মধ্যযুগের ইউরোপ

   ইউরোপে ১০৬৬ থেকে ১৪৮৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ব্যাপক আকারের এবং বিচ্ছিন্ন প্রকৃতির যুদ্ধ বিগ্রহ চলে। এই যুদ্ধাদি তাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নানান পরিবর্তন আনে। ১৫ শো শতকে গান-পাউডারের ব্যবহার শুরু হয়। ভূপতি নৌবলরা (অউরোপীয় সামন্ততান্ত্রিক প্রথায় বাদশার সরাসরি নিচের শ্রেণী) যুদ্ধে তাদের জনশক্তি হারাতে থাকলে ক্ষেত খামারে তার প্রভাব পড়ে। তাছাড়া কয়েকবার মহামারি চরম আকারে দেখা দিলে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। এসব মিলিয়ে ১৫ শো শতকের শেষ দিক থেকে উৎপাদনের প্রকার পদ্ধতিতে (mode of production) পরিবর্তনের সূচনা হয়। আগামী শতাব্দীতে ইউরোপের সমাজ ও অর্থনীতি কোন দিকে মোড় নেবে তার কার্য্য-কারণ এখান থেকেই প্রস্তুত হতে থাকে। এই প্রবন্ধে ইউরোপের মধ্যযুগীয় প্রায় সাড়ে ৪ শতকের কলহ বিবাদের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত করে দেখানো হবে। এতে যুদ্ধের কথা থাকবে, মহামারীর কথা থাকবে, সামাজিক কথা থাকবে এবং ব্যাখ্যাও থাকবে। আবার এসবের মধ্যে গীর্জীয় অবস্থান কোথায় ছিল তাও দেখা যাবে।

মধ্যযুগের আগের যুগটি ছিল ‘অন্ধকার যুগ’ (Age of Darkness) এবং এই যুগটি নিয়ে ইতিপূর্বে আরেকটি আলোচনা এখানে হয়েছে: ‘ইউরোপের অন্ধকার যুগ’। এতে ইউরোপীয় বিভিন্ন যুগের শ্রেণী বিন্যাস দেখানো হয়েছে। মধ্যযুগের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে কেউ কেউ এই যুগকে অন্ধকার যুগের সাথে তা গণনা করেন। আবার বলা হয়েছে যে কেউ কেউ কেবল ১৪শো ও ১৫শো শতাব্দীকেই মধ্যযুগ বলেন। তবে অনেক ঐতিহাসিক এই সময়টিকে ১০৬৬ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৪৮৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত -এই প্রায় সাড়ে ৪ শত বছরকে দেখেন। গোটা অন্ধকার যুগের এক হাজার বৎসরকেও কেউ কেউ মধ্যযুগ বা মেডিভ্যাল যুগ বলে থাকতেও দেখা যায়। এসব তারতম্যের কিছু কারণ আগের লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে। বক্ষ্যমাণ আলোচনায় মধ্য যুগকে ১০৬৬ থেকে ১৪৮৫ ধরেই আলোচনা করা হবে। প্রকৃত বিচারে এটাই বর্ধিত অর্থের মধ্যযুগ।

এই এই লেখাটি এবং আগের লেখাটি তৈরি করার কারণ হচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো যে কোন ধরনের সামাজিক বাস্তবতা অতিক্রম করে যুক্তির যুগ (Age of Reason) এবং এনলাইটনম্যান্টের (Age of Enlightenment, জ্ঞান ও আলোর যুগ) যুগে প্রবেশ করেছিল, তার প্রেক্ষিত দেখানো এবং কোন ধরনের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের এক প্রান্তে গিয়ে নাস্তিক্যবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় উপনীত হয়েছিল –তা উপলব্ধির প্রেক্ষাপট সামনে আনা।

ইউরোপের মধ্যযুগ ১০৬৬-১৪৮৫ 

  প্রায় সাড়ে চার শো বছরের এই চওড়া সময়ে ইউরোপে অনেক রাজনৈতিক বিবর্তন/পরিবর্তন হয়েছে। অনেক রাজকীয় আক্রমণ, পালটা আক্রমণ হয়েছে। শতাব্দী ব্যাপী চলেছে। এগুলো ছিল করুণ, রক্তক্ষয়ী, হিংস্র ও বীভৎস। যুদ্ধের পরিণতি সব দিন যা হয় –তাই। ইউরোপিয়ানদের নৃশংস রূপ বহির্বিশ্বে যেভাবে প্রকাশ পেতে দেখা যায়, সেই একই রূপ সেদিন প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল নিজেদের মধ্যে। ধ্বংস, বিপর্যয়, হত্যা, একে অন্যের প্রতি অকরুণ আচরণ –এগুলো সামাজিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। পরবর্তী যুগে যখন এই সময়টির দিকে তাকানো হয়, তখন কারো কারো চোখে কেবল ‘অন্ধকার’ই প্রতিভাত হয়, তাই যুগটিকেও তারা অন্ধকারের বৈশিষ্ট্যে টানেন। তবে অনেকে এতটা নেতিবাচক হিসেবে দেখেন নি। এই সময়ের পরিধিতে অনেক ভাল এবং উন্নয়নমূলক কাজও হয়েছে।

যুদ্ধের কথা প্রথমেই উল্লেখ করেছি। ধর্মের দিক দিয়ে ইউরোপের যুদ্ধের সব পক্ষই মোটামুটিভাবে খৃষ্টীয়ান ছিলেন। সকল পক্ষেই চার্চের সমর্থন গিয়েছিল। মানি প্রত্যেক পক্ষের চার্চই নিজেদের পক্ষে সমর্থন দিয়েছিল এবং বিজয়ের জন্য দোয়া করেছিল। কিন্তু যুদ্ধে যেহেতু দুই পক্ষের একপক্ষই জয়ী হতে হয়, তাই এমন পক্ষা-পক্ষিতে ধর্মের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। তাছাড়া চার্চের প্রাতিষ্ঠানিকতায় দুই ধরণের অবস্থান ছিল।

একদিকে চার্চ রাজকীয় শক্তির সাথে সম্পৃক্ত ছিল এই অর্থে যে রাজকীয় ব্যবস্থায় নৌবিলিটি (nobility) যে স্তর ছিল, চার্চ ক্ষমতার দিক দিয়ে ছিল সেই স্তরে। আবার রাজাদের রাজত্ব ও তাদের কর্তৃত্বের অধিকার যেহেতু ছিল ‘খোদায়ী’ এবং এবং পাদ্রীরা যেহেতু ছিলেন সেই খোদায়ী ব্যবস্থার পুরোহিত, তাই পরবর্তী যুগে যখন নৌবিলিটির একাংশের হাতে শিল্প ও কলকারখানা গড়ে উঠবে এবং তারা অন্য এক ধরণের শ্রেণীতে পরিণত হবেন, এবং রাজকীয় প্রথা উড়িয়ে দিয়ে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব নিজের শ্রেণীতে আনতে যাবেন তখন সেই প্রথার সাথে ‘খোদা’ ও ‘চার্চ’ সংযুক্ত থাকায় এই দুই উপাদানকে উড়িয়ে দেবার পথ খুঁজবেন। এই ধারায় একদল এনলাইটনম্যান্টের পুরোধা হবেন এবং এদের হাতে আসবে নাস্তিক্যবাদ। এই প্রেক্ষিতে বেকায়দায় পড়া একদল দার্শনিক ও সমাজ বিজ্ঞানী বাইবেলের খোদাকে বর্জন করে এমন এক খোদাকে খোঁজতে যাবেন যিনি হবেন জীবন ও জগত থকে অসম্পৃক্ত –এরাই হবেন ডেইস্ট (deist)। আরেক দল কাচু মাচু করে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে নির্বাসিত দিয়ে কোন রকমে বিশ্বাসী থেকে যাবেন। আমরা এদের এই ‘যুদ্ধ’ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে গিয়েই পাব। একথা এখানে থাক।

    অপর দিকে চার্চের দখলে ছিল অঠেল ভূসম্পত্তি। এগুলোর ব্যবস্থাপনা তদানীন্তন অন্যান্য সামন্ততান্ত্রিক (fuedal) লর্ডদের মতই হত। সর্বসাধারণ তথা কৃষকেরা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভিন্নভাবে নিষ্পেষিত হত। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা রাজকীয় নৌবিলিটির কুক্ষিগত ছিল। কৃষকেরা মালিকের অনুমতির বাইরে কাজ করতে পারত না, বিয়ে-শাদিতেও তাদের অনুমতি নিতে হত। এক মালিকের অঞ্চল ছেড়ে অন্য, বসবাসের জন্য, অন্য এলাকায় যেতে হলে অনুমতি নিতে হত এবং মালিকদের যুদ্ধে তাদেরকে যেতেই হত। একথাও স্বীকার করা দরকার যে মালিকগণ রুগ্ন, বৃদ্ধ, পঙ্গুদের দায়-দায়িত্ব নিত। এটাকে নৈতিক দায়িত্ব ভাবত। ধর্মের প্রচার প্রসার করত, চার্চ তৈরি করে দিত –যাতে সর্ব সাধারণ ইবাদত আরাধনা করতে পারে।

যুদ্ধাদির বাইরে মধ্যযুগে ইউরোপে অনেকবার দারুণ আকারের মহামারী দেখা দিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই লাখ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছিল, অনেক পরিবারে বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। ক্ষয়-ক্ষতি তো ছিলই। এসবের প্রতিফলন সামাজিক জীবনে ঘটেছিল।

তবে মধ্য যুগে, ক্রুসেডের যুদ্ধ এক পাশে রেখে, বলা যেতে পারে যে ইউরোপ এক বৃহৎ আকারে ইসলামী সভ্যতার পরশ লাভ করে। অনুবাদের মধ্যমে ইসলামী জগতের জ্ঞান বিজ্ঞান আরোহণ করে। পরবর্তীতে এই জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো ইসলামী জগতে স্তিমিত হয়ে পড়লে, ইউরোপ সে আলোর ধারা প্রজ্বলিত রাখে, এর বিকাশ ঘটায় এবং এক্ষেত্রে ইসলামী জগতকে পিছনে রেখে অনেক দূর অগ্রসর হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও উন্নয়নের বিষয় মূলত মানবিক কাহিনী, মানুষেরই অর্জন -যার বিকাশ কখনো এখানে, কখনো সেখানে ঘটে। এটাকে এভাবেই দেখা যেতে পারে।

আলোচ্য বিষয়বস্তু

বক্ষ্যমাণ আলোচনাটি কিছু নির্দিষ্ট সীমায় রাখতে চাই, নচেৎ ৫০০ শত বছরের কথা অত্যধিক হয়ে পড়বে। তাই পরবর্তীতে যা আলোচনা করা হবে তা নিম্নরূপ:

  • হেস্টিংগের যুদ্ধ
  • ডুমসদে বুক
  • কালো-মৃত্যু
  • ক্রুসেডের যুদ্ধ
  • একশো বছরের যুদ্ধ
  • ত্রিশ বছরের যুদ্ধ
  • উপসংহার

মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞান ইউরোপকে প্রভাবিত করেছিল। এই দিকটি এখানে আলোচনা করব না। এর উপর আলাদা একটি লেখা তৈরি করব।

  হেস্টিংগের যুদ্ধ 

এই যুগের প্রথম যুদ্ধ হয় ‘হেস্টিংগের’ যুদ্ধ। এটা সংঘটিত হয় ১০৬৬ সালে –ইংরেজ ও নরম্যানদের মধ্যে। নরম্যানরা ছিল ফরাসী, নরম্যান্ডি (Normandy)অঞ্চল থেকে আসা লোক। এদের মধ্যে সুদূর অতীতে জার্মান রক্ত সঞ্চালিত। বাদশাহ উইলিয়ামের (১০২৮-১০৮৭) নেতৃত্বে নরম্যানরা আক্রমণ শুরু করে। উইলিয়াম ছিলেন ফ্রান্সের নরম্যান্ডি এলাকার ডিউক। নরম্যানদের মোকাবেলায় নিজ দেশ প্রতিরক্ষায় দাঁড়ান এঙলো-সাক্সন রাজা (ছয়শো বৎসর পূর্বে আসা সাক্সনরা যারা তখন ইংরেজ) হেরল্ড গডউইনসন (Herold Godwinson, ১০২২-১০৬৬)। তাকে দ্বিতীয় হেরল্ডও বলা হয়। এই যুদ্ধের প্রথম পর্যায় নরম্যানরা পরাজিত হতে থাকে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে গুজব রটে উইলিয়ামের মৃত্যু ঘটেছে। এটা প্রায় আমদের  ওহুদ যুদ্ধের গুজবের মত।

    উইলিয়ামের মৃত্যু সংবাদে নরম্যানরা পলায়োন্মুখ হয়ে পড়ে। আর ইংরেজরা তাদের পিছু ধাওয়া করে। অবস্থা দৃষ্টে উইলিয়াম তার শিরস্ত্রাণ উন্মোচন করেন এবং বলতে থাকেন, ‘আমি জীবিত, আমি জীবিত। আল্লাহর সাহায্যে আমরা বিজয় লাভ করতে যাচ্ছি।’ মূহুর্ত্তের মধ্যে অবস্থা পালটে যায়। তার সেনারা ফিরে আসেন, আবার পুনরুদ্যোমে যুদ্ধে নেমে পড়েন। তারপর যা হয়, তা ইতিহাস। ইংরেজ পক্ষ বেগতিক অবস্থায় পালাতে থাকে কিন্তু নিস্তার পায়নি। উইলিয়ামের সৈন্যরা তাদের উপর চড়াও হয়। সেখানে এক ধ্বংস লীলা চলতে থাকে। এক সময় বিশপরা যুদ্ধে নামেন। কিন্তু লাভ হয়নি। বাদশাহ হেরল্ড ধরাশায়ী হন। কিন্তু তবুও নরম্যানরা থামেনি। তার দেহকে কেটে টুকরা টুকরা করে। এটাও ওহুদের মত আরেক বীভৎস চিত্র।

হেস্টিংগের মৃতদেহগুলোর প্রতি উইলিয়াম কোন শ্রদ্ধা দেখাননি। অনেকদিন ধরে দেহগুলো পড়ে থেকে পচে যাওয়ার পর তিনি সামান্য সদয় হন এবং সেখানে তাদের স্মরণে একটি আবি (abbey) বা উপাসনাগৃহ  নির্মাণ করেন।

ইংল্যান্ড আক্রমণের পূর্বে উইলিয়াম নাকি তার নিজ দেশে জারজ উইলিয়াম (William the Bastard) নামে পরিচিত ছিলেন। [১] ঘটনা যাই হোক, এভাবেই উইলিয়াম ইংল্যান্ডের রাজা হয়ে বসেন।

হেস্টিংগের যুদ্ধে ইংরেজরা পরাজিত না হলে ইউরোপের ইতিহাস অন্যরূপে লিখা হত। এর পরিণতি ছিল সুদূর প্রসারী। এর জের ধরে পরবর্তীতে আরও অনেক হবে। যুগান্তর ব্যাপী যুদ্ধ চলতে থাকবে। ইংরেজ ও ফরাসীদের মানসিক দূরত্ব এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও  তেমন কোন সৌহার্দে আসেনি। এটা অনেকটা ভারতের আর্য-ব্রাহ্মণ্য ও মুসলিম মানসিকতার মত থেকে যায়।

ডুমসডে বুক ১০৮৬

ডুমসডে বুক [২] প্রণয়নের ইতিহাসখানি খুবই জরুরী। এখানে নরম্যানরা ইংরেজদের ভূমির মালিকায় পরিবর্তন আনে এবং খাজনার যাঁতাকল বসিয়ে তাদের জিন্দেগীর গোটা ইতিহাসকে পাল্টে দেয়। ইংরেজরাও অনুরূপ একটি কাজ (চিরস্থায়ী বন্দবস্ত) পলাশী বিজয়ের পর, ২৬ বছরের মাথায়, বর্ণ-হিন্দুদের সহযোগিতায়, ভারতবাসীর উপর চাপিয়েছিল। এতে বর্ণ-হিন্দু ও ইংরেজ পক্ষ দারুণভাবে  লাভবান হলেও মুসলমানরা নিষ্পিষ্ট ও হত-দরিদ্র হয়ে রাস্তায় নামে।

হেস্টিং যুদ্ধের পরে পূর্বেকার সরকার ব্যবস্থায় অসন্তুষ্ট ও কিছু স্বার্থান্বেষী ইংরেজের সহযোগিতায় বাদশাহ উইলিয়াম দেশের জনগণ, ভূমি ও সম্পদের এক বিশাল রেজিস্ট্রি বহি ব্যাপক জরীপের মাধ্যমে প্রণয়ন করেন। এতে কে কী পরিমাণ সম্পদের অধিকারী -তা তার নামধাম সহ রেজিস্টার করা হয়। গরু, ঘোড়া, ভেড়া, বকরি কিছুই বাদ যায়নি। বইটির নামের তাৎপর্যের ব্যাখ্যা আসে এভাবে: ‘… the irreversible nature of the information collected led people to compare it to the Last Judgement, or ‘Doomsday’, described in the Bible, when the deeds of Christians written in the Book of Life were to be placed before God for judgement অর্থাৎ সংগৃহীত তথ্যের অপরিবর্তনীয় প্রকৃতি দৃষ্টে জনগণ এটাকে বাইবেলে বর্ণিত কিয়ামত দিবসের সাথে তুলনা করতে যান যখন খৃষ্টীয়ানদের ইহজীবনের আমলনামা পুস্তকাকারে বিচারের জন্য খোদার সমীপে পেশ করা হবে।’ [৩] কোরানের ভাষায় বলতে পারেন, মা লি হাজাল কিতাব, লা ইউগাদিরু কাবিরাতান ওয়ালা সাগিরাতান ইল্লা আহসাহা অর্থাৎ আহারে! এই কোন বই যা ছোট থেকে বড়, এমন কিছুই বাকী রাখেনি –সবকিছু রেকর্ড করে রেখেছে।

লক্ষণীয় যে এই ‘ডুমসডে বহি’ হচ্ছিল চিরস্থায়ী বন্দবস্তের বহি। নরম্যান লর্ডদের অধীনে জরীপের কাজ চলে এবং জরীপ দোভাষীর মাধ্যমে চালাতে হয়। এতে অনেক মিথ্যা তথ্য থেকে যায়। খাজনা কম দেয়ার জন্য স্থাবর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ অনেকে কম দেখান। কিন্তু লিখিত কম পরিমাণ একসময় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ইংরেজ অনেক জমিদার এই জরীপের ব্যাপারে সন্দিহান থাকায় জরিপকারীদের সম্মুখীন হননি। কিন্তু ওরা অন্যদের কাছ থেকে একটা হিসেব নিয়ে যায়। এটাও শেষে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ইতিপূর্বে জমির খাজনা, সম্পদের খাজনা আদায়দের জন্য এমন বন্দবস্ত কখনো স্থির হয়নি। এই কাজের পিছনে আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল। সেদিন স্কেন্ডেনেভিয়া (বর্তমানের ডেনমার্ক, নরওয়ে ও সুইডেন) থেকে ইংল্যান্ড আক্রমণের আশংকা ছিল। তাই স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাবত বিরাট তহবিল ভাণ্ডারের প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু এই কাজটি করতে গেলে সমাজ ব্যবস্থাপনায় দারুণ পরিবর্তন আসে।

সামান্য একটু ব্রেক নিয়ে ডুমসডে বইয়ের জরিপের উপর একটি রসিক ভিডিও দেখা যেতে পারে। ভিডিওটি এখানে:

Horrible Histories- The Doomsday Book- HD 1080p:

 

কালো-মৃত্যু (Black Death)

Photo: Pieter Bruegel's The Triumph of Death painting   কালো মৃত্যু নামে একটি সর্ব-ধ্বংসী মহামারী ইউরোপে দেখা দেয়। ইয়ার্সিনিয়া পেস্টিস (Yersinia pestis) নামক এই সংক্রামক বেক্টেরিয়া গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ১৩২৮ সালের দিকে এটি আস্তে আস্তে শুরু হয়। ১৩৪৮-৫০ তে চরম রূপ ধারণ করে। ১৩৫১ সালের দিকে তা শেষ হয়। কিন্তু তখন ইউরোপের এক তৃতীয়াংশ মানুষের জীবন বিনাশ হয়ে গিয়েছে (প্রায় ২০ কোটি লোকের মৃত্যু)। তবে সংখ্যায় দ্বিমত আছে, যেহেতু পরিসংখ্যান হয়নি। কেউ কেউ সাড়ে ৭ কোটি থেকে ২০ বলে থাকেন [৪]। রোগটি এভাবে দেখা দিতঃ প্রথমে সংক্রামিত ব্যক্তির গায়ে বিভিন্ন স্থান ফুলে উঠত, তারপর স্থানটি কালো হত, এবং সবুজের মত দুর্গন্ধময় পুঁজ বেরিয়ে আসত, তারপর মৃত্যু। মশা মাছি, ইঁদুর ইত্যাদির মাধ্যমের এই রোগ ছড়াচ্ছিল। এই মহামারীর কারণে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষতি হয়, জিনিস পত্রের দাম বাড়ে, কৃষিকাজ বিঘ্নিত হয়, মানুষ শহরমুখী হয়, চার্চের প্রার্থনার পরেও কোন ফল না দেখে চার্চের উপর অনেক বিশ্বাস শিথিল হয়, সামন্তপ্রথায় অবক্ষয় আসে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে ভবিষ্যতে ‘ইংলিশ রিফরমেশ’ এর পথ খোলে দেয়, বা সে পথের এক ক্রমবর্ধমান সূত্রের উত্থান ঘটায়।

 

ক্রুসেডের যুদ্ধ

[নোট: যারা আমার আগের লেখা ক্রুসেডের যুদ্ধ (১০৯৯-১২৯২)’ পড়েছেন, তারা এই অংশ না পড়লেও চলবে।]

  ক্রুসেডের যুদ্ধ মুসলমানদের সাথে হয়। এই যুদ্ধ ২০০ শত বর্ষ ব্যাপী চলে। এর সূচনা হয় ১০৯৫ সালে। ফ্রান্সের বুউয়েঁ অঞ্চলের গডফ্রি নামক (Godfrey of Bouillon) একজন নৌবলম্যান (সামন্ততন্ত্রে বাদশাহর নিচের শ্রেণীর লোক) জেরুজালেম দখল করার অভিযান থেকে। তিনি ১০৯৯ সালে মুসলমানদের পরাজিত করে জেরুজালেম দখল করেন এবং নিজ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বিজয়ের পর তার সৈন্যরা জেরুজালেমে রক্তের বন্যা বহান। [৫] নারী,পুরুষ,শিশু,বৃদ্ধ –যাকেই পাওয়া গিয়েছিল তাকেই হত্যা করা হয়েছিল। এই যুদ্ধে গোটা ক্যাথোলিক চার্চ ও পোপ ২য় আর্বানের (১০৩৫-১০৯৯) সমর্থন ও আশীর্বাদ ছিল।

জেরুজালেম দখলের পরও সেই রাজ্যটিকে আরও ব্যাপৃত করার লক্ষ্যে মুসলমানদের সাথে আরও যেসব যুদ্ধ চালানো হয়,সেগুলোও ছিল ক্রুসেড।

প্রথম ক্রুসেডের পরের বড় অভিযান হয় এবোট বার্নার্ড অব ক্লেয়ারভক্স (Bernard of Clairvaux) এর আহবানে। এবোট ফ্রান্সের লোক ছিলেন। এই অভিযান পরিচালনা করা হয় বাদশাহ ৭ম লুইস ও ৩য় কনরাডের অধীনে। এই ১১৪৭ থেকে ১১৪৯ পর্যন্ত চলে। কিন্তু তারা এই অভিযানে তেমন কোন ফায়দা হাসিল করতে পারেননি। [৬] ১১৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে একটি একটি অন্যায় ও ভয়ংকর কাজ সংঘটিত হয়। রেনোল্ড (Raynald) একটি হজ্জ-যাত্রী কাফেলাকে আক্রমণ করে বসেন, মালামাল লুট করেন, এবং মারধর করে জেলে নিক্ষেপ করেন। রেনোল্ড মুসলিম শাসক সালাউদ্দীনের সাথে যুদ্ধ বাধানোর উদ্দেশ্যেই এটি করেন। সালাউদ্দীন যুদ্ধে নামেন এবং নিজ হাতে রেনোন্ডকে হত্যা করেন। ১১৮৭ সালে জেরুজালেম মুসলামানদের দখলে যায়। সালাউদ্দীনের জেরুজালেমে প্রবেশ ছিল রক্তহীন।

১১৮৯ সালে ইংল্যান্ডের বাদশাহ তৃতীয় রিচার্ড সেকালের সবচেয়ে ভারী অস্ত্র ও কামান সহ ১৭,০০০ সৈন্য নিয়ে বেরিয়ে পড়েন [প্রাগুক্ত ৫]। সেখানে তার সাথে খৃষ্টিয়ান সৈন্যরা (যারা আগে বল্ডউইন ও গীর অধীনে ছিল –তারাও) সংঘবদ্ধ হন। রিচার্ড বিপুল শক্তিতে যুদ্ধ শুরু করে একর, জাফা, কেসারিয়া এবং টায়ার –এই শহরগুলো নিজ দখলে নেন। রিচার্ড সেখানে যুদ্ধাপরাধও করেন। তার হাতে ২,৭০০ মুসলিম সৈন্য ধরা পড়লে তিনি কয়েক হাজার স্বর্ণমুদ্রার বিনিয়ে মুক্তিপণে ফিরত দিতে রাজি হন। কিন্তু স্বর্ণ হস্তান্তর ও সৈন্য ফিরত পাওয়া প্রক্রিয়া স্পষ্ট করতে খানিক দেরি হলে তিনি সকল সৈন্যদেরে সারিবদ্ধ করে শিরচ্ছেন করেন। [প্রাগুক্ত ৫] অবশেষে রিচার্ড জেরুজালেম আক্রমণ না করেই রিচার্ড ইংল্যান্ডে ফিরে যান।

এই যুদ্ধ তার পরের একশো বছর পর্যন্ত চলতে থাকে। কিন্তু ক্রুসেডরা জেরুজালেম দখল করতে সমর্থ হননি। ছোট বড় যুদ্ধ হয়, তাদের মধ্যে হচ্ছে ১২০২-৪ সালে, ১২১২-২১ সালে, ১২২৮-২৯ সালে, ১২৪৯-৫৪ সালে, ১২৭০-৭২ সালে, ও ১২৯১ সালে। [৭]

১২৯২ সালে একমাত্র শহর একর ব্যতীত আর কোনো শহর নাইট টেম্পলারদের অধিকারে থাকেনি এবং ১২৯২ সালের যুদ্ধেই (মতান্তরে ১২৯১ সালে) তারা পরাজিত হয়ে তাদের শেষ লর্ড (Grand Master of the Knights Templar) জ্যাক ডি মলোয়সহ সাগর পাড়ি দিয়ে সাইপ্রাসে আশ্রয় নেন।

 

শতবর্ষের যুদ্ধ (Hundred Years’ War)

ইংরেজ বাদশাহ ৩য় এডওয়ার্ড তাঁর মায়ের সূত্রে ফরাসী সিংহাসনের উপর উত্তরাধিকারের দাবি উত্তাপন করলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে এক দীর্ঘ যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। এটা ১৩৩৭ থেকে ১৪৫৩ পর্যন্ত বিরতির পর পর চলতে থাকে।   শুরু থেকে তিন যুগ ইংল্যান্ডের জয়-জয়কার ঘটে। ১৩৪০ সালে তিন-চার শো রণতরী নিয়ে এডওয়ার্ড ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে বীর বিক্রমে স্লয় (Sluys) এলাকা জয় করে নেন। [৮]

তারপর ১৩৪৬ সালে ক্রিসিতে (Crecy) শুরু হয়। সেখানেও ইংরেজরা বিজয় লাভ করে। ফরাসী পক্ষের আহত নিহত সংখ্যা ছিল ১৩০০০ এর মত। ক্রিসি ইংরেজদের দখলে আসে। ১৩৫৬ সালে পটইয়ের (Poitiers) যুদ্ধেও ফরাসীরা পরাজয়ের সম্মুখীন হয়। আহত-নিহত মিলে ২,৫০০ আর ধরা পড়ে ২,০০০।

কিন্তু ১৩৬৯ সালের পর থেকে ফরাসীদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে। ১৩৭৭ সালে বাদশাহ ৩য় এডওয়ার্ড মৃত্যু বরণ করেন। এই সময় মাত্র  তিনটি এলাকা -কালেইস  (Calais), বরডও (Bordeaux), বাইওন (Bayonne)ছাড়া ইংরেজদের দখলে আর কোন ফরাসী এলাকা ছিল না। এর পর থেকে উভয় পক্ষে এক ধরণের “আছে-আছে, নাই-নাই” যুদ্ধ বিরাজ করে।

তারপর ৫ম হেনরি ১৪১৫ সালে ফ্রান্স আক্রমণ করলে যুদ্ধ আবার থমথম করে ওঠে। যুদ্ধ এজিনপোর্টে (Agincourt) হয় এবং ইংরেজরা বিজয় লাভ করে। কিন্তু পরে ১৪২৯ সালে অরলিন (Orleans)অবরোধে ইংরেজ পক্ষ চরমভাবে ব্যর্থ হয় এবং শতবর্ষের এই যুদ্ধের ধারা সমাপ্তির দিকে ছুটে। ১৪৫৩ সাল নাগাত একমাত্র কেলেইস ব্যতীত আর কোন স্থান ইংল্যান্ডের দখলে থাকেনি এবং এক সময় তাও হাতছাড়া হয়ে যুদ্ধ শেষ হয়।

এই যুদ্ধে উভয় পক্ষ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অসংখ্য প্রাণহানি হয়। অনেক আহত হয়। এসবের প্রতিক্রিয়া সমাজ জীবনে দেখা দেয়। ফ্রান্সের সামন্ততান্ত্রিক প্রথায় দারুণ আঘাত আনে। বলা যায় যে সুপ্তভাবে সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার উপর সমালোচনার পট তৈরি হয়। এই যুদ্ধ ফ্রান্সের নাইটদের অধীনস্থ কর্মশক্তিকে দুর্বল করে দেয়। যুদ্ধের প্রস্তুতি ও দৃষ্টি সেদিকে থাকায় ইংল্যান্ডেও তার প্রভাব পড়ে। ফরাসী ও ইংলিশ মানসিকতায় যে দীর্ঘ মেয়াদী ছাপ ফেলে তা এখনও যায় নি। আজও ইংরেজরা ফরাসীদেরকে তেমন বিশ্বাস করতে পারে না এবং প্রতিপক্ষও তাই। তাছাড়া এই যুদ্ধে গান-পাউডারের ব্যবহার শুরু হয়। এটা ভবিষ্যতের অন্যান্য যুদ্ধের আরেক দিগন্ত খোলে। এই এক শো বৎসরের যুদ্ধে প্রয়োজনের তাগিদে যুদ্ধজাহাজ তৈরির শিল্প গড়ে ওঠে ও উন্নয়ন হয়।  এই শিল্প আগামীতে শক্তিশালী পণ্য-জাহাজ তৈরি এবং বিদেশে পাড়ি জমাবার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে গড়ে উঠবে।

 

ওয়েলসের যুদ্ধ

   ১০৮৭-১১০০ পর্যন্ত ওয়েলসের (Wales-বর্তমান ব্রিটেনের এক অংশ)  সাথে উইলিয়ামের পুত্র রাফাস যুদ্ধ করেন। ১১৭০ সালে টমাস বেকেট (Thomas a Becket) কে কেন্টারবারি কেথিড্রেলে হত্যা করা হয়।

ত্রিশ বৎসরের যুদ্ধ (Thirty Years’ War)

এই যুদ্ধটি ১৬১৮ থেকে ১৬৪৮ পর্যন্ত মধ্য-ইউরোপে ব্যাপকভাবে ঘটে। এই দীর্ঘ যুদ্ধকে ‘বিশৃঙ্খল’ যুদ্ধ বলেও আখ্যায়িত করা যেতে পারে। এখানে অনেক কারণের সংমিশ্রণ ঘটে। ধর্মীয়, রাজ-বংশীয়, এলাকা দখলদারি, বাণিজ্যিক –ইত্যাদি পাওয়া যাবে। [৯]

এই যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল প্রটেস্টান্ট ও ক্যাথোলিক সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে। কিন্তু পরে এর জের দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়ত হতে থাকে। এক সময় তা হাপসবার্গস (Hupsburgs রাজবংশ) জার্মানিকে কন্ট্রোল করবে, কী করবে না, তাই হয়ে পড়ে ইস্যু। [১০] এই দীর্ঘ যুদ্ধের নানান প্যাচে থাকবে সুইডেন, জার্মান, পোল্যান্ড, এমন কি রাশিয়া ও স্পেন; তারপর এতে থাকবে ধর্মীয় দল –লুথারিয়ান, কেলভিনিয়ান, রোমান ক্যাথলিক ইত্যাদি।

১৬১৮-২০ সালে অস্ট্রিয়ান শাসনের বিপক্ষে বওহিমিয়ানদের (Bohemian) বিদ্রোহ চলতে থাকে। এর কারণ ছিল হলি রোমান সম্রাট ২য় ফারডিনেন্ড রোমান ক্যাথোলিক ধর্মের একচ্ছত্র (স্বৈরশাসন) ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে প্রটেস্টান্ট বওহিমিয়ান (বর্তমানের Czech Republic) ও অস্ট্রিয়ান নৌবলরা (সামন্ততান্ত্রিক প্রভুরা) রুখে দাঁড়ান। ১৬২০ সালে এই বিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হয়। কিন্তু কিছু প্রটেস্টান্ট রাজপুত্র ডেনমার্কের সাহায্যে ১৬২৫-১৬২৭ সাল পর্যন্ত অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন কিন্তু যুদ্ধের দিক-দিগন্ত তখন বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। ডেনমার্ক জার্মান অঞ্চল থেকে কিছু অংশ দখল করার সুযোগ দেখে। কিন্তু ১৬২৯ সালের এক যুদ্ধে ডেনমার্কের ব্যাপক পরাজয় হয় এবং ইউরোপিয়ান শক্তি হিসেবে নগণ্য হয়ে পড়ে।

এরপর পোল্যান্ডের সাথে পূর্বেকার আরেক যুদ্ধ শেষ করে, সুইডেনের গাস্টাভাস এডলফাস (Gustavus Adolphus) ১৬৩০ সালে এই যুদ্ধে নেমে আসেন এবং জার্মানির অনেক অঞ্চল দখল করেন। ১৬৩২ সালে এডলফাসের মৃত্যু হয় এবং পরের বৎসর সুইডিসরা নর্ডলিনজেনের (Nordlingen) পরাজিত হন। এর পর ফরাসী নৌবল ও কার্ডিনেল রিসলিও (Richeliu) ফ্রান্সকে সেই যুদ্ধে নামিয়ে আনেন এবং অস্ট্রিয়ার স্পেনিস মিত্র পক্ষকে কয়েক ময়দানে পরাজয় ঘটান। ১৬৪৮ সালে যুদ্ধ বিরতিতে একটি সন্ধি চুক্তি সাক্ষরিত হয় –যা দ্যা ট্রিটি অফ ওয়েস্টফালিয়া (The Treaty of Westphalia ) নামে পরিচিতি লাভ করে। এই চুক্তিতে ফ্রান্স দক্ষিণ আলসাস (South Alsace) লাভ করে এবং সুইডেন বলকানের কয়েকটি অঞ্চল। জার্মান সম্রাটের ক্ষমতা একান্ত কমিয়ে গিয়ে একেবারে নামে মাত্র সম্রাটে পরিণত হয়। ওলেস্টেইন (Wallenstein), টিলি (Tilly), মেন্সফেডের (Mansfed) ভাড়াটে (mercenary) সৈন্যরা জার্মানের এই চরম বিপর্যয় ঘটায়। এই যুদ্ধটি অত্যন্ত বিশৃঙ্খল ছিল এবং সকল পক্ষের উদ্দেশ্য-বিধেয় একত্র করা কঠিন হয়।

উপসংহার

আজ থেকে প্রায় ৩,০০০ হাজার বছর আগে সাবার রাণী বিলকিস যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে বলেছিলেন,‘রাজারা যখন কোন জনপদে প্রবেশ করে,তখন তাকে বিপর্যস্ত করে দেয় এবং সেখানকার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গকে অপদস্থ করে।’ (কোরান, ২৭:৩৪)। যুদ্ধ নানান ধরণের ধ্বংস ডেকে আনে, সমাজকে উলট পালট করে। ৫০০ শো বৎসরের টানা যুদ্ধ ইউরোপকে বিপর্যস্ত করেছিল। কিন্তু পরবর্তী শতাব্দীতে ইউরোপ নিজেদের বিপর্যয়ের ইতিহাস ভুলে গিয়ে বিশ্বের চতুর্দিকে সেই বিপর্যয় ঘটায়। অনেক জাতিকে একদম নির্মূল করে দেয়, যেমন আমেরিকান আদিবাসী অনেক জাতিকে। আর বিশ্বের অনেক জাতিকে পঙ্গু করে, দাবিয়ে রাখে, তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে। কোরানের ভাষায়, ‘তাদেরকে যখন বলা হয় “তোমরা দুনিয়ার বুকে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে, আমরা তো শুধু শান্তি শৃঙ্খলাই নিশ্চিত করি।”’ (কোরান, ২:১১)।

মধ্যযুগে ইউরোপের ইতিবাচক দিক হল ইসলামী বিশ্বের সংস্পর্শে আসা। যদিও ইতিপূর্বে মুসলমানরা স্পেনে অবস্থান করছিল, কিন্তু গোটা ইউরোপে সেই অবস্থান খুব একটা বড় আকারে দেখা দিয়েছিল বলে মনে হয় না। জেরুজালেম দখল করার পর অনেক কিছু তাদের নজরে পড়ে। মুসলিম শাসনের আওতায় জনসাধারণের