ভাস্কর্য কি এখন আমাদের বিচারক

ভাস্কর্য এবং মূর্তির মধ্যে পার্থক্য কি জানেন? ভাস্কর তার মনের মাধুরী দিয়ে ভাস্কর্য তৈরি করে; আর মানুষের অতিমাত্রায় মহব্বত পেয়ে এই ভাস্কর্যই একদিন দেবদেবী হয়ে মূর্তি হয়ে যায়। গ্রীকদের এই দেবী হয়তো একদিন ভাস্কর্য ছিল। গ্রীকদের অতিমাত্রায় ভালবাসা পেয়ে একদিন নিজেই হয়তো বসে গিয়েছিল গ্রীকদের দেবীর আসনে। আবার গ্রীকরাই একদিন এই দেবীকে সমাহিত করে দিয়েছিল যিশুখৃষ্টের পায়ের নিচে। তাই গ্রীকদের দেশেও এই দেবী এখন আর বেঁচে নেই। এই মৃত দেবীকে যিশুখৃষ্টের পায়ের নিচ থেকে তুলে এনে চুপিসারে বসিয়ে দেওয়া হলো আমাদের সর্বোচ্ছ আশ্রয়স্থল সর্বোচ্ছ বিচারালয়ের সামনে।  গ্রীকদের দেবদেবী এবং তাদের ধর্ম বিশ্বাস এখন আর গ্রীক দেশেই বেঁচে নেই। অপরদিকে বাংলাদেশের কোন একজন মানুষের ধর্ম, বিশ্বাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি এমন কি চেহারার সাথেও গ্রীকদের এই মৃত ভাস্কর্য বা মূর্তির সাথে নূন্যতম সম্পর্ক নেই। তারপরও মূর্তি এখানে বসলো কি করে? কে বসালেন? কেন বসালেন? যারা বসিয়েছেন তারা অবশ্যই সমাজের সাধারণ মানুষ নয় এবং কোন বিশেষ উদ্দেশ্য ছাড়া এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এটা বসানো হয়নি। আর যারা এখন এই মূর্তি পুন:স্থাপনের জন্য যুদ্ধ করছেন তারাও উদ্দেশ্য ছাড়া তা করছেন না। কিন্তু কি এই উদ্দেশ্য, জাতীর কি তা জানা উচিৎ নয়? আমার বিশ্বাস যারা এই মূর্তি এখানে স্থাপন করেছেন এবং যারা এখন এজন্য যুদ্ধ করছেন তারা অবশ্যই এই মূর্তির মোজেজা জাতীর কাছে প্রকাশ করবেন।

কিন্তু এসব প্রশ্নের  জবাব পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না। তবে এই মূর্তি সুপ্রিম কোর্টের সামনে বসানোর পেছনে যে বিশেষ বার্তা রয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যে কোন দেশে ন্যায়-অন্যায় নিশ্চিত করার সব চেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু আমাদেরকে বলা হচ্ছে যে ন্যায়-অন্যায় নিশ্চিত করার মালিক ভাড়া করা এই দেবী মূর্তি। অন্তত: প্রতিস্থাপনের পর থেকে এটিকে ন্যায়ের দেবী হিসাবে যে ভাবে প্রচার করা হচ্ছে তাতেতো এমনটাই মনে হয়। অর্থাৎ আইন আদালত নয় ভিনদেশী এই দেবী মূর্তিই আমাদের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করনের একমাত্র ভরসার স্থল। কিন্তু গ্রীকদের এই দেবী কি তার নিজ দেশে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল? পারলে সক্রেটিসের মতো জগৎ বিখ্যাত দার্শনিককে অপঘাতে মৃত্যু বরন করতে হলো কেন? আপনাদের দেবী সাকার না নিরাকার তা আপনারই ভাল জানেন কিন্তু তিনি যে একটি মূর্তি তাতে কোন সন্ধেয় নেই। ইব্রাহীম (আ:) এরকম মূর্তি ভেঙ্গে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে আইন আদালত দুরের কথা, মূর্তি তার নিজের নিথর আকৃতিটাও আগলে রাখার ক্ষমতা রাখে না। বাংলাদেশের আইন আছে আদালত আছে, আবার সবার উপরে এই দেবী মূর্তিও রয়েছে। কিন্তু এতবড় (?) একটি দেবী মূর্তি থাকতেও বাংলাদেশে ন্যায়-নীতি নির্ধারণের ক্ষত্রে এখন যে লেজে গোবরে অবস্থা, এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে বেকায়দায় পড়ে ইব্রাহিম (আ:) এর মূর্তি ভাঙ্গার ঘটনার মতো হয়তো আপনারও বলবেন দেবীতো মূর্তিই, এক্ষেত্রে মূর্তির কি করার থাকে। আসলেই কিছু করার থাকেনা, থাকলে আপনাদের দেবী, দর্শন আর রাজনীতির মধ্যে তালগোল পাকিয়ে সক্রেটিসের মতো দার্শনিককে মৃত্যু দণ্ড দিতে পাতেন না। অবশ্য একদিক থেকে আপনারা পুরোপুরি সঠিক। বর্তমান বিশ্বে মিথ্যা এখন আর মিথ্যা নেই; সত্যও সমাহিত হয়ে গেছে অনেক আগে। সত্যবাদিতাকে এখন অপরাধ মূলক কাজ মনে করা হয়। ফলে বিচারের বাণী এখন সর্বত্রই নিভৃতে কাঁদে। দেশে আইন আছে আদালত আছে; কিন্তু ন্যায় নীতি নির্ধারণ করে থাকে হয়তো আপনাদের দেবী মূর্তির মতই অদৃশ্যে থেকে দৃশ্যমান কোন নারী মূর্তি। তা নাহলে প্রধান বিচারপতিকে বলতে হচ্ছে কেন ‘হে অদৃশ্য দেবী আপনি ইতিমধ্যে আমার নিম্ন আদালত দখল করে নিয়েছেন; এবার উচ্চ আদালতটিকে অন্তত: মুক্তি দিন।’ মধ্যযুগীয় বর্বরতার কথা অবশ্যই শুনেছেন। আপনাদের এই দেবীর প্রেতাত্মার উপর ভর করেই শুরু হয়েছিল মধ্যযুগীয় বর্বরতার শুভ সূচনা।

এবার মহামান্য ভাস্কর মৃনাল বাবুর কাছে আমার একটি প্রশ্ন : ইতিহাসের আস্তাকুড়ে হারিয়ে যাওয়া ভিনদেশী কোন মৃত দেবীকে চুরি করে এনে তার গায়ে শাড়ি পরিয়ে দিলেই কি তা ভাস্কর্য হয়ে যায়? তবুও যে ভাবেই হোক, আপনিতো আপনার এই শিল্পকর্মটির সৃষ্টিকর্তা, তাই আপনিই বলুন, বাংলাদেশীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে আপনার ধার করা মৃত রোমান সাম্রাজ্যের এই মৃত রোমান দেবী মূর্তির কি সম্পর্ক? আমরা কি পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে রোমানদের মত কোন প্যাগান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম?

ময়মনসিংহের মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সামনে (সম্ভবত অন্যকোন গ্রীক দেবীর হবে) যে নগ্ন মূর্তিটি স্থাপন করা হয়েছে, তাও কি আপনার এই দৃশ্যমান নারী মূর্তির অদৃশ্য আলামত? দেশের সকল মহিলাকে নেংটা করে রাস্তায় নামিয়ে দিতে পারলেতো আপনাদেরই লাভ। কিন্তু আল্লাহ নারী সৃষ্টি করেছেন এবং নারীকে করে দিয়েছেন আপনার ও  আপনার সন্তানের মা, স্ত্রী, বোন ও কন্যা। অথচ আপনারা নারীদেরকে দেখছেন আপনাদের ভোগ্যপণ্য হিসাবে। মানুষের এই লালসার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহ মণি মুক্তা সংরক্ষণের মতো নারীকে পর্দার আড়ালে লুকাতে বাধ্য হয়েছেন।

অবশ্য এসবের জন্য একা আপনাকেই বা একক ভাবে অভিযুক্ত করছি কেন। চারদিকেইতো শুধু চুরি জোচ্চুরি আর নকলের ছড়াছড়ি।  এত নকল আর চুরি জোচ্চুরির মধ্যে আপনিইবা বাদ থাকবেন কেন? কিন্তু আমরা জানতাম রাজনীতি, শিক্ষা, সাংঙ্কৃতির মতো জায়গা গুলোই বুঝি নকলের সাম্রাজ্য হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এতটা খারাপ মনে করিনি যে ভাস্কর্যের মতো শিল্প কর্ম গুলোও এখন চুরি-জোচ্চুরি আর নকল অভিশাপ থেকে বাদ নেই। আগে নকল জিনিস দেখলে আমরা বলতাম ‘জিঞ্জিরা মেইড’। তখন নকলের কাজটি করা হতো বুড়িগঙ্গার ওপারে সবার অগোচরে সঙ্গোপনে। কিন্তু আজকাল নকলবাজদের  বসবাস গণভবন, বঙ্গভবন, পার্লামেন্ট ভবন সহ রাষ্ট্রীয় অরাষ্ট্রীয় সকল ভবনের ভিতরে বাইরে সর্বত্র। হয়ত এর মধ্যেও নিহিত রয়েছে আপনার গ্রীক-দেবীর অদৃশ্য প্রেতাত্মার মতো কোন অদৃশ্য প্রেতাত্মার অদৃশ্য আশীর্বাদ। আগে ধর্মীয় বিধি-নিষেধ আর সামাজিক ভয় ভীতিতে মানুষ কিছুটা সংযত ছিল। এখন হবুচন্দ্রের দেশে আমরা সবাই  গবুচন্দ্র। সক্রেটিসের মতো দেশের বুদ্ধিমান, ধর্মপরায়ণ মানুষ গুলোর মুখ স্তব্ধ হয়ে গেলেও এই রাজার দেশে আমরা এখন সবাই রাজা। তাই খুন রাহাজানির অপরাধ করে এখন কাকেও আর ভাবতে হয় না। কারণ অপরাধ আর এখন অপরাধ নেই, অপরাধ হয়ে-গেছে  ভিকটিমের বেহেশত লাভের প্রক্রিয়া।

পরিশেষ একটা অনুরোধ: একবার নিজের চেহারার দিকে তাকান এবং নিজকে জিজ্ঞাসা করুন, ‘একটি জোড়াতালি দেওয়া শিল্পকর্মের অবমাননার জন্য যদি আপনার এতটা কষ্ট হয়, তাহলে যে সত্ত্বা  আপনাকে বানিয়েছেন এবং বানিয়ে রক্ত মাংস, চোখ মুখ নাক কান মস্তিষ্ক বিদ্যা বুদ্ধি বিচার বিবেচনা দিয়ে মনুষ্য জীবন দান করেছেন, আপনার পদস্খলনের জন্য তাঁর কতটা কষ্ট হওয়া উচিত?’

 

About ওয়াহিদুর রহমান

লেখক একজন কষ্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট একাউন্ট্যান্ট। ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধানের উপর গবেষনা মূলক চিন্তা ভাবনা করে থাকেন। কম্পারেটিভ ধর্ম চর্চা লেখকের একটি পুরনো অভ্যাস। লেখকের গবেষনা মুলক গ্রন্থ ‘ইসলাম ও আমাদের দৈনন্দিন জীবন’ সমাপ্তির পথে। বইটি টরন্টস্থ বাংলা সাপ্তাহিক ‘দেশের আলো’ পত্রিকায় অনেকদিন থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। লেখক টরন্টস্থ ’বৃহত্তর নোয়াখালী এসোসিয়েশন ওন্টারিও’ এর বর্তমান প্রেসিডেন্ট।

Comments are closed.