মুসলিম দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবর্তন

মুসলিম বিশ্বে সর্বপ্রথম তুরস্কে  ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় নীতিতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন মুস্তফা কামাল পাশা আতাতুর্ক (জন্ম : ১৮৮১, মৃত্যু : ১৯৩৮)।  ১৯২৮ সালে দেশটির শাসনতন্ত্রে “রাষ্ট্রের ধর্ম ইসলাম” সরানোর সংশোধনী বিল চালু করে সেকুলারিজম প্রতিষ্ঠা করা হয়।  তার ক্ষমতার মেয়াদকাল ছিল ১৯২৩-১৯৩৮ পর্যন্ত।উসমানী খেলাফতের শেষের দিকের সুলতানদের অযোগ্যতা-অদক্ষতা ও অপরিণামদর্শিতার কারণে মুস্তফা কামাল পাশা আতাতুর্ক তার শাসন আমলে  তুরস্ককে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিলেন। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তির এজেন্ট ঐ লোকটি ইউরোপের একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ তুরস্ককে তথাকথিত প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সংস্কার এবং আধুনিকীকরণের নামে তখনকার সময়ে সেকুলারিজমকে সে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে তিনি যে সব কাজ করেছিলেন তা আজ অনেক মুসলিমের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে।

একসময়ে সালতানাতে উসমানিয়ার রাজধানী ছিল তুরস্ক ছিল এবং  সে খেলাফতের শাসনে (মক্কা ও মদিনা) হারামাইন শরীফাইনসহ পৃথিবীর একটি বিশাল অংশ শত শত বছর ছিল। সেই দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ঝোঁক (whims) একটি মুসলিম জাতিকে কত উঁচু থেকে কত নিচুতে নিক্ষেপ করতে পারে তার উদাহরণ মিলে কামাল আতাতুর্কের শাসন আমলে। তুরস্কে আতাতুর্কের সে আমলে সেকুলারিষ্টরা ইসলাম ও মুসলিমদের ট্র্যাডিশন বিনষ্ট করতে কি কি করেছিল তা হয়ত অনেকেরই জানা আছে যারা ইতিহাস চর্চা করেন। মিডিয়াতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তুরস্কের সবাইকে তাদের দৈনন্দিন চলাফেরা ও পোশাকে, চিন্তাধারায় ইউরোপিয়ান লাইফ স্টাইল অনুসরণের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া হত।

খুব সহজ একটা উদাহরণ হল নামাজের আহ্বান আযান। মাইকে দেওয়া আযান তো নিষিদ্ধই ছিল এমন কি ১৪ শত বৎসর ধরে মুসলিমরা যেভাবে আযান দিত তা বদলিয়ে  তুর্কি ভাষায় আযান দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। সকল ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। মানুষ লুকিয়ে, বলা যায় গর্তের ভিতরে থেকে থেকে কুরআন ও ইসলামি শিক্ষা চালু রেখেছিল।  তুরস্কের বর্ণমালা ঠিক আরবির মতোই ছিল। এখনো তুর্কী ভাষায় লেখা বই-পত্র পাওয়া যায়। কিন্তু আতাতুর্ক সে বর্ণমালাকে নিষিদ্ধ করে রোমান অক্ষর চালু করেছিল। এখন সেখানে রোমান লিপি চলে। অর্থাৎ ইংরেজি অক্ষরে তুর্কী ভাষা লেখা চালু করা হয়। আতাতুর্ক শুধু ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান তৈরি করে এবং ইসলামী শিক্ষা বন্ধ করেই ক্ষান্ত হননি; বরং সে দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে সেক্যুলারিজমের আখড়া করেছিলেন। বিশেষ করে  প্রতিরক্ষা তথা আর্মি ও আদালতকে কড়া সেক্যুলার বানিয়ে গেছেন। কঠোর হস্তে সেখানে সেক্যুলারিজমের ধর্ম ও ইসলাম পন্থীদের বিরুদ্ধে একপক্ষীয় যুদ্ধ চালানো হয়েছে। কেননা ধর্মের পক্ষের লোকজন ছিল অস্ত্রশস্ত্রহীন। হাজার হাজার লোককে প্রহসনের বিচার করে-বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে। এভাবে সেক্যুলারিজমকে সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছিল। সেক্যলারিজমের  বিপক্ষে কিছু বলা বা করা ছিল বেআইনি এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। আর আর্মি ও আদালতকে এত কড়া সেক্যুলার বানানো হয়েছিল যে, তারা কোনো ধর্মীয় দলকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে  ক্ষমতায় আসতে দেওয়া তো দূরের কথা, কোনো দাড়িওয়ালা বা কোনো হিজাব পড়ুয়া মহিলার স্বামীকেও রাষ্ট্রপতি হিসেবে গ্রহণ করেনি; যদিও তাদের কর্তৃক পরিচালিত নির্বাচনেই ঐ ব্যক্তিরা জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত দলকে নিষিদ্ধ করে দিতে কোনো দ্বিধাই করেনি ঐ শক্তিগুলো।

তবে তুরস্কের ইসলামিক চিন্তাবিদরা ও ধর্মপ্রাণ মানুষেরা অত্যন্ত সুপরিকল্পিত, সুকৌশল আর ধৈর্য সহকারে  ও অক্লান্ত পরিশ্রমে সে দেশের জনগণকে সেক্যুলারিজমের কুপ্রভাব থেকে মুক্ত করতে সম্ভব হচ্ছেন। তুরস্কের  বর্তমান সরকারের নীতিতে সেই প্রচেষ্টার সুফল দেখা যায়। তাই বর্তমান সরকারকে পশ্চিমা মিডিয়া মুস্তফা কামাল পাশা আতাতুর্কের সেক্যুলারিজম বিরোধী ইসলামপন্থী বলে অসন্তোষ প্রকাশ করে। তবে বর্তমান এই সরকারকেও অনেক ধৈর্য ও কৌশলের বিনিময়ে ক্ষমতায় আসতে হয়েছে। বিভিন্ন কারণে কয়েকবারই দলের নাম পরিবর্তন করতে হয়েছে। কখনো দেশের সংবিধানের সাথে মিল নেই বলে, কখনো দেশের মেইন স্ট্রিম আদর্শের সাথে মিল নেই ইত্যাদি নানা বাহানায় পুরো দলকেই অযোগ্য ঘোষণা করে দিয়েছে আদালত ও আর্মিরা। তারপরও তারা ধৈর্য হারায়নি। চেষ্টা ও পরিশ্রম  অব্যাহত রেখেছে। মহান আল্লাহ মেহেরবানিতে এখন সেখানে পরিবর্তন ঘটছে। তুরস্কের বৃহত্তর জনগণ আজ তাদের দেশের স্বার্থ রক্ষা কিভাবে করা যায় তা বুঝতে সক্ষম। কট্টর সেক্যুলার কামাল আতাতুর্ক শাসনামলে তুরস্কের জনগণের ধর্ম পালনের অধিকার কেড়ে নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামী ঐতিহ্য ও চেতনা বিমুখ যে সমাজ গড়ে উঠেছিল সেখানে রক্ষণশীল রাজনীতিতে ফিরে আসা সহজ কাজ ছিলনা।

বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা

বাংলাদেশে সেকুলারিজমের জোয়ার উঠে ১৯৭২ সালে । সদ্য স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রের নতুন সংবিধানের মূলনীতিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়  এবং  জনগণকে বলা হয় এই ধর্মনিরপেক্ষতার জন্যই এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। সম্প্রতি মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ তাঁর এক নিবন্ধে লিখেন, ” মুক্তিযোদ্ধাদের ধর্মীয় পরিচয় যাই হোক, অল্প ধার্মিক হোক বা বেশি ধার্মিক যুদ্ধের সময় তারা জানতেন না যে, তারা সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য যুদ্ধ করছেন। এটা জেনেছেন তারা ১৯৭২ এর শেষে স্বাধীনতা যুদ্ধেরও আরো এক বছর পরে। ১৯৭২ সালে ২৫ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তির মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়।  ভারত সেক্যুলার হওয়ার জন্যে বাংলাদেশকে প্রেসক্রিপশন দেয়ার পর থেকেই সি আর দত্ত সহ একশ্রেণীর লোক উপরোক্ত দাবি জানাতে শুরু করে”

সেকুলারিজমের ব্যাপারে কোন গণভোট বা জনমত নেয়া হয় নাই তাই সেকুলারিজমের কোন গণতান্ত্রিক ভিত্তি নাই বাংলাদেশে। বাংলাদেশের অনেক উদারপন্থী বা লিবারেল মুসলিমদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতা তেমন দুষের কিছু নয় মনে হওয়া স্বাভাবিক কারণ ইসলামী আদর্শে ধর্মনিরপেক্ষতার অবস্থান কোথায় তারা তা জানেন না বা জানার প্রয়োজন মনে করেন না। তারা জানেন না বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হচ্ছে এদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মন মানসিকতা থেকে ইসলামকে বিদায় করা তাদেরকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করা ও একটি বিশেষ গুষ্টির সুদূর প্রসারী স্বার্থ সিদ্ধি। এমন একটি যুব সমাজ সৃষ্টি করা যারা রাষ্ট্রের বা জাতিয় স্বার্থের পরিপন্থী কোন পদক্ষেপ কেউ নিলে তার বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ উপায়ে হলেও সংগ্রাম বা আন্দোলন করার স্পৃহাকে নিভিয়ে দেয়া। এক এগারোর পর থেকে বাংলাদেশ যে রাজনৈতিক শক্তির কবলে পড়েছে তাদের শক্তির উৎস ও ভিত্তি হচ্ছে একটি বিদেশী রাষ্ট্রের করুণা নির্ভর। এদের কাজ হচ্ছে এদেশের মানুষকে মনে প্রাণে তাদের অনুগত করা। সে জন্য সব চেয়ে বড় প্রয়োজন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন।

আমাদের শিক্ষা কমিশন

বাংলাদেশে আজ অনেকেরই অভিযুগ হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতার ও সেকুলারিজমের নামে বাংলাদেশের শিক্ষা নীতি প্রনয়ন করা হয়েছে যাতে মুসলিম যুবসমাজের মনে ইসলামী মূল্যবোধের চর্চা, রাসুলের শিক্ষা  তথা সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব, ন্যায়পরায়ণতা, মানবতা, সততা, আল্লাহর উপর আস্থা বিশ্বাস ও  দেশ প্রেম ইত্যাদি ইসলামের  আদর্শকে গুরুত্বহীন করে শুধু মাত্র বৈষয়িক বিষয়ের প্রধান্য দিতে। তাই আজ অনেকেই বলেন বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের নামে ধর্মীয় মূল্যবোধকে বিসর্জন দেয়া হয়েছ। ধর্মনিরপেক্ষতাকে মাথায় নিয়ে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। শিক্ষা কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তিন জায়গাতেই পাকাপোক্ত কড়া বাম ব্যক্তিরা দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই বর্তমান শিক্ষানীতিতে শিশু শ্রেণী থেকেই মুসলিম ছেলেমেয়ের সেক্যুলার আদর্শে গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়েছে। সেভাবেই তৈরি হয়েছে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্যাস্ত

বাংলাদেশের মানুষ ভারত বিরোধী হতে চায় না। ভারতের সাথে আমাদের সুসম্পর্ক থাকার প্রয়োজন আছে উভয়ের স্বার্থে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি ভারতে আচরণ লক্ষ্য করলে এটা স্পষ্ট দেখা যায় যে ভারত  চায় না বাংলাদেশের সত্যিকার স্বাধীনতা। চায় না, এ দেশটির সংখ্যগরিষ্ট জনগণ তাদের নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ও  নিজ ধর্মীয় বিশ্বাসের আদর্শ নিয়ে স্বাধীন ভাবে বেড়ে উঠুক। আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী ভারত লবির সে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে স্বাধীনতার সূর্যাস্ত হয়ে গিয়েছে এক এগারোর তত্বাবধায়ক সরকারের ছদ্মবেশে ভারতের স্বার্থ রক্ষার  মইন ইউ আহমেদের সামরিক শাসনের  যাত্রা থেকে এবং তাকে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের আন্দোলনের ফসল বলে দাবী করেছেন শেখ হাসিনা নিজে বহুবার যা আমরা মিডিয়ায় শুনেছি। সে ধারাবাহিকতায় দেশের বর্তমান শাসকগুষ্টিও ভারতের স্বার্থ রক্ষায় নাকে খত দিয়ে  ভারতের সরাসরি সহযোগিতায় ক্ষমতায় আছেন তা এখন সবাই দেখতে পাচ্ছেন। তারা ভাবছে তারা যা করছে তা হচ্ছে নিছক রাজনীতি এবং রাজনীতিতে ক্ষমতায় থাকতে এরকম করাটাই সঠিক। কিন্তু তারা যে দেশের ভবিষ্যত নির্মূল করে দিচ্ছে শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে ও হালুয়া রুটির ভাগিদার হতে গিয়ে সেটা তাদের বিবেকে আসছে না। আর দেশ শাসনে বিএনপি দলটি যে একেবারে তুলসি ধোয়া নিষ্কলুষ তা কেউ বলবে না এবং তাদের মধ্যে যে ভারত লবীর দালাল ছিল না তাও অস্বীকার করা যায় না  কিন্তু তা স্বত্বেও তাদের শাসন আমলে ভারতের কোন মন্ত্রী এসে এ দেশের নির্বাচনে কোন পার্টি ক্ষমতায় দেখতে চায় এ কথা বাংলাদেশের মাটিতে বসে বলার মত সাহস ছিল না। কিন্তু বর্তমানে তা সম্ভব হচ্ছে এতেই বুঝা যায় এদেশের উপর কতটুকু হোল্ড স্থাপন করতে পারলে একটি স্বাধীন দেশের আভ্যন্তরিন বিষয়ে এরকম কথা বলার সাহস হয়। আজ কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশের রাজনৈতিক মেরুকরণ  বিদেশী শক্তির আজ্ঞাবাহী তা সবাই বুঝলেও করার কিছু নাই! এভাবে সার্বভৌমত্বের চরম অবনতি কি কোন স্বাধীন দেশে হতে দেয়া যায়? এ প্রশ্ন সবার মনে জাগলেও আজ কেউ এগিয়ে আসবে না। তাই সামজিক মিডিয়ায় অনেকের লিখায় দেখা যায় বলতে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী “ভারত লবীর”  সৌভাগ্য যে আজ তাদরেকে চোরা পথে আগরতলায় গিয়ে ভারতীয় গুপ্তচরদের সাথে গোপন বৈঠক করতে হয় না, সে বৈঠকগুলি বসে এখন এদেশের ভিতরে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে। আর সেখানে ষড়যন্ত্র হয় কিভাবে জাতীয়তাবাদী শক্তি নিধনে কত জনকে হত্যা, গুম কিংবা ফাঁসীতে ঝুলানো যায়।

একটা জিনিস লক্ষণীয় যা আজকাল অনেককে বলতে শুনি যে বিশ্বের বহু দেশই বহু যুদ্ধ জয় করেছে, বিশাল বিশাল সাম্রাজ্যও প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু বছরে মাসব্যাপী এরূপ উৎসব পালনের ইতিহাস সৃষ্টিতে এক শ্রেণীর চেতনা ব্যবসায়ীদের অতি উৎসাহ দেখে আজ যদি প্রশ্ন করা হয় এ অঞ্চলের জনগণের অতীত সব ইতিহাসকে বিলীন করে শুধু মাত্র ইতিহাসের একটি সময় নিয়ে এত আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে থাকার কি তাৎপর্য?  এটা কি এ জন্য যে আমরা একটি পতাকা পেয়েছি বলে এবং এ দেশকে স্বাধীন করতে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদেরকে শ্রদ্ধা করতে কিংবা এদেশের মানুষকে সত্ ও ন্যায়পরায়ণ, দেশপ্রেমিক ও  দুর্নীতিমুক্ত করতে? কিন্তু বাস্তবে তো তার কোন ফল আমরা দেখছি না! বরং যত দিন যাচ্ছে খুনির দল, লুটপাটের দল, বিদেশী দালালের দল, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, সন্ত্রাসীদের ত্রাসের রাজত্ব কেবল  আরো বাড়ছে দিনে দিনে!

তাহলে উদ্দেশ্য কি অন্য কিছু? তাই আজ অনেকেই বলতে  দেখি,

বাংলাদেশী মানুষের সমগ্র ইতিহাস ডুবে আছে  ভারতের শত্রু একমাত্র পাকিস্তানকে পরাজিত করার খুশীতে আর এ  প্রচেষ্টায় এদেশের যুব-সমাজ আজ যে আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছে তা বুঝার ক্ষমতা কয় জনের আছে? দেশপ্রেম, মানবতা, ক্ষমা ও ভালবাসা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার যে ঐতিহ্য এদেশের যুবসমাজের ছিল তা আজ কোথায়? গরীবের ছেলেরা ভুগছে বেকারত্বে আর ধনীর দুলালেরা হয়েছে ডিজিট্যল জাম্বি। তাই আজ খুঁজতে হয় স্বাধীনতার চেতনা তুমি কোথায়?

রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম।

বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম রাখাটা বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষতার কনসেপ্টের সাথে সাংঘর্ষিক বলে সেকুলারিষ্টরা যে দাবী করছেন তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সঠিক বললে ভুল হবেনা। কয়েক দিন আগে শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম থাকবে কি না সে মামলার শুনানী হতে যাচ্ছে শুনে হুজুররা রাস্থায় মিছিল করেছেন, “রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম” লিখা থাকতে হবে শাসনতন্ত্রে এ দাবীতে। কিন্তু আদালত সে মামলা না শুনেই অন্য কারণে বিচারক মামলা খারিজ করে দিয়েছেন। যার অর্থ দাড়ালো সময় মত অন্য কেউ এ মামলা আবার করতে পারবে।

হুজুরদেকে জানতে হবে কি প্রেক্ষাপটে এসব সৃষ্টি হচ্ছে? আগে জানতে হবে এ প্রেক্ষাপট যাতে সৃষ্টি হতে না পারে সে জন্য কি করতে হবে? সাপের মাথায় আঘাত করার দক্ষতা অর্জন করতে না পারলে কিছু হবে না আর সেটা সহিংসতায় না গিয়েও সম্ভব শুধু প্রয়োজন ব্রেইন পাওয়ার। আর সে জন্য প্রয়োজন সুপরিকল্পিত, সুকৌশল আর ধৈর্যসহকারে সকল ইসলামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ  অক্লান্ত প্রচেষ্টা যাতে আধুনিক শিক্ষিত মুসলিম নারী পুরুষ এবং যুব সমাজকেও সম্পৃক্ত করা যায়। আর এসব অবশ্যই হতে হবে উপস্থাপনযোগ্য ও সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য, যুক্তিপূর্ন কথাবার্তা, লেখালেখি ও বক্তৃতা দিয়ে। নিজেদেরকে কিং মেইকার বানাতে হবে। শুধু মাঝে মধ্যে রাস্তায় নেমে চিৎকার দিলে কোন কাজ হবে না। যারা আজ  রাস্তায় নেমে চিৎকার দেন তাদেরকে যদি প্রশ্ন করা হয় তাদের দাবী মানলে এদেশের শাসন ব্যবস্থায় ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে তা কীভাবে কাজে লাগবে? কীভাবে দেশের আন্যান্য সংখ্যালগু জনগুষ্টির স্বার্থ রক্ষা হবে? তার উত্তর কি তারা দিতে পারবেন? এখানেই আসে ব্রেইন পাওয়ার যা একটু আগে উল্লেখ করা হয়েছে।

তুরস্ক বনাম বাংলাদেশ

তুরস্কের অনুরূপ অতীত ষড়যন্ত্র এবং দীর্ঘকালীন যাত্রা ভেদ করে তুরস্ক যে অবস্থানে এসেছে সেখান থেকে আমাদের কিছু শিখার আছে, কি নাই –তা বিবেচনা করে দেখতে হবে। তুরস্কের ইতিহাস থেকে বাংলাদেশের মুসলিমদেরকে শিক্ষা নিতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে। অন্যদেরকে সতর্ক করতে হবে এবং যারা মজলুম তাদের জন্য আশার বাণী হচ্ছে, তুরস্কের বর্তমান পরিস্থিতি। যেখানে ঐ অপশক্তিগুলোর হুংকার কমে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু সেটি ঘটেছে অসংখ্য শহীদের রক্ত, মজলুমানের কান্না, অসীম ধৈর্য ও অক্লান্ত পরিশ্রমের পর। এ তুর্কিতেই একসময় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হত পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটে। পার্লামেন্ট নির্বাচনে সেক্যুলার আর্মি বড় বড় অফিসাররা পাহারাদারি করত। প্রায় বিশ-ত্রিশজন বড় বড় আর্মি অফিসারের রাঙ্গানো চোখের সামনে দিয়ে ভোট দিতে হত। ভোটের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বসে থাকত লোকগুলো। এভাবে তারা যতদিন পেরেছে নিয়ন্ত্রণ করেছে। আজ তুরস্কের বর্তমান সরকারকে   মুসলিম বিশ্বের স্বার্থের পক্ষের শক্তি হিসাবে দেখা যায় কিন্তু তারা অনেক ধৈর্য ও কৌশলের বিনিময়ে সে ক্ষমতা অর্জন করেছে। তুরস্ক কেন ন্যটোর সদস্য হয়ে আছে সে সম্পর্কে উগ্রপন্থী তথাকথিত ইসলামিষ্টরা নানা বিরূপ মন্তব্য করতে দেখা যায়! তবে এসব যে তাদের সংকীর্ণ মানসিকতা ও দূরদৃষ্টির অভাব এবং হঠকারী স্বভাবের প্রকাশ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কীভাবে পশ্চিমা শক্তিকে সামাল দিয়ে তুরস্কের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে চলতে হবে তা তুরস্কের বর্তমান সরকার ভাল করেই জানেন বলে বিভিন্ন সময় দেখা গিয়েছে। তবে তুরস্ককে অস্থিতিশীল করার জন্য পশ্চিমা শক্তিরা যে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে তা তুরষ্কের জনগণ ভালভাবে জানেন। তুরষ্কের বর্তমান সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে কুর্দিস বিছিন্নবাদীদের সন্ত্রাসী আন্দোলন।  ইহুদিবাদী ইসরাইলের লক্ষ্য হচ্ছে  ইরাককে ভেঙ্গে ও সিরিয়ার কিছু অংশ ও তুরষ্কের কিছু অংশ আলাদা করে কুর্দিদের জন্য তাদের তাবেদার একটি স্বাধীন রাষ্ট্র করা।  তাই স্বাধীন কুর্দিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে পিছন থেকে মদদ যোগাচ্ছে পশ্চিমা শক্তি। আর এই এজেন্ডা বাস্তবায়নে ইরাকের কুর্দিস্তান আধা-স্বায়ত্তশাসিত সরকারকে অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ দিয়ে  সাহায্য করা হচ্ছে।  তাছাড়া তুরস্কের আরেক সমস্যা সিরিয়ায় সংঘাত শুরু হওয়ার পর দেশটির বিশ লাখেরও বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে তুরস্ক কিন্তু আরও শরণার্থীকে তারা এখন আশ্রয় দেবে কিনা সেটা এখন পরিস্কার নয়। নতুন করে যে শরণার্থীদের ঢল নেমেছে, তাদের আশ্রয় দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দিক থেকেও চাপের মুখে আছে তুরস্ক। তবে দেশে আশ্রয় না দিতে চাইলেও সীমান্তে তাদের খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তুরস্ক। এসব সমস্যা মোকাবিলায় তুরষ্কের অধিকাংশ মানুষ বর্তমান সরকারের পক্ষে। ইউরুপের অন্যান্য দেশের তুলনায় তুরষ্কের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবৃদ্ধির হারও বাড়ছে। তুরষ্কের সাথে বাংলাদেশের বিলিয়ন ডলারের চলমান বানিজ্য আগামী দিনে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন আঙ্কারায় গত সাড়ে ৪ বছর দায়িত্ব পালনকারী রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমান।  সম্প্রতি  নতুন এক জনমত জরিপে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে যে শতকরা ৫৭ ভাগ জার্মান নাগরিক তুরস্কের অর্থনীতি ও সামরিক শক্তি বাড়ায় উদ্বিগ্ন। এ ছাড়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নে তুরস্ককে অন্তর্ভূক্ত করার বিরোধিতা করেছে শতকরা ৬০ ভাগ জার্মান নাগরিক। দেশটির সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন বিল্ড অ্যাম সোনট্যাগ এ তথ্য প্রকাশ করেছে।

