংসা ছাড়াই তখন একটা যুদ্ধবিরতি হয়। সে অবস্থা এখনো বজায় আছে। বিগত বছরগুলোতে প্রায়ই খবর পাওয়া যাচ্ছে যে উভয় পক্ষই সে অঞ্চলে সমরশক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত, আরেকটি চীন-ভারত যুদ্ধ অনিবার্য এবং আসন্ন। দিল্লি থেকে অহরহ অভিযোগ হয়, চীন উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যের বিদ্রোহীদের গোপনে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করছে। কখনও শত্রু, কখনও মিত্র এসব কারণে চীনের প্রভাব সীমিত করার ব্যাপারে ওয়াশিংটনের অতীতের অসদ্ভাবের কথা ভুলে গিয়ে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছে। দিল্লি আর ওয়াশিংটনের মধ্যে এখন পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশে ২০০৬-২০০৮ সময়ের রাজনৈতি এঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যাপারে এই দুই দেশের সহযোগিতার ইতিহাস এখন সবারই জানা আছে। শেখ হাসিনার দেয়া অপমানগুলো ভুলে গিয়ে ওয়াশিংটন যদি তাকে গদিতে রাখার জন্য আবারও ভারতের অনুরোধে রাজি হয় তাহলে বিস্ময়ের কারণ ঘটবে না। বিশেষ করে সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচন লজ্জাকর পরাজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী হাসিনা এখন গদি বাঁচানোর চিন্তায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সাধু এবং অসাধু যে কোনো উপায়ে আসন্ন নির্বাচনে জয়লাভ এখন তার একমাত্র চিন্তা। ডুবন্ত ব্যক্তি যেমন খড়কুটো যা পায় আঁকড়ে ধরে, সে রকম অবস্থা হয়েছে শেখ হাসিনার। সুতরাং সম্ভব হলে ১৮ দলের জোটে ভাঙন ধরানোর, বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কে ফাটল ধরানোর যে কোনো চেষ্টা তিনি করবেন। কিন্তু বিগত সাড়ে চার বছরে জামায়াতের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সরকারের নজিরবিহীন নির্যাতন ও দমন নীতির কারণে আপাতত দৃষ্টিতে জামায়াত-আওয়ামী লীগ গাঁটছড়া বাঁধা অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। এমন কোনো অত্যাচার ও নির্যাতন নেই যা এ সরকার জামায়াতের বিরুদ্ধে চালায়নি। ইসলামী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তিনি তত্পর, এ ধারণা সৃষ্টি করে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মন পাওয়ার লক্ষ্যে টুপি-দাড়ি পরিহিতদের বিরুদ্ধে নির্যাতন এ সরকার গোড়ার দিনগুলো থেকেই শুরু করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে বিচারকে দেশে-বিদেশে রাজনৈতিক অভিসন্ধি হিসেবেই দেখা হচ্ছে। একটা কারণ এই যে, যেসব যুদ্ধাপরাধী আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে তাদের বিচারের দাবি সরকার বরাবরই এড়িয়ে গেছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে এরই মধ্যে অভিযুক্তদের দুজনকে ফাঁসির দণ্ড এবং একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ ৯১ বছর বয়স্ক অধ্যাপক গোলাম আযমকে দেয়া হয়েছে ৯০ বছরের কারাদণ্ড। আরও ক’জন জামায়াত নেতার বিচারের রায় আসন্ন বলে মনে হচ্ছে। জামায়াতকে যা ভাবতে হবে দাবি করা হয়, এ যাবত্ জামায়াতের ৪৩ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে এ সরকার। জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের ২৩১ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। জামায়াত ও শিবিরের সদস্য সমর্থক মিলিয়ে পাঁচ লক্ষাধিক ব্যক্তিকে আসামি করে ২৬ হাজার মামলা রুজু করা হয়েছে। নিপীড়নের এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। সাধারণ বুদ্ধিতে বলে এত সবের পর জামায়াতকে দলে টানার চেষ্টা আওয়ামী লীগের পক্ষে জঘন্য ধৃষ্টতা হবে, সে চেষ্টায় জামায়াতের সাড়া দেয়া অসম্ভব বলেই আপাতত দৃষ্টিতে মনে হবে। কিন্তু রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কোনো কথা নেই। যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত নেতাদের ফাঁসি আপাতত কার্যকর না করা এবং অবশিষ্টদের বিচার ধামাচাপা দেয়াসহ রাজনৈতিক সুবিধার টোপ জামায়াতের বর্তমানে সক্রিয় নেতাদের লোভনীয় মনে হতে পারে। তবে তারা নিশ্চয়ই ভেবে দেখবেন, এ সরকার এযাবত্ শত শত কর্মীকে হত্যা করেছে, যে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে এবং যে লাখ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজানো হয়েছে—তাদের পরিবার-পরিজন এবং বন্ধুবান্ধব কিছুতেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের জোট বাধাকে সমর্থন করবে না। ময়দানে বর্তমানে নেতারা তেমন কোনো ভুল করলে তারা সবাই জামায়াতের বিপক্ষে চলে যাবেন। সাধারণ সমর্থকরাও তেমন বিশ্বাসঘাতকতাকে ক্ষমা করবে না। বিগত সাড়ে চার বছর গণতন্ত্রের ও তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির সমর্থনে আন্দোলন করে জামায়াতের জনপ্রিয়তা প্রকৃতই বেড়ে গিয়েছিল। সে জনপ্রিয়তাকে জলাঞ্জলি দেয়া দলটির পক্ষে আত্মঘাতী হবে। আরও মনে রাখা দরকার, সংবিধান থেকে ইসলাম ও বিসমিল্লাহকে বাদ দিয়ে, সরকারি চাকরি-বাকরিতে সংখ্যালঘুদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে, ভালো ফসলের জন্য তার মা-দুর্গাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এবং শেষ নাগাদ কয়েকজন ব্লগারের আল্লাহ-রাসুল (দ.) ও ইসলামের কুত্সা রটনাকে সমর্থন দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার প্রকৃতই ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আল্লামা শফীর নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলাম আন্দোলন বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ নাগরিক মুসলমানদের সত্যিকারের অভিব্যক্তি এবং একটি প্রকৃত তৃণমূল আন্দোলন। শাপলা চত্বরে গত ৬ মে ভোররাতের গণহত্যা তারা কোনোদিনই ভুলে যেতে পারবেন না। শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল করার উদ্দেশ্যে সব বেসরকারি পত্রপত্রিকা আইন করে নিষিদ্ধ করেছিলেন। শেখ হাসিনা আইন করেননি সত্যি, কিন্তু বিভিন্ন আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে এবং কখনও কখনও গায়ের জোরে বিরুদ্ধ মতের অনুসারী মিডিয়াকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছেন। নািস জার্মানির মতো এখন রাজত্ব করছে সরকারের আজ্ঞাবহ মিডিয়া। তাদের ব্যবহার করে হেফাজতে ইসলাম এবং আল্লামা শফীর বিরুদ্ধে দিনরাত্রি অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। সেটাই প্রমাণ করে, এ আন্দোলনকে সরকার কত ভয় পায়। সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনেও দেখা গেছে, হেফাজতে ইসলাম সত্যি সত্যি খুবই প্রভাবশালী। জামায়াতে ইসলাম যদি সব বিচার-বিবেচনা অগ্রাহ্য করে আওয়ামী লীগের ডুবন্ত এবং ভাঙা নৌকোয় চড়তে চায়, তাহলে বাংলাদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি জামায়াতের পরিবর্তে হেফাজতে ইসলামের মাধ্যমে অভিব্যক্তি পাবে। জামায়াতে ইসলামীর অস্তিত্ব সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়বে। (লন্ডন, ১৬.০৭.১৩)
(পূর্ব প্রকাশিত, আমারদেশ)
জামায়াতের বিষয়ে কথা হল এ দলের লিডারশীপের মাঝে পরিণামদর্শীতার অত্যন্ত অভাব এবং আধুনিক সেক্যুলার বিশ্বের রাজনীতির মারপ্যচ বুঝার যোগ্যতাও নাই তাদের মাঝে। বিএনপিকে সরাবার জন্য ৯০ এ দশকে এরা আওয়ামী লীগের সাথে জোট বেধে কেয়ার টেকার সরকারের আন্দোলন করে ধর্মনিপেক্ষতাবাদী শক্তিকে ক্ষমতায় আসার সুযোগ করে দিয়েছিল যার মাসুল তারা এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। মঈন উদ্দিনের অবৈধ সরকারের আমলেই এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে তাদের উপর বিপদ আসছে কিন্তু তারা বুঝতে চান নাই। আজ তাদের উপর যে বাহানায় অত্যাচার চলছে তা যে আসবে তা সময়মত বুঝতে না পারায় শিবিরের ছেলেদের কত মায়ের বুক খালি হয়েছে কত অর্থের অপচয় হচ্ছে! কবে যে এর শেষ হবে তা আল্লাহ জানেন। সিরাজুর রহমান সাহেব যা লিখেছেন তা বুঝার মত মানষিকতা ও যোগ্যতা জামাতের হবে না কখনও।