রোজার বাজারঃ এমনটি তো হওয়ার কথা নয়!

এবারকার রোজার প্রথম দিনের ঢাকার বাজার দরের খবর উঠেছে পরদিন -অর্থাত্ জুলাইর ২২ তারিখ দ্বিতীয় রোজায় প্রায় সবকটি জাতীয় দৈনিকে। একেক কাগজ খবর ছেপেছে একেক রকম, কিন্তু সবার মূল সুর একই, অর্থাত্ দাম বেড়েছে। পাঠকগণ, ওই দিনের সংবাদপত্রে মূল্যসংক্রান্ত শিরোনামগুলোর দিকে একটু নজর দিন – ‘সরকার কঠোর, তবু বাড়ছে দাম’ ( দৈনিক সংবাদ); ‘চকবাজারে শাহি ইফতার: দাম বেড়েছে তবুও ক্রেতার ভিড়’ (মানব জমিন); ‘রমজানের শুরুতে দাম বাড়ল আরেক দফা’ (প্রথম আলো); ‘নিত্য পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে’ (সমকাল); ‘ইফতারির বাজারে অস্বাভাবিক দামে নিরাশ ক্রেতা’ (আমার দেশ); ‘মূল্যবৃদ্ধি সব ছাড়িয়ে গেছেঃ টমেটোর কেজি ১৫০ টাকা’ (দৈনিক দিনকাল), ইত্যাদি, ইত্যাদি।

রোজার শুরুতে ঢাকার বাজারের এমন খবর নতুন কিছু নয়। প্রতি বছর এ পবিত্র মাসের প্রাক্কালে অবধারিতভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে। ক্রেতা/ভোক্তারা আহাজারি করে, প্রতিবাদ জানায়, কিন্তু কার কথা কে শোনে? অবস্থার কোনো বিহিত হয় না, উন্নতি হয় না, যেমন আছে তেমনি থাকে, মাঝে মধ্যে বলাবলিতে দাম আরো বাড়ে। রোজা আসলে তাই সীমিত আয়ের মানুষদের আয়-ব্যয়ের হিসেব মেলান বড় কঠিন হয়ে পড়ে। ঘরে ঘরে পেরেশানি বেড়ে যায় দ্বিগুণ তিনগুণ। বেশিরভাগ মানুষের জন্য বাজারের আগুন রোজা আর ঈদের আনন্দকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। কিন্তু কেন? আমি অর্থনীতির ছাত্র। আর দশ পাঁচ জন এ প্রশ্নের উত্তর যেভাবে বুঝে আমিও সেভাবেই বুঝি। তারপরও আমি বলব, ‘এমনটি হওয়ার তো কথা নয়!’ কেন নয়? বিষয়টি একটু খোলাসা করে বলার জন্যই আজ এ ছোট্ট নিবন্ধের অবতারণা।

বাজারে জিনিসপত্রের দাম কেন বাড়ে? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আজকাল আর কাউকে পন্ডিত হতে হয় না। যে কেউ চটজল্দি বলে দেবে, ‘কোনো দ্রব্যের সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেশি বাড়লে বাজারে মূল্য ঊর্ধ্বমুখি হবেই হবে’। জনসাধারণ জানুক বা না জানুক, খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা সবাই একথা জানেন এবং কোরান-হাদিসের মত মানেন। আর তাই রোজার আগে ট্রাক বোঝাই করে মাল এনে দোকানে স্টক করেন, তবে দ্রব্যমূল্য খরিদ্দারের নাগালের ভেতর রাখার জন্য নয়, বাড়তি মুনাফার জন্য। ব্যাংকওয়ালাদেরও এ তত্ত্ব অজানা নয়, তাই রোজার আগে আমদানির জন্য ব্যবসায়ীদের বেশি বেশি এলসি খোলে দেন, বড় বড় ঋণ মঞ্জুর করেন, তাতে ব্যবসা বাড়ে, লাভের অঙ্ক স্ফীত হয়। সরকার বাহাদুর বিষয়টি আরো ভাল জানেন। তাই টিসিবিকে আমদানির জন্য রিঅ্যাক্টিভেট করেন, তবে প্রায়শই দেরি করে। বিপণন ও বিতরণের জন্য যানবাহন লাইনআপ করেও রাখা হয়। ব্যবহার হয় কি না কে জানে? এসব তোড়জোড় ক্রেতা/ভোক্তাদের মুশকিল আহ্সানের জন্য না লোক দেখানোর জন্য সে কথা আল্লাই মালুম। মাস শেষ হলে দেখা যায় কমবেশি সবার উদ্দেশ্যই হাসিল হয়, কিন্তু বেচারা জনগণের ভোগান্তি কমে না। কেউ কিছু বললে সুবিধাভোগীদের সোজা সাপ্টা একই উত্তর, ‘চাহিদা বাড়লে দাম তো বাড়বেই’। না, ব্যাপারটা এত সোজা নয়। এ কথার মাঝে একটি ফাঁক আছে, একটি চালাকি আছে। পাঠকদেরকে চালাকিটি ধরিয়ে দেই। ‘চাহিদা বাড়লে আপনা আপনি দাম বাড়ে না, বাড়তে পারে না’। সাপ্লাই চেইন যদি অটুট থাকে এবং টিসিবি ও ছোটবড় সব ধরণের সরবরাহকারিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বজায় থাকে, তাহলে চাহিদা বাড়লেও মূল্য ঊর্ধ্বমুখি হবে না। বাংলাদেশের বাজারে রোজায় দাম বাড়ার কারণ চাহিদা বৃদ্ধি নয় বরং এর আসল হেতু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সীমিত সরবরাহকারিদের বাজার নিয়ন্ত্রণ। অশুভ সিন্ডিকেট ভাঙার দায়িত্ব সরকারের। এ ব্যাপারে সরকার কতটা সফল পাঠকরা আমার চেয়ে ভাল জানেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন আরো গোড়ায়, আরো মৌলিক – আমার কথা, ‘রোজা আসলে খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা এভাবে বাড়বে কেন’? এ আমি বুঝি না। এবার সমস্যাটির আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক। সোয়া ১৫ কোটি লোকের দেশ বাংলাদেশ। এদেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ মুসলমান। এ বিশাল জনগোষ্ঠির জীবনে প্রতি বছর রোজার মাস এবং ঈদ আসে একটি বিশেষ আমেজ ও পবিত্রতা নিয়ে, একটি বিশেষ বাণী ও বার্তা নিয়ে। তাদের জন্য এটা একটি নিছক ধর্মীয় বিধান নয় বরং এটা তাদের জীবন, সমাজ, ও সংস্কৃতিরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঈদ রোজার লাগালাগ হলেও, রোজা ও রমজানের মেজাজ এবং বার্তা ঈদের থেকে একটু ভিন্ন বৈকি। আমি যতটুকু বুঝি রোজা এবং ঈদকে আমরা উত্সবের আমেজে গুলিয়ে একাকার করে ফেলেছি। আর সে জন্য বাজার সমস্যায় যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। রোজার শেষে মুসলমানদের জীবনে ঈদ আসে একটি নির্ভেজাল ও নিখাদ আনন্দ নিয়ে। এটা নিঃসন্ধেহে একটি উত্সবের দিন, উদ্যাপনের জন্য নির্ধারিত। আর তাই ঈদের আগে খাদ্য দ্রব্য, নতুন জামা কাপড়, সুরমা, আতর, টুপী, জায়নামাজ, ইত্যাদির চাহিদা বাড়া অস্বাভাবিক নয়, তবে বাজারে সরবরাহ এবং প্রতিযোগিতা বজায় থাকলে দাম বেশামাল হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবু ঈদে যেটা সম্ভব হতে পারে, রোজার শুরুতে তা হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। ঈদের আগে পুরো রোজার মাস জুড়ে সবকিছুর চাহিদা ও দাম বাড়ার কথা নয়, বাড়তে পারে না। যা হয়, এবং আমরা প্রতি বছর যা দেখি তার একটি ব্যাখ্যা হতে পারে এরকম।

রোজা আত্মপরিশুদ্ধির মাস, সংযমের মাস। আল্লাহ অন্য নবীদের উম্মতের মত আমাদের নবীজীর অনুসারীদের ওপর একইভাবে রোজা ফরজ করেছেন যাতে আমরা তাক্ওয়া অর্জন করতে পারি। এ মাসের তাত্পর্য এবং বৈশিষ্ট্য বহুবিদ। রমজান মাসেই পবিত্র কোরান নাজিলের সূত্রপাত। এ মাসে মুসলমানদের জীবনে একটি রাত আসে যা কিনা ১ হাজার মাসের চেয়ে উত্কৃষ্ট, অর্থাত এই এক রাতের উপাসনা মানুষের সারা জীবনের এবাদতকে গুণেমানে ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ মাসে মহান আল্লাহ বেহেশতের সব দরজা খুলে দেন এবং জাহান্নামের কপাট বন্ধ করে রাখেন। রোজায় শয়তানকে শিকল পরিয়ে রাখা হয়। এ মাসে এবাদত বন্দেগীর মূল্য অন্য সময়ের তুলনায় অনেক অনেক গুণ বেশি। যে ব্যক্তি তার জীবনে রোজার মাস পেল অথচ জান্নাতি হতে পারল না তাকে জিবরাইল (আঃ) লানত্ করেছেন। রমজান মাসকে যদি আমরা উত্সবের মাস মনে করি, সেটা করতে পারি, তবে সেটা হবে অন্য ধরণের উত্সব, অন্য মেজাজের উত্সব। এ উত্সব এবাদত বন্দেগীর উত্সব। সংযম চর্চা ও ত্যাগ স্বীকারের উত্সব। অফুরন্ত সওয়াব হাসিলের উত্সব। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উত্সব। জীবনের সব গুনাহ মাফ করিয়ে নেওয়ার আনন্দের উত্সব।

কিন্তু আমরা কী করছি? আমরা রোজার মাসকে বানিয়ে ফেলেছি ঈদের দিনের মত খাওয়া দাওয়ার উত্সবের মাসে। রোজা আসার আগে থেকেই আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি সারা মাসের জন্য খাদ্য বস্তুর যোগাড় যন্ত্রে। অথচ এ মাসে আমাদের কম খেয়ে বেশি এবাদত করার কথা। গরিব দুঃখীদের দুঃখ কষ্ট বেশি করে বোঝার কুশেশ করার কথা। এ মাসে বাড়তি করে দান খয়রাত করার কথা। আমার হিসেবে এমাসে বাজারে খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা বাড়ার বদলে কমার কথা। রোজার মাসে এত রান্নাবান্না ও খাবার দাবারের সময় কোথায়? এ মাসে রসনা তৃপ্তিতেই যদি সব সময় যায় তো মা’বুদের কাছে আসল চাওয়া চাইব কখন? আর না চাইলে নাজাত পাব কী করে? এ সব কথা কী আমরা বুঝি? না বোঝার চেষ্টা করি? আলবত্ না, একেবারেই করি না, করতে চাই না। বুঝি আর না বুঝি, কাজ করি ঠিক উল্টোটা। রোজা আসতে না আসতে আমরা গোশত্ কিনে থরে থরে ফ্রিজে সাজিয়ে রাখি, তেল, ডাল, চাল, ছোলা, চিনি, ঘি, মাখন, মিষ্টি, খেজুর, ফলফলাদি কিনে ঘর ভরে ফেলার আয়োজন করি। এটা সম্পূর্ণরূপে রোজার মাসের পবিত্রতা ও তার মেজাজের পরিপন্থী। আমরা কী কখনো ব্যাপারটা এভাবে ভেবে দেখেছি? ভেবে থাকলেও ভাবনাটা ভাবনা জগতেই রয়ে যায়। আমরা সে মত কাজ করি না, করতে পারি না। রোজার মাস এলে খাওয়া দাওয়ার বেহায়াপনায় আমরা মাতোয়ারা হয়ে যাই, পাগল হয়ে উঠি। আজকাল রোজার মাসে বাংলাদেশে শুরু হয় বিশ্রী এক ভোজন বিলাসী প্রতিযোগিতা। রোজায় অতিরিক্ত পানাহার শুধু অস্বাস্থ্যকর ও অনৈতিকই নয়, অনৈসলামিক ও বটে।

আরেকটু ভেবে দেখি, খাদ্য চাহিদার হিসেবটা মেলাই। আ-রোজায় বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস কী? গ্রামের মানুষ দিনে তিনবেলা ভাত খায়। শহরের নাগরিকরা সকালে নাস্তা খায় এবং দুপুরে ও রাতে ভাত খায়। রোজায় গ্রামের মানুষের দিনে তিনবেলা পেটভরে ভাত খাওয়ার তো সুযোগই নেই। বড়জোর দুবেলা খেতে পারে – সন্ধ্যায় এবং শেষ রাতে। সুতারং তাদের খাওয়া এবং খাদ্য চাহিদা তো রোজায় বেশি নয় বরং সোজা এক তৃতীয়াংশ কম হওয়ার কথা। এবার আসেন শহরের কথায়। ধরে নিলাম শহরের রোজাদাররা ইফতারের সময় না হয় নাস্তার মত করে খেলেন। তারপর এশা ও তারাবির পর খেলেন একবার ফুল মিল এবং আরেকটি খেলেন শেষ রাতে। হিসেব মতো তাদেরও তো আমি রোজায় খাদ্য চাহিদা বাড়ার কোনো কারণ দেখি না। বরং রোজার সংযত আচরণের জন্য, এবং বাড়তি এবাদতের জন্য খাবার দাবার ও অন্য ভোগবিলাসের চাহিদা কমার কথা। আর চাহিদা কমলে বাজারে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখি না হয়ে নিুগামী হতে বাধ্য। আমরা যদি রোজার পবিত্রতা ও তার স্পিরিট মেনে চলি তাহলে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি পাব না, আমাদের বৈষয়িক জীবনে শান্তিও ফিরে আসতে পারে।

আজকের নিবন্ধ শেষ করছি আমার ইংল্যান্ড প্রবাসী বন্ধু মাহবুবুর রহমান চৌধুরীর একটি কথা দিয়ে। সে আমাকে বলেছিল এ বিষয়ে লিখতে, তাই লিখলাম। আজকের এ কলামের কৃতিত্বের পুরোটাই মাহবুবের, অবশ্য ভুল ভ্রান্তি বা দূর্বলতা কিছু থেকে থাকলে তার দায়ভার ষোলো আনা আমার। মাহবুব আরো বলেছিল, রোজায় যখন বেগুনের কেজি হয় ৮০ টাকা, কাঁচা মরিচ বিক্রি হয় ১২০ টাকায়, টমেটোর খুচরা মূল্য দাঁড়ায় ১৫০ টাকায়, তখন এগুলো না কিনলে কী হয়? এসব খাদ্যদ্রব্য আমাদের জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য নয়, এবং ইফতার সেহরিতে এগুলো না খেলে যে রোজা মকরুহ হবে এমনটিও নয়।

লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক – টেনেসী স্টেইট ইউনিভার্সিটি
এডিটর – জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ।
[email protected]

Loading


Comments

রোজার বাজারঃ এমনটি তো হওয়ার কথা নয়! — 1 Comment

  1. “রোজার মাস এলে খাওয়া দাওয়ার বেহায়াপনায় আমরা মাতোয়ারা হয়ে যাই, পাগল হয়ে উঠি। আজকাল রোজার মাসে বাংলাদেশে শুরু হয় বিশ্রী এক ভোজন বিলাসী প্রতিযোগিতা। রোজায় অতিরিক্ত পানাহার শুধু অস্বাস্থ্যকর ও অনৈতিকই নয়, অনৈসলামিক ও বটে।”
    ***সহমত।***

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *