লিবিয়ায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও শান্তি উদ্যোগ

শেষ পর্যন্ত লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধরত দুই পক্ষ জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত ত্রিপোলি সরকার ও মিসর-সৌদি-আমিরাত সমর্থিত জেনারেল হাফতার বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও এখনো চুক্তি চূড়ান্ত স্বাক্ষর হয়নি। গত সোমবার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জাতীয় সরকারের (জিএনএ) প্রধান ফয়েজ আল-সররাজ এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী কমান্ডার খলিফা হাফতার রাশিয়ায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করার জন্য মস্কো গিয়েছিলেন। জিএনএ’র পক্ষে সররাজ চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও হাফতার চুক্তি স্বাক্ষর ছাড়াই মস্কো ত্যাগ করেন।

প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগানের মধ্যেকার আঙ্কারা আলোচনা শেষে এই দুই নেতা ১২ জানুয়ারির মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের আহ্বান জানিয়েছিলেন। জেনারেল হাফতার প্রাথমিকভাবে যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব দেখালেও শেষ পর্যন্ত দুই শক্তিধর দেশের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করেন এবং চুক্তি স্বাক্ষর করতে মস্কো যান।

যে দু’টি দেশের শীর্ষ নেতার বৈঠকে লিবিয়া পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয় তার মধ্যে তুরস্ক আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ত্রিপোলি সরকারের সাথে সম্প্রতি এক সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তিটি তুর্কি সংসদে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় অনুমোদনও করা হয়। অন্য দিকে, পূর্বের সীমান্তবর্তী শহর তবরুকভিত্তিক হাফতারের লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (এলএনএ) সরকারকে রাশিয়া সামরিক ঠিকাদারদের মাধ্যমে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। হাফতারের সরকারকে শুরু থেকে সৌদি আরব মিসর ও আরব আমিরাত এবং সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বশির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সুদান সহযোগিতা দিয়ে আসছিল।

মূলত হাফতারের প্রতি অন্যান্য দেশের সহযোগিতার সাথে রাশিয়ান সামরিক সহযোগিতা যুক্ত হওয়ার পর মাঠের দৃশ্যপট পাল্টে যায়। অন্য দিকে, জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত ত্রিপোলি সরকার হাফতারের আক্রমণে কোণঠাসা অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ায় তুরস্ক-কাতারের সহায়তা জোরদার হওয়ার পর।

লিবিয়ায় রাশিয়া-তুরস্ক সমঝোতা উদ্যোগে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরে ব্যর্থতার পরে মূলত নতুন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান আগামী রোববার অনুষ্ঠেয় বার্লিন সম্মেলনের আগে ত্রিপোলি সরকারকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি পুনঃনিশ্চিত করেছেন।

লিবিয়ার ন্যাশনাল আর্মির (এলএনএ) কমান্ডার খলিফা হাফতার যুদ্ধবিরতির খসড়া প্রস্তাবে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে চুক্তি সম্পাদনের প্রচেষ্টা কার্যত ব্যর্থ হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় এরদোগান মঙ্গলবার বলেছেন, ‘তিনি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লিবিয়া সরকার (জিএনএ) সরকারকে রক্ষার জন্য কাজ করবেন। তুরস্কের সংসদের সামনে দেয়া বক্তব্যে এরদোগান বলেন, হাফতার যুদ্ধবিরতি চুক্তি থেকে ‘পালিয়ে’ গেছে। ত্রিপোলিতে এলএনএ বাহিনী তাদের ১০ মাসব্যাপী আক্রমণ যদি অব্যাহত রাখে তবে তুরস্ক পূর্ব লিবিয়ার কমান্ডারকে ‘একটি উচিত শিক্ষা’ দেবে। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের দায়িত্ব শেষ করেছি; বাকিটা পুতিন এবং তার দলের দায়িত্ব।’

আগামী রোববার শান্তি আলোচনার পরবর্তী দফা বার্লিন সম্মেলনে অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত হয়েছে। সেখানে বিশ্বনেতারা ২০১১ সালে গাদ্দাফির পতনের পর থেকে চলে আসা লিবিয়ার সঙ্ঘাতের অবসান ঘটাতে আরো একবার চেষ্টা করবেন।

মস্কোর আলোচনা নিষ্ফল হলেও, কিছু বিশ্লেষক মনে করেছেন যে, যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা এবং লিবিয়ার বিরোধীদের আলোচনায় আনতে সফল হওয়া রাশিয়ান ও তুর্কি নেতৃত্বের জন্য একরকম কূটনৈতিক জয়। সিরিয়ায় আস্তানা প্রক্রিয়ার মতোই এ ক্ষেত্রে রাশিয়া ও তুরস্ক পশ্চিমা ক্লাসিক কূটনীতির সমান্তরাল এক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করছে। রাশিয়া এবং তুরস্ক উভয়েই সম্ভবত লিবিয়ায় সহিংসতার অবসানের চেষ্টা করবে। কারণ লিবিয়ায় টানা প্রক্সি যুদ্ধের সামর্থ্য তাদের নেই।

২০১২ সালের এপ্রিল থেকে প্রধানমন্ত্রী ফয়েজ আল সররাজের নেতৃত্বে ত্রিপোলিভিত্তিক সরকার ইতালি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্কের নৈতিক বা কার্যকর সমর্থন নিয়ে এলএনএ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। হাফতারের স্থল আক্রমণটি প্রথমে ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে। পরে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং রাশিয়ান বেসরকারি সংস্থা ওয়াগনার গ্রুপের চালিত ভাড়াটেদের বিমান সহায়তায় ত্রিপোলির দক্ষিণে তারা ক্রমাগতভাবে এগিয়ে গেছে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এলএনএ বাহিনী কৌশলগত বন্দর শহর সির্তে দখলের দাবি জানায়। এই অবস্থায় তুর্কি কর্মকর্তারা সররাজের জিএনএ বাহিনীর জন্য কৌশলগত ও বৈষয়িক সমর্থন বাড়িয়েছেন। বিশেষত আঙ্কারা ও ত্রিপোলির মধ্যে নভেম্বরে একটি সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে দু’টি দেশের মধ্যে নতুন সামুদ্রিক সীমানা নির্ধারণ হওয়ার পর এই সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়।

ইস্তাম্বুল আয়িন ইউনিভার্সিটির আফ্রিকা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান সিদাত আইবার বলেছেন, ‘লিবিয়ায় তুরস্ক তার উদ্যোগ আরো এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে এবং স্থায়ী শান্তিচুক্তির জন্য কাজ করবে, যার মধ্যে হাফতার ও তার প্রতিনিধিত্বকারী জোট বাহিনীও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তুরস্ক বৈধ সরকারের কাছ থেকে অনুরোধের ভিত্তিতে সামরিকভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেও পিছপা হবে না।’

ক্লিনজেন্ডেল ইনস্টিটিউটের গবেষণা সহযোগী জালেল হারচাউই উল্লেখ করেছেন যে, রাশিয়া-তুরস্কের নেতৃত্বাধীন শান্তি আলোচনা অগ্রগতি ছাড়াই মূলত সোমবার শেষ হয়েছে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির অভাবে। সোমবারের আলোচনায় সর্বশেষ অধিকৃত লাইন অনুসারে স্থিতি থাকবে নাকি ৪ এপ্রিলের আগের লাইন বজায় থাকবে তা নিয়ে বিরোধের অবসান আগে থেকে করে রাখা হয়নি। জিএনএ বাহিনী প্রাক আক্রমণাত্মক লাইনে ফিরে যেতে চেয়েছিল।

হারচাউই বলেন যে, ‘বার্লিন সম্মেলনে এবং এর বাইরেও ঐকমত্যে পৌঁছতে হাফতারের বাহিনীর ওপর রাশিয়ার যে প্রভাব তা কাজে লাগাতে হবে। সামরিক সহায়তা ছাড়াও রাশিয়া এলএনএ সেনাদের ‘অর্থনৈতিক লাইফলাইন’ হয়ে গেছে। হাফতারের বাহিনীকে প্রদত্ত লিবিয়ার দিনার রাশিয়ায় ছাপা হয়েছে। ২০১৬ সালের মে থেকে প্রায় ১২ বিলিয়ন রাশিয়ান-মুদ্রিত দিনার হাফতারকে দেয়া হয়েছে, যা মস্কোকে সেখানকার উন্নয়নের বিষয়ে অন্যভাবে প্রভাবিত করেছে।

লিবিয়ায় ইউরোপীয় নেতারা যে সুবিধাজনক অবস্থান বজায় রেখেছেন তার সম্পূর্ণ বিপরীতে নতুন সংশ্লিষ্টতা এসেছে। জার্মানি, ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সরকারগুলো লিবিয়ার দ্বন্দ্ব নিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত বারবার বিলম্বিত করেছে। গত নভেম্বর মাসেও বার্লিন সম্মেলন একবার স্থগিত করা হয়েছিল। তারা হয়তো আশা করেছিলেন এর মধ্যে হাফতার পুরো লিবিয়ায় কর্তৃত্ব স্থাপন করে ফেলতে পারবেন। কিন্তু এর মধ্যে তুরস্কের বিশেষ সক্রিয়তায় মাঠপরিস্থিতি পাল্টে যায়। চলতি মাসের শুরুর দিকে তুরস্কের সেনা মোতায়েন স্থিতিশীল শান্তিতে পৌঁছানোর প্রয়াসকে নতুন করে জরুরি করে তোলে।

আসলে লিবিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধ এবং কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে দেশটিতে যে বিপুল জ্বালানি তেলের মজুদ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে তাতে ভাগ বসানোর প্রতিযোগিতা। এর সাথে আরো রয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও কর্তৃত্ব দখলের লড়াই। ১৯৫০-এর দশকে তেল আবিষ্কারের পর থেকে লিবিয়া আফ্রিকার সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর একটি। তবে এখনো এখানকার অনেক লোক খামার ও পশুচারণের কাজে নিয়োজিত, যদিও ভালো খামারভূমির পরিমাণ অত্যন্ত কম।

১৯৫১ সালের ২৪ ডিসেম্বর লিবিয়া স্বাধীনতা লাভের পর রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৯ সালে কর্নেল মোয়াম্মার গাদ্দাফি দেশটির শাসনক্ষমতা নেয়ার পর একধরনের কর্তৃত্ববাদী জনকল্যাণমূলক শাসনের প্রবর্তন করেন। প্রাথমিক পররাষ্ট্র কৌশলের ক্ষেত্রে সোভিয়েত বলয়ে অবস্থান নেন তিনি। ’৮০-এর দশকের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়ে একক পরাশক্তি আমেরিকার বিশ্ব শাসন শুরু হলে গাদ্দাফি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের সাথে সমঝোতা করেন। অন্য দিকে, আঞ্চলিকভাবে শক্তিধর রাষ্ট্র সৌদি আরবের সাথে যে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত সেটিকেও নমনীয় করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এর মধ্যে লিবিয়ায় গাদ্দাফির শাসনের অবসান ঘটানোর গোপন সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী পশ্চিমা দেশগুলো।

বৈশ্বিক প্রভুত্ব বিস্তারের ক্ষেত্রে আমেরিকা ও তার সহযোগীদের ইচ্ছার বিপরীতে পাল্টা কোনো অবস্থান নির্ধারণের অবস্থা তখনো রাশিয়া-চীন বা অন্য কোনো শক্তি সৃষ্টি করতে পারেনি। ২০১১ সালের পর থেকে আরব বসন্ত বা গণবিক্ষোভ শুরু হয় আরবের দেশে দেশে। এর রেশ ধরে লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে হত্যার মাধ্যমে তার শাসনের চূড়ান্ত অবসান ঘটানো হয়। এরপর নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালুর প্রচেষ্টা বারবার ব্যাহত হয়। গাদ্দাফি-উত্তর নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামিস্টরা অধিক আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী পক্ষগুলো লিবিয়াকে খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলে বিবদমান বিভিন্ন গোষ্ঠীকে মদদ দিয়ে।

এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ মেরুকরণে যে দু’টি পক্ষ সৃষ্টি হয় তার একটি হলো ত্রিপোলিভিত্তিক জিএনএ সরকার আর অন্যটি হলো তবরুকভিত্তিক জেনারেল হাফতারের এলএনএ সরকার। লিবিয়ায় নতুন সঙ্ঘাত শুরু হয়, সামরিক কমান্ডার খলিফা হাফতার গত এপ্রিল মাসে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে আক্রমণ শুরু করার পর। ত্রিপোলিতে অবস্থিত জাতিসঙ্ঘ-অনুমোদিত জাতীয় চুক্তির (জিএনএ) সরকার হাফতারকে রাজধানী শহর দখল করতে বাধা দেয়।

যুদ্ধের সাম্প্রতিক ক্রমাবনতির পরে, জাতিসঙ্ঘ গত বুধবার তুরস্ক ও রাশিয়াকে স্বাগত জানায়। এই বিরোধে বিপরীত পক্ষকে সমর্থন করে আসছে এই দুই দেশ। বিরোধের সাথে যুক্ত উল্লেখযোগ্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত। আমিরাতের বহু বিশেষজ্ঞ খলিফা হাফতারকে সহযোগিতা করছে। নভেম্বরে প্রকাশিত জাতিসঙ্ঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত রাশিয়ার তৈরি প্যান্টসির এস-১ উন্নত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও হাফতারকে সরবরাহ করে, যা ঘড়িয়ান শহরের কাছে আল-জুফ্রা বেসে স্থাপন করা হয়। ২০১৩ সালে জাতিসঙ্ঘের একটি পৃথক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউএই পূর্ব লিবিয়ার আল খাদিমে একটি বিমানবন্দর তৈরি করে দেয় এবং হাফতারকে বিমানের পাশাপাশি সামরিক যানবাহন সরবরাহ করে। আমিরাত হাফতারকে রাজনৈতিক ইসলামের বিস্তার রোধ বিশেষত মুসলিম ব্রাদারহুডকে প্রতিরোধে সক্ষম বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার হিসাবে বিবেচনা করে।

আমিরাতের মতো, জেনারেল সিসির নেতৃত্বাধীন মিসর মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ থেকে হাফতারকে স্বাভাবিক মিত্র হিসাবে গ্রহণ করে। মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান এবং ব্রাদারহুডের সদস্য মোহাম্মদ মুরসিকে পদচ্যুত করার পর ২০১৩ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আল-সিসি ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সিসি ব্রাদারহুডকে একই বছর বেআইনি ও ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন ঘোষণা করেন। কায়রোর বক্তব্য হলো, লিবিয়ায় জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত জিএনএ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ব্রাদারহুডকে মেনে নেয়া হয়েছে। এটি তারা গ্রহণ করবে না।

ফরাসি রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ আনুষ্ঠানিকভাবে লিবিয়ার সঙ্ঘাতের রাজনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টা সমর্থন করেছেন। কিন্তু গত এপ্রিলে জিএনএ প্রধানমন্ত্রী ফয়েজ আল সররাজ অভিযোগ আনেন যে, ম্যাক্রোঁ হাফতারকে সমর্থন দিচ্ছেন। গত জুনে, ফ্রান্সের তৈরি জাভেলিন ক্ষেপণাস্ত্র হাফতারের সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত দক্ষিণে একটি বেসে পাওয়া গিয়েছিল।

২০১৫ সালের শেষ দিকে জিএনএ তৈরির প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছিল এমন দেশগুলোর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ছিল। তবে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণের পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি লিবিয়ায় কোনো ‘ভূমিকা’ পালনের অবকাশ দেখছেন না। বরং হাফতার ত্রিপোলিতে আক্রমণ শুরু করার পরই ওয়াশিংটন মিশ্র সঙ্কেত পাঠাতে শুরু করে। গত ১৯ এপ্রিলের হাফতারের (মার্কিন নাগরিক) সাথে ফোনে কথোপকথনে ট্রাম্প সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং লিবিয়ার তেলসম্পদ সুরক্ষায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতি দেন।

নভেম্বর মাসে ইউএনএসসির লিবিয়া নিষেধাজ্ঞার কমিটির এক প্রতিবেদনে সুদান এবং সুদানের র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সের (আরএসএফ) প্রধান মোহাম্মদ হামদান দাগালোকে লিবিয়াতে এক হাজার সেনা মোতায়েন করে জাতিসঙ্ঘের নিষেধাজ্ঞাগুলো লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে। লিবিয়ায় সুদানিজ সামরিক কমান্ডারদের বরাত দিয়ে দ্য গার্ডিয়ান ডিসেম্বর মাসে বলে, হাফতারের সামরিক অভিযানে প্রায় ৩,০০০ সুদানি সেনা অংশ নিচ্ছে। এই রিপোর্টে একই ধরনের সহায়তা জর্দানও দিচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

সম্প্রতি সংসদের অনুমোদনের পর আঙ্কারা লিবিয়ায় সেনা মোতায়েন শুরু করেছে বলে এরদোগান বলেছেন। তিনি বলেন যে, এই সামরিক বাহিনী মোতায়েনের উদ্দেশ্য ‘লড়াই করা নয়’ বরং ‘বৈধ সরকারকে সমর্থন করা এবং একটি মানবিক ট্র্যাজেডি এড়ানো।’

লিবিয়ায় মস্কোর যুদ্ধবিরতি আলোচনা ভেঙে গেলেও শান্তির সব চেষ্টা নিঃশেষ হয়ে গেছে বলা যাবে না। এই বিরোধের সাথে যুক্ত পশ্চিমা দেশগুলো এবং এলএনএ’র আরব মিত্র ইউএই সৌদি আরব বা মিসর চাইবে না শুধু রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় এই বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে। রাশিয়ার এ বিষয়ে সমঝোতার আগে আরো কিছু আদায়ের এজেন্ডা থাকতে পারে। মস্কোতেই তুরস্ক ও সিরিয়ার গোয়েন্দা প্রধানের যে বৈঠক হয়েছে সেটিও তাৎপর্যপূর্ণ। লিবিয়ায় রাশিয়া আরো অগ্রগামী ভূমিকা নেয়ার আগে সিরিয়ার বিষয়ে তুরস্কের আরো ছাড় চাইতে পারে। অন্য দিকে, আমিরাত-সৌদি-মিসর অক্ষ এবং সেই সাথে গ্রিস জিএনএ সরকারের সাথে তুরস্কের চুক্তির ফলে সমুদ্রসীমায় যে অধিকার আঙ্কারা পাবে সেটিকে তাদের স্বার্থের পরিপন্থী মনে করতে পারে। রোববার বার্লিন সম্মেলনের আগে স্বার্থের এসব টানাপড়েনের বিষয় নিষ্পত্তি হতে হবে। সেটি হলে লিবিয়ার শান্তির একটি উপায় তৈরি হতে পারে। তবে প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল এবং এর সাথে মধ্যপ্রাচ্যের অনেকের স্বার্থ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয় যুক্ত রয়েছে।

[email protected]

সৌজন্যে: নয়াদিগন্ত

Comments are closed.