রিমান্ডে মানবাধিকার

বহু পুরনো ইংরেজি প্রবাদ। যদি তুমি কাউকে অপছন্দ করো তবে তাকে একটি খারাপ নাম দাও। তারপর তাকে হত্যা করো। অথবা আমরা ফিরে যেতে পারি হিটলারীয় যুগে। হিটলার ইহুদিদের মানুষ গণ্য করতেন না। যে কারণে তাদের হত্যাকে জায়েজ মনে করতেন তিনি। বাংলাদেশেও সেই পুরনো খেলা চলছে নতুন করে। কাউকে অপছন্দ করলেই নাম দেয়া হচ্ছে ‘জামায়াত’। যেন এতে নির্যাতন অথবা হত্যা জায়েজ হবে। একদা বামপন্থার সঙ্গে যুক্ত ‘অধিকার’ সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খান শুভ্রের জামায়াত লিংক খোঁজার চেষ্টা সত্যিই বিস্ময়কর। যদিও তা হালে পানি পায়নি। তবে উইলিয়াম বি. মাইলাম কথিত হাইব্রিড গণতন্ত্র যেন প্রতিদিনই পরীক্ষা দিচ্ছে বাংলাদেশে। সরকার অবশ্য ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। ঈদের দিনেই তারা আদিলুর রহমানকে গ্রেপ্তার করেনি। তার পরিবারের সঙ্গে তাকে ঈদ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। যদিও শনিবার রাতে পাজেরো অভিযানে তাকে যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা বিস্ময়ের জন্ম না দিয়ে পারে না। রাত ১০টার কিছু পর এক সামাজিক অনুষ্ঠান শেষে নিজ বাড়িতে ফেরার পথে গতিরোধ করে তাকে তুলে নেয়া হয় ডিবি পুলিশের গাড়িতে। মিন্টো রোডে তাকে পাওয়াও অবশ্য বিশেষ সৌভাগ্যেরই ব্যাপার। অনেককে এভাবে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আর পাওয়া যায়নি। এই তুলে নেয়ার বিরুদ্ধেই দীর্ঘ দিন থেকে লড়াই করে আসছেন মিষ্টভাষী এ মানবাধিকার কর্মী। সাবেক এই ডেপুটি এটর্নি জেনারেলের ক্ষেত্রে সামান্যতম সৌজন্যবোধ আর আইনের অনুসরণও করা হয়নি। এটা স্বীকার করতেই হবে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। আদিলুর রহমান খান শুভ্রও নন। কোন অপরাধ করে থাকলে তার ক্ষেত্রেও আইন তার নিজস্ব গতিতে চলার কথা। কিন্তু কোন মামলা আর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই সুপরিচিত এক মানবাধিকার কর্মীকে যেভাবে গ্রেপ্তার করা হলো তা ক্ষমতার দম্ভেরই প্রকাশ।
ডিবি পুলিশের কার্যালয়ে নিজেকে খুঁজে পেয়ে আদিলুর রহমান স্বস্তি পেলেও ভাগ্য বেশি সময় তার সহায় হয়নি। রোববার তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বিচারক অমিত কুমার দে’র আদালতে। পুলিশের পক্ষ থেকে চাওয়া হয় ১০ দিনের রিমান্ড। তথ্য ও প্রযুক্তি আইন লঙ্ঘনের কথা বলা হলেও তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয় ৫৪ ধারায়। যদিও বিএনপির আমলে প্রণীত তথ্য ও প্রযুক্তি আইনটি এখন বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতোই কালো আইনের স্বীকৃতি পাচ্ছে। আইনবিদরা নিশ্চিত করেছেন, আদিলুর রহমানের রিমান্ড মঞ্জুর আদেশে কমপক্ষে তিনটি ক্ষেত্রে আইন এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ব্যত্যয় ঘটেছে। সংবিধানের ভাষা একেবারেই স্পষ্ট। সুপ্রিম কোর্টের দেয়া যে কোন সিদ্ধান্ত নিম্ন আদালতের বিচারকরা মানতে বাধ্য। ৫৪ ধারায় কারও রিমান্ড মঞ্জুর না করার উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়নি নিম্ন আদালতের আদেশে। তিন দিনের বেশি টানা রিমান্ড না দেয়ার বিধানেরও ব্যত্যয় ঘটেছে। রিমান্ড দেয়ার ক্ষেত্রে ব্লাস্ট বনাম সরকার মামলায় হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনাও অনুসরণ করা হয়নি। তবে আশার কথা হচ্ছে, এ আদেশে হাইকোর্ট হস্তক্ষেপ করেছে দ্রুত। বিচারপতি বোরহান উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকালই এ রিমান্ড স্থগিত করেছে। আদিলুর রহমানকে কারাগারে ফিরিয়ে নেয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার আদিলুর রহমান খান শুভ্রের নিজের মানবাধিকারই আজ লঙ্ঘিত। কবে তিনি আবার মুক্ত আকাশের নিচে ফিরবেন তাই এখন দেখার বিষয়। স্বস্তির বিষয় দেশী-বিদেশী সব মানবাধিকার সংগঠনই সোচ্চার হয়েছে তার এই নিবর্তনমূলক গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে। মিনমিনে কণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও। বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিবেশে দিনে দিনে বিবৃতি পার্টির সংখ্যা আরও বাড়ছে। আদিলুর রহমান খানের বিরুদ্ধে অভিযোগের হালখাতার দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে মৃতের সংখ্যা ৬১ দেখানোকেই তার অপরাধ হিসেবে জাহির করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে অধিকার-এর কাছে নিহতদের নাম-ঠিকানাও চাওয়া হয়েছিল। অধিকার সে চিঠির জবাবও দেয়। জবাবে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করতে অনুরোধ করা হয়। অধিকার-এর পক্ষ থেকে বলা হয়, ভিকটিমের পরিবারের নিরাপত্তার কারণে সরকারের কাছে নয়, ওই কমিশনের কাছে নিহতদের সম্পর্কে তথ্য দেবে অধিকার। তথ্য বিনিময়ের পথ অনুসরণ না করে সরকারের পক্ষ থেকে অনুসরণ করা হয়েছে জেলে নিক্ষেপের পথ। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতিতে যেমনটা বলা হয়েছে, সরকার যদি মনে করে মে মাসের সহিংসতার ব্যাপারে আদিল তার প্রতিবেদনে কোথাও ভুল করেছেন, সেক্ষেত্রে জেলে নিক্ষেপের চেয়ে জনসমক্ষে তার সঙ্গে সরকারের বিতর্ক করার সাহস থাকা উচিত।
সুত্র: মানবজমিন

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *