মার্কিন নির্বাচন আর বিশ্ব সঙ্কট- প্রভাবিত করবে একে অন্যকে

২০১৬ সাল, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তপ্ত ও সঙ্কটাপন্ন বিশ্ব- দুইয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে কোন দল আসছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে, সেটি এই পরাশক্তির বিশ্বনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার চলমান বিশ্বপরিস্থিতি আমেরিকার স্বার্থের জন্য কতটা অনুকূল অবয়ব নিচ্ছে, তার প্রভাব পড়বে মার্কিন নির্বাচনে। মাত্র কয়েক দিন পর, ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির দলীয় মনোনয়ন কে পাবেন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরূপে তার প্রতিযোগিতা। এটাকে মনে করা হয়, প্রেসিডেন্টের মূল নির্বাচনের আগে আরেক নির্বাচন। আগামী জুনের মধ্যেই দলীয় প্রার্থী নির্বাচন চূড়ান্ত হয়ে যাবে। এর পর শুরু হবে নভেম্বরের ৪ তারিখের চূড়ান্ত নির্বাচনের প্রচারণা। এই নির্বাচনে যিনি জয়ী হবেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবেন ২০১৭ সালের শুরু থেকে। ফলে তার কাজের কোনো প্রভাব হয়তো পড়বে না ২০১৬ সালে। কিন্তু আমেরিকার জন্য নির্বাচনের এই বছরটিই হবে সবচেয়ে ঘটনাবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ।
ডেমোক্র্যাট দলের উল্লেখযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রথম প্রার্থিতা ঘোষণা করেছিলেন একসময়ের ফার্স্ট লেডি এবং পরে সিনেটর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন। দলীয় মনোনয়ন লাভের প্রতিযোগিতায় জয়ী হলে তিনি হবেন দুই বড় দলের মধ্যে প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্টপ্রার্থী। সঙ্গত কারণেই, জয়ী হলে তিনি হবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট। দলীয় মনোনয়ন লাভের ক্ষেত্রে একসময় হিলারিকে মনে করা হতো অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু সময় যত যাচ্ছে, ততই দলের মধ্যে নিকটতম জনপ্রিয় প্রার্থীর সাথে তার দূরত্ব কমছে। বিশেষত ভারমন্টের সিনেটর বেরনিয়ে স্যানডার্স সমর্থনের ব্যবধান এক অঙ্কের কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামাসহ বাঘা বাঘা ডেমোক্র্যাট নেতার সমর্থন সত্ত্বেও নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না, হিলারি দলের মনোনয়ন পেয়ে যাবেন। তবে দীর্ঘ সময় ধরে দলের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি সমর্থন থাকা অবশ্যই কিনটনপতœীর জন্য বেশ খানিকটা যে স্বস্তিকর, তাতে সংশয় নেই।
রিপাবলিকান শিবিরে মনোনয়নের জন্য ‘কামড়াকামড়ি’ খানিকটা বেশি। একসময় মনে করা হয়েছিল ফোরিডার সাবেক গভর্নর, সাবেক প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশের ছোট ছেলে ও আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট ওয়াকার বুশের ভাই জেব বুশ নিশ্চিতভাবে রিপাবলিকান মনোনয়ন পাবেন। কিন্তু ওই শিবিরের সর্বশেষ জনমত যাচাইয়ে ৪-৫ শতাংশের ওপরে উঠতে পারছে না জেবের সমর্থন। সে তুলনায় ঝড়ের মতো আবির্ভূত হয়ে নিউ ইয়র্কের আবাসন ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প কট্টর মুসলিমবিরোধী বক্তব্য দিয়ে সমর্থনের জোয়ার তুলেছেন রিপাবলিকান শিবিরে। প্রায় সব নির্ভরযোগ্য জনমত জরিপ বলছে, ট্রাম্প ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত রিপাবলিকানের সমর্থন পাচ্ছেন। ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে তার কাছ থেকে অনেক দূরত্বে, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন টেক্সাসের সিনেটর টেড ক্রুজ। ওবামার সাথে লড়াইয়ে নেমে হেরে যাওয়া ম্যাককেইনের সুন্দরী ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সারাহ পলিনও সমর্থন ঘোষণা করেছেন ট্রাম্পের প্রতি। সারাহ বলেছেন, আইএসের পশ্চাদ্দেশে লাথি মারার জন্য সৈন্য পাঠাতে পারবেন কেবলই ট্রাম্প। রিপাবলিকান শিবিরের কট্টর টি পার্টির বড় অংশের সমর্থনও ট্রাম্পকে এগিয়ে দিচ্ছে।
উগ্র বর্ণবাদী বক্তব্য দিয়ে আমেরিকায় ঝড় ও ঘৃণা দুটোই সৃষ্টি করা ধনাঢ্য এবং এ যাবৎ তিন মহিলাকে বিয়ে করা ট্রাম্প কি শেষ পর্যন্ত রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন পাবেন? বিশেষ করে যে দলটির হোয়াইট হাউজ দখলে না থাকলেও সিনেট ও হাউজ আইন সভার এ দু’কক্ষেই রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আর দেশের বেশির ভাগ রাজ্যের গভর্নরও এ দলের মনোনীত প্রার্থী। ট্রাম্পের মতো এক ‘পাগলাটে’ ব্যবসায়ী, যিনি অতীতে কোনো সময় গভর্নর সিনেটর অথবা পাঁচ তারকা জেনারেলÑ কোনোটাই ছিলেন না, তিনি কি মনোনয়ন পাবেন রিপাবলিকান দলের? আমেরিকার রাজনীতিকে যারা কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে থাকেন, তাদের অনেকের ধারণা, ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন পাবেন না। দলের প্রার্থী হতে পারেন জেব বুশ, টেড ক্রুজ কিংবা মারকো রুবিও। কিন্তু হস্তি শিবিরের বিপদ হলো ট্রাম্প মনোনয়ন পেলেও যেমন হারের সম্ভাবনা প্রবল, তেমনি ৭০-এর কাছাকাছি বয়সের এই ধনাঢ্য রোমান্টিক বৃদ্ধের মধ্যে যে নির্বাচনী যৌবন দেখা দিয়েছে, তাতে মনোনয়ন না পেলেও স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারেন তিনি। তা হলে নানা জনমত জরিপ অনুযায়ী, রিপাবলিকানদের অফিসিয়াল প্রার্থীকে তিনি পেছনে ফেলে দিতে পারেন।
জানুয়ারির চতুর্থ সপ্তাহের শেষ সময়ে প্রকাশিত জরিপে দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্প রিপাবলিকানদের আনুষ্ঠানিক প্রার্থী হলে ৪১ থেকে ৪৩ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পেতে পারেন। কোনো জরিপেই বলা হয়নি, ‘যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হবে’ মর্মে ঘোষণা দানকারী ট্র্রাম্প নির্বাচনে জেতার কোনো সম্ভাবনা রয়েছে। কট্টর মনমানসিকতার অধিকারী, অপেক্ষাকৃত বয়সী রিপাবরিকানরা ঝোঁকের বশে ট্রাম্পকে সমর্থন করলেও শেষ পর্যন্ত জুনে প্রার্থিতা নিশ্চিত হওয়ার আগে অনেক পরিবর্তন এসে যেতে পারে। তখন প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে যেতে পারেন টেড ক্রুজ, জেব বুশ অথবা ফোরিডার সিনেটর মারকো রুবিও। শেষের দু’জন রিপাবলিকান প্রার্থী হলে অপেক্ষাকৃত ভালো করবে বলে আশা করা হলেও দলের মধ্যে সমর্থনের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান প্রায় তলানিতে। ট্রাম্পকে মনোনয়ন দেয়া না হলে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন, এটি অনেকেই হয়তো ধরে নিয়েছেন। এ কারণে এটাকে হিসাবে এনে ত্রিপক্ষীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফলাফল কী দাঁড়াতে পারে, তার ওপরও জরিপ চালানো হয়েছে। এ ধরনের একাধিক সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে, যেখানে হিলারি ৪৫ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পাবেন, সেখানে ট্রাম্প ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ এবং ক্রুজ রুবিও অথবা জেব বুশের ভোট ২০ থেকে ২২ শতাংশের ওপরে উঠবে না।
আমেরিকার রাজনীতিতে গত কয়েক দশকে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান যেবার ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থীকে হারিয়ে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখন প্রতি ১০ জন ভোটারের মধ্যে ৯ জন ছিল শ্বেতাঙ্গ। তিনি সাদাদের যে পরিমাণ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন, তার চেয়ে বেশি ভোট পেয়ে বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনি। এ সময় ৩০ শতাংশ ভোটারই ছিল অশ্বেতাঙ্গ। এই ভোটারদের তিন-চতুর্থাংশই ভোট দিয়েছে ওবামাকে।
সাধারণভাবে কট্টর আমেরিকান জাতীয়তাবাদী, রক্ষণশীল, খ্রিষ্টবাদী ইভানজেলিক্যালরা রিপাবলিকান পার্টির মূল ভোটভিত্তি। রিপাবলিকানরা ধনী বৃহৎ পুঁজিপতিদের নানাভাবে করসুবিধা দিয়ে থাকে এই যুক্তি দেখিয়ে যে, এর মাধ্যমে পুঁজির যে সমাবেশ ঘটবে, তা বিনিয়োগ করার ফলে নতুন কর্মসংস্থান হবে। আর তাতে লাভবান হবে দরিদ্ররা। অভিবাসী, অশ্বেতাঙ্গ বা ভিন্ন সংস্কৃতির জনগোষ্ঠীর প্রতি মোটেই সুপ্রসন্ন নয় রিপাবলিকানরা। এ কারণে অশ্বেতাঙ্গদের বড় অংশ বরাবরই ডেমোক্র্যাট সমর্থক। ডেমোক্র্যাটদের নীতি হয়ে থাকে উদারপন্থী, অভিবাসীবান্ধব এবং ধর্মীয় বিধিনিষেধের ব্যাপারে উদার। স্বল্প আয়ের লোকদের স্বাস্থ্যসেবা ও কর রেয়াত দেয়ার ব্যাপারে থাকে তাদের অগ্রাধিকার। সমকামী অধিকারের ব্যাপারে ডেমোক্র্যাটরা যেখানে ইতিবাচক, সেখানে এটাকে প্রকৃতি ও ধর্মবিরোধী হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে আসছে রিপাবলিকানরা। এই দুই ধরনের ভাবনা পুরো আমেরিকাকে হস্তিবাদী লাল শিবির এবং গর্দভপন্থী নীল শিবিরে বিভক্ত করেছে। এর মাঝখানে কয়েকটি রাজ্য রয়েছে যেগুলোকে সুইং বা পরিবর্তনবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এসব রাজ্যে এক দল সব সময় জেতে না। ফোরিডা, উত্তর ক্যারোলিনা, নিউ হ্যাম্পশায়ার প্রভৃতি রাজ্য পরিবর্তনশীল। রিপাবলিকানরা দক্ষিণের রক্ষণশীল রাজ্যগুলোতে আর ডেমোক্র্যাটরা অভিবাসীপ্রধান রাজ্যগুলোতে বেশি মনোযোগ দেয় না। এগুলোকে তারা নিজেদের জন্য নিরাপদ ভাবে।
২০১২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ওবামার জয়ী হওয়াটা অনেকেই মিরাকল বা বিস্ময়কর হিসেবে উল্লেখ করেন। নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই পেছনে পড়ে যান ওবামা। তিনটি প্রধান বিতর্কের দু’টিতেই হেরে যান মিট রমনির কাছে। কিন্তু রমনির অভিবাসী ও গর্ভপাত বিরোধী বক্তব্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকানদের একটি অংশে। অশ্বেতাঙ্গদের পাশাপাশি সাদা তরুণী ও যুবারাও এক হয়ে ভোট দেয় ডেমোক্র্যাট প্রতীক গর্দভ বা খচ্চরে। ফলে সিনেটর, প্রতিনিধি সভা সদস্য বা গভর্নর পদে যেখানে রিপাবলিকান প্রার্থীরা বেশি জয়ী হয়েছেন, সেখানে প্রেসিডেন্ট পদে বড় ব্যবধানে জিতেছেন বারাক ওবামা।
ওবামার সামনে এবার প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল, অর্থনীতিতে বিপর্যয় কাটিয়ে দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়া। আর তার ভোটভিত্তি, অভিবাসী ও নিম্নবিত্তদের জন্য কিছু করা। প্রথম মেয়াদে ওবামা রিপাবলিকান প্রভাবিত হাউজের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে অভিবাসীদের জন্য কিছু প্রণোদনা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এতে সফল না হয়ে শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট তার নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগ করেন এ ব্যাপারে। এরপর যদি রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় আসেন, সেই ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অন্য দিকে, নিম্নবিত্তদের জন্য স্বাস্থ্যপরিচর্যা ও শিক্ষাসেবার বিল নিয়েও অনেক দরকষাকষি করতে হয়েছে রিপাবলিকানদের সাথে। শেষ দুই বছরে ডেমোক্র্যাটরা হাউজ ও সিনেট দুটোর ওপরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। এর ফলে ওবামার কাজ করার ক্ষেত্রগুলো বেশ সঙ্কুচিত হয়ে আসে। এর পরও ওবামা তার অগ্রাধিকারে রাখেন অর্থনীতিতে আবার গতি আনার বিষয়টি। এ ক্ষেত্রে তিনি বেশ খানিকটা সফল হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার ৫ শতাংশের নিচে চলে এসেছে। ডলারের মান আবার চাঙ্গা হতে শুরু করেছে। বাজেটঘাটতি বৃদ্ধির রাশ টেনে ধরতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। আরেকটি অর্থসঙ্কট অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে বলে রিপাবলিকান শিবির থেকে প্রচার চালানো হলেও অর্থনীতির সূচকগুলোতে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রতিরক্ষা শিল্পগুলোও বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। কিনটনের মতো ওবামার শেষ সময়ে এসে তার নীতির প্রতি সমর্থনের হার বেশ বাড়ছে।
ওবামার পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার রিপাবলিকান থিংক ট্যাংকগুলো। রিপাবলিকানদের সমালোচনা হলো, ডেমোক্র্যাটরা আমেরিকাকে বিশ্বনিয়ন্ত্রণ এবং পরিস্থিতির ওপর প্রভাব বিস্তার থেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার আগের ভূমিকা এখন নেই। ওবামার আমলেই রাশিয়া আবার বিশ্বশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পথে এগোচ্ছে। ক্রিমিয়া দখলের পর ইউক্রেনে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন পুতিন। এর বিপরীতে ওবামা যুদ্ধের কোনো গেমে না গিয়ে অর্থনৈতিক অস্ত্র ব্যবহার শুরু করেছেন। এর মধ্যেই মস্কো সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে সিরিয়ায়। ওবামা এখানেও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়ানো থেকে বিরত রেখেছেন। তেলের দাম কমানোর মাধ্যমে রাশিয়ার অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে তিনি পঙ্গু করতে চাইছেন। এ নীতি কতটা ফল দেবে এ ব্যাপারে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে, তেমনিভাবে এর ক্ষতি থেকে মার্কিন তেল কোম্পানিও মুক্ত থাকছে না। এভাবে চলতে থাকলে একসময় আমেরিকাকে কেউ গোনার মধ্যে ধরবে না। তারা বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ওবামা প্রশাসনের ভূমিকাকে ব্যর্থ বলে চিহ্নিত করতে চাইছেন।
অবশ্য এর পাল্টা মূল্যায়নে বলা হচ্ছে, রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ভুল ইরাক যুদ্ধের কারণে আমেরিকাকে অর্থনৈতিকভাবে যেমন মূল্য দিতে হয়েছে, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ত থাকার সুযোগ সীমিত হয়েছে। ওবামা শুরুতেই ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহার এবং আফগানিস্তান থেকে সেনা গুটিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ইরাক থেকে তিনি সৈন্য প্রত্যাহার করেছেন, যদিও দেশটি এখন ইরান আর রাশিয়ার বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। অন্য দিকে, আফগানিস্তানের জটিল পরিস্থিতির কারণে সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। তবে এই প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ওবামা অবশ্য ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি এবং অন্যান্য পদক্ষেপ নিয়ে কৌশলে অস্থির ও যুদ্ধ-সঙ্ঘাতপ্রবণ বিশ্বের মুখ্য সারি থেকে নিজেকে সরিয়ে এনেছেন। সামনে রেখেছেন পরস্পর বৈরী আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে। এর মাধ্যমে আমেরিকা প্রত্যক্ষ রক্তক্ষরণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে। কিন্তু বিপত্তি ঘটছে এই পরাশক্তিটির ভূমিকা ও প্রভাব থাকছে না আগের মতো।
হিলারি কিনটন প্রেসিডেন্ট হলে এই ধারার কোনো ব্যত্যয় হবে বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রকেরাও সম্ভবত চাইছেন তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ডেমোক্র্যাট প্রার্থী যেন আবারো প্রেসিডেন্ট হন। এ কারণে প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট প্রার্থী, ইহুদি স্বার্থের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং বেশ খানিকটা মধ্যপন্থী ও উদার হিলারি কিনটনকে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে প্রভাবশালী বিভিন্ন মহল থেকে। আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রায় সবাই হিলারিকে পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান। তবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নারী হয়েও কামনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হেরে যাক।
রিপাবলিকান প্রার্থী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হলে মার্কিন বিশ্বনীতির কয়েকটি ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আসতে পারে। প্রথমত, রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট আমেরিকাকে অপ্রত্যক্ষ ভূমিকা থেকে আবারো আগ্রাসী অবস্থানে নিয়ে যেতে পারেন। বৈশ্বিক পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসনের যে অঙ্গীকার রয়েছে, তখন সেখান থেকে সরে আসতে পারে হোয়াইট হাউজ। ট্রাম্পসহ একাধিক রিপাবলিকান প্রার্থী বলেছেন, পরিবেশবিপর্যয়ে মানুষের কোনো হাত নেই। এ ব্যাপারে আমেরিকার কিছু করারও নেই। আমেরিকার পরিবেশবিদেরা এ বক্তব্যকে মারাত্মক অশনিসঙ্কেত হিসেবে মনে করছেন। আমেরিকার ভিন্ন ধারার চিন্তাবিদ প্রফেসর নোয়াম চমস্কি রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দুই দলেরই সমালোচক। তিনি মনে করেন, আমেরিকায় একটি দলই আছে, সেটি হলো ব্যবসায়ীদের দল। তাদের দু’টি ইউনিটের একটি রয়েছে রিপাবলিকানে, আরেকটি ডেমোক্র্যাট দলে। এ কারণে যে দলেরই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন না কেন, করপোরেট স্বার্থে খুব একটা হেরফের হয় না। সেই চমস্কিও ফক্স নিউজ ও আলজাজিরাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি বা স্যানডার্স যেই হোন না কেন, তার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। রিপাবলিকান প্রার্থী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার মধ্যে তিনি বিশ্বের জন্য ভয়ানক বিপদসঙ্কেত দেখতে পাচ্ছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্ব দু’টিই এমন এক ক্রান্তিকাল ও অস্থিরতার মধ্যে চলে এসেছে, যে সময় একজন পরিণামদর্শী প্রেসিডেন্ট আমেরিকার নিজের স্বার্থে যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন বিশ্বের জন্যও।

ইমেইল : [email protected]

পূর্ব প্রকাশিত: নয়া দিগন্ত

Loading

Comments are closed.