শত বছরের ‘ওয়াজ মাহফিল’ সংস্কৃতি ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

বাসে ওয়াজ চলছে। এক হুজুর ওয়াজ করছেন। চিৎকার করে টেনেটেনে তিনি বিভিন্ন কিচ্ছা-কাহিনী বর্ণনা করছেন। হঠাৎ ওয়াজের কিছু শব্দের মধ্যে কান দুটো আটকে গেলো, হুজুর অন্য কোনো ওয়ায়েজিনকে ইঙ্গিত করে বলছেন, ‘‘ওরে বাটপার, ওরে বাটপার, ঐ দলের দালালী ছাড়, তারপর দেখি; কি তোর খেলা কেমন হয়? আমরা হেলিকপ্টারে উঠলে হেলিকপ্টার হুজুর। তোমাদের গুরুঠাকুর হেলিকপ্টারে উঠলে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা! বাটপার, আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা দেখান যাইতো যদি আজকে বৃষ্টি না হইতো।

বুঝতে অসুবিধা হলোনা হুজুর প্রতিপক্ষ কোনো হুজুরকে লক্ষ্যকরে বিশাল সমাবেশে আগত মুসল্লিদের সামনে নিজের রাগ ঝাড়ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ সহজ সরল ঈমানদার মুসল্লিগণ কি শুনতে আসছেন? কিছু ইসলামী আলোচনা, না হিংসা-বিদ্বেষমাখা দম্ভোক্তি। এটা কি কোনো আলেমের ভাষা হতে পারে? আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত প্রদানকারী এতো অহংকারী, হিংসুটে স্বভাবের হওয়া কি উচিৎ? আল্লাহর দ্বীনের দায়ীদেও বৈশিষ্ট্যেও সাথে এ সকল কথা কি যায়? এ কথাগুলো শুনে আমি বাকরুদ্ধ, হতবাক ও মর্মাহত। ভিন্ন মতের লোকদের ব্যাপারে শিক্ষিত এ সকল আলেমদের বক্তব্য এমন হলে তার অনুসারীদের মনোভাব কেমন হবে! এ কথাগুলো ভাবতে ভাবতে শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করতে শুরু করলাম। আমাদের ছোটবেলায় শীতকালে গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন ইসলামী জলসা হতো। ওয়াজ ও দোয়ার মাহফিলে বিভিন্ন গ্রাম থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ দলে দলে ওয়াজ শুনার জন্য একত্রিত হতো। মাহফিলের একটু দূরে পাশে হাট-বাজার বসতো। দোকানিদের থেকে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন খাবার, খেলনা ও বিভিন্ন জিনিস কেনাকাটা করতো।

বাদাম খেতে খেতে আমরা ওয়াজ শুনতে বসে যেতাম। ওয়াজের ঘটনা, হুজুরের নামাজ-কালামের গুরুত্ব ও কিছু কাহিনী অনেকদিন মনে থাকতো। মধ্যরাত পর্যন্ত চলতো হুজুরের ওয়াজ। বন্ধু-বান্ধব অনেকেই রাতদূপুরে ঘওে ফিরে ঘুমাতো আর ফজরের সময় উঠা হতো না। ওয়াজের বক্তব্যে মনোজগতে সুদূর প্রসারী কোনো পরিবতর্ন তখন আসতো কি-না জানিনা বরং একটি উৎসব উৎসব ভাব যে তৈরী হতো; তা নির্দিদায় বলা যায়। সে ধারায় এখনো ইংরেজি বর্ষের অক্টোবর, আরবী বর্ষের সফর-রবিউল আউয়াল ও বাংলা বর্ষের আশ্বিন-কার্তিক নাগাদ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ওয়াজ শুরু হয়। মার্চ-এপ্রিল (জমাদিউস সানী-রজব) অবধি মাহফিল হয়ে থাকে। ছয় মাসব্যাপী সারাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই এটি অনুষ্ঠিত হয়।

কওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা, মসজিদ কমিটি, যুবসংগঠন, ওলামা সংগঠনগুলো ওয়াজ মাহফিলের আয়োজক হিসেবে ভূমিকা রাখে। তবে বিশেষভাবে চরমোনাইপন্থী মুজাহিদ কমিটির উদ্যোগে সারাবছরই মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের মুসলমানদের কাছে এটি একটি মহান কাজ। নবী-রাসূলদের প্রদর্শিত কাজ। ইসলামের মহিমান্বিত বাণী প্রচারের এ প্রক্রিয়া প্রচীনকাল থেকে চলে এসেছে। তাবেয়ী উবাইদ বিন উমাইরের কথা বলা যায়। তিনি মক্কায় বসবাস করতেন। ৬৮ হিজরীতে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার ওয়াজের মজলিসে আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বসতেন। উবাইদ বিন উমাইরের আলোচনায় প্রভাবিত হয়ে তিনি কান্নাও করতেন।

তা ছিলো কেবল কোরআন ও হাদীসের আলোচনা; তাকওয়ায় পরিপূর্ণ, ভ্রাতৃত্বাবোধে সমৃদ্ধ ও আন্তরিকতার চাদরে মোড়ানো দ্বীনি চেতনায় উজ্জিবীত। তাওহিদ, আখেরাত ও আল্লাহর নেক বান্দাহ হওয়ার আলোচনা হতো। মোখরোচক কাহিনী নির্ভর বা ধারণা প্রসূত কোনো বক্তব্য তিনি দিতেন না। ইবনে যুবাইর আন্দালুসি ৫৮১ হিজরীতে জামেয়া নিজামিয়া বাগদাদের এক ওয়াজের মজলিসে বসেছিলেন। তিনি তার ভ্রমনকাহিনীতে সেই মজলিসের বিবরণ দিয়েছেন এভাবে, ‘আমরা প্রথমে জামিয়া নিজামিয়ার উস্তাদ শায়খ রাযিউদ্দিন কাযভিনির ওয়াজে বসি। দিনটি ছিল ৫ই সফর। শায়খ হাদিস ও তাফসির থেকে ওয়াজ করছিলেন। তার কথা শুনে শ্রোতারা কান্না করছিল। পুরো মজলিসে ছিল কান্নার রোল। লোকজন পাপাচার থেকে তওবা করছিল। কেউ কেউ লিখিত প্রশ্ন করছিল।

শায়খ এসকল প্রশ্নের জবাব দেন। যা ছিলো কোরআন ও হাদীস থেকে নিসৃত। খোদাভীতির চেতনায় সমৃদ্ধ।’ আবার এমনিভাবে শায়খ আবুল কাসেম কুশাইরি যখন নিশাপুরের মুতাররায মসজিদে ওয়াজ করতেন তখন শ্রোতারা তন্ময় হয়ে শুনতো। তার ওয়াজ সম্পর্কে একজনের বক্তব্য ছিল, যদি শয়তানও তার মজলিসে বসে, তাহলে হয়তো সেও তওবা করে ফেলবে। এতো আকর্ষনীয় ও যুক্তিনির্ভর এবং কোরআন হাদীসভিত্তিক ছিলো সে বক্তব্যগুলো। নির্ভেজাল তাওহিদের কথা বলাই তাদের একমাত্র কাজ ছিলো। অন্যদিকে ইবনুল জাওযি রহিমাহুল্লাহ যখন বাগদাদে ওয়াজ করতেন তখন শ্রোতাদের কেউ কেউ বেহুশ হয়ে যেত। অনেকেই কান্না করতো। অন্তত বিশ হাজার ইহুদি-খ্রিস্টান তার হাতে কালিমা পড়ে মুসলমান হয়েছিল। তওবা করেছিল প্রায় এক লক্ষ লোক। কতোটা আকর্ষনীয় ও যুক্তিগ্রাহ্য ছিলো সে বক্তব্য। দুনিয়াবী কোনো লোভ-লালসায় তারা এ নসিহতমাখা ওয়াজ করেননি। ছিলো না কোনো আত্ম অহংকার বা ওয়াজ করার পর হাদীয়া গ্রহণ। এ ভাবে হাসান বসরির ওয়াজের মজলিসের কথাও ইতিহাসে বিখ্যাত। ওয়াজের মজলিস থেকেই তিনি জনগনের সংশোধনের কথা আলোচনা করেছেন। আবার হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মত জালিম শাসকের বিরুদ্ধে সত্য উচ্চারণ থেকেও বিরত থাকেননি তিনি। তৎকালিন জনজীবনে এসব ওয়াজ মাহফিলের প্রভাব ছিল অপরিসীম ও সুদূরপ্রসারী। ইবনুল জাওযির ওয়াজে কখনো কখনো এক লক্ষ মানুষও হতো। লোকজন তন্ময় হয়ে তার দারস শুনতেন এবং তাদের ‘ইলমি মাহারাত’ তৈরী হতো। ইমাম গাজ্জালি যখন জামেয়া নিজামিয়া বাগদাদে ওয়াজ করতেন তখন প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষ একত্রিত হত। সে সময় আলেমরা মুসলিম বিশ্বের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে নিয়মিত সফর করতেন শুধু ধর্মেও মৌলিক বাণী প্রচারের নেশায়।

তারা নতুন কোনো শহরে গেলে সেখানে হাদিসের দারসে বসতেন, অথবা হাদিসের দারস নিজেরা দিতেন। রিয়া বা অহংকার তাদের বক্তব্যে কখনও ফুটে উঠতো না। বরং তাকওয়ার বৈশিষ্টাবলীর আলোকচ্ছটায় বিমোহিত হতো দরবারের আলোচনায় অংশগ্রহণকারী শ্রোতাগণ। কখনো কখনো তাদের ওয়াজের মজলিস দীর্ঘ সময় ধরে অনুষ্ঠিত হত; যা রূপ নিতো দ্বীনি চেতনায় ইলমি মারকাজের। এমনিভাবে ঈসা বিন আবদুল্লাহ গযনভী ৪৯৫ হিজরীতে বাগদাদে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি বেশকিছু মজলিসে ওয়াজ করেছিলেন। ভারতবর্ষে সুলতানি আমল থেকেই ওয়াজের প্রচলন ছিল। সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনকালে নাসিরুদ্দিন নামে একজন বিখ্যাত ওয়ায়েজ ছিলেন। তার ইসলামের মৌলিক বিধানাবলী বর্ণনার আকর্ষণীয় উপস্থাপনের কারণে সুলতান তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন।

সুলতান তার বসার জন্য একটি মিম্বার নির্মান করে দেন। সুলতান নিজেও তার ওয়াজে বসতেন। ওয়াজ শেষে তার সাথে কোলাকুলি করতেন। হিজরী নবম শতাব্দীতে মাওলানা শোয়াইব দিল্লীতে ওয়াজ করতেন। শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী তার প্রশংসা করেছেন। মাওলানা আলাউদ্দিন আউধি দিল্লীতে ওয়াজ করতেন। ওয়াজে তারা কবিতাও আবৃত্তি করতেন। যেমন শায়খ তকিউদ্দিন তার ওয়াজে চান্দায়ন নামে একটি গ্রন্থ থেকে হিন্দী কবিতা আবৃত্তি করতেন। ১৮০০ সালের ১২ জুন মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী ভারতের উত্তর প্রদেশের জৈনপুরে জন্মগ্রহণ করেন। সৈয়দ আহমাদ বেরেলভী তাকে সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে বাংলা ও আসাম অঞ্চলে ওয়াজ-নসীহত ও লেখনীর মাধ্যমে সমাজ সংস্কার ও ধর্মপ্রচারের নির্দেশ দেন। এর সুবাদে কারামত আলী (রহ.) নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, আসাম, রংপুরসহ বেশকিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরেছেন। উইলিয়াম হান্টার রচিত ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ গ্রন্থের তথ্যমতে, উত্তর-ভারতের আলেম সমাজ ফরায়েজীপন্থীদের তৎকালীন ভারতে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যে ‘দারুল হরব’ ফতোয়া ঘোষণা করা হয়েছিল, এর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী। ইতিহাসে তা কলকাতা মোহামেডান সোসাইটির ফতোয়া হিসেবে স্বীকৃত। সেখানে তিনি ভারতবর্ষকে দারুল ইসলাম হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, যেখানে জিহাদ করা আইনসঙ্গত নয়। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মে কারামত আলী ইন্তেকাল করেন। রংপুর মুন্সীপাড়া জামে মসজিদের পাশে তার মাজার রয়েছে।

আসলে ওয়াজ শব্দের শাব্দিক অর্থ উপদেশ, নসিহত। মূলত ওয়াজ হলো, মানুষের মধ্যে দ্বীনি ইলম প্রচার ও মানুষকে ঈমান আমলের প্রতি মনোযোগী করার একটি অন্যতম পদ্ধতি। কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, তুমি উপদেশ দিতে থাকো, কারন উপদেশ মুমিনদেরই উপকারে আসে। (সুরা যারিয়াত, আয়াত ৫৫)। রাসূল সা: বিদায় হজ্বের ভাষণে বলেছেন, ‘আজকের উপস্থিত লোকজন অনুপস্থিত লোকদের কাছে (দ্বীনি দাওয়াত) পৌছে দেবে।’ ওয়াজ মাহফিল এই আয়াত ও হাদীসের নির্দেশের উপর আমল করার শক্তিশালী মাধ্যম। তবে ওয়ায়েজদেরও কিছু যোগ্যতা অর্জন করা আবশ্যক। তাদের কোরআন, হাদিস ও ফিকহের উপর তাদের পারদর্শিতা থাকা আবশ্যক। ইখলাসের সাথে সঠিক কথা বলার সঠিক পদ্ধতি রপ্ত করাও গুরুত্বপূর্ণ। ইখলাসের সাথে উম্মাহর কল্যানের জন্য যে কথা বলা হয় তা মানুষের অন্তরে রেখাপাত করে। তবে শুরু থেকেই আজকের মতো ওয়ায়েজদের একাংশের প্রবনতা ছিল আজগুবি গল্প-কাহিনী বলে জনসাধারণের মনোযোগ আকর্ষন করা। এভাবেই অনেক জাল হাদিস ও বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনীর সূচনা হয়।

এ থেকেই বিদআতি কর্মকান্ডের প্রচার ও প্রসার ঘটে। এ কারণে নিজাম উদ্দিন আউলিয়া ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় হাদীস প্রচার করার ক্ষেত্রে মানুষের বাধার সম্মুখিন হন। মানুষ হাদীসের চেয়ে বাপ-দাদার রোসম-রেওয়াজকে বেশী গুরুত্ব দিতে থাকে। ‘ইলমে হাদীসের ক্রমবিকাশে ভারতীয় উপমহাদেশের অবদান’ বিষয়ক ড. ইসহাকের বইতে বিস্তারিত আলোচনা এসছে। এই ধরনের গল্পকারদের বলা হতো কাসসাস। জালালুদ্দিন সুয়ুতি এই ধরনের গল্পকারদের সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করে লিখেছেন, ‘তাহজিরুল খাওয়াছ মিন আকাজিবিল কাসসাস’ নামক গ্রন্থ। ইমাম ইবনে তাইমিয়া এইসব গল্পকারদের বানোয়াট হাদিসগুলো একত্রিত করে দিয়েছেন ‘আহাদিসুল কাসসাস’ নামক গ্রন্থে। ইবনুল জাওযি এ ধরনের ওয়ায়েজদের সম্পর্কে লিখেছেন, ওয়ায়েজদের অনেকের কথাই অন্তসারশূন্য। তাদের ওয়াজের বিরাট অংশ হজরত মুসা (আ) ও তুর পাহাড়ের কাহিনী এবং ইউসুফ (আ) ও জুলায়খার কাহিনী দিয়ে ভরপুর। এসব ওয়াজ নসিহতে ইসলামের ফরজ বিধান নিয়ে আলোচনা নেই, কী করে গোনাহ থেকে বাচা যায় তা নিয়েও আলোচনা নেই।

মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের বহুমাত্রিক সমস্যা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। তাহলে এসব ওয়াজ দ্বারা কী করে একজন সুদখোর ও ব্যাভিচারী তওবা করতে আগ্রহী হবে? ওয়ায়েজিনরা শরিয়তকে পেছনে ঠেলে দিয়েছে; সহমর্মিতা, আন্তরিকতা ও ভালবাসার স্থলে পারস্পরিক কাদাছুড়াছুড়ি, হিংসা-দ্বেষ ও আত্মঅহংকারে লিপ্ত হয়েছে। ফলে তাদের আয় বেড়েছে, জনপ্রিয়তা বেড়েছে। বৃহত্তর মুসলিম সংহতির ধ্বস নেমেছে। বিভক্তি চরম আকার ধারণ করেছে। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমেছে। নবী-রাসূলদের এ মহান বিশুদ্ধ দাওয়াতী কর্মতৎপরতার উপর সাধারণ জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

আমাদের এ দেশে এক সময় ভারতের মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরির ওয়াজের মাধ্যমে হাজারো মানুষের জীবন বদলে গিয়েছিল। পরবর্তীতে এই ধারায় মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিসবাহ (র), মাওলানা সিদ্দিক আহমদ চাটগামি (র), মাওলানা আবদুর রহমান জামি (র), মাওলানা দেলোয়ার হুসাইন সাইদি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। কিন্তু ধীরে ধীরে ওয়াজ মাহফিলগুলো হয়ে উঠেছে অন্তসারশূন্য। বেশিরভাগ শ্রোতার আকর্ষণ কিচ্ছা-কাহিনী ও সুরের মূর্ছনার দিকে। কেউ কেউ মুরিদানকে জজবায় সরগরম রাখার জন্যে বিভিন্ন হালকায়ে যিকিরের আয়োজন করেন। এ ক্ষেত্রে নবী সা: এর অনুসৃত জিকিরের পদ্ধতি বাদ দিয়ে ‘ইল্লাল্লাহ-ইল্লাল্লাহ, হু-হু, আল্লাহু-আল্লাহু’ জিকির চালু করে দিয়েছেন। অনেক সময় উপস্থিত শ্রোতা নেচে-গেয়ে, লাফিয়ে বেহুশ হয়ে যান, বাঁশে উঠে যান, স্টেজে স্বয়ং ওয়ায়েজিনকে ঝাপটে ধরেন। এ এক আজব দৃশ্যের অবতারণা হয়। কেউ কিন্তু কাটাযুক্ত গাছে উঠেন না। আবার বাজারদর বাড়াতে এক শ্রেনীর বক্তাও শ্রোতাদের চাহিদা পূরনে বদ্ধপরিকর। ওয়াজের চেয়ে আওয়াজ করাটাই হয়ে উঠছে মূখ্য উদ্দেশ্য। সাধারণ কথাও টেনে টেনে লম্বা করে ‘ঐ যুবক’ বলে চিৎকার করে সম্বোধন করেন। অনেক সময়ে গল্প বলতে বলতে ‘সাপের খেলাফত’ লাভ পর্যন্ত বলে ফেলেন। যোগ্য আলোচকদের চেয়ে অযোগ্যদের জনপ্রিয়তাই এখানে এখন অনেক বেশি। কেউ কেউ ওয়াজের মাহফিলকে যাত্রাপালার মঞ্চ বানিয়ে ছেড়েছে। হাসেন, রস দেন। মিথ্যা কথা-কাহিনীকে গল্পে রূপদান করে মোখরোচক ও আকর্ষনীয় করে উপস্থাপন করেন। কক্সবাজারের এক মাহফিলে চট্টগ্রামের এক ওয়ায়েজিন হুজুর শুধু গালাগাল করতে থাকেন আল্লামা শফী থেকে শুরু করে আল্লামা মিজান আজহারী পর্যন্ত সকলকে। ইউটিউব ও সোস্যাল মিডিয়ায় দেখা গেছে এ গালাগালের দৃশ্য। গত কয়েকদিন আগে তাকে আইসিটি মামলায় পুলিশ গ্রেফতার করেছে।

এ সব ওয়াজের নামে অনৈসলামিক কর্মকা- এখনি থামাতে হবে। সত্যিকারের দ্বীনী চেতনা থাকলে তবে চাইলেই এ নৈরাজ্যকর অবস্থা ও পরিস্থিতি বদলানো যায়। ওয়াজ মাহফিল গুলোতে সরকার ও আইন শৃঙ্খলা বিরোধী এবং মুসলিম অনৈক্য তৈরী করে এমন বক্তব্য যেনো না দেওয়া হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। বক্তব্য হতে হবে কোরআন ও হাদীসের দলিল ভিত্তিক; কোনো গাল-গপ্পো নং। ইদানিং অবশ্যই আলোচকদের অনেকেই এখন দলিল ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনার দিকে ঝুকছেন। পথটি কঠিন, তবে শ্রোতাদের অভ্যস্ত করে তুলতে পারলে পুরো ময়দানের চেহারাই বদলে যাবে। বিশেষ করে আয়োজকদের কিছু বিষয় খেয়াল রাখা দরকার। জনতার চাহিদার দিকে না তাকিয়ে যার আলোচনায় জনগনের ঈমান আমলের ফায়দা হবে তাকেই আমন্ত্রণ করা উচিত। নিজ মতের বিরুদ্ধে কাউকে পেলে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে গর্জে উঠে ময়দানে ঝড় তোলা বক্তাদেরকে পরিত্যাগ করা উচিত।

যারা কথায় কথায় হিংসা-বিদ্বেষ ও কাফির ঘোষণা করে তাদের সরকারী ভাবে নিষিদ্ধের পাশাপাশি বয়কট করতে হবে। শহরাঞ্চলে মাঠের বাইরে অনেকদূর পর্যন্ত মাইক লাগিয়ে জনগনের ভোগান্তি বাড়ানো হয়, আয়োজকরা চাইলেই এটি পরিহার করতে পারেন। ওয়াজ মাহফিলে বক্তাদের সম্মানী নিয়ে পাওয়া গেছে বিভিন্ন ধরনের তথ্য। একশ্রেণির বক্তারা সম্মানী নিয়ে দরকষাকষি করেন, এমন তথ্য কোনও কোনও আলেম জানালেও তারা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। তবে মাহফিলেই চরমোনাইপন্থী বক্তা মাওলানা শামসুল হক শ্রোতাদের জানান, তিনি প্রতি ওয়াজে ৩০ হাজার টাকা করে নেন। তা না হলে তিনি মাহফিলে যান না (বাংলা টিবিউন)। বক্তাদের কয়েকজন জানান, যাতায়াত, খেদমতে নিযুক্ত খাদেম, সংসার পরিচালনার ব্যয়ভার করতে গিয়ে হাদিয়া নিতে হয়, কখনও বলে-কয়ে নেন তারা। নরসিংদীর বক্তা মাওলানা মাজহারুল ইসলাম মাজহারী ওয়াজে নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানান, তিনি ডিম বিক্রি করে পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছেন। এখন তার কোটি টাকা, গাড়ি-বাড়ি সবই আছে। এ বিষয়ে ইউটিউবে তার একটি ভিডিও থাকলেও তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একটি মাহফিলে মাওলানা শামসুল হক নওমুসলিম ওরফে রানা মাস্তান বলেন, ‘আমি প্রতি মাহফিলে ৩০ হাজার টাকা করে নিই। আমার মাদ্রাসা চালাইতে লাগে, তাই নিই আমি। আমারে দিতে পারলে নিবেন, না হলে কষ্ট হলে অন্য বক্তা দিয়ে করেন। আমি খুশি।’

মাওলানা শামসুল হকের মন্তব্য, ‘ওয়াজের বক্তাদের ফ্ল্যাট করতে বেশি সময় লাগে না! তিন দিনের বক্তাও ফ্ল্যাট কিনেছে ঢাকায়। একেক বক্তা ঢাকা শহরে কী ডাটে বাড়ি বানাইছে জানেন আপনারা? চাইলে এক মাসের ইনকাম দিয়া গাড়ি কিনতে পারি আমি। কিন্তু মাদ্রাসা পরিচালনা করতে গিয়ে পারি না।’

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই ওয়াজ মাহফিল শুরু করেন মাওলানা হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদী। দেশ ও দেশের বাইরে তিনি যুক্তিবাদী হিসেবে পরিচিত। কেবল ওয়াজ করেই চলছে তার পেশাগত জীবন। যদিও তিনি মাহফিলকে পেশা হিসেবে দেখতে নারাজ। বাংলা ট্রিবিউনকে হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদী বলেন, ‘ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য দেওয়াকে পেশা হিসেবে নেওয়া ঠিক না। এখানে উদ্দেশ্য হতে হবে হেদায়েতের। মানুষকে ভালো ও সুন্দর কথা শোনাতে হবে। দেশ স্বাধীনের পরপরই ওয়াজ শুরু করেছিলাম। তবে কখনও চুক্তি করি নাই। বুঝিও না ব্যাপারটা। কিছু বক্তা আছে চুক্তি-টুক্তি করে।’

কেউ কেউ আছেন হেলিকপ্টার ছাড়া যান না। ৫০ হাজার টাকা দিয়ে নিলেও তিনি ৪৫ মিনিট ওয়াজ করে চলে আসতে চাওয়ায় এন্তেজামিয়া কমিটির সাথে তার বাকবিত-া ইউটিউবে দেখা যায়। ইসলামের এ মহান দাওয়াতী কাজের এ মাধ্যমটিকে এসব ভাড়াটে হুজুররা কলুষিত করছে বলে অনেকেই মনে করেন। অথচ এ মাধ্যমে দেশের আমজনতা বিশেষকরে সরকার তার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে জনসাধারণের নিকট সহজভাবে পৌছাতে পারেন। আমাদের যুবকরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে, মাদকের ছোবল থেকে তাদের রক্ষার বিষয়ে কোরআন ও হাদীস দিয়ে তাদের বুঝানো যেতে পারে। বাল্যবিবাহ, যৌতুকবিরোধী প্রচারণায় আলেম সমাজ এ ওয়াজকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। দূর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত পুরো সমাজ। ইসলামে দূর্নীতির কোনো স্থান নেই। এটি কবিরা গুনাহ; এতে অন্যের অধিকার লুণ্ঠিত হয়। এই মর্মে আলেম সমাজ ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য রাখতে পারেন।

ইভটিজিং, যৌতুক, নারী নির্যাতন, ধর্ষন ও জঙ্গিবাদসহ ভয়াবহ সামাজিক এ ব্যাধির বিরুধ্যে জনসচেতনতা তৈরী ও জনসচেতনতায় এ ওয়াজ মাহফিলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষ করে নারীরা তাদের পিতা-মাতার উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়; অধিকাংশ অভিভাবক ঠিকমতো তাদের প্রাপ্য হিস্সা তাদের দেয় না। এ বিষয়েও ওয়াজগুলোতে আলোচনা হতে পারে।

যে সমস্ত ওয়ায়েজিনগণ পারস্পরিক গালাগাল করেন, দেশ-বিরোধী বক্তব্য রাখেন অথবা আন্ত:ধর্মীয় সম্পর্ক বহাল রাখার পরিবর্তে উস্কানীমূলক বক্তব্য প্রদান করেন, তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি উচ্চতর ইসলামী চিন্তাবিদদের নিয়ে বোর্ড গঠন করা যেতে পারে। সর্বোপরি কথা হলো কাউকে হেয়প্রতিপন্ন করা, গালাগাল দেওয়া কোনক্রমেই ওয়াজ মাহফিলের চরিত্রের সাথে যায় না। এ বিষয় সকল ওয়ায়েজিনদের সতর্ক থেকে শতবছরের দাওয়াতে দ্বীনের এ পথকে কলুষিত করা ঠিক হবে না। এতে করে মানুষ হেদায়েতের পরিবর্তে বরং গোমরাহীর পথকেই বেচে নিবে। এ সকল অপতৎপরতা যা ইসলামের জন্য ক্ষতিকর তা থেকে বিরত থাকতে হবে।

মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
পিএইচডি গবেষক
ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

বি: দ্র: লেখাটি পূর্বপ্রকাশিত : SomayNews24.Com

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *