সুষমা স্বরাজের সফর ও অন্ধের হাতি দেখা

তিনি এলেন, দেখলেন এবং তিনি স্বদেশে ফিরে গেলেন। উচিত ছিল সবার সুস্থ মস্তিষ্কে এই যাত্রার মূল্যায়ন করা, তার থেকে উপকৃত হওয়া। কিন্তু সুস্থ মস্তিষ্ক আপনাকে খুঁজতে হবে অন্যত্র, বাংলাদেশে যারা গডফাদারতন্ত্রের জোরে অন্যায়ভাবে ক্ষমতায় আছে তাদের মধ্যে নয়। 
ভারতে নতুন নির্বাচন হয়েছে, নতুন সরকার ক্ষমতা পেয়েছে। সুষমা স্বরাজ এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশ আর ভারতের সুসম্পর্ক উভয় দেশের জন্যই সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে যে সরকার দিল্লিতে ক্ষমতায় ছিল তারা বাংলাদেশকে চিনতে পারেনি, চিনতে চায়নি। যেকোনো প্রকারে হোক, আওয়ামী লীগকে গদিতে রাখা এবং বিনিময়ে গোয়ালের গরুর দুধ দোহনের মতো ইচ্ছেমতো সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেয়াই ছিল মনমোহন সিং সরকারের বাংলাদেশ নীতি। সে নীতির বিষময় ফল সারা বিশ্ব দেখেছে; কিন্তু মনমোহন সরকার দেখেনি। একটা কার্যত অনির্বাচিত, অবৈধ ও স্বেচ্ছাচারী সরকারকে গায়ের জোরে গদিতে টিকিয়ে রেখে দিল্লির সরকার গণতান্ত্রিক বিশ্বের সাথে অপ্রীতির সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে। মনমোহন সরকারের ভুলভ্রান্তির দায় বহন করা নরেন্দ্র মোদির সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। তারা ইউরোপ-আমেরিকার সাথে সুসম্পর্ক ফিরে পেতে চান। সুতরাং বিচিত্র নয় যে, মোদি সরকার বাংলাদেশনীতি সম্বন্ধেও নতুন করে ভেবেচিন্তে দেখতে চাইবে। সে কারণেই সুষমা স্বরাজের সফর স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত ছিল।
 আওয়ামী লীগ সরকার অনেক কিছু দিয়েছে। ঐতিহ্যবাহী বিডিআর বাহিনী দেশের সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী ছিল। মুক্তিযুদ্ধে তারাই প্রথম অস্ত্র হাতে হানাদার বাহিনীর আগ্রাসনের মোকাবেলা করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের কোনো অনুপ্রবেশ অথবা ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশের ভূমি দখল বিডিআর সহ্য করেনি। বিডিআর যত দিন ছিল, অবলীলায় সীমান্তে ফেলানীদের মতো বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যার ঘটনাও ঘটতে পারেনি। ভারতীয় ফেনসিডিল আর ইয়াবা বড়িতে বাংলাদেশের বাজার সয়লাব হয়ে যেতে পারত না। 
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা পাওয়ার মাত্র দেড় মাসের মাথায় দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে বিডিআর বাহিনী ভেঙে দেয়া হলো, তাদের ৫৭ জন সিনিয়র অফিসারের হত্যা রোধ করার জন্য বাংলাদেশের জাতীয় সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে বাধা দেয়া হলো সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে। অনেক বিডিআর সিপাহি বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। শত শত বিডিআর কর্মীকে কঠোর দণ্ড দেয়া হয়েছে, কিন্তু যে কারণে এবং যেসব ষড়যন্ত্রে বিডিআর বিদ্রোহ হলো সে সম্বন্ধে গুরুত্ব দিয়ে কোনো তদন্তই হলো না। এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য প্রকৃতপক্ষে কে বা কারা দায়ী ছিল, বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারল না।
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতকে উত্তর-পূর্বের সাত রাজ্যের ‘স্বাধীনতা’র যুদ্ধ দমনের উদ্দেশ্যে এবং ভবিষ্যতে চীনের সাথে যুদ্ধ হলে সমরাস্ত্র ও সৈন্য পাঠানোর পথ হিসেবে সড়ক, রেল ও নদীপথে করিডোর দিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। দিতে তারা বাধ্য হয়েছে, নইলে দিল্লি তাদের ক্ষমতায় থাকতে দিত না। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান তখনো বলেছিলেন এবং সম্প্রতি আবারো বলেছেন যে, করিডোর, ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্টের জন্য কোনো প্রকার মাশুল নেয়া বাংলাদেশের জন্য অসভ্যতা হবে। উল্লেখ্য, পৃথিবীর অন্য যে যে দেশে এসব ব্যবস্থা আছে সেখানেই এবং অনিবার্যভাবেই মাশুল দেয়া-নেয়ার বিধান আছে। শুল্ক না দিয়ে সুয়েজ খাল কিংবা পানামা খাল দিয়ে একখানি ডিঙি নৌকাও পার হতে পারে না। কিন্তু তাতে সভ্যতা উল্টে গেছে বলে শুনিনি। 
 
এসওএস কি আর কোনো কাজে লাগবে?
 মইন-ফখরুদ্দীন বর্ণচোরা সামরিক সরকার বেগম খালেদা জিয়াকে কারাবন্দী করেছিল। অভিযোগ আছে, লোকদেখানোর মতো করে শেখ হাসিনাকে আটক করা হয়েছিল। কিন্তু তখনো ভারতীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির কাছে ‘এসওএস’ পাঠিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। জানা যায়, মনমোহন সিংয়ের সরকার যেভাবে হোক তাকে রক্ষা করবে, সে আশ্বাস ভারত সরকারের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন। অনেকেই মনে করেন, বিগত ভারত সরকারের আমলে বাংলাদেশের ভেতরের কলকাঠিও ঘোরাত দিল্লির শাসকমহল। পাঁচ জানুয়ারির তামাশার নির্বাচন এবং আগে পরে কূটনৈতিক তৎপরতাই বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের কদর্য হস্তক্ষেপের অকাট্য প্রমাণ দেয়। 
 খালেদা জিয়া নির্বাচনী বিজয়ে নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন পাঠিয়েছিলেন। তারেক রহমানও পাঠিয়েছিলেন অভিনন্দন। মি. মোদি তারেককে দিল্লি সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ঈর্ষাতুর ব্যক্তির মতো এই ব্যাপারগুলো সহ্য করা বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আসলে এতে বিগত সাড়ে পাঁচ বছর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের তাৎপর্যপূর্ণ একটা বর্ণনা পাওয়া যাবে। হাসিনার সরকারের মনোভাব ভারত সরকার শুধু তার ও তার সরকারের সাথেই বন্ধুত্ব রাখবেÑ অন্য কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা বাংলাদেশের মানুষের সাথে নয়। গণতন্ত্রের বিবেচনা সেখানে মোটেই মুখ্য ছিল না। 
বিনিময়ে ভারতও আশা করেছে, বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে শুধু তার সাথেই ঘনিষ্ঠতা রাখবে, অন্য কারো সাথে নয়। চীনের সাথে সখ্য হাসিনা সরকার সে জন্যই এড়িয়ে চলেছে। সম্প্রতি হাসিনার বেইজিং সফরে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল যে, চীন সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরটি তৈরি করে দেয়ার চুক্তি করতে রাজি হয়েছে। সে প্রস্তাব বেইজিং সরকার আগেও দিয়েছিল। কিন্তু গোড়ায় উৎসাহ দেখালেও শেষ পর্যন্ত ভারত সরকার কী মনে করবে, সে অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশী পক্ষ বেইজিংয়েই পিঠটান দেয়। ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বের’ ঘোষিত পুরনো নীতিকে সরকার ভারতের স্বার্থে যেন বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিয়েছিল। 
 
খালেদা কি বলবেন তাকে নিয়ে এত ভয় কেন? 
 বাংলাদেশ সফরকালে সুষমা স্বরাজ যাতে বেগম জিয়া কিংবা অন্য কোনো সরকারবিরোধী নেতার সাথে সাক্ষাৎ না করেন, সে জন্য সরকারের চেষ্টা-তদবিরের অন্ত ছিল না। সরকার সত্যি সত্যি আশা করেছিল যে, সুষমা তাদের অনুরোধ ও চেষ্টা-তদবির অগ্রাহ্য করে অন্তত খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করবেন না। খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামকে অনেকেই বাচাল বলে ব্যঙ্গ করেন। তিনি তার উল্লাস চেপে রাখতে পারেননি। তিনি দাবি করেছিলেন যে, সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফরে (বিএনপিকে এড়িয়ে) বিএনপির মুখে চুনকালি লেপিত হয়েছে। কিন্তু উল্লাসটা তিনি আগেভাগেই করে ফেলেছিলেন। সরকারের সব তদবির উপেক্ষা করে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীর্ঘ ৪০ মিনিট ধরে খালেদা জিয়ার সাথে আলাপ করেছেন, তার মধ্যে আবার ১২ মিনিট কোনো উপদেষ্টা ছাড়াই, একান্তে। সমালোচকদের গালে এখন শুধু চুনকালিই নয়, সেই সাথে কিছু গোবরও কি মাখামাখি হয়ে যায়নি? 
 প্রধানমন্ত্রী ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা এখন অন্য সুর ধরেছেন। তারা বলছেন, খালেদা জিয়া সুষমা স্বরাজের কাছে নালিশ করেছেন, কান্নাকাটি করেছেন। ‘আঙুর ফল টক’ আর কাকে বলে? ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যদি বাংলাদেশের প্রকৃত পরিস্থিতি জানতে চান (এবং সেটাই ছিল তার উদ্দেশ্য), তাহলে তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের ৯৫ শতাংশ মানুষের অবিসংবাদিত প্রতিনিধি খালেদা জিয়া ছাড়া আর কার সাথে কথা বলবেন তিনি? নৈতিক ভিত্তি ছাড়াই অবৈধভাবে গদি আঁকড়ে থাকা ‘প্রধানমন্ত্রী’র সাথে এককভাবে? আওয়ামী লীগের কোনো কোনো মহল এবং ভারতে তাদের গুণগ্রাহী আনন্দবাজার পত্রিকা মিন মিন করা শুরু করেছে এই বলে যে, খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠক করে সুষমা স্বরাজ মহা অন্যায় করে ফেলেছেন, প্রোটকলের নাকি সর্বনাশ করেছেন তিনি। কিন্তু কোন প্রোটকল বলে শেখ হাসিনার বোন ব্রিটিশ নাগরিক শেখ রেহানা ও কানাডীয় নাগরিক কন্যা পুতুলের সাথে সুষমা স্বরাজের বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল, সে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে কেউ এগিয়ে আসছেন না।
 সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশ সফর শেষ করে দিল্লিতে ফিরে গেছেন। দিল্লি ও ঢাকা ছাড়াও পৃথিবীর আরো কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজধানীতে এই সফর, পরবর্তী বিবর্তন, ইত্যাদি নিয়ে প্রচুর জল্পনা-কল্পনা হবে। বাংলাদেশে এ সফরের বিভিন্ন মূল্যায়ন অন্ধের হাতি দেখার কাহিনী মনে করিয়ে দিতে বাধ্য। একদল অন্ধ হাতি দেখতে গিয়েছিল। বিভিন্ন জন হাতির বিভিন্ন অঙ্গ ছুঁয়ে দেখেছে। তাদের হাতির বর্ণনাও ছিল ভিন্ন ভিন্ন। যে কান ধরেছিল সে বলল, হাতি কুলার মতো। যে শুঁড় ধরেছিল তার বর্ণনায় হাতি মোটা পাইপের মতো। একজন বলেছিল, হাতি খামের মতো। আর একজনের বর্ণনায়, হাতি নাকি মোটা দড়ির মতো। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফর নিয়েও বাংলাদেশে ভিন্ন ভিন্ন এবং পরস্পরবিরোধী বিশ্লেষণ দেয়া হচ্ছে।
 
কিছু উক্তি খুবই আশাব্যঞ্জক
গোপনে সুষমা শেখ হাসিনাকে কী বলে গেছেন আমাদের জানার কথা নয়। কিন্তু সরকার বাহ্যত জাহির করতে চাইছে যে দিল্লির নতুন সরকার তাদের সাথে লেনদেন করবে বলে আশ্বাস দিয়ে গেছেন মিজ স্বরাজ। সরকারের দিক থেকে কৃত্রিম উল্লাসের অবধি নেই। তাদের পোষ্য মিডিয়া ঢাকঢোল পেটাচ্ছে সে নিয়ে। চুলচেরা বিচার করলে দেখা যাবে, এ আশ্বাস রীতি রক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়। আধুনিক কালের অবস্থা এমনই যে, এক দেশ অন্য দেশের সাথে লেনদেন না করেই পারে না; অন্তত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। সে জন্যই রীতি বা প্রথা হচ্ছে, যে সরকার গদিতে আছে অন্য দেশগুলো বাধ্য হয়ে সে সরকারের সাথেই লেনদেন করে। 
 গত ৫ জানুয়ারির তামাশার নির্বাচনকে ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন কিংবা জাপান কেউই বিশ্বাসযোগ্য কিংবা জনমতের প্রতিফলন বলে স্বীকার করেনি। কিন্তু প্রহসনের নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ সরকারের সাথে লেনদেন করতে তারা বাধ্য হচ্ছে। তার অর্থ এই নয় যে, এ সরকারকে তারা বৈধ কিংবা বন্ধু মনে করে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ওয়াশিংটনে ধরনা দিয়েও পোশাক রফতানির জিএসপি আদায় করে আনতে পারেননি। ব্যর্থ হয়ে উল্টোপাল্টা কথাবার্তা বলছেন। এ দিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভারত থেকে প্রথমে আম, পরে পান আমদানির লাভজনক ব্যবসায় বন্ধ করে দিয়েছে। 
 সুষমা স্বরাজ এমন কিছু কথা বলেছেন, যা আমার আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। তিনি বলেছেন, ভারতের নতুন সরকার বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা বিশেষ কোনো দলের সরকারের প্রতি আনুকূল্য দেখানোর পরিবর্তে জাতিতে জাতিতে সুসম্পর্কের ওপর জোর দিতে চায়। একটু খতিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, অতীতে, বিশেষ করে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারগুলোর আমলে, দিল্লি আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, বিশেষ একটি পরিবারকে স্বজনের মতো যতœ করেছে। তারা দেশে দেশে এবং জাতিতে জাতিতে সুসম্পর্কের পরিবর্তে কংগ্রেস-আওয়ামী লীগেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। বাংলাদেশে আর কে কী ভাবছে সেটাকে তারা গ্রাহ্য করেনি। দিল্লির নতুন সরকার যদি এই অশুভ গোলক ধাঁধা ভঙ্গ করতে পারে, তাহলে দুই দেশের এবং গোটা উপমহাদেশে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা হতে পারে। 
 খোন্দকার মোশতাক আহমদের সরকার চেষ্টা করেও দিল্লির মন জয় করতে পারেনিÑ যদিও সেটাও ছিল আওয়ামী লীগ দলীয় একটা সরকার। জিয়াউর রহমান শুধু স্বাধীনতার ঘোষক এবং প্রথম প্রেসিডেন্টই ছিলেন না, অবশ্যই তাকে গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পুনঃপ্রবর্তক বলতেই হবে। তার বন্ধুত্বের ডাকে দিল্লি সাড়া দেয়নি। এ দিকে, নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সার্ক সম্বন্ধে উৎসাহী বলেই মনে হয়। এই সার্কের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল রাষ্ট্রপতি জিয়ার উদ্যোগে। ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতাই ছিল তার উদ্দেশ্য। কিন্তু ভারত সরকার তখন থেকে সার্ককে সপতœীপুত্রের মতোই দূরে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছে।
 
ভারতীয় জুজুর ভয় কি আর নেই? 
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরেকটা অত্যন্ত মূল্যবান কথা বলেছেন এ প্রসঙ্গে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বাংলাদেশের জনগণই মেটাবে। এ উক্তির তাৎপর্য খতিয়ে দেখা যাক। সুষমা স্বরাজ কার্যত বলে দিলেন যে, দিল্লি কোনো সরকারকে বাংলাদেশের গদি থেকে সরিয়ে দেবে না। সরকার পরিবর্তন করতে হবে বাংলাদেশীদের। সেটা তারা আন্দোলন করেই হোক অথবা অন্য যেকোনো প্রকারেই হোক। বস্তুত ব্রিটেন, আমেরিকা, জার্মানি প্রমুখ দেশগুলো বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি এবং ন্যক্কারজনক নির্বাচন সম্বন্ধে যেসব কথা বলেছে, তার মধ্যেও এমন কোনো আশ্বাস ছিল না যে, সরকার পরিবর্তনে তারা বাংলাদেশীদের সাহায্য করবে। বস্তুত কূটনৈতিক সমর্থনের ওপর অতিমাত্রিক নির্ভরশীলতা বিএনপির গণতন্ত্রের আন্দোলনে অনেক ক্ষতি করেছে। এখন সুষমা স্বরাজ যে বললেন, নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয় জনগণই মেটাবে, তাতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার প্রচ্ছন্ন আছে।
 কংগ্রেস কোয়ালিশন সরকার প্রকাশ্যে এবং ইঙ্গিতে বলে এসেছে যে শেখ হাসিনার সরকারকে সকল প্রকার সংরক্ষণ দিয়ে আসবে। আন্দোলন করে ওই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যাপারে ভারতের হস্তক্ষেপের ভয়টা একটা বাস্তব বিষয় ছিল। আন্দোলনে ‘বাড়াবাড়ি’ হলে ভারত হস্তক্ষেপ পাঠাবে, বহু মানুষ তারা হত্যা করবেÑ এসব বিবেচনায় ইচ্ছা থাকলেও অনেকে ভয়ে খালেদা জিয়ার আন্দোলনে যোগ দেননি। ২৯ ডিসেম্বরের কর্মসূচির দিনে বিএনপিরও কোনো কোনো নেতা যে ঘরের বাইরে বের হননি, সম্ভবত এটাই হচ্ছে তার কারণ। সুষমা স্বরাজ এই আশ্বাস দিয়ে গেলেন যে, কোনো দলকে, এমনকি শেখ হাসিনার দলকেও গদিতে বহাল রাখার কিংবা বিতাড়িত করার ব্যাপারে দিল্লির নতুন সরকার কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করবে না।
 লন্ডন, ০১.০৭.১৪
বিবিসি বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান

পূর্ব প্রকাশিত নয়া দিগন্ত

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *