বর্তমান বিশ্বের বেশিরভাগ মুসলিম দেশেগুলোতে স্বৈরাচারী কর্তৃত্ববাদী, অত্যাচারী, অবৈধ দু:শাসন ও চরম স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্র এবং অনুন্নত অবকাঠামোর উন্নয়নের নামে দুর্নীতি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে চরম সঙ্কট বিরাজমান তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নাই। তাছাড়া মুসলিম দেশের চলমান গৃহযুদ্ধ, বৈদেশিক হস্তক্ষেপ এবং অর্থনৈতিক বঞ্চনার সাক্ষী তো সবাই হয়েই আছেন! সে কারণে সবাই যেন চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করতে চায় “মুসলিম ঐক্য আজ কোথায়?”
ঠিক আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে, এই উদ্দেশ্যে একটি মুসলিমদের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা তৈরি করা হয়েছিল।
৫৭টি সদস্য রাষ্ট্র মিলে গঠন করা হয়েছিল ওআইসি অর্থাৎ ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (প্রথমে বলা হত সম্মেলন)। আর এ সংস্থাটি জাতিসংঘের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সংস্থা।
জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদে অগ্নিসংযোগের হামলার প্রতিক্রিয়ায় মরক্কোর রাবাতে ১৯৬৯ সনের সেপ্টেম্বরের ২২ থেকে ২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত মুসলিম শীর্ষ সম্মেলনে ওআইসি গঠিত হয়েছিল।
ওআই সি সনদের ঘোষণা ছিল “আল কুদস শহরকে মুক্ত করে সেথায় হবে এ সংস্থার স্থায়ী সদর দফতর আর তা না হওয়া পর্যন্ত সৌদি আরবের জেদ্দা শহরেই থাকবে ওআইসির অস্থায়ী দফতর”। সৌদি আরবে ইসলামের প্রাণ কেন্দ্র তথা পবিত্রতম শহর মক্কা এবং মদিনা অবস্থিত হওয়ায় স্বভাবতই সে সময় সবাই জেদ্দা শহরকেই মিলনস্থান করে এ কাজ পরিচালনায় সম্মতি প্রকাশ করেন। তদুপরি, এই শীর্ষ সম্মেলনের পিছনে সূচনা শক্তিটি ছিল তৎকালীন সৌদি বাদশাহ ফয়সাল যিনি ছিলেন তাঁর সময়ের শীর্ষস্থানীয় প্যান-ইসলামিক ব্যক্তিত্ব।
তবে বাদশাহ ফয়সলের সময়কার সৌদি আরব আর আজকের সৌদি আরব এক নয়! তখনকার চেয়ে আজ অনেকটাই আলাদা।
তাহলে কি সময় এসেছে নতুন করে ওআইসি তৈরির?
মুসলিম বিশ্বের বর্তমানের হতাশাজনক পরিস্থিতির আলোকে মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রপতি মাহাথির মোহামাদ কুয়ালালামপুরে একটি সম্মেলন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন যাতে মুসলিম বিশ্বের জ্ঞানীগুণী বুদ্ধিজীবী এবং এক্টিভিষ্টদের একত্রিত হতে পারেন।
তিনি এটিকে বর্ণনা করেছিলেন: “[এ] প্রথম পদক্ষেপ… মুসলমানদের তাদের অতীত গৌরব পুনরুদ্ধারে সহায়তা করার জন্য, বা কমপক্ষে আজকে আমরা বিশ্বজুড়ে যে ধরণের অপমান ও নিপীড়ন দেখি তা এড়াতে তাদের সহায়তা করার জন্য।”
সে শীর্ষ সম্মেলনটির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলনা কেবল রাজনৈতিক ইস্যুতে,বিশেষ করে অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম বিশ্বে টেকসই উন্নয়নের প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে আলাপ আলোচনা মাধ্যমে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছার চেষ্টা করা।
কিন্তু এ শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণার সাথে সাথেই গুজব ছড়িয়ে পড়ে এবং আশঙ্কা দেখা দেয় যে শীর্ষ সম্মেলনের উদ্যোক্তারা যারা বা যে পাঁচটি প্রাথমিক দেশ মালয়েশিয়া, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান এবং কাতার এরা হয়তবা ওআইসির বিকল্পে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য একটি নতুন শক্তি গঠনের চেষ্টা করছে! অবশ্য প্রধানমন্ত্রী মাহাথির সে গুজব অফিসিয়ালি অস্বীকার করে সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজকে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে এ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলে খবর এসেছে কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়েছে বলে দেখা যায়নি। মালয়েশিয়ার আয়োজিত সম্মেলনটির কঠোর সমালোচনা করছে সৌদি আরব। সৌদি নেতৃত্বাধীন ‘ইসলামী সহযোগিতা সংস্থাকে (ওআইসি) ধ্বংস করার জন্য এটির আয়োজন হচ্ছে বলে জানিয়েছে রিয়াদ। ওআইসির সদস্য সংখ্যা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ৫৭। অন্যদিকে ওআইসির সব সদস্য দেশকে কুয়ালালামপুর সম্মেলনে নিমন্ত্রণ জানানো সত্ত্বেও মাত্র ২০ দেশ এতে সাড়া দিয়েছে।
‘জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষা উদ্বেগ’
কুয়ালালামপুরে সামিট ২০১৯ শীর্ষ সম্মেলন চলাকালীন সময়ে মিডিয়াতে কনফারেন্সের এজেন্ডা বা এর সম্ভাব্যতার উপর আলোচনার পরিবর্তে বেশিরভাগ কভারেজ ছিল এ সম্মেলন থেকে পাকিস্তানের সরে যাওয়ার খবরে এবং মিডিয়া এ বিষয়ে আলোচনায় বেশী নিবদ্ধ ছিল।
খবরে প্রকাশ শীর্ষ সম্মেলনের চার দিন আগে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানের সাথে বৈঠকের জন্য “তলব করা” হওয়ার পর পাকিস্তানের ইমরান খান সম্মেলন থেকে বেরিয়ে যান। সৌদি আরবের অর্থনৈতিক চাপের কারণে খান মালয়েশিয়ার শীর্ষ সম্মেলন থেকে সরে আসার কথা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে। তবে কুয়ালালামপুরের শীর্ষ সম্মেলনে পাকিস্তানের অংশগ্রহণ না করার বিষয়ে রিয়াদের প্রতিক্রিয়া এসেছে।
পাকিস্তান, বর্তমানে একটি অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি, গত বছর সৌদি আরব থেকে ছয় বিলিয়ন ডলার ব্যাইলআউট পেয়েছে এবং সে দেশে তাদের ৪০ লক্ষ অর্থাৎ ৪ মিলিয়ন পাকিস্তানি চাকুরী করে যারা দেশে প্রচুর রেমিট্যান্স প্রেরণ করে। তাছাড়া দু’দেশের মধ্যকার দীর্ঘদিনের সামরিক সহযোগিতা চুক্তি
বিদ্যমান।
তদুপরি, পাকিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জেনারেল পারভেজ মোশাররফ, যাকে সম্প্রতি চরম দেশদ্রোহিতার দায়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানি আদালতে, বর্তমানে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রবাস জীবন কাটাচ্ছেন সে দেশও সৌদির বড় মিত্র।
এ বছরের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন চলাকালীন সময় মালয়েশিয়ান ও তুর্কি রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে বৈঠকে এ সম্মেলন সূচনা করার ব্যাপারে ইমরান খানের অন্যতম ভূমিকা ছিল তাই এ সম্মেলন থেকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানকে প্রত্যাহার করা খানের জন্য ছিল একটি বড় ধাক্কা! খানের এই ঘোষণার পর শীঘ্রই ইন্দোনেশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট মা’রুফ আমিনের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসে যে তিনিও তার অসুস্থ স্বাস্থ্যের কথা উল্লেখ করে উপস্থিত থাকবেন না।
একটি উঠতি জোয়ার
ইরানের প্রেসিডেন্ট কুয়ালালামপুর শীর্ষ সম্মেলনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পেশ করেছেন। প্রস্তাবগুলো হচ্ছে:
- মুসলিম দেশগুলোর মাঝে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার জন্য যৌথ তহবিল গঠন করা।
- আর্টেফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিসহ সাইবার সিকিউরিটির ক্ষেত্রে যৌথ গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা এবং
- ডিজিটাল অর্থনীতি ক্ষেত্রে মুসলিম দেশগুলোর যৌথ বাজার প্রতিষ্ঠা করা।
এই তিনটি প্রস্তাব কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে মুসলিম বিশ্বে প্রভাব বিস্তারকারী একটি মেরু তৈরি হবে। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক, ভাষাগত, ধর্মীয় এবং সভ্যতাগত অভিন্নতা। ফলে এরকম শক্তিশালী একটি মেরু তৈরি হওয়াটা খুবই সহজ।
ড. রুহানির দেয়া প্রস্তাবগুলো কোনো মুসলিম দেশের স্বার্থেরই বিরোধী নয়। এমনকি কোনো মুসলিম দেশের সমাজব্যবস্থার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক নয়। কাজেই ইরানের প্রেসিডেন্টের দেয়া গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলো মুসলিম বিশ্ব ইতিবাচকভাবেই নেবে বলে বিশেষজ্ঞমহল মনে করছে।
কুয়ালালামপুরে সামিট ২০১৯-এ দেয়া বক্তৃতায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান মুসলিম দেশগুলোর দুর্দশায় মুসলিম সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তার তীব্র নিন্দা এবং সমালোচনা করেছেন। এরদোগান বলেন, “আমরা যদি এখনো ফিলিস্তিন ইস্যুতে কোনো কিছু করতে না পারি, আমরা যদি এখনো আমাদের সম্পদ শোষণ করা বন্ধ করতে না পারি, যদি এখনো আমরা বলতে না পারি যে, মুসলিম বিশ্বে সাম্প্রদায়িক বিভাজন বন্ধ করো- তাহলে এটা চলতেই থাকবে।”
মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন সংকট ও দুর্দশায় এ পর্যন্ত ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা বা ওআইসি তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে নি। এরদোগান দৃশ্যত ওআইসি-কে লক্ষ্য করেই এসব কথা বলেছেন। কুয়ালালামপুর সামিটে সৌদি রাজা সালমান বিন আব্দুল আজিজ অংশ নিতে অস্বীকার করেছেন। এরপর ওআইসি গতকাল বলেছে, সৌদিভিত্তিক এ সংস্থার বাইরে এ ধরনের বৈঠক ডাকা মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ-বিরোধী।
প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেন, কুয়ালালামপুর সম্মেলন মুসলিম নেতাদের জন্য মুক্তভাবে ইসলামফোবিয়া থেকে শুরু করে সন্ত্রাসবাদ, বিভক্তি, অন্তর্কলহ, আমাদের অঞ্চল ধ্বংস করা এবং সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সংঘাতের মতো বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনার সুযোগ এনে দিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট এরদোগান তার বক্তৃতায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পূনর্গঠনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এ সংস্থার স্থায়ী এ পাঁচটি দেশ বিশ্বের ১৭০ কোটি মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। এসব দেশের চেয়ে বিশ্ব অনেক বড়।
সম্মেলনের শেষ দিন ইরান, মালয়েশিয়া, তুরস্ক ও কাতার নিজেদের মধ্যে লেনদেনে স্বর্ণ ও বার্টার প্রথার কথা ভাবছে বলে জানান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির। খবর রয়টার্স।
অনুষ্ঠানের সমাপনী দিন আন্তর্জাতিক মহলসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দেয়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলা করার ইরান ও কাতারের পদক্ষেপের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন মাহাথির। আগামীতে এমন ধরনের যেকোনো নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলায় মুসলিম বিশ্বকে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য সার্বিকভাবে প্রস্তুতি নেয়ারও আহ্বান জানান তিনি।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইরান ও কাতারের ওপর বিভিন্ন জাতি একজোট হয়ে যেসব অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা পুরো বিশ্ব দেখছে। এখান থেকে মালয়েশিয়াসহ অন্য জাতিগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো, আমাদের ওপরও যেকোনো সময় এমন নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে পারে।
ওআইসির প্রতিদ্বন্দ্বী ব্লক বা সংস্থার ভয়ে সৌদি আরবের নেতিবাচক তৎপরতা কুয়ালালামপুর শীর্ষ সম্মেলনের সম্ভাব্য প্রভাব হ্রাস করতে সফল হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবে অনেকই মনে করেন ভূ-রাজনীতির এ খেলা যথারীতি খেলতে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদে সত্যিকার অর্থে এই শীর্ষ সম্মেলনটি কি অর্জন করতে পারে বা প্রভাব বিস্তার করবে সে স্বীকৃতি বা সে বিষয়ে দূরদৃষ্টি দিতে ব্যর্থ হয়েছে সৌদি আরব ।
যদিও কুয়ালালামপুর শীর্ষ সম্মেলনে যে পরামর্শগুলি পেশ করা হয়েছে তার মধ্যে কয়টি নীতিমালাকে কার্যকর পদক্ষেপে বাস্তবে রূপ দেয়া সম্ভব হবে তা দেখার বিষয়,তবে কুয়ালালামপুর শীর্ষ সম্মেলনটি মুসলিম বিশ্বের পরিবর্তন ও ঐক্য গড়ার প্রয়োজনে বিশ্বের সাধারণ মুসলিমদের মনে যে গভীর উদ্বেগ বিরাজমান সেদিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
আল জাজিরা টিভির পর্যালোচনা
নিচের ভিডিওটিতে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর পুরা ভাষন: