উচ্চশির, পূণ্যহৃদয়, কণ্ঠে-জালালী কীর্ত্তন
বাংলার বার্তা হাতে, দেখো-শ্রীহট্টের নন্দন।
বাঙ্গালী জাতির বরপুত্র সিলেটবাসীকে এভাবেই একদিন উষ্ণ অভ্যর্থনায় বিশ্ব মানব সম্প্রদায় তার কোলে স্থান দিয়েছিল। “ঘর মুখো বাঙ্গালী” অপবাদ ঘুঁচানোর দায়ীত্ব যাদের কাঁধে পরেছিল, তারা একদিন ঠিকই বাঙ্গালী জাতিকে বিশ্বসভায় এক সম্মানের আসনে পৌঁছে দিতে প্রাণান্তকর যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে গেল। সেই প্রচেষ্টার সুফল জাতি অনেকাংশেই ভোগ করতে পেরেছে ইতিমধ্যেই। পৃথিবীর ১৯০ টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ফিলিপিনোরা, এরপরই ২য় এ্যাডভেঞ্চারাস জাতি হিসাবে বাঙ্গালীরা সুপরিচিত। বিশ্বজয়ে বের হয়ে যাওয়া দিগ্বিজয়ী সিলেটি নাবিকদের পথ ধরেই আজ বাঙ্গালী পৌঁছে গিয়েছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। এই যাত্রা সুখের ছিল না কোন সময়ই। এই যাত্রা ছিল কণ্টকাকীর্ণ, বন্ধুর, সীমাহীন দুর্ভোগ, লাঞ্চনা, মৃত্যু যন্ত্রনা, আর হাজার হাজার অকুতোভয় সিলেটী নাবিকদের জীবনদানের ইতিহাসের নামই ‘বাঙ্গালী জাতির প্রবাস যাত্রার ইতিহাস’। “ আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের অতল গহবর হতে আজও সিলেটী যুবকের অতৃপ্ত আত্মার ক্রন্দন থেকে থেকে ভেসে আসে রাতের আঁধারে। সিলেটের কোন এক পল্লীতে উঠোনে বসে আজও প্রহর গুনে কোন এক মা তার ছেলে ফিরে আসবে বলে। কোন এক সন্তান জানতে চায় কোন সে সাগরে তার পিতার সলিল সমাধি।“ ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা আর আরবের বন্দরে বন্দরে সিলেটী নাবিকের স্মৃতি চিহ্ন আজও ঠোট বাঁকা করে বিদ্রূপ করে বলে ‘অকৃতজ্ঞ বাঙ্গালী’।
ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে সমূদ্র উপকূল হতে সিলেটের অবস্থান বেশ দূরে। যদিও বাংলাদেশের বড় বড় হাওর গুলোর অধিকাংশই সিলেটে, সিলেটকে ‘পাহাড়ী অঞ্চল’ বলেও গন্য করা হয়। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলেই সবচেয়ে বড় বড় পাহাড় ও টিলা রয়েছে। এই সিলেটের মানুষগুলো কিভাবে একদিন দিগ্বিজয়ী নাবিক বেশে প্রবাসী বাঙ্গালীর পথিকৃত হয়ে গেল তা জানবার বিষয়। তবে এটা যে হঠাৎ করেই হয়ে যায় নাই তা নিশ্চিত, অন্ততঃ কিছুটা হলেও ইতিহাসের উপর নির্ভর করা যায়। ইতিহাসের সাহায্য নিয়ে ৪ টি বিষয়ের প্রমান করতে পারলেই আমাদের আজকের আলোচনা সার্থক হবে ; এই তিনটি বিষয় হচ্ছে (১) প্রাচীন সিলেট সমূদ্র তীরে ছিল (২) সিলেটে প্রাচীন কাল থেকেই এক বিচক্ষণ সভ্য জাতির বসবাস ছিল যারা ডিংগি নৌকা থেকে আরম্ভ করে সমূদ্র গামী যুদ্ধ জাহাজ নির্মানে ও চালনে ছিল সিদ্ধহস্ত । (৩) কয়েক শত বছর আগেই সিলেটবাসিরা বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পরে। (৪) বাঙ্গালী জাতির মধ্যে সিলেটের ‘সৈয়দ উল্লাহ’ প্রথম বিলাত যাত্রী ‘শ্রীহট্টিয়া কলম্বাস’ ।
(১)বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চলগুলোই ভূমির প্রাচীনত্বের দাবীদার। সিলেটের ভূমির অধিকাংশ টারশিয়ারী যুগের সৃষ্টি বলে গবেষকদের ধারনা। অধ্যক্ষ তোফায়েল আহমদের মতানূসারে সিলেটের পাহাড়ী অঞ্চল প্রায় টারশিয়ারী যুগের সৃষ্টি। গবেষক ও লেখক জনাব হাফিজুর রহমান ভূইয়ার মতে ভূতাত্বিকভাবে সিলেটের এ সকল পাহাড়ী অঞ্চলের বয়স ৬ কোটি বছর। সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চল ছাড়া আজকের বাংলাদেশের মানচিত্র সমুদ্রগর্ভে ছিল। সপ্তম শতাব্দীতে চৈনিক পবিব্রাজক হিউয়েন সাঙের বর্ণনা মতে সিলেট সমুদ্রতীরবর্তী পর্বত উপত্যকায় আবৃত ছিল। তিনি সিলেটকে’ শিলিচট্টল ‘বলে উল্লেখ করেন। ইংরেজ ইতিহাসবিদ উইলিয়াম হান্টার তার A statistical Account of Assam গ্রন্থে উল্লেখ করেন “The conformation of some of the sandy hillocks and the presence of marine shells at the foot of the hills of northern boundary indicate that sea flowed at the base of the hills at a comparatively recent period ” অর্থাৎ সিলেটের পর্বতের পাদদেশে সমুদ্র শম্বুকের উপস্থিতি প্রমান করে সমূদ্র এক সময়ে সিলেটের চারিদিকে প্রবাহিত ছিল। হান্টারের বেশ আগে স্যার জোসেফ ডেল্টন হকার খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে শাখা সমূদ্র প্রবাহিত ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। শামসুল আলম “হজরত শায়খ জালাল” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন “বাংলার অধিকাংশ ভূমি এক সময় সমুদ্রগর্ভে ছিল কিন্তু সিলেট অঞ্চল অতি প্রাচীন।” বিশিষ্ট জ্ঞানতাপস সুরেশ চন্দ্র সমাজপতির ভাষায় “যখন আমাদের সমস্ত বঙ্গদেশ সমুদ্রগর্ভে বিলীন ছিল তখন শ্রীহট্টে আর্য্য জাতির বিজয় বৈজয়ন্তী উড়ছিল। শ্রীহট্টের এই প্রাচীন ঐতিহ্যের কথা অধ্যায়ন করবার জন্য যে বাঙ্গালী উদগ্রীব নন বা ইচ্ছুক নন তিনি বাঙ্গালী নামের যোগ্য নন”। তাঁর এই উক্তি থেকে সিলেট যে সাগরতীরে ছিল তার প্রমাণ সহ একটি সভ্য সমাজ ব্যবস্থার ইঙ্গিত বহন করে। সিলেটের চারিদিকের সাগর ক্রমান্বয়ে সরে গিয়ে হৃদের জন্ম হয়। এই হৃদগুলোই হাওর নামে পরিচিত। হাওর শব্দকে অনেকে সাগরের অপভ্রংশ বলে উল্লেখ করেন, অনেকে এটাকে ফার্সী শব্দ “বাহার” এর বিকৃত রূপ মনে করেন। সিলেটের বিশিষ্ট গবেষক ও ঐতিহাসিক অচ্যুতচরন চৌধুরী তত্ত্বনিধি উল্লেখ করেছেন প্রাচীন দলিল পত্রে “রত্নাভরাং” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এই রত্নাভরাং পদ সাগর ভরাটেরই প্রতিশব্দ। এছাড়াও আমাদের কাছে একটি দলিল রয়েছে। খৃষ্ট জন্মের (২ হাজার বছর) আগের একটি তাম্রশাসন সিলেটের ভাটেরাতে পাওয়া গিয়েছিল। এই তাম্র শাসনের এক জায়গায় “সাগর পশ্চিমে” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ।সুতরাং উল্লেখিত প্রমাণাদি, গবেষক ইতিহাসবিদদের অভিমত থেকে এ পর্যন্ত আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি যে সমুদ্র সিলেটের পাদদেশে ছিল।
(২) এই সমুদ্রতীরের মানুষ এবং তাদের সামাজিক অবস্থা, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি জানার মাধ্যমেই আমরা নিশ্চিত হতে পারবো তাদের দুঃসাহসী নাবিক হয়ে যাবার ইতিহাস। এ ক্ষেত্রে কিছু যৌক্তিক প্রমাণাদির জন্য আমরা পৌরানিক গ্রন্থ’াদির আশ্রয় নিচ্ছি। মহাভারতে উল্লেখ আছে সেই যুগে আর্যগণ বঙ্গভূমিকে বসবাসের উপযুক্ত মনে করেননি। তবে সিলেট পূণ্যভূমি হিসাবে তারা সম্মান দেখাতেন। সিলেটের মানুষ ব্যতীত অন্যান্য এলাকার মানুষজনকে আর্য্যগণ অসূর, দস্যু এবং মাংসভোজী বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। রামায়নে রামের পিতা দশরথ বলেন “সিংহদেশের (ত্রেতা যুগে সিলেটের নাম) সমাজ, আচার, ব্যবহার, আতিথ্য, শিষ্ঠতা, বিবাহের বিধি বিধান ও প্রথা আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। ইহা কখনও ভূলবার নয়”। এই উক্তি থেকে সহজেই অনুমেয় তৎকালে সিলেটে একটি সভ্যজাতির বসবাস ছিল। এছাড়াও পরবর্তীতে ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাং ও হজরত শাহজালালের বিভিন্ন উক্তি থেকে সিলেটের মানুষের বিচক্ষণতার প্রমাণ পাওয়া যায়। সিলেটের আদিবাসিরা হচ্ছেন অষ্ট্রিক জাতি। তবে ভোটব্রহ্ম সংস্কৃতিবাসীরাও সিলেট ও কাছাড় অঞ্চলে ছিলেন বলে ঐতিহাসিকদের ধারনা। এই অষ্টিক জাতিরাই অর্থনৈতিক উন্নয়নে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনে সক্ষম হয়েছিলেন। কৃষিকাজের প্রচলন ও ডিঙি নৌকা (যা অষ্ট্রিক শব্দ ডোঙা থেকে এসেছে) উদ্ভাবন করেন। এই ডিঙি নৌকা দিয়ে অস্ট্রিকরা সমুদ্র পথে এক বিশাল বাণিজ্য গড়ে তুলেছিল। তারা হাড়, ও পাথর দিযে অস্ত্র নির্মান করতো এবং তামা ও লোহার ব্যবহার জানতো, কড়ির সাহায্যে বেচাকেনা করতো। এক কড়ি, দুই কড়ি, এক গন্ডা, দুই গন্ডা তাদের কাছ থেকেই আমাদের কাছে এসেছে। এ পর্যন্ত আলোচনায় এ সিদ্ধান্তে আসা গেল যে বর্তমান বাংলাদেশের চট্রগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ী অঞ্চল ব্যতিত মানচিত্রের বাকী সমতলভূমি সমুদ্রগর্ভে ছিল সুতরাং মানব সভ্যতার গোড়াপত্তন এ দুজায়গাতেই হয়েছিল এবং তৎকালে সিলেটে একটি বিচক্ষণ সভ্যজাতির বসবাস ছিল যারা নৌকা চালায়ে বাণিজ্য করতো। সুতরাং সিলেটবাসীর ধমনীতে নাবিকের শোণিত প্রবাহিত হচ্ছিল প্রাচীন কাল থেকেই।
প্রাচীন কালের পর সিলেটের ইতিহাস বিস্মৃতির অন্ধকারে তলীয়ে গেছে। হজরত শাহজালালের আগমনের ইতিহাস থেকে জানা যায় রাজা গৌড় গোবিন্দের অনেক গুলো যুদ্ধ জাহাজ ছিল এবং ওগুলো এক একটি ভাসমান দুর্গ বলেই মতে হত। ১৭০০ সালের শেষের ইতিহাস থেকে জানা যায় সিলেটে তখন সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরী হত। এই অভ্যাস প্রাচীন অষ্ট্রিক জাতির ডিঙি নৌকা তৈরীর ধারাবাহিকতা বলেই মনে করা হয়। মুগল আমলে সিলেটে যুদ্ধ জাহাজ তৈরী করে দিল্লীতে পাঠানো হত। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের আক্রমন প্রতিহত করনে সিলেট হতে রনতরী তৈরী করে ঢাকা প্রেরণ করা হত। নবাব আলবর্দী খা’র নির্দেশে সিলেটের বানিয়াচঙের শাসককে ৪৮ খানা যুদ্ধ জাহাজ তৈরী করে পাঠাতে হয়েছিল। বৃটিশ শাসনের গোড়ার দিকে ১৭৭৮ সালে রবার্ট লিনড্সে সিলেটের কালেক্টরের দায়ীত্ব নিয়ে আসেন। তার Anecdotes of an Indian life ( এনোকডট অব এন ইন্ডিয়ান লাইফ) গ্রন্থে সিলেটের তৎকালীন অর্থনীতি ও সমাজচিত্র ফুটে উঠেছে। তার ১২ বছরের শাসন ও ব্যবসায়িক সাফল্যের উল্লেখ করে বলেন তিনি ২০ খানা সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরী করেছিলেন। “অগাষ্টা” নামে ৪০০ টন মালবাহী একখানা জাহাজ ১৭ ফুট পানি ভেঙ্গে চলতো। মাদ্রাজে দুর্ভিক্ষের সময় এই সমস্ত জাহাজে করে ৫০০০ টন চাউল প্রেরণ করা হয়েছিল। লিনডসের বিবরণ থেকে জানা যায় এই সকল জাহাজ সিলেটের কারিগর দ্বারাই তৈরী হয়েছিল এবং এর নাবিকরাও প্রায় সবাই ছিলেন সিলেটের। সিলেটে যে বন্দর ছিল তার সাক্ষ্য আজো বহন করে চলেছে সিলেটের “চালীবন্দর”। আরেকদফা আমরা লিনডসের বর্ণনা থেকে জানতে পারলাম সিলেটে একটি বিচক্ষন জাতি ছিল যারা কারিগরি বিদ্যায় পারদর্শী ছিল এবং জাহাজ নির্মান ও চালনায় সমান দক্ষ ছিল।
(৩) কিন্তু এই দুঃসাহসী নাবিকরা কবে কিভাবে ইউরোপ আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দিকে ধাবিত হওয়া শুরু করলো তার ইতিহাস বাঙালীর প্রবাস যাত্রার ইতিহাস ঘাটলে বের হয়ে আসবে। তাতে সঠিক সন তারিখ উল্লেখ না থাকলেও এটাই বাঙালীর প্রবাস যাত্রার ইতিহাস। হজরত মোহাম্মদ (সঃ) এর জীবদ্দশায়ই আরবরা ধর্ম প্রচার ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এর জের ধরেই সিলেটে কিছু কিছু আরব মুসলমানদের উপস্থিতির ইতিহাস জানা যায়। বোরহান উদ্দীন যার পুত্র হত্যার সূত্র ধরেই শাহজালাল সিলেটে এসেছিলেন তিনিও আরবীয় ছিলেন। ১৭০০ শতাব্দীতে আরবরা নদীপথে ছড়িয়ে পড়েন সারা বিশ্বে। এই আরব নাবিকদের হাত ধরেই সিলেটিয় নাবিকরা বিশ্ববাণিজ্যে উদ্ধুদ্ধ হয়েছিলেন বলে ঐতিহাসিকদের ধারনা। ভারতীয়দের বিলাতগামী ও ইউরোপগামী যে ক‘জনের নাম লিখিত ইতিহাসে পাওয়া যায় তাদের মধ্যে ১৭৫৯ সালে মীরজাফরের কর্মচারী আব্দুল্লাহর নাম প্রথমে আসে। ১৭৬৫ সালে মীর্জা শেখ সৈয়দ ইহতেশাম উদ্দিন দিল্লীর সম্রাটের প্রতিনিধি হয়ে বিলাতে যান। ১৭৯৯ সালের ৭ই জানুয়ারী রওয়ানা দিয়ে ১৮০০ সালের ২১ জানুয়ারী লন্ডনে পৌঁছেন মীর্জা আবু তালিব। তিনি কোলকাতার বাসীন্দা হলেও বাঙ্গালী ছিলেন না। এর পরই প্রথম বাঙ্গালী বিলাত যাত্রী হিসাবে রাজা রামমোহন রায় এর নাম চলে আসে। ১৮৩০ সালের ১৫ই নভেম্বর দিল্লীর মোঘল সম্রাট ২য় আকবরের দূত হিসাবে তিনি বিলাতে যান। তখন হিন্দু রীতি অনুযায়ী কালাপানি পার হওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। রামমোহনের এই যাত্রার মধ্যদিয়ে ইতিহাসে বাঙ্গালীর প্রথম বিলাত যাত্রী হিসাবে তার নাম লিখা হয়ে গেল। অথচ রাজা রামমোহানের বিলাত যাত্রার ২১ বছর পূর্বে সিলেটের এক অকুতোভয় যুবক পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে বিলাতে পৌঁছে যান।
((৪) তাঁর নাম হচ্ছে সৈয়দ উল্লাহ। তিনি বিলেতে পৌছেন ১৮০৯ সালে। রবার্ট লিনডসে সৈয়দ উল্লাহর ঘটনা তার গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেন। সিলেটের কালেক্টর থাকাকালীন ১৭৮২ সালে মহররমের দাঙ্গা নামে সিলেট শহরে বৃটিশ বিরোধী এক সশস্ত্র যুদ্ধ হয়। ঐতিহাসিকদের মতে বৃটিশ শাসনের বিরূদ্ধে সম্ভবতঃ এটাই প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহ। বিদ্রোহী বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন হাদা মিয়া ও মাদা মিয়া। য্ুেদ্ধ উনারা দুজনই মৃত্যুবরন করেন এর সাথে সৈয়দ উল্লাহর পিতাও শহীদ হন। সৈয়দ উল্লাহ দূরে দাড়ায়ে তার পিতার মৃত্যু দেখেন। এই ঘটনার অনেকদিন পর সৈয়দ উল্লাহ পিতৃহত্যার প্রতিশোধ স্পৃহায় জ্বলে উঠেন। রবার্ট লিনডসের স্কটল্যান্ডের ঠিকান সংগ্রহ করে প্রথমে কোলকাতা পৌছেন। বিলাত গামী জাহাজে নাবিকের (লস্কর) চাকুরী নিয়ে লন্ডন হয়ে স্কটল্যান্ডে পৌছে যান। লিনডসেকে সনাক্ত করে যখন আঘাত করতে যান তখন লিনডসে তাকে ধরে ফেলেন এবং শান্ত করতে সমর্থ হন। সৈয়দ উল্লাহর সিলেটি আঞ্চলিক ভাষা থেকে তিনি নিশ্চিত হন যে সে সিলেট থেকে এসেছে। লিনডসে সৈয়দ উল্লাহকে বুঝাতে সমর্থ হন যে ঐ যুদ্ধে সৈয়দ উল্লাহর বাবা যখন আহত হয়েছিলেন তখন তিনি উনাকে বাচাতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি সৈয়দ উল্লাহর বাবার হন্তা নন। লিনডসের লিখা বইখানি ১৮৪০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের নিহত পিতার প্রতিশোধ গ্রহনে বিলাতে পৌছে যাওয়া সৈয়দ উল্লাহ প্রথম বাঙ্গালী বিলাতযাত্রী ছিলেন তাতে সন্দেহ নাই। যে দু এক ভারতীয় তখন বিলাতে গিয়েছিলেন তারা বাঙ্গালী ছিলেন না, রাজা রামমোহন সরকারী অর্থানুকুল্যে গিয়েছিলেন কিন্তু সৈয়দ উল্লাহ তার অনেক আগেই নিজের প্রচেষ্টায় জাহাজের নাবিকের চাকুরী নিয়ে বিলাতে পৌছে যান। সুতরাং বাঙ্গালীর প্রথম বিলাত যাত্রী হিসাবে সৈয়দ উল্লাহকে সেই সম্মান দিতেই হবে। সৈয়দ উল্লাহ বাঙ্গালীর জাতির কলম্বাস এতে দ্বীধা করার ফুরসৎ নাই।
রক্তে যাদের দিগ¦ীজয়ের নেশা তাদেরকে শাড়ীর আঁচলে বেধে রাখা যায় না। ১৭৪৪ সাল থেকেই কোলকাতা থেকে সমুদ্রগামী জাহাজে নাবিকের কাজ নিয়ে সিলেটিদের বের হয়ে পড়ার ইতিহাস পাওয়া যায়। ইংরেজ শাসনের প্রথম থেকেই সিলেটি নাবিকরা জাহাজে করে বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে বন্দরে পৌছে যান। ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর রেকর্ডে তার উল্লেখ রয়েছে। সেই সময়ে কোলকাতার খিদিরপুর জাহাজী নাবিকদের বিচরণভুমি বলে খ্যাতি লাভ করে। প্রায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার নাবিকের ৭৫% ই ছিলেন সিলেটি ঐ সময় সিলেটের ঘরে ঘরে এই নাবিকদের পরিচয় ছিল “কোলকাত্তী” বলে।
এখানে মজার একটি ঘটনা উল্লেখের প্রয়োজন। কোলকাতা থেকে ৩০০ মাইল দূরের সিলেটি নাবিকরা আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকাগামী জাহাজের নাবিকের হাল ধরতেন, ঠিক একই সময়ে সমুদ্রউপকূলবাসী চট্রগ্রাম ও নোয়াখালীর নাবিকরা বার্মা, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি নিকটবর্তী ব্যাতিত দূরের জাহাজে চড়তেন না। তাদের বলা হত “কিনারী”। পরবর্তীতে সিলেটি নাবিকদের হাত ধরে ধরে উনারা ইউরোপ, আমেরিকাগামী জাহাজে চাকুরী নেন। এভাবেই বাঙ্গালী জাতির এ্যাডভেঞ্চারের ইতিহাস রচিত হয়েছিল।
এই যে জাহাজীদের কথা সংক্ষিপ্ত ভাবে তুলে ধরা হল সে যাত্রা সহজ ছিল না। জনাব নুরুল ইসলাম তার প্রবাসীর কথা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধে ২০/২৫ হাজার সিলেটি নাবিকের সলিল সমাধি হয়েছে। শ্বেতাঙ্গ সাহেবদের অত্যাচার, সাগরের বৈরী আবহাওয়া, বন্দরে বন্দরে “কালা আদমী” তিরস্কার, ভাষিক সঙ্কট দেশীয় খাবারের অপ্রতুলতা, পেছনে ফেলে আসা আতœীয় পরিজনদের স্মৃতিসহ সমস্ত প্রতিবন্ধকতার বিরূদ্ধে সংগ্রামে সিলেটি নাবিকদের বিজয়ের ইতিহাসই বাঙ্গালী জাতির প্রবাস যাত্রার ইতিহাস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাবিক যারা যুদ্ধে নিহত হয়েছেন তাদের নাম রাষ্ট্রীয় ভাবে লিখিত রয়েছে অথচ সিলেটি হাজার হাজার অকুতোভয় নাবিকরা তলিয়ে গেল আটলান্টিক আর প্রশান্ত মহাসাগারের গভীরে। কেউ তাদের নামটি পর্যন্ত জানার চেষ্টা করলো না। আজ পর্যন্ততাদেরক নিয়ে কোন ইতিহাসও রচনা হলনা। লন্ডনের টাওয়ার ছিল মেমোরিয়াল এর দেয়ালে প্রথম মহাযুদ্ধে নিহত সিলেটি নাবিকদের নাম লিখা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের কোথাও ওদের নাম কেউ জানে বলে মনে হয় না। জনাব নুরুল ইসলাম “প্রবাসীর কথায়” এই নাবিকদের কথা তুলে ধরেছেন। এ পর্যন্ত বাঙ্গালীর প্রবাস যাত্রার ইতিহাস বা জাহাজীদের ইতিহাস হিসাবে এই পুস্তক খানাই বাইবেল হিসাবে গণ্য করা যায়। অন্য দিকে খুবই দুঃখের বিষয় “ কালাপানির হাতছানি-বিলেতে বাংগালীর ইতিহাস ” নামে গোলাম মুরশিদ এর ৩১৫ পৃষ্টার এক খানা বই পড়লাম , বইয়ের প্রতিটি লাইন তন্য তন্য করে খুজলাম কিন্তু সৈয়দ উল্লার ঘটনা বা নামটিও খুজে পেলাম না । অথচ সৈয়দ উল্লাহর এই ঘটনা সম্বলিত লিনডসের “এনোকডট অব এন ইন্ডিয়ান লাইফ” গ্রন্থটি কালের সাক্ষী হয়ে বৃটিশ মিউজিয়ামে এখনও রক্ষিত আছে। সৈয়দ উল্লাহ বাঙ্গালী জাতির গর্ব, বাঙ্গালীর সংগ্রামী চেতনার দৃষ্টান্ত, বাঙ্গালীর প্রবাস যাত্রার অগ্রসৈনিক, এক শ্রীহট্টিয়া কলম্বাস। শুধু এই সৈয়দ উল্লাহর ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি ইতিহাস গ্রন্থ রচনা সম্ভব। সম্ভব একটি সুন্দর চলচ্চিত্র নির্মান। অনাবাসীদেরকে নিয়ে ইতিহাস রচনা আর চলচ্চিত্র নির্মানের দায়ীত্ব প্রবাসীদেরকে ই নিতে হবে।্ ঘরে বসে থাকা অকৃতজ্ঞ বাঙ্গালীদেরকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার দায়ীত্ব প্রবাসীদের উপরই ন্যস্ত হয়েছে।
ফয়জুল হক, CRSP, CCP – , টরন্টো।
তথ্যসূত্রঃ-
১। বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাস ১ম খন্ড
২। প্রবাসীর কথা – নুরুল ইসলাম
৩। সিলেটে আমার বারো বছর – রবার্ট লিনডসে
৪। শ্রীহট্টে তাম্রশাসন – কমলাকান্ত গুপ্ত
৫। সিলেট বিভাগের প্রশাসন ও ভূমি ব্যবস্থা হাফিজুর রহমান ভূইয়া
৬। আসদ্দর রচনা সমগ্র
৭। শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত-অচ্যুত চরণ চৌধুরী তত্বনিধি
৮। শ্রীহট্ট কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক রূপরেখা
৯। সিলেটের মাটি সিলেটের মানুষ-ফজলুর রহমান
১০। চরণ ছুয়ে যাই- শংকর
১১। বাঙালীর ইতিহাস- নিহার রঞ্জন রায়
১২। কালাপানির হাতছানি-বিলেতে বাংগালীর ইতিহাস – গোলাম মুরশীদ