সেই ইতিহাস যেন আমরা ভুলে না যাই!

অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের সূচনাতে আসে মুসলিমদের পতন, বর্ণ হিন্দুদের উত্থান, পরে স্বদেশী আন্দোলন, হিন্দু-মুসলিমের মিলন, তারপর আল্লাহু আকবার আর বন্দে মাতরমের সংযোগ ব্রিটিশ তাড়ানোর সম্মিলিত উদ্যোগ ও খণ্ড স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন!!!
কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে দিলেন ১৯২৮ সালে জওহর লাল নেহেরুর পিতা ইন্দিরা গান্ধীর দাদা মতিলাল নেহেরু। সেই সালে মতিলাল নেহেরু নেতৃত্বে ভারত শাসন আইন সংশোধনীর রিপোর্টে পৃথক নির্বাচন বাতিল করে যুক্ত নির্বাচনের সুপারিশ করে ভারত ভাগের প্রথম পেরেকটি তিনিই মেরে দিলেন। এই রূপ সুপারিশের কথা শুনেই অখণ্ড ভারতের মুসলিমদের অখণ্ড ভারতে তাদের অবস্থান কোথায় এসে দাঁড়াবে বুঝতে বাকি থাকে নাই। তখন থেকেই মুসলিমদের অখণ্ড স্বাধীন ভারতের মোহ ভঙ্গ ঘটে।
ভারতের মুসলিমরা যখন এই অন্যায়ের প্রতিবাদে ফাটিয়া পড়ে তখন তা শুনিয়া পাটনার এক জনসভায় মতিলাল নেহেরু সদম্ভে ঘোষণা করেন, “মুসলিমরা যদি কংগ্রেসের নীতি না মানে তবে ঝাড়ু মেরে তাদেরকে আরবের খেজুর গাছের তলায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে।”
তখন থেকেই ঘুমন্ত মুসলিমদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ফিরে আসতে শুরু করে।তারা বুঝিতে পারে যে অখণ্ড ভারত স্বাধীন হলেও তারা সংখ্যা গুরুর করুণা ভিক্ষা চাইয়া বসবাস করিতে হবে। নিজস্ব সত্ত্বা ও বৈশিষ্ট্য বজায়  রেখে চলা সম্ভব হবেনা। সেই সময় থেকে মুমূর্ষু মুসলিম লীগের মধ্যে ভারত ভাগের চেতনা জেগে উঠে এবং এর ফলশ্রুতিতে ভারত ভাগের আন্দোলনের শুরু হয়।
ভারতের শতকরা ৯৫ জন মুসলিম কেন সেই সময় পৃথক রাষ্ট্রের দাবী করে বসে, তা কোন সাহসে এবং কেন দাবী করেছিল তা বর্তমান প্রজন্মের মুসলিম পরিবারের সন্তানদের পক্ষে সেই সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাস না অনুধাবন করতে পারলে বুঝিয়া উঠা কোন রূপে সম্ভব নয়।
তখন এমন অবস্থা বিরাজমান ছিল যে, সেই অবস্থায় তাদের কোন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সত্তা বজায় থাকা সম্ভব ছিলনা। তাদের ধর্মীয় অনুশাসন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য চিরতরে বিলুপ্ত হবে, স্বাধীন ভারতে মুসলিমদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে বসবাস করতে হবে। ভারতের মুসলিমরা তখন বিরাজমান বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অসহায় হয়েই মুসলিম লীগের পতাকা তলে একত্রিত হয়েছিলেন। নতুবা এত বড় এক বিরাট সংখ্যাগুরু, বিশাল শক্তিধর কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জীবন মরণের সম্মুখীন হবার প্রয়োজন ছিলনা। তাই তো ১৯৪০ সালে বাঙ্গালী মুসলিমদের গৌরব এ,কে, ফজলুল হক ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলিম জনপদ নিয়ে পৃথক,পৃথক রাষ্ট্র কায়েমের প্রস্তাব করেছিলেন। ফজলুল হক কোন আবেগী বা হঠকারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। পরিণাম না বুঝে তিনি এই প্রকার প্রস্তাব উত্থাপন করে বসেন নাই। পরবর্তীকালে ১৯৪৬ সালে পৃথক রাষ্ট্রের উপর যে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল তাঁর ফলাফলে দেখা গিয়েছিল শতকরা ৯৮ ভাগ মুসলিমগণ পৃথক রাষ্ট্রের পক্ষেই গণরায় দিয়েছিলেন। আর সেই আন্দোলনের পুরো ভাগে সরওয়ার্দি, মাওলানা ভাসানী,তরুণ রাজনৈতিক শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন। আফসোস সেদিন যারা নির্বাচনের মাধ্যমে পৃথক রাষ্ট্রের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন তাদের নাতিপুতিরা ভারত বিভাগকে ভুল বলে চিহ্নিত করছেন।
যে দুইভাগ মুসলিম তখনও অখণ্ড ভারতের পক্ষে ছিলেন তারা যখন দেখতে পেলেন ১৯৪৭ এর প্রথম দিকে শুধু পৃথক রাষ্ট্র দাবী করার অপরাধে সুপরিকল্পিত ভাবে রাতের অন্ধকারে বিহারে গণহারে মুসলিম গণহত্যা,তাদের ঘর বাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া এবং মুসলিম নারীদের গণহারে ধর্ষিত হতে দেখে তারাও তখন ভাবিতে লাগিলেন যে, ভারতের মুসলিমদের জন্য অন্ততঃ এমন কিছু জায়গা থাকার প্রয়োজন যাতে বিপদের সময় তারা সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারেন। আর সেই কারণে বিহারের মুসলিমরা তাদের বাপ দাদার ভিটে মাটি যে পৃথক রাষ্ট্রের ভিতরে অন্তর্ভুক্ত হবেনা জেনেও পৃথক রাষ্ট্র কায়েমের আন্দোলনে শরীক হয়েছিলেন।

Loading

মুনিম সিদ্দিকী

About মুনিম সিদ্দিকী

ব্লগে দেখছি অন্য সহ ব্লগাররা তাদের আত্মপরিচয় তুলে ধরেছেন নিজ নিজ ব্লগে! কুঁজো লোকের যেমন চিৎ হয়ে শোয়ার ইচ্ছা জাগে তেমন করে আমারও ইচ্ছা জাগে আমি আমার আত্মপরিচয় তুলে ধরি! কিন্তু সত্য যে কথা তা হচ্ছে শুধু জন্মদাতা পিতা কর্তৃক আমার নাম আর পরিবারের পদবী ছাড়া আমার পরিচয় দেবার মত কিছু নেই! আমি এক বন্ধ্যা মাটি যেখানে কোন চাষবাস হয় নাই। যাক আমি একটি গান শুনিয়ে আত্মপ্রতারণা বর্ণনা শেষ করছি- কত শহর বন্দরও পেরিয়ে চলেছি অজানা পথে - কালেরও নিঠুর টানে- আমার চলার শেষ কোন সাগরে তা তো জানা নাই! ধন্যবাদ।

Comments

সেই ইতিহাস যেন আমরা ভুলে না যাই! — 3 Comments

  1. মুনীম ভাই এর ইতিহাসের উপর লেখাগুলো সব সময়ই ব্যতিক্রম হয়। অসাধারণ কিছু বিষয় উঠে আসে। আল্লাহ আপনার কলমকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ব্যবহারের সামর্থ দান করুন, সেই সাথে দেশ ও জাতির কল্যানে যেন আপনার লেখনী আরো শাণিত হয়, সেই কামনা করছি।

  2. ‘যে দুইভাগ মুসলিম তখনও অখণ্ড ভারতের পক্ষে ছিলেন তারা যখন দেখতে পেলেন ১৯৪৭ এর প্রথম দিকে শুধু পৃথক রাষ্ট্র দাবী করার অপরাধে সুপরিকল্পিত ভাবে রাতের অন্ধকারে বিহারে গণহারে মুসলিম গণহত্যা,তাদের ঘর বাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া এবং মুসলিম নারীদের গণহারে ধর্ষিত হতে দেখে তারাও তখন ভাবিতে লাগিলেন যে, ভারতের মুসলিমদের জন্য অন্ততঃ এমন কিছু জায়গা থাকার প্রয়োজন যাতে বিপদের সময় তারা সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারেন। আর সেই কারণে বিহারের মুসলিমরা তাদের বাপ দাদার ভিটে মাটি যে পৃথক রাষ্ট্রের ভিতরে অন্তর্ভুক্ত হবেনা জেনেও পৃথক রাষ্ট্র কায়েমের আন্দোলনে শরীক হয়েছিলেন।’

    এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে বাংলাদেশের এক শ্রেণীর লোক যাদের ভাষাতাত্ত্বিক জ্ঞান ছিল না তারাই বাংলা-উর্দু নিয়ে বেশি হৈচৈ করেছে এবং ভাষার প্রশ্নে আজও করে। আবার যারা ইতিহাস সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান রাখে না, তারাই ইতিহাস নিয়ে চিল্লাচিল্লি করে। কোন একটি বিষয়ের তাত্ত্বিক বিবেচনা কেবল তারাই করতে পারে যারা সেই বিষয়ের উপর জ্ঞান রাখে। কিন্তু এখানেই কলঙ্ক। যার যে বিষয়ে জ্ঞান নেই, সে সেই বিষয়ে রাজনৈতিক ময়দানে চিৎকার করতে থাকে। এই বৈশিষ্ট্য অতীতে অনেক রক্ত বহিয়েছে এবং আরও রক্ত বহানোর প্রেক্ষিত তৈরি করে যাচ্ছে।

    সেদিন কেন পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখা হচ্ছিল, সেটা সেই বাস্তবতা অধ্যয়নের মাধ্যমেই কেবল আত্মস্থ করা যেতে পারে। কিন্তু যারা শ্রেণী পাশ করে কাজে-কর্মে ঢুকেছে এবং যারা নিত্য-বর্তমান সংবাদ-পত্র পড়ে শিক্ষিত হয়েছে, এবং নিজেদেরকে শিক্ষিত ভেবে যা তা বলে বেড়াচ্ছে, তাদের জন্য আক্ষেপ করা ছাড়া কী করা যেতে পারে?

    লেখাটির জন্য ধন্যবাদ।

  3. ইন্ডিয়ান মুসলিমদের ইতিহসের একটি গুরুত্বপূর্ন দিক তুলে ধরেছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ প্রসঙ্গে অনেক কথা বলার অছে সময়ের অভাবে বলতে পারছি না।
    ধন্যবাদ দেয়ার জন্য মন্তব্য করলাম। পরে হয়তো কখনও চেষ্টা করব।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *