সাম্প্রতিক তুরস্ক সফর

৭ নবেম্বর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের উপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আমাকে সেখানে যোগ দিতে হয়েছে। Union of NGOs in the Islamic World (UNIW) নামক তুরস্কের শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারী সংস্থা এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিল।সারা দুনিয়ার ১৪৫টি দেশের ২৮৭টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এই প্রতিষ্ঠানটির সদস্য। পাকিস্তানের আল খিদমত ফাউন্ডেশনের অনুরোধে তারা রোহিঙ্গাদের উপর এই সম্মেলনটির আয়োজন করেছিল।

সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, তুরস্ক, ভারত, ফিলিপাইন, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতিসহ ১৮টি দেশের ২৭ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছিলেন। অভ্যাগত অতিথিরা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর মায়ানমার সরকারের অমানবিক নির্যাতনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন এবং বাংলাদেশ সরকার তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করায় তাদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। বলা বাহুল্য, নতুন পুরাতন উভয়ে মিলে বাংলাদেশে এখন প্রায় এগারো লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু রয়েছে। প্রতিদিনই তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্মেলনে বাংলাদেশের দুর্বল অর্থনীতির উপর এই বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তুর ভরন-পোষণের চাপকে অস্বাভাবিক আখ্যায়িত করে এই সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান হয় এবং বেসরকারী ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোকে বাংলাদেশ সরকার ও স্থানীয় এনজিওসমূহের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে অর্থ সাহায্য প্রদানের অনুরোধ করা হয়।

সম্মেলন প্রাথমিকভাবে ২৭টি এনজিওর সমন্বয়ে একটি Consortium গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। International Consortium on Rohingyas বা ICR তার কাজকে ৭টি ক্লাস্টার বা গুচ্ছে বিভক্ত করে প্রতিটি গুচ্ছের জন্য এক একটি এনজিওকে দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের এনজিও ব্যুরোর মাধ্যমে সম্পদ প্রবাহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। রোহিঙ্গা সমস্যাকে অত্যন্ত জটিল সমস্যা হিসাবে আখ্যায়িত করে উদ্বাস্তুদের মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করার উপরও এতে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সম্মেলনটি ৭ তারিখের জন্য নির্ধারিত থাকলেও ৮ তারিখ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

৯ নবেম্বর বিমানযোগে তুরস্কের হাতাই শহরে যাই। ইস্তাম্বুল থেকে বিমানে হাতাই-এর দূরত্ব প্রায় দেড় ঘন্টা। শহরটি অত্যন্ত প্রাচীন। এখানে সিরীয় রিফিউজিদের অনেকগুলো ক্যাম্প আছে। এই ক্যাম্পগুলো এককভাবে পরিচালনা করে তুরস্কেরই অন্যতম শীর্ষ এনজিও জাংসুই। মানবতার সেবায় নিয়োজিত এই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশে কাজ করছে। ঐ দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন সমাজসেবক, সংস্কারক ও উচুমানের বুদ্ধিজীবী জনাব মোস্তফা কইলো- এর সভাপতি, এই প্রতিষ্ঠানের বিদেশ বিভাগের সমন্বয়ক ও সংগঠক জার্মান নাগরিক বেরাম নুমান ককসাল অক্লান্ত পরিশ্রমী অঙ্গীকারবদ্ধ মানবদরদী একজন সমাজসেবী। সফরকৃত উদ্বাস্তু শিবিরসমূহে তাদের দরদী তৎপরতা ছাপ দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। এই উদ্বাস্তুরা সেখানে যেন নিজ বাড়ীতেই আছেন। যারা কর্মক্ষম এই সংস্থাটি তাদের কাজ কর্মের সংস্থান করে দিচ্ছে। উদ্বাস্তুরা যাতে রিলিফ প্রেমী, অলস ও অপরাধী হয়ে না পড়ে তার জন্য তাদের তীক্ষè দৃষ্টি রয়েছে। যুদ্ধাহত, বেদনা কাতর বহু মহিলা-শিশুকে সেখানে দেখেছি। তারা সিভিলিয়ান। সরকারী বাহিনীর গোলাগুলিতে তারা মারাত্মকভাবে আহত। হাসপাতালে জরুরী চিকিৎসা শেষে জাংসুই তাদের জন্য বাড়ীগুলো ভাড়া করে তাদের এখানে নিয়ে এসেছে এবং সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এদের সকলেই মেহমানের মতো আছেন। শিশুদের জন্য এখানে যেমন স্কুল আছে তেমনি কিশোর যুবকদের জন্যও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। ৪০০ ছাত্রের এরকম দু’টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম পরিদর্শন করলাম। একটিতে শিশুরা কুরআন শিখছে এবং হেফজ্ করছে। আরেকটিতে সিয়াসিত্তাহ ও উসুলে ফিকাহ শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। শিক্ষকদের সবাই উচ্চ শিক্ষিত, ডক্টরেট ডিগ্রীধারী। জাংসুই-এর স্থানীয় সংগঠক ও স্বেচ্ছাসেবী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, জনাব আবদুল হাদি ঘুরে ফিরে শিবিরগুলো দেখালেন।

শিবির পরিদর্শন শেষে আন্তাকিয়া শহরে যাই। এই শহরটি হাতাই থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে সিরীয় সীমান্তের কাছে। এখানে হজরত ইয়াহিয়া (আ:) ও হজরত ইউনুছ (আ:)-এর কবর অবস্থিত বলে জনশ্রুতি আছে। কবরগুলো জিয়ারত করেছি। হাবিবে নাজ্জারের কবর এবং গুহাও দেখেছি। হাবিবে নাজ্জার হজরত ঈসা (আ:)-এর আবির্ভাবের পূর্বে একজন আবেদ লোক ছিলেন। তিনি তার সমাজের লোকজন কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে গুহাবাসী হয়েছিলেন। অনেক উঁচু রকি পাহাড়ের চূড়ায় গুহাটি অবস্থিত। ঈসা (আ:) নবুওত প্রাপ্তির সময়ও তিনি জীবিত ছিলেন। তার সাহাবারা যখন ঐ এলাকায় দাওয়াতি কাজ করতে এসেছিলেন তখন তিনি গুহা থেকে নেমে এসে ঈসা (আ:) এর নবুয়তের সত্যতা মেনে নেয়ার জন্য ঐ জনপদের লোকদের আহ্বান জানিয়েছিলেন কিন্তু তারা তার কথা মানেনি বরং তাকেসহ দাওয়াতি কাজে আগত ব্যক্তিদের হত্যা করে। গুহার বিপরীত দিকে লোকালয়ের পাশে তাদের কবর রয়েছে। এর নীচেই রোমান আমলের একটি শহর যা এখনো অক্ষত আছে। এর প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে হিল্টন কোম্পানী একটি হোটেল নির্মাণ করতে গিয়ে মাটির নীচে একটি পুরাতন শহরের সন্ধান পেয়েছে। তুরস্ক সরকার এই শহরটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছে।

এখান থেকে সিরীয় সীমান্তে রেহানলি নামক শহরে যাই। সেখানে জাংসুই পরিচালিত উদ্বাস্তু এতিমদের একটি এতিম খানা পরিদর্শন করি। এই এতিম খানায় এতিমদের সাথে তাদের মায়েরাও থাকেন। জাংসুইর যতœ আদরে তারা বেড়ে উঠছে এবং লেখাপড়া শিখছে। অনুমতি না পাওয়ায় সিরীয় সীমান্তের সরকার পরিচালিত উদ্বাস্তু শিবিরসমূহে যাওয়া সম্ভব হয়নি। সেখানে যাবার একটি মাত্র গেট- বাবে হাওয়া। ত্রাণবাহী শত শত ট্রাক উদ্বাস্তু শিবিরে যাবার জন্য সেখানে অপেক্ষা করতে দেখেছি। কোনও পর্যটক সেখানে যাবার অনুমতি পাচ্ছে না।

১১ তারিখ আঙ্কারা ছিলাম। ১২ তারিখ ইস্তাম্বুলে ফিরে আসি। ১৩ তারিখ মালয়েশিয়া ভিত্তিক International Federation for Relief and Development এর বার্ষিক সভায় যোগদান করি। এ বছর ইস্তাম্বুলের ওয়াও হোটেলে এই সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১০টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত এই ফেডারেশনের অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ। তার প্রতিনিধি হিসেবে আমি এর নির্বাহী কমিটির সদস্য।

এরপর ১৪ ও ১৫ নবেম্বর ইস্তাম্বুলের ওয়াও হোটেলের বিশাল সম্মেলন কক্ষে তুরস্কের খ্যাতনামা অর্থনৈতিক সামাজিক গবেষণা কেন্দ্র তথা ইসাম (ESAM) তার ২৬তম বার্ষিক কংগ্রেস উপলক্ষে “বৈশ্বিক সংকট ইসলামী বিশ্ব এবং পশ্চিমা জগত” শিরোনামে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে দুনিয়ার ৮১টি দেশের ১৭২ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। ১২টি অধিবেশনে বিভক্ত এই সম্মেলনে বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান সংকটের ধরন-প্রকৃতি, তার কারণ ও সম্ভাব্য সমাধান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।

সম্মেলন শেষে একটি ঘোষণাপত্রও অনুমোদন করা হয়। ঘোষণা পত্রে দুঃখ প্রকাশ করে বলা হয় যে দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে মুসলিম প্রধান এলাকাসমূহে যুদ্ধবিগ্রহ ও হানাহানির কারণে লক্ষ লক্ষ লোক মৃত্যু বরণ করছে এবং লক্ষ লক্ষ লোক বাড়িঘর ছেড়ে উদ্বাস্তু হিসেবে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। এতে বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তু হিসেবে বসবাসরত লোকের সংখ্যা সাড়ে ছয় কোটিতে উন্নীত হয়েছে। আবার যুদ্ধ ও সংঘর্ষের পরিবেশে ২৫ কোটি শিশুকে জীবনের আশঙ্কা নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে, গত দশকে ২৫ লক্ষ শিশু যুদ্ধের ফলে প্রাণ হারিয়েছে। দেশে দেশে শোষণমূলক ব্যবস্থা চালু থাকার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমস্যা-সংকট ছাড়াও মানবতার উপর নেতিবাচক প্রভাবের কারণে এই ব্যবস্থার ফলে বহু দেশ অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়ছে। বিশ্বের এক শতাংশ জনগণের সম্পদের পরিমাণ অবশিষ্ট ৯৯ শতাংশ মানুষের সম্পদের সমান হয়ে পড়েছে। ফলে বঞ্চনা ও বৈষম্যের পরিমাণ ও পরিসর দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের ৬২ জন শীর্ষ ধনীর সম্পদের পরিমাণ ৫০০ বিলিয়ন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৫ বছরে ১.৭৬ ট্রিলিয়ন ডলারে উপনীত হয়েছে। পক্ষান্তরে প্রায় ১৫০ কোটি লোক এক ডলার বা তার কম আয় দিয়ে জীবিকা নির্বাহে বাধ্য হচ্ছে।

মানব জাতির কল্যাণে সম্পদ বন্টনের এই অবিচার ও বৈষম্যের অবসান হওয়া প্রয়োজন। বিশ্বের কোটি কোটি লোক বিশুদ্ধ পানি ও পুষ্টিকর খাবারের অভাবে মারাত্মক রোগব্যাধিতে আক্রান্ত। বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী আগামী কয়েক বছরে বিশ্বব্যাপী বিশুদ্ধ পানি ও পুষ্টিকর খাদ্যের সংকট আরো প্রকট হয়ে দেখা দিতে পারে।

এছাড়া রয়েছে মাদক ও নেশা জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার, ব্যভিচার, হোমোসেক্সচুয়েলিটি প্রভৃতির ন্যায় অনৈতিক ও চরিত্র ধ্বংসী তৎপরতার প্রচার ও প্রসার। নৈতিক অবক্ষয়ের ফলে শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মানুষ তার সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলো হারিয়ে পশুতে পরিণত হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী দুনিয়ার ২৫ কোটিরও বেশি লোক এখন মাদকের শিকার।

সংকটের কারণ হিসেবে ঘোষণায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সৃষ্ট আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বিশেষ করে জাতিসংঘ, ন্যাটো, বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আইএমএফ প্রভৃতি কর্তৃক সংকট সমাধানের পরিবর্তে তাকে আরো ঘনীভুতকরণ, পক্ষপাত দুষ্ট আচরণ এবং তাদের অযোগ্যতা প্রভৃতিকে দায়ী করা হয়। এতে আরো বলা হয় যে বিশ্বব্যাপী পাশ্চাত্যের শক্তিধর দেশগুলোর স্বার্থবাদী তৎপরতা এবং আধিপত্যবাদ এই দ্বন্দ্ব সংঘাতের মূল কারণ। যেখানেই তাদের অর্থনেতিক ও কুটনৈতিক স্বার্থ জড়িত আছে সেখানেই তারা সংঘাত সৃষ্টির ইন্ধন যোগায়। ইহুদীচক্র ও পাশ্চাত্য সভ্যতা ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বকে তাদের লক্ষ্য অর্জন ও স্বার্থ আদায়ের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক বলে মনে করে। মধ্যপ্রাচ্যে সংকটের প্রধান কারণ হচ্ছে শতাব্দি পুরাতন বালফোর ঘোষণা। এই ঘোষণার মাধ্যমে সম্পূর্ণ অবৈধ ও অন্যায়ভাবে নিজ ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনীদের উৎখাত করে ইংল্যান্ড কর্তৃক ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালী তাকে সমর্থন করেছিল।
সংকটের জন্য মুসলিম বিশ্বের অনৈক্য এবং শিক্ষা দীক্ষা ও জ্ঞানবিজ্ঞানে অনগ্রসরতা, পারস্পরিক যুদ্ধ বিগ্রহ ও দ্বন্দ্ব সংঘাত, ইসলাম বিচ্যুতি ও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শাসক গোষ্ঠি কর্তৃক পরাশক্তিসমূহের লেজুড় বৃত্তি প্রভৃতিকে দায়ী করে মুসলিম মিল্লাতকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানানো হয়। এতে বলা হয় যে এক মাত্র কুরআন সুন্নাহর অনুসরণ ও অনুশীলনই আমাদের সমৃদ্ধি অর্জনের গ্যারান্টি দিতে পারে।

Comments are closed.