রাজনীতি ও নিরপেক্ষতা

এই কলাম লিখছি সোমবার ৫ জানুয়ারি ২০১৫ সন্ধ্যায়। সম্মানিত পাঠক কলাম পড়ছেন বুধবার ৭ জানুয়ারি। ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর তথাকথিত নির্বাচনের স্মরণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের সরকারবিরোধী অংশ তথা রাজনৈতিক অঙ্গনের বৃহত্তর অংশ সোমবার ৫ জানুয়ারি ২০১৫-কে গণতন্ত্র হত্যা দিবস এবং কালো পতাকা দিবস ঘোষণা করে পালন করেছে। দেশনেত্রী তথা ২০ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কর্তৃক আহূত সমাবেশ করার সরকার অনুমতি দেয়নি। সরকার ঢাকাকে অবরুদ্ধ করেছে এবং সমগ্র বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। সরকারের হুকুমে অথবা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকার সাথে অন্যান্য জেলার সড়কপথের দূরপাল্লার বাস যোগাযোগ, নদীপথে লঞ্চ যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সব ট্রেন সার্ভিস বিচ্ছিন্ন করা হয়নি, কিছু কিছু হয়েছে। ২০ দলীয় জোট যদি ৫ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে অবরোধ বা হরতাল ডাকত তাহলে যেমন ঢাকা বিচ্ছিন্ন থাকত, তেমনি সরকারই ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। জনগণের খেদমতগার, জনগণের সেবক, জনগণের পাহারাদার সরকারই ঢাকা ও দেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীকে বহুমুখী কষ্টে ফেলেছে। সোমবার ৫ জানুয়ারি ২০১৫ ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন অংশে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহরে ও অন্যান্য জনপদে বিএনপি, জামায়াত এবং ২০ দলীয় জোটের অন্য কয়েকটি দলের প থেকে অগণিত মিছিলের চেষ্টা করা হয়েছে, মিছিল বাধার সম্মুখীন হয়েছে, সরকারি রাজনৈতিক বাহিনী এবং সরকারি পুলিশবাহিনী তাদেরকে আক্রমণ করেছে, অনেক হতাহত হয়েছেন। ২০ দলীয় জোটের চারটি দলের চারজন চেয়ারম্যান বা সভাপতি সারা দিন একত্রেই ছিলাম, নিজেদের দলীয় নেতাকর্মীদের বুদ্ধি-পরামর্শ, নির্দেশ-উপদেশ প্রদানের মাধ্যমে যোগাযোগ রেখেছি, সার্বিক কর্মকাণ্ড অনুসরণ করেছি, জাতীয় প্রেস কাবে সংঘটিত আগ্রাসী কর্মকাণ্ড অবলোকন করেছি এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অবরুদ্ধ অবস্থা দেখে বের হওয়ার চেষ্টা করেছি। অতঃপর পৌনে পাঁচটার দিকে যখন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গাড়িতে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকগণের সামনে বক্তব্য রাখছিলেন তখন সেই বক্তব্য অনুসরণ করেছি। ৫ জানুয়ারি ২০১৫ সন্ধ্যা ৭টার পর এক বছর আগে এই দিনে জবরদস্তি ও ভোটারবিহীন নির্বাচনী নাটকের মাধ্যমে বাংলাদেশের সম্মানিত প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে আসীন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার টিভি ভাষণ শুনেছি।
গত সপ্তাহে এই পত্রিকারই কলামের মাঝামাঝি অংশে লিখেছিলাম যে, বাংলাদেশের আপাতদৃষ্টিতে শান্ত পরিবেশ আসলে শান্ত নয়। প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝামাঝি এলাকায় অবস্থিত হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের হাওয়াই দ্বীপে অবস্থিত মোনালোওয়া পর্বত তথা আগ্নেয়গিরির উদাহরণ আমি উল্লেখ করেছিলাম। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা উদগিরণের আগের আগ্নেয়গিরির মতো। অর্থনীতি শুভঙ্করের ফাঁকির মধ্য দিয়ে চলছে। বৈদেশিক এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ প্রায় স্থবির। ইটের ভাটা থেকে ইট বিক্রি, খুচরা রড বিক্রেতার দোকানে রড বিক্রি এবং খুচরা সিমেন্ট বিক্রেতাদের দোকানে সিমেন্ট বিক্রি অতীতের তুলনায় রেকর্ড পরিমাণ নি¤েœ। এক দিকে ভারত থেকে চাল আমদানি হচ্ছে, অপর দিকে বাংলাদেশ থেকে চাল রফতানি করা হচ্ছে। অঘোষিতভাবে বাংলাদেশ এখন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বাণিজ্যিক কলোনিতে পরিণত হয়ে গেছে; অথবা পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে। তিন-চার দিন আগে ঢাকা মহানগরে অবস্থিত বিখ্যাত গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান সিপিডি প্রকাশ করে যে, বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতিবেশী রাষ্ট্রে পাচার হয়ে গিয়েছে। সংবাদমাধ্যমের অতীতের তথ্য মোতাবেক, ভারত বিভিন্ন বৈদেশিক রাষ্ট্র থেকে যেই রূপ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে, সেই প্রোপটে বা সূচকে বাংলাদেশ হলো ওপরের দিক থেকে ক্রমিক নম্বর ৫। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে বৈধ ও অবৈধ নিয়মে হাজার হাজার কোটি ডলার বা টাকা ভারতে রফতানি হয় বা পাচার হয়। চার-পাঁচ দিন আগে ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপির একজন অতি জ্যেষ্ঠ না হলেও জ্যেষ্ঠ নেতা ঢাকা সফর করেছেন এবং বক্তব্য রেখেছেন। মিডিয়ায় প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক তিনি বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীকে আহ্বান জানিয়েছেন, যেকোনো মূল্যেই হোক না কেন, তারা যেন শাসক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে অব্যাহতভাবে সমর্থন করে এবং ক্ষমতায় আসীন রাখে। আজ থেকে এক বছর দুই মাস আগে তৎকালীন কংগ্রেস শাসিত ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব (অর্থাৎ একজন অতি জ্যেষ্ঠ আমলা) ভদ্রমহিলা সুষমা সরাজ, ঢাকায় এসে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাথে সাাৎ করে তাকে বলেছিলেন অনেকটা এ রকম : ‘আপনারা জাতীয় পার্টি যদি নির্বাচনে অংশ না নেন, তাহলে বিএনপির সাথে জামায়াত ক্ষমতায় চলে আসবে। এটা আমাদের জন্য বা আপনাদের জন্য সুসংবাদ হবে না।’ (আরো ডজন ডজন ঘটনার উল্লেখ না করে) শুধু ১৪ মাস আগের একটি এবং আজ থেকে চার-পাঁচ দিন আগের একটিসহ মোট দু’টি ঘটনা দ্বারা আমি বোঝাতে চাচ্ছি, আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর ভারতের পরো ও প্রত্য নিয়ন্ত্রণ গভীরভাবে প্রথিত। এই নিয়ন্ত্রণের ফলে ৫ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়েছে। এই নিয়ন্ত্রণের ফলেই চার-পাঁচ দিন আগে ভারতীয় রাজনৈতিক নেতা এসে সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে গেলেন।
বেগম জিয়া ঘোষণা করেছেন, কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। বেগম জিয়ার ঘোষণা এবং আজ বুধবার যখন আপনারা কলাম পড়ছেন, এর মাঝখানের সময়টুকুতে কী ঘটেছে এবং কোথায় ঘটেছে, সে ব্যাপারে পাঠকসমাজ যথাসম্ভব অবহিত। যা কিছু ঘটেছে তার তাৎপর্য বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকগণ অবশ্যই অনুভব করতে পারছেন। বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকার বাংলাদেশকে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ক্রমান্বয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে মানুষের জান ও মালের নিরাপত্তা অধিকতর হুমকিতে পড়ে, দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যায় এবং পৃথিবীব্যাপী দেশের ভাবমূর্তি ুণœ হয়। শুধু ক্ষমতায় থাকার নিমিত্তে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় এবং জনমানুষের স্বার্থকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে ও জলাঞ্জলি দিচ্ছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের দূরদর্শিতা (নেতিবাচকভাবে) প্রশংসার দাবিদার। আজ থেকে চার বছর আগে ২০১১ সালের মে মাসে তার প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল যখন সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সংপ্তি রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছিলেন। আগামীতে যত শিগগির সম্ভব একটি কলামে এই প্রসঙ্গের কথাগুলো লিখার আশা করছি। সরকার একটি আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অথবা দলের অঙ্গসংগঠনের সদস্যগণকে ঢালাওভাবে বন্যার পানির মতো আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীতে ভর্তি করানো হয়েছে। দলীয়করণ কত প্রকার ও কী কী তা যদি বুঝতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের গত ছয় বছরের সরকারি কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলেই যথেষ্ট হবে। কিন্তু এই নিয়মে বা এ রকমভাবে দেশ চলতে পারে না।
বিধায় পরিবর্তন প্রয়োজন। পরিবর্তনের জন্য গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রয়োজন। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা-সাতটার দিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের প থেকে ৭ দফা রাজনৈতিক প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। অত্যন্ত বিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার পরিচায়ক ওই প্রস্তাবগুলোতে তত্ত্বাবধায়ক শব্দটি কোথাও উল্লিখিত নেই। উল্লিখিত আছে অন্য দু’টি পরিচিত শব্দ যথা : নির্দলীয় নিরপে। আমি বিশ্বাস করি, আমি যত জায়গায় আলাপ-আলোচনা করেছি, সবাই বিশ্বাস করে নিরপে ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সরকারই নিরপে ও দ একটি নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান বা পরিচালনা করতে পারে। ইচ্ছা থাকলেই নিরপে ব্যক্তির সন্ধান করা সম্ভব। একটি দেশে নিরপে ব্যক্তি নেই এটা অবিশ্বাস্য। অনেক ব্যক্তির মনে কিছুটা পপাতিত্ব থাকলেও কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যে নিরপেতা প্রদর্শন করা অসম্ভব কিছু নয়।
ভিন্ন একটি আলোচনায় যাই। ২৫-২৬-২৭ ডিসেম্বর ছিল ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ নামক একটি সুপরিচিত শিাপ্রতিষ্ঠানের সাবেক ক্যাডেট বা শিার্থীগণের ‘পুনর্মিলনী’। অবশ্যম্ভাবীভাবেই সাবেক ক্যাডেট এবং বর্তমানদের মধ্যে এটি একটি ‘মিলনী’ও বটে। ১৯৫৮ সালে কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ছয় বছরমেয়াদি লেখাপড়া, সপ্তম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত। সপ্তম থেকে দশম শ্রেণী পড়ে বের হয়ে এসেছিলেন (জুন ১৯৬২-তে) অনেক ছাত্রের মধ্যে একজনের নাম (জাতীয় পার্টির) ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। একই ব্যাচের অন্য একজনের নাম হচ্ছে, যিনি দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে বের হয়ে এসেছিলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অন্যতম একজন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম বীর বিক্রম। আমি নিজে নবম ব্যাচের ছাত্র, ৭ জুলাই ১৯৬২ থেকে ছয় বছর পড়াশোনা করে ১৯৬৮-তে বের হই। বর্তমানে ৫৬তম ব্যাচ সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বর্তমান সেনাপ্রধান (চার তারকা) জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া ১৬তম ব্যাচের ক্যাডেট। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের বর্তমান প্রিন্সিপাল লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ রেজাউল হাসান, বর্তমান অ্যাডজুটেন্ট মেজর মাহবুব পারভেজ এবং বর্তমান মেডিক্যাল অফিসার তথা ডাক্তার ক্যাপ্টেন মাহমুদুস সামাদ তিনজনই সাবেক ক্যাডেট তথা ওল্ড ফৌজিয়ান, যথাক্রমে ৩১তম, ৪২তম এবং ৪৬তম ব্যাচের। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তথা সামরিকবাহিনীতে, বাংলাদেশের বিভিন্ন গোয়েন্দাবাহিনীতে, ব্যাংকিং জগতে, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতে, চিকিৎসা জগতে, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনায়, আইন পেশায়, বিভিন্ন মাত্রার গবেষণাকর্মে, ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্ররা প্রশংসনীয় উৎকর্ষতা প্রদর্শন করেছে। গত পাঁচ-ছয়টি পুনর্মিলনীর মধ্যে এবারের পুনর্মিলনীটি উপস্থিতির বিচারে, জাঁকজমকের বিচারে, উৎকর্ষতার বিচারে এবং মনোজ্ঞতার বিচারে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও উত্তম ছিল। দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই সব আয়োজককে, অন্যতম উপভোগকারী হিসেবে কৃতজ্ঞতা জানাই। সাবেক ক্যাডেট বা ওল্ড ফৌজিয়ানগণের মধ্যে অনেকেই যে যেরূপ প্রভাবশালী অবস্থানে আছেন, সেখানে থেকেই পুনর্মিলনীর জন্য সাহায্য-সহযোগিতামূলক অবদান রেখেছেন। যারা অবদান রাখতে পারেননি, তারা উত্তেজনা নিয়ে মাসের পর মাস অপো করেছেন উপস্থিত হওয়ার জন্য এবং শেষে উপস্থিত হয়েছেন সপরিবারে। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত দুই হাজার ৯৭২ জন ছাত্র বা ক্যাডেট ফৌজদারহাট থেকে পাস করেছেন; তাদের মধ্যে বিদেশ ও দেশ থেকে রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন প্রায় এক হাজার ২০০। সময়ের অভাবে রেজিস্ট্রেশন করতে না পারলেও উপস্থিত হয়েছিলেন প্রায় আরো এক-দেড় শ’ সাবেক ক্যাডেট বা ওল্ড ফৌজিয়ান। ওল্ড ফৌজিয়ান এবং তাদের পরিবার-পরিজন মিলে প্রায় দুই হাজার ১০০ ব্যক্তি রি-ইউনিয়নের চূড়ান্ত সময়ে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানমালার খরচের এক শ’ ভাগের এক ভাগ হচ্ছে সরকারি অনুদান এবং বাকি নিরানব্বই ভাগের মধ্যে প্রায় তিরিশ ভাগ হচ্ছে সাবেক ফৌজিয়ানদের অনুদান। চারটি বড় খাওয়ার পর্ব অর্থাৎ লাঞ্চ ও ডিনারের খরচই প্রায় পঞ্চাশ লাখ টাকার ওপরে। সবগুলো মিটিয়েছেন চারটি ব্যাচের সাবেক ক্যাডেটগণ সবার হয়ে। আমি, আমার স্ত্রী ও কন্যা এবং দুই নাতি আরহাম-আজফার পূর্ণ অনুষ্ঠানমালায় উপস্থিত ছিলাম। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল বর্তমানে মরহুম নিউজিল্যান্ডের নাগরিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সক্রিয় যোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্নেল উইলিয়াম মরিস ব্রাউনসহ অন্য মরহুম শিকদের স্মৃতিকে স্মরণ করে, সাবেক ফৌজিয়ানদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তাদের স্মৃতিকে স্মরণ করে এবং পুনর্মিলনীতে উপস্থিত রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাগণকে সম্মান জানিয়েই কলেজের মূল প্রোগ্রাম শুরু হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো দারুণ ছিল এবং অনেক দিন মনে থাকবে। বাংলাদেশে বারোটি ক্যাডেট কলেজ আছে এখন, দশটি ছেলেদের, দু’টি মেয়েদের। আমার ছেলে মুজাহিদ কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। প্রত্যেক ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্রদের সংগঠন আছে এবং তারা প্রচুর পরিমাণে সমাজসেবামূলক কাজ করে। ‘ওফা’ তথা ফৌজদারহাটের সাবেক ছাত্রদের সংগঠন ওল্ড ফৌজিয়ানস অ্যাসোসিয়েশনও অনেক ভালো কাজ করে, তবে অন্যান্য ক্যাডেট কলেজের সংগঠনগুলো আমাদের থেকেও পরিমাণে বেশি এবং গুণগতভাবে বেশি প্রশংসনীয় কাজ করে। এবার পুনর্মিলনী উপলে ফৌজদারহাটের সাবেক ক্যাডেটগণ তথা ওল্ড ফৌজিয়ানস, নিজেদের প থেকে এবং অন্যান্য দানশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করে, বিরাট একটি অনুদান কলেজকে দিয়েছে শুধু বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড করার জন্য। বস্তুত কলেজের বর্তমান প্রশাসন অতি প্রশংসনীয়ভাবেই সেই উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডগুলো করে যাচ্ছেন। সব ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্ররা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও নৈতিক উন্নয়নে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন, এটা আমাদের কামনা। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সাম্প্রতিক পুনর্মিলনীর বর্ণনা দেয়ার পেছনে একটি ুদ্র উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্যটি হলো, পাঠকসমাজের সামনে দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যে, অনেক সাবেক ক্যাডেটই অনেক রাজনৈতিক দলের সদস্য বা অনুসারী। কিন্তু পুনর্মিলনী চলাকালে রাজনৈতিক মতের ভিন্নতা, মেলামেশায় কোনো বাধার সৃষ্টি করেনি। কিন্তু গল্পচ্ছলে রাজনৈতিক কথা যে উঠে আসেনি, সেটাও নয়। অবসরপ্রাপ্ত এবং চাকরিরত সরকারি ও সামরিক ব্যক্তিবর্গ, যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
রাজনৈতিক নিরপেতা বা বহুপতা প্রদানের বা প্রদর্শনের আরেকটি উদাহরণ তুলে ধরছি। ২ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ও বিকেলে আরেকটি পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। চট্টগ্রামের অন্যতম বিখ্যাত ও বর্ধিষ্ণু উপজেলার নাম হাটহাজারী। হালদা নদীর একটা অংশ উপজেলার মধ্য দিয়ে যায় এবং ওই অংশটিতেই বছরের সুনির্দিষ্ট একটি মওসুমে মাত্র দুই দিন-দুই রাতে মিঠাপানির মাছ ডিম ছাড়ে নদীর পানিতে। এই অংশটি পৃথিবীতে মাছের প্রাকৃতিক প্রজননকেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এই উপজেলায় অবস্থিত। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ কওমি মাদরাসা এখানে অবস্থিত। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ দু’টি আলিয়া-কামিল মাদরাসাও এখানে অবস্থিত। কিন্তু এই উপজেলায় কোনো সরকারি কলেজ বা সরকারি হাইস্কুল নেই। বেসরকারি হাইস্কুলগুলোর মধ্যে একটি নাম কুয়াইশ-বুড়িশ্চর সম্মিলনী হাইস্কুল এবং আরেকটির নাম গড়দুয়ারা বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়। শেষোক্তটির (তথা গড়দুয়ারা) প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান ছিল তিন দিনব্যাপী। প্রথম দিন প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা পরিষদ প্রশাসক এম এ সালাম। দ্বিতীয় দিনে প্রধান অতিথি ছিলাম আমি ২০ দলীয় জোটের অন্যতম একজন শীর্ষ নেতা। তৃতীয় দিনে প্রধান অতিথি ছিলেন পার্লামেন্টে তথাকথিত বিরোধী দলের সংসদ সদস্য কিন্তু সরকারি ক্যাবিনেটের অন্যতম মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। সালাম সাহেব উপস্থিত হয়েছিলেন, আমিও উপস্থিত হয়েছিলাম, কিন্তু ব্যারিস্টার মহোদয় উপস্থিত হতে পারেননি। স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আহমুদুর রহমান চৌধুরীর সুযোগ্য ছেলে সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অত্যন্ত উপভোগ্য ও হৃদয়গ্রাহী অনুষ্ঠানমালা ছিল ২ জানুয়ারি। স্কুল পরিচালনা পরিষদের অন্যতম সদস্য, হাটহাজারী উপজেলায় আমার মিডিয়া উপদেষ্টা এবং ওই উপজেলার জনপ্রিয় সাংবাদিক খোরশেদুল আলম শিমুলের সাবলীল ব্যতিক্রমধর্মী উপস্থাপনাও অনেকাংশেই অবদান রেখেছিল অনুষ্ঠানকে উপভোগ্য করার জন্য। উপস্থিত তরুণদের মধ্যে বৃহৎ রাজনৈতিক দল দু’টিরই প্রচুর অনুসারী ছিলেন। তাদের অনেকেই এবং উপস্থাপক আমাকে অনুরোধ করেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বক্তব্য রাখার জন্য, ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রেরণামূলক বক্তব্য রাখার জন্য। আমি গল্পচ্ছলে বলেছিলাম : আমি একটি দল করি এবং জোটের সদস্য। তারা সহাস্যে উচ্চৈঃস্বরে বলেছিল অনেকটা এ রকম : ‘আপনি পরে মধ্যেও নিরপে, আপনি সবাইকে সম্মান জানিয়ে যেকোনো কিছু বলতে পারেন এটাই আমরা দেখেছি এবং জানি। অতএব, আমরা নিশ্চিন্ত যে আপনি যা বলবেন সেটা গঠনমূলকই বলবেন।’ নিশ্চিতভাবেই সর্বজনগ্রাহ্য বক্তব্য রেখেছি এবং সবার সাথে মেলামেশা করেছিলাম। স্কুলের অনুষ্ঠান কোনো অবস্থাতেই দলীয়করণ তো হয়নিই, এমনকি রাজনীতিকীকরণও হয়নি।
দু’টি উদাহরণের পর আবার রাজনৈতিক আলোচনায় ফিরে আসি। ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বেগম খালেদা জিয়ার প্রেস-ভাষণ এবং ৫ জানুয়ারি ২০১৫ অপরাহ্ণে জিপে দাঁড়িয়ে দেয়া ভাষণে বেগম জিয়া অত্যন্ত শোভনীয় ভাষায় এবং হৃদয়গ্রাহী ভাষায় সরকার, জনগণ এবং আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর উদ্দেশে বক্তব্য রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ধ্যা ৭টার পর তার টিভি-ভাষণে বেগম জিয়ার প্রতি আহ্বান রেখেছেন শান্তির পথে ফিরে আসার জন্য। শুধু তর্কের খাতিরে যদি বলি যে বেগম জিয়া অশান্তির পথে আছেন, তাহলে অবশ্যই আলোচনা করতে হবে, কেন আছেন? উত্তরে বলতে বাধ্য যে, বাংলাদেশের এই মুহূর্তের রাজনৈতিক সরকারের জিদ, সরকারি দলের জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিগণের অহংবোধ, সরকারি দলের প থেকে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকার লিপ্সা এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প থেকে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলটিকে অযাচিত রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাই, বেগম জিয়া এবং তার দল ও জোটকে অশান্তির পথে ঠেলে দিচ্ছে। আমি আবারো উল্লেখ করছি যে, শুধু তর্কের খাতিরে বলছি অশান্তির পথের কথা। আমার মতে, ২০ দলীয় জোট শান্তিপূর্ণভাবে বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। সরকার উসকানি দিচ্ছে, যেন ২০ দলীয় জোট অশান্তিপূর্ণ পথ অবলম্বন করে। এইরূপ সরকারি কৌশল বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকারক।

(পূর্ব প্রকাশিত ৭ জানুয়ারি ২০১৫ দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায়)

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *