সরকার নির্বাচিত না হওয়ায় যত অঘটন

পুলিশের ওপর দায়িত্বহীন আচরণের প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ বোস্টন পুলিশ ওবামার লেবার ডে অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দিয়ে প্রমাণ করল, ব্যক্তি যত ক্ষমতাশালীই হোক, অন্যায়ের প্রতিবাদে কোনো ছাড় নেই। হিলারি ক্লিনটনের মতো ক্ষমতাশালী পরিবারের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তার ইমেইল কেলেঙ্কারির ঘটনার ওপর হামলে পড়েছে শত শত প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং সংস্থা। মার্কিন প্রেসিডেন্টকে সরাসরি মিথ্যাবাদী বললেও জেল-জরিমানার ভয় নেই। একমাত্র বাকস্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ব্যতিক্রম। এর বাইরে সব বিষয়েই আমেরিকার সাথে প্রতিযোগিতায় নামে আওয়ামী লীগ। আমাদের দেশে ৫ জানুয়ারির ঘটনা সত্ত্বেও কতটুকু সমালোচনা হয়েছে? না হলে, কার ভয়ে হয়নি? মানবাধিকারের কণ্ঠে এই মাত্রায় বন্দুকের নল একমাত্র অগণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষেই সম্ভব।
নাস্তিকদের জন্য বাইবেল মোতাবেক জীবনযাপন আর ভোটচুরি করে ক্ষমতায় আসা সরকারের জন্য সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা- একই ধরনের তামাশা। অনির্বাচিত সরকারের বেলায় সংবিধান কখনোই বাধ্যবাধকতা নয়। ঠিক তেমনই ব্লগারদের লেখায় ধর্মের সমালোচনা ছাড়া প্রশংসা থাকবে না। বলতেই হয় ৫ জানুয়ারির অপকর্মের পর অদ্ভুত সব বেআইন তৈরি করে আইনের নামে দমন-পীড়ন চালাচ্ছে সরকার। দিন দিনই আইনের সংখ্যা এবং দমন-পীড়নের মাত্রা বাড়ছে। তদন্ত টিম নামে আওয়ামী চিড়িয়াখানায় একটি চিড়িয়ার জন্ম হয়েছে। মানুষ এখন এই চিড়িয়াটিকে নিয়ে তামাশা করে। চেয়ারম্যান মাও-এর ইতিহাস যারা পড়েছেন, দমন-পীড়নের নিষ্ঠুর চেহারা তারা জানেন। মাও থেকে তিয়েনমেন স্কোয়ার… বন্দুকের চেহারা এক, পাল্টায়নি ব্যবহারের পদ্ধতিও। প্রমাণ, ১৯৮৯ সালে তিয়েনমেন স্কোয়ারে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী ছাত্রদের বুকে গুলিবর্ষণের ঘটনা। আমাদের আইজি সাহেব ঠিক সে রকমই বললেন, ক্রসফায়ার হচ্ছে আইন মেনে। আইন মেনে ক্রসফায়ার? এ কোন মগের মুল্লুক! মনের আনন্দে প্রতিদিন খুন করছেন। যেন ৩৯ বছর পর চেয়ারম্যান মাও-এর পুনর্জন্ম হয়েছে বাংলাদেশে। গণতন্ত্রকে ঘৃণা করতেন মাও, স্টালিন, লেনিন। ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা দখলে রাখতে উদ্ভট সব উন্নয়নের ফর্মুলা তৈরি করে এমন দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, যা চেয়ারম্যান মাওয়ের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। মানুষ যা চায়, তা পাত্তা দেয় না অনির্বাচিত সরকার। গেইম থিওরির খেলা খেলে উন্নতি এবং মধ্যম আয়ের দেশের নামে অব্যাহত প্রপাগান্ডা। কারো কথাই আমলে নিচ্ছে না, প্রত্যেকেরই সমালোচনা, নিজেরা ধোয়া তুলসীপাতা। ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত না হলে জবাবদিহিতা থাকবে কেন?
যে দৃষ্টান্ত কোনো গণতান্ত্রিক দেশেই নেই। আমি শুধু দুয়েকটির চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছি। আমাদের দেশে মামলার পাহাড়। সেদিন রায় হলো, ১৯৯২ সালের মামলার। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যাদের বিচার এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি, তারা হলেন অভিযুক্ত খুনি সোহেল রানা, দেলোয়ার হোসেন, সাত মার্ডার, সাগর-রুনি, ত্বকির, বিশ্বজিতের খুনি, হলমার্ক এবং বেসিক ব্যাংকের চোর-ডাকাত ইত্যাদি। কিন্তু তা না করে, কী করছে? সাহস থাকলেও বলতে পারে না, আইনের বারোটা বেজেছে। বলামাত্রই আওয়ামী স্তাবক রিট করে। আর সাথে সাথে রিমান্ড মঞ্জুর করিয়ে নিচ্ছে পুলিশ। এটাই স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত। বিশ্বজিতের খুনিদের ফাঁসি কার্যকর করা যতটা জরুরি, অন্যগুলো নয়। কিন্তু জুডিশিয়াল কিলিংয়ের দিকে সরকারের অতিমাত্রায় ঝোঁক, সমালোচকদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দিয়ে ঢাকা যাবে কি?
সাংবাদিক প্রবীর সিকদার যে অভিযোগটি তুলেছেন সামান্য নয়। দেশে-বিদেশে এই সংবাদ গুরুত্ব পেয়েছে। তার অভিযোগ, সরকারের মধ্যেই রাজাকার। কেউ কেউ মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়ও বটে। অভিযোগ মাফিক, মন্ত্রী শুধু রাজাকারই নন, হিন্দু সম্পত্তি দখলদার এবং সংখ্যালঘু নির্যাতকও (দ্র: বিডি নিউজ.কম, ৮/১৭/২০১৫, নিউএইজ, ১৯/৮/২০১৫)। এখানে তিনি প্রিন্স মুসা এবং মন্ত্রীর রাজাকারি ও খুনের ঘটনা ব্যাপকভাবে তুলে ধরেছেন (দ্র: সাংবাদিকের ফেসবুক)। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মন্ত্রীর বিরুদ্ধে জিডি করতে চাইলে পুলিশ সেটা না নেয়ার কারণ আমরা বুঝি। মন্ত্রী বলেছেন, তাকে গ্রেফতার করা ছাড়া উপায় ছিল না। বিষয়টি কী দাঁড়াল? ডালমে কুছ কালা হ্যায়। সাকা চৌধুরীদের বিচার হবে কিন্তু আওয়ামী লীগের হলে হবে না। কোনো গণতান্ত্রিক দেশেই মুখ চিনে বিচার হয় না, হয় অপরাধ বুঝে। ভোট ছাড়া যারাই ক্ষমতায় আসে, জবাবদিহিতায় বাধ্য নয়। ভোট চুরি করে ক্ষমতায় গেলে যা হয়। সাধারণ মানুষের জীবন-নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। আইজিপির কথায় সেটাই প্রমাণ হলো। অবৈধ সরকার চেয়ারম্যান মাওয়ের মতোই নিষ্ঠুর। তাই মানুষ এখন ঘর ছেড়ে হয় বন-জঙ্গলে, নয় বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় কেন, জরায়ুতে থাকা শিশুকেও গুলি করছে আওয়ামী লীগ।
মাও লেগেসির চর্চা বাড়ছে চীনে। আমাদের ভাগ্যে কী আছে কেউ জানে না। আমাদের দেশে অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা দখল করে ২০৪১ পর্যন্ত দমন-পীড়নের টার্গেট। সেই লক্ষ্যে উন্নতির প্রপাগান্ডা দিন দিনই বাড়ছে। উন্নতি ছাড়া মুখে কোনো শব্দ নেই। প্রায় ৬০ লাখ মানুষ যখন বন্যাকবলিত, তখনো উন্নতির কথা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে প্রবীর সিকদার এবং আমি সম্পূর্ণ একমত, শুধু একটি ছাড়া। তারা কখনোই আওয়ামী অন্ধকার ছেড়ে আলোর মুখ দেখবে না। যত দিন আমি ওদের কথায় বিশ্বাস করেছি তত দিন পর্যন্ত ওদের মতো চিন্তা করেছি। এখন আমি নিজের মতো চিন্তা করি। তাই অনেক কিছুই আমার চোখে অন্যরকম, যা তাদের ভালো লাগে না। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই না। কথাটি মিথ্যা। বেছে বেছে নয়, আমি সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাই। সত্য সব সময় কঠিন। আওয়ামী আদর্শবাদীরা বিরোধী দলকে ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দলটিকে মুছে ফেলতে চায়। আমার মতো যারাই চেতনা ধোঁয়ামুক্ত হতে পেরেছে, শুধু তারাই এই অসুখটিকে চিহ্নিত করতে পেরেছে। আর এ ধরনের মানুষগুলোই সরকারের রোষানলে।
চেতনার নামে মানুষকে যেভাবে বিভ্রান্ত করছে আওয়ামী লীগ, ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় থেকে ছিটকে পড়েছে অন্তত দুই প্রজন্ম। যারা আওয়ামী লীগেই সীমাবদ্ধ, প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কখনোই জানবে না। কারণ জানতে দেয়া হবে না। ৯/১১-এর মতো ’৭১ নিয়েও বহু ষড়যন্ত্রের কথা এখন পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত। মতবাদ রয়েছে। প্রকৃত ইতিহাস বেরিয়ে এলে, সাকা চৌধুরীর সাথে প্রভাবশালী মন্ত্রী এবং অন্যেরও বিচার হওয়ার কথা; কিন্তু হবে না। মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলে ধরলেন এই সাংবাদিক, নিজামী কিংবা কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেকটাই এক। স্বাধীনতাবিরোধীদের গাড়িতে পতাকা তুলে দেয়ার অপরাধে প্রকাশ্যে জিয়াউর রহমানকে হারামজাদা বলেছেন সাংবাদিক বাবু। কিন্তু আওয়ামী লীগমুক্ত না হতে পারার কারণে মন্ত্রীর গাড়িতে পতাকা তুলে দেয়ার অপরাধে পাতানো বোনের বিচার চাননি। প্রবীর সিকদারের জিডি বনাম স্কাইপ কেলেঙ্কারি, আইনের এই ব্যত্যয় মোটেও গণতান্ত্রিক দেশের পরিচয় নয়।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত
প্রবীর সিকদারকে ৫৭ ধারায় গ্রেফতার করার পর, শুধু আওয়ামী আদর্শের হওয়ায় আইন ভঙ্গ করে মুক্তি। অন্যথায় তার ভাগ্য হতো দিগন্ত টিভি এবং মাহমুদুর রহমানের মতো অন্ধকার। বলছি ৫৭ ধারা নিয়ে সাপ খেলা। অতীতে কখনোই ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে এ ধরনের দৃষ্টান্ত দেখিনি। ’৬৫ সালে যুদ্ধ শুরু হলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের প্রতিশোধ নিতে হিন্দুরাই উল্টো আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে গিয়েছিল। তারা দুর্গাপূজা বন্ধ করে দিয়েছিল। অনেক দেনদরবারের পর শুধু ঘটপূজায় সম্মত হয়েছিল, তাও ঢাকের বাজনা বাদে। আমি তখন ছোট। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অর্থ কতটুকু জানে সরকার? রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আবার ধর্মনিরপেক্ষতা দাবি একমাত্র অগণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষেই সম্ভব। ব্লগাররা শুধু নাস্তিক নাকি ৫৭ ধারায় পড়ে, সেই ধারণাটুকুও কি সরকারের আছে? আমি বলব, ব্লগারদের মৃত্যুর জন্য দায়ী সরকার। কারণ তারাই ৫৭ ধারার নামে সাপের বাক্স খুলে দিয়েছে। ব্লগারদের বিষয়ে আমি কী ভাবি সেটা ব্যক্তিগত। কিন্তু খুন হলেই ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি নিয়ে মঞ্চে হাজির হতে এক মুহূর্তও দেরি করেন না মন্ত্রীরা। ইনুরা বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করলে নাকি সহ্য করা হবে না। আমার তো মনে হয় ৫৭ ধারার সবচেয়ে বড় ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে সরকার নিজে। অন্যথায় লতিফ সিদ্দিকী এবং আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বিচার হওয়ার কথা সবার আগে। তাদের বক্তব্য পাবলিকে এবং ইউটিউবে। সরকারপক্ষের জন্য আইন প্রযোজ্য নয়, প্রযোজ্য একমাত্র বিরোধী দলের বেলায়। ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় না এলে সর্বোচ্চ আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানোই বাস্তবতা। ৫ জানুয়ারিতে নির্বাচন হয়নি, হয়েছে ভোট ডাকাতি। অনেকের সংগ্রহেই ডিজিটাল ডাকাতির প্রমাণ রয়েছে। এরা মাহমুদুর রহমানদের জেলখানায় বন্দী রেখে লতিফ সিদ্দিকীর মতো সরাসরি ধর্ম প্রতারককে সংসদে ঢুকতে দিয়ে নিজেদের অবৈধতাকেই বিস্তার করেছে। ধর্মের বিরুদ্ধে গাফ্ফার চৌধুরী যত বড় বোমা ফাটালেন নিউ ইয়র্কে এবং কলামে, এরপর কলাম প্রত্যাহারই নয় ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতার করে বিচার করার কথা। ৫৭ ধারা কি শুধুই দিগন্ত টিভি এবং আমার দেশ? মাথাপিছু আয় ১০ হাজার ডলার আর সর্ববৃহৎ স্যাটেলাইট আনলেও আইনের ব্যত্যয়গুলো ধামাচাপা দেয়া সম্ভব নয়। হলে চীনা রেভ্যুলিশউনের এত বছর পর, স্বৈরাচার মাওয়ের কথা কেউ লিখত না। সরকার যে অসাংবিধানিক, প্রবীর সিকদারের গ্রেফতার এবং শুধু তার জন্য আইন ভঙ্গ করে মুক্তি দেয়াটা নৈরাজ্যের অন্যতম দৃষ্টান্ত।

অভিবাসী সঙ্কট
নয়া দিগন্তে ৮ সেপ্টেম্বরের খবর, ইউরোপ অভিমুখে ১৫ হাজার বাংলাদেশী। শুধু কি তাই? লাখ লাখ রিফিউজির ভিড়ে বাংলাদেশীদের সংখ্যা কয়েক লাখ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কারণ, মূলত অধিকসংখ্যক বাংলাদেশী ওই অঞ্চলে শ্রমিক হিসেবে গেছে। অসাংবিধানিক সরকার ১০০ ভাগ জনবিচ্ছিন্ন। ভূমধ্যসাগরের ক্রাইসিসে ন্যূনতম মাথাব্যথা নেই, টুঁ-শব্দটিও নেই। কোনো নির্বাচিত সরকারই এই ক্রাইসিসে চুপ থাকতে পারে না। নিউ ইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, আলজাজিরা বলছে, নৌকায় হাজার হাজার বাংলাদেশী। উত্তরে সরকার কী বলে? বলে, মাথাপিছু আয় ১৩ হাজার ৫০০ ডলার। স্বজনেরা চিৎকার করে, অন্তত লাশগুলো ফিরিয়ে দিন। উত্তরে সরকার কী বলে? বলে, ২০১৬ সালে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হবে। আমরা কী বলি? বলি, ক্রসফায়ার বন্ধ করুন। উত্তরে সরকার বলে, স্কুলে যাওয়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। বলে, প্রতিটি ইউনিয়নে ওমুক করা হবে, তমুক করা হবে। উন্নয়নের কাওয়ালিতে কান পচে গেছে, মাথাব্যথা করে। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু সরকার অন্য জিনিস। লাখ লাখ রিফিউজির আশ্রয় দিতে এগিয়ে এসেছে পশ্চিমারা। পোপ ফ্রান্সিস প্রত্যেক খ্রিষ্টানকেই একটি করে পরিবারকে আশ্রয় দিতে বলেছেন। শরণার্থী ক্রাইসিসে কাঁপছে ইউরোপ। জরুরি জি-৮ মিটিং করে শরণার্থী নেয়ার কোটা ঘোষণা হলো। ব্রিটেন নেবে ২০ হাজার, জার্মানি ৩০ হাজার, ফ্রান্স ২৫ হাজার। তাদের মধ্যে মোটা দাগে বাংলাদেশীরা। আমাদের সরকার কী বলছে? সব দোষ মার্কিনসাম্রাজ্যবাদের। টকশোগুলোতে তাদের স্তাবকেরা এসে দোষ চাপাচ্ছে ধনী দেশগুলোর ওপর। শরণার্থী সঙ্কটে অনেকেরই বক্তব্য ঘোর সমাজতান্ত্রিক। এরা নিজেদের শ্রমিকদের জীবন বাঁচাতে টুঁ-শব্দটিও করছে না। আমরা কি ইউরোপের ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে উন্নতির গান গাইতেই থাকব? নাকি দায়িত্ব নিজেরাও শেয়ার করব? পুরো আগস্ট মাসে শোকের নামে কী দেখলাম! শেখ মুজিবকে এখন রহমাতুল্লাহি-আলাইহি বলানোর জন্য লবি চলছে। এসব অন্য আলোচনা। তবে এই মুহূর্তে সাগরে ভাসছে হাজার হাজার বাংলাদেশী পরিবার। চীন-রাশিয়া পারস্য উপকূলীয় মুসলিম দেশগুলো ছাড়াও একমাত্র বাংলাদেশই একজন শরণার্থীকেও জায়গা দিলো না। তবে বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশই শুধু নয়, ক্রাইসিসের অন্যতম শরিকও। আমাদের শ্রমিকেরাই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে। অথচ আমরাই সেই দেশ, যারা নেপালের দুর্যোগে চাল পাঠিয়েছি, মালদ্বীপের ক্রাইসিসে পানি পাঠিয়েছি, হাইতির ভূমিকম্পে জাহাজ ভরে ডাক্তার এবং ওষুধ পাঠিয়েছি। খুব ভালো কথা, কিন্তু শরণার্থীদের কী হবে?
অনির্বাচিত সরকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে পশ্চিমারা। বারবারই নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বললেও আমলে নিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। বরং গালাগাল এবং কটূক্তি। লক্ষণীয়, বাংলাদেশ এখন একঘরে। এই সরকার কোথাও আর কাক্সিক্ষত নয়। ফলে হাসিনার বিদেশ যাওয়া প্রায় বন্ধ। আগে দেখতাম বিপরীত চিত্র। এ ধরনের অনির্বাচিত সরকার যে নাকি এই মাত্রায় স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে, একটি গরিব দেশের জন্য বিপজ্জনক। কারণ ইউরোপই রফতানির মূল কোটা। পশ্চিমাদের মধ্যে জার্মানি আমাদের এক নম্বর আয়ের উৎস। এসব উৎস হঠাৎ বন্ধ হবে না বলা যায় না। জার্মানি, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া বারবার নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলছে। ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশ ৫ জানুয়ারিকে ধিক্কার দিয়েছে। সরকার প্রত্যেকের সমালোচনা করেছে। এবার শরণার্থী ক্রাইসিসে কী বলল জার্মানি? তারা অনেককেই অ্যাসাইলাম দেবে; কিন্তু বাংলাদেশীরা বাদ। ফ্রাঙ্কফোর্ট এবং ঢাকা অফিসের মাধ্যমে সরকারকে জানিয়ে দিলো, শরণার্থীদের দায়িত্ব বাংলাদেশকেই নিতে হবে। ক্ষোভের এটাই বহিঃপ্রকাশ। এ ধরনের সরকার যত দিন থাকবে, তত দিন অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইতোমধ্যেই অনেক দেশ বাংলাদেশে তাদের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এতকিছুর পরও জনবিচ্ছিন্ন সরকার নির্বাচন নিয়ে গোলমাল করছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে, এ ধরনের স্বৈরাচারী আচরণ সম্ভব নয়। ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার মানেই জনগণের সরকার। প্রায় শত শত বাংলাদেশীর লাশ ভূমধ্যসাগরে। স্বজনদের আহাজারি সত্ত্বেও লাশ ফিরিয়ে আনা দূরের কথা, আচরণ দেখে মনেই হবে না, এ ধরনের ক্রাইসিস ঘটেছে। মিডিয়াতেও খুব একটা দেখা যায় না। বরং ঢাকঢোল পিটিয়ে আদর্শ প্রচারই মূল। প্রবাসীদের ডলার ভালো লাগে, মরলে সমস্যা নেই। মূলত শ্রমিকদের ওপরই নির্ভরশীল আমাদের অর্থনীতি। সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন এখন মৃত্যুপুরী। ওইসব দেশের বাংলাদেশীরা ভূমধ্যসাগরের পথে। ইনু, মতিয়াদের একমাত্র কাজ, করের টাকা খরচ করে ড. ইউনূস এবং জিয়া পরিবারকে উলঙ্গ করা।
শুধুই কি ভূমধ্যসাগর? অর্থনীতি ধসে পড়ায় অসংখ্য মানুষ ছুটে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরে। উদ্দেশ্য, একটি চাকরি। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায় গণকবরের কথা জানি। অসংখ্য মৃত্যু বঙ্গোপসাগরে ট্রলার ডুবে। অসাংবিধানিক সরকার হলে যা হয়। জবাবদিহিতার অভাবে সবকিছুই ধসে যায়। তাই অভিবাসী সঙ্কটে বাংলাদেশের নাম আজ পশ্চিমের মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। এ রকমই একটি খবর ‘বাংলাদেশী রিফিউজি ক্রাইসিস ইন লিবিয়া।’ এই প্রতিবেদনে প্রায় ৪০০ ছবি জুড়ে দিয়েছে। যে পর্যন্ত না সাংবিধানিক সরকার আসবে, তত দিন মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে সরকার।

মিলিয়ে নিন দমন-পীড়ন
হিটলার কিংবা স্টালিন নন, সবচেয়ে বড় গণহত্যা করেছিলেন মাও। ‘কমিউনিজমের কালো গর্ত’ বইতে সাড়ে ৬ কোটি চায়নিজ হত্যার কথা উল্লিখিত। চেয়ারম্যান মাওয়ের সবচেয়ে বড় শত্র“ ছিল গণতন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবীদের মেধা। তখন প্রায় ৪৬ হাজার বুদ্ধিজীবীকে জ্যান্ত কবর দিয়েছিলেন মাও। কৃষি বিপ্লবের নামে চায়নিজদের সাথে দারুণ প্রতারণার ফসল, দুর্ভিক্ষে প্রায় ৪ কোটি মানুষের মৃত্যু। প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হতো রেডগার্ড। কুকুরের পোশাক পরিয়ে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করতে বাধ্য করা হতো বুদ্ধিজীবীদের। পরবর্তী সময়ে পিটিয়ে হত্যা করা হতো কুকুরের মতোই। চেয়ারম্যান মাও মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, একমাত্র বন্দুকের নলেই সব ক্ষমতা। কথাগুলো লিখেছেন, হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের গবেষক লি অ্যাডওয়ার্ড (বিস্তারিত গুগলে)। চুপ করে ঘরে বসে থাকার জন্য বিরোধী দলকে দোষ দেবো কেন? চেয়ারম্যান মাওয়ের অত্যাচার যে কত দুর্ধর্ষ, আর কেউ নয়, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। পিটিয়ে মেরুদণ্ডের সব ক’টা হাড় গুঁড়া করে দিয়েছে। উলঙ্গ করে ছেড়েছে মান-সম্মান। মাও স্টাইলে লাখ লাখ নেতাকর্মীকে গুম-খুন, জেলের মাধ্যমে পরিবারগুলোকে শেষ করে দিয়েছে। মিডিয়াগুলোকে বিটিভি বানিয়ে প্রচার করছে উন্নতির বিলবোর্ড। ফ্রন্ট লাইনের মতো জনপ্রিয় টকশো বন্ধ। সমালোচকদের বিরুদ্ধে রেডকার্ড। শিক্ষিত সমালোচকদের বিদায় করা শেষ। দিগন্ত এবং ইসলামিক টিভি বন্ধ। আমার দেশ বন্ধ এবং মাহমুদুর রহমান জেলে। স্বৈরাচারী কাণ্ডকলাপ তুলে ধরামাত্রই হয়রানির শিকার হচ্ছে পত্রিকাগুলো। বিজ্ঞাপন না দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ। টেলিভিশনের একাধিক সিইও জেলে গেছেন। দেশের মধ্যে একটি অস্থির-অস্থির ভাব। চার দিকেই ধড়পাকড়ে মুষড়ে পড়েছে মানুষ। যেন অঘোষিত জরুরি অবস্থা। কমিউনিজম নিয়ে লেখা ‘কালো গর্ত’ বইটি যতই পড়ি, ততই বিস্মিত হই। সরকার অনির্বাচিত হলে জবাবদিহিতা থাকবে কোন দুঃখে?

ষড়যন্ত্রবাদীদের গেইম থিওরি
যদি কেউ ভুল করেও ভাবে, এতগুলো বছর ধরে ড. ইউনূস এবং খালেদাকে আওয়ামী লীগের গালিগালাজের অর্থ শুধুই গালিগালাজ, বিষয়টি সম্পূর্ণ ভুল। সরকারের ভাবমূর্তি বহু আগেই শূন্যের কোঠায়, টাকার জন্য পড়ালেখার ওপর ভ্যাট, তেলের মূল্য কমে যাওয়া সত্ত্বেও বিদ্যুতের দাম বাড়াল, আনন্দবাজার পত্রিকার খবর- ভারতের দয়ায় ক্ষমতায় টিকে আছে হাসিনা। এটাই বাস্তবতা। নোবেল জয়ী ড. ন্যাশের গেইম থিওরি আগেও লিখেছি। জিরো সাম অর্থাৎ তোমাকে ধ্বংস করে আমি জিতব। যে বিষয়টি আগেই বোঝা উচিত ছিল, এই মাত্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে গালিগালাজ কেন! দেশে দুঃসংবাদের ঢল নেমেছে। সরকারপ্রধান প্রতিদিনই অনুষ্ঠানে যা বলেন, প্রয়োজনীয় হোক আর অপ্রয়োজনীয়, এমনকি বাসি কথাও লিড নিউজ হয়। যদি তাই না হতো, দুঃসংবাদগুলোই লিড নিউজ হতো। এতে থলের বেড়াল বেরিয়ে যেত। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারত, কতটা খাদে পড়েছে অর্থনীতি। সুতরাং আওয়ামী লীগ যা করছে, বুঝেশুনেই করছে। তারা দুঃসংবাদ ধামাচাপা দিতে বিতর্কিত বিষয়গুলোকে সামনে তুলে আনে। প্রতিদিনই প্রাধান্য পায়, প্রধানমন্ত্রী কী বলেছেন। সংসদ খোলার প্রথম দিন থেকে অবিরাম ইউনূস-খালেদার ওপর কথার বোমাবর্ষণ। যে বক্তব্য ৫ মিনিটে শেষ হয়, দুই ব্যক্তির চরিত্র হননে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গালিগালাজ। সর্বশেষ ঘটনা, ঘরের শত্রু বিভীষণ নামক ৫ মাইল লম্বা বক্তৃতা। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মহলে অভিবাসী ক্রাইসিসের অন্যতম খবর বাংলাদেশ। ঘরের শত্রু বিভীষণ কিংবা খালেদাকে গালিগালাজ না করলে অভিবাসীদের সংবাদ প্রাধান্য পেত। আমি যদি বলি, সাত বছর ধরে সরকারের যে লাগাতার ব্যর্থতা, ধামাচাপা দিতেই ইউনূস-খালেদাকে নিয়ে গেইম থিওরি! আরো যা দৃশ্যমান, কথার বোমাবর্ষণ তখনই বাড়ে, যখন দুঃসংবাদের মাত্রা হয় খুব বেশি ভয়ঙ্কর। ঘরের শত্রু বিভীষণ দিয়ে অভিবাসী সঙ্কটকে হত্যা করা। প্রতিবারই ড. ইউনূসকে সামনে এনে জিএসপির ব্যর্থতা ভিন্ন খাতে ধাবিত করার গেইম থিওরি। সরকারপ্রধান যা বলেন, সেটাই দখলে রাখে লিড নিউজ, ব্রেকিং নিউজ, রানিং নিউজ। অন্য সংবাদগুলো চাপা পড়ে যায়। এদের গেইম থিওরির পাল্লায় পড়ে হেরে গেছে মানুষ, জিতে গেছে সরকার। তবে কত দিনের জন্য এই সাফল্য, বলা কঠিন।

Loading

Comments are closed.