তবে এটা বুঝতে হবে  ইসলামী ইতিহাসে তুরষ্কের যে এক গৌরব উজ্জল ইতিহাস ছিল তার কারণেই হয়তবা তারা আবার ইসলামের দিকে ফিরে যেতে চাচ্ছে তাদের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে। অনেকে বলেন বাংলাদেশের তেমন কোন ইতিহাস নাই যা বাংলাদেশকে সেকুলারিজমের চাপ থেকে মুক্তি পেতে একটি সম্পুরক শক্তি হিসাবে কাজ করতে পারে। আর আমাদের নতুন প্রজন্মের যুবসমাজকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা যেভাবে মগজ ধোলাই করে যাচ্ছে সেটাই হচ্ছে  উদ্বেগের কারণ! তাই বর্তমান বাম রামদের অধিকৃত বাংলাদেশের  চরম বৈরিতামূলক পরিবেশে এ দেশের আলেম উলেমারা যদি তাদের দলীয় কোন্দল এড়িয়ে বৃহত্তর লক্ষ্যে একতাবদ্ধ হয়ে অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারেন তাহলে ইসলামের আলো জালিয়ে রাখার সম্ভব হতে পারবে ইনশাল্লাহ।  তবে এটাও মানতে হবে এই জাতি যুগে যুগে আগ্রাসী শক্তির সাথে আন্দোলন সংগ্রাম করে জানিয়ে এসেছে তারা কারো তাঁবেদারি মেনে নিতে রাজী নয়। ইসলামের শিকড় এদেশের মানুষের মন থেকে সহজে উপড়িয়ে ফেলা যাবেনা

এটা বুঝেই হয়তো আমাদের  প্রতিবেশী  বন্ধুরা  নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক দাবী করলেও বাংলাদেশে স্বৈরাচারীদের শরীরে গণতন্ত্রের শাড়ী পরতে দেখলেও ওরা না দেখার ভান করে । তারা ভাবছে এ অবস্থা আরো কয়েক দশক চালিয়ে যেতে পারলে সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে কার স্বার্থে?

 

 

রেফারেন্স কৃতজ্ঞতা প্রকাশ:  মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ রচিত “ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও ইসলাম”

 

 

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *