জীবনে দুটি পর্যায় – সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে

যদিও ধর্মে বিশ্বাসী প্রায় সবাই জানেন যে মানব জীবনে দুটি পর্যায় রয়েছে। ইহকাল ও পরকাল। ইহকাল হলো দুনিয়ার জীবন। আর মৃত্যুর পর যে জীবন তার নাম পরকালের জীবন। দুনিয়ার জীবন সময় সীমায় আবদ্ধ এখানে “সময়” একটি বড় মূল্যবান ফ্যাক্টর ।  আর আখেরাতের জীবন অসীম সেখানে “সময়” বলতে কিছু নাই। যেহেতু এ দুটি জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি জগতের ভিন্ন প্রকৃতির দুটি প্ল্যাটফর্মে। তাই দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে মানুষের ধারনা থাকলেও আখিরাত বা পরকালের জীবন সম্পর্কে দুনিয়া থেকে স্পষ্ট ধারনা পাওয়া সম্ভব নয়। তবে আধুনিক বিজ্ঞানেরও সে ব্যাপারে  জানার তেমন আগ্রহ নাই! কিন্তু তাই বলে পরকালের জীবনকে আমরা কি অস্বীকার করতে পারি? ধর্মে বিশ্বাসীরা আমাদের প্রার্থনায় বলে থাকি “‍‍হে দু জাহানের মালিক আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন, আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং ইহকাল ও পরকালে সফলতা দান করুন”।

ইসলামী দর্শনে এ দু জাহানের সমগ্র জীবনকে মোট পাঁচ ভাগে বর্ণনা করা হয়েছে:

প্রথম জগৎ:  রুহ বা আত্মার জগত আলমে আরওয়াহ যা হচ্ছে  “আলমে আ’মরী” বা আদেশঘটিত।  কোরআনের আল্লাহ বলছেন,”..আর আপনাকে তারা রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে বলুন,‘রূহ আমার রবের আদেশঘটিত এবং তোমাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে অতি সামান্যই।

দ্বিতীয় জগৎ : মাতৃগর্ভ বা আলমে রেহেম মাতৃগর্ভ বা আলমে রেহেম সেখানে কি হয় তা নিচের ভিডিওতে স্পষ্ট বুঝা যাবে।

তৃতীয় জগৎ :  বস্তু জগৎ বা আলমে খাল্কী”  অর্থাৎ পার্থিব জীবন।

চতুর্থ জগৎ : আলমে বারযাখ অর্থাৎ মরার পর থেকে আখিরাতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মানুষের রুহ যেখানে অবস্থান করে।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন- এবং তাদের পেছনে রয়েছে বারযাখ – যার সময়কাল হচ্ছে সেদিন পর্যন্ত যেদিন তাদেরকে পুনর্জীবিত ও পুনরুত্থিত করা হবে (সূরা মুমিনুন-১০০)এই আয়াতে ইহকাল ও পরকাল জীবনের মধ্যকার যে একটি (transition period) সময় রয়েছে, তাকেই ‘বারযাখ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মানব দেহের মৃত্যুর পরপরই পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। আর আখেরাতের জীবন তখন শুরু হবে, যখন সমস্ত মানুষের অগণিত রুহকে দেহের সাথে সংযোজিত করা হবে। তখন মানুষের দুনিয়ার জীবনের কাজ কর্মের হিসাব নিকাশ করে বিচার করা হবে এবং সে অনুসারে তাকে পুরস্কার ও শাস্তি দেয়া হবে।

মানব দেহের মৃত্যুর পরের  মধ্যকার জীবন যা কবরে বা পশু-পক্ষীর পেটে কিংবা পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে অবশেষে মাটির ধূলিকণা আকারে অতিবাহিত হয়ে থাকাকে ‘বারযাখী জীবন’ বলে। মানুষের এই অস্তিত্ব যেখানেই থাক আর যেভাবেই থাক, শেষ পর্যন্ত মাটিতে মিশে ধূলিকণায় পরিণত হয়ে যাক  অথবা ছাই হয়ে হাওয়ায় উড়ে যাক, অথবা সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হ্উক অথবা কোন জন্তুর খাদ্যে পরিণত হয়ে যাক না কেন। পরিশেষে মহান আল্লাহ সকলকে এক নতুন অস্তিত্ব দান করে হাশরের মাঠে জমা করবেন। তাফসির সুত্র (তাফসীরে আহসানুল বায়ান)

পঞ্চম জগৎ: আলমে আখিরাত বা পুনরুত্থানে পরে অনন্ত কালের জীবন।

পরকালের জীবন সম্পর্কে দুনিয়া থেকে যোগাযোগ করা সম্ভব না হলেও সে জীবন যে থাকতেই হবে সে বিষয়ে আলোচনা করা জরুরী তা না হলে পুরা সৃষ্টি জগতই বৃথা। তাই বিশ্বাসীরা বলে “রাব্বানা মা খালাকতা হাজা বা’তিলান”

অর্থাৎ ‘হে আমাদের রব!  আপনি এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করেননি”(১৯০ -সুরা আল ইমরান),

আসলে সত্যকে জেনে উপকৃত হতে চায় সবাই ? তবে যে কোন কিছুকে সত্য বলা যেতে পারে, আর সেটি যদি সত্যিই সত্য হয়, তবে তা মানা বা অস্বীকার করাও মানুষের পছন্দের ব্যাপার। আর কেউ না চাইলে বা পছন্দ না হলে সেটি সত্যি হলেইবা তার কি লাভ? আমরা জানি যে সবাই সুখ অর্জন করতে এবং দুর্ভাগ্য এড়াতে চায়। এটি যেমন একটি সত্য কথা এবং সেটি বিজ্ঞান  প্রমাণ করতে না পারলেও তা মিথ্যা হয়ে যায় না।

মানুষের মনে দুটি স্ববিরোধী প্রবণতা থাকে। তার একটি আসে আদি বা মৌলিক মন থেকে যা সবসময় ভাল ও মঙ্গল কাজ করতে চায় আর অন্যটি হচ্ছে তার মন্দ মন (evil mind) যা সবসময় মন্দ কাজে লিপ্ত হতে চায়। মানুষের রুহ যতদিন তার দেহে থাকবে ততদিন ভাল ও মন্দের এ দ্বন্দ্ব চলতেই থাকবে। রুহ যেহেতু এসেছে উপর থেকে তাই সে যেতে চায় উপরের দিকে আর দেহে আছে দুনিয়ার উপাদান তাই দেহের টান থাকে দুনিয়ার দিকে। মানুষ টাকা খরচ করে দেহরক্ষী বা বডি গার্ড রাখতে পারে কিন্তু “রুহ গার্ড” রাখতে পারে না। মানুষ ক্ষমতার দাপটে বা কিছু জ্ঞান বিজ্ঞান শিখে নিজেকে যতই শক্তিশালী মনে করুক না কেন সে যে আসলেই দুর্বল এক সৃষ্টি সেটি ভুলে যায়।

আমরা অনেকেই বলে থাকি, “মানব জীবনে চলছে : ‘সু’ ও ‘কু’ এই দুই বৃত্তির অভিনব খেলা। ‘সু’ টানছে সত্যের পথে ‘কু’ প্ররোচিত করছে অসত্য ও মিথ্যার পানে। কখনো ‘সু’ মন বা আত্মার ওপর এর প্রভাব বিস্তার করে আবার কখনো কখনো ‘কু’-এর আধিক্য প্রবল হয়ে ওঠে- এই দোদুল্যমানতার ভেতর দিয়েই চলছে জীবনপ্রবাহ।”

এখানে চিন্তার বিষয় হচ্ছে মানুষের সুপ্রবৃত্তি তাকে ন্যায়, সৎ ও সঠিক পথে চলার যে নির্দেশ দেয় এবং  তা পালনে সে যে এত কষ্ট ও ত্যাগ তার জীবনে করল আর শেষে একদিন সে মরে গেল বা কোন জালিমের হাতে মারা গেল। এখন প্রশ্ন এই ভারসাম্যপূর্ণ তথা সুষমতাপূর্ণ মহা বিশ্বের একজন স্রষ্টা যে আছেন তা সকল চিন্তাশীল ব্যক্তিরা স্বীকার করেন তাহলে সেখানে কিভাবে চিন্তা করা যায় একজন সুপ্রবৃত্তির মানুষের মৃত্যুর সাথে অর্থাৎ এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার সাথে তার জীবনের সব শেষ হয়ে গেল? তার এত সব উত্তম কাজের ও ত্যাগের কোন মূল্য থাকবে না বা এর প্রতিদান পাওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকবেনা তার স্রষ্টার কাছে! তাহলে তো এ এক বিরাট অন্যায় হয়ে যাবে!

অন্য দিকে কুপ্রবৃত্তি অনুসারী মানুষটি যে সারা জীবন অন্যায়, অত্যাচার, অসৎ ও বিপথে লিপ্ত থাকল এক দিন সেও মরে গেল তার কোন বিচার হবে না সেও মুক্তি পেয়ে গেল! তাহলে এর চেয়ে বড় অন্যায্য ও নিষ্ঠুর ব্যবস্থা কি হতে পারে এত সুন্দর শোভামণ্ডিত ও অনুপম ভারসাম্যপূর্ণ এই মহা বিশ্বের স্রষ্টার কাছে? এ প্রশ্নের উত্তর কে দিতে পারবে?  সুন্দর এ পৃথিবীকে যারা করেছে অস্থির তাদের কি শাস্তি হবে না?

তাই ধর্মীয় অঙ্গনের জ্ঞানীদের কাছে  যে গল্পটি শোনা যায় তা হচ্ছে, “একবার দুষ্ট প্রকৃতির দুই ব্যক্তি , যার একজন ছিল অন্ধ আর অন্যজন ছিল পঙ্গু। তারা এক দিন এক ব্যক্তির গাছের ফল চুরি করতে গেল। ওরা ধরা পড়লে ওদেরকে বিচারের জন্য আদালতে নেয়া হল।

বিচারকের সামনে অন্ধ বলেছিল হুজুর আমি তো কিছু দেখতে পাই না আমি গাছের ফল দেখে সেটি চুরি করতে পারার অপরাধে শাস্তি পাই কিভাবে? আর পঙ্গু লোকটির কথা ছিল  আমি তো হাঁটতেই পারিনা  আমাকে কেন  ফলের গাছে যাওয়ার অপরাধে অভিযুক্ত করা যাবে?”

এ সমস্যার সঠিক বিচার কিভাবে হবে বুঝতে পারলে আখিরাতে দেহের সাথে রুহকে সংযুক্ত করে কেন বিচার করতে তা হবে বুঝা যাবে।

পরকালের জীবন যে থাকতেই হবে সে সম্পর্কে  “Principle of Creation- Two Worlds Apart”  এ নিবন্ধটিতে চিন্তার খোরাক জাগানো বেশ কিছু জ্ঞানগর্ব আলোচনা হয়েছে। কথাগুলো আমার ভাল লেগেছে।

____________________________________________________________

Comments are closed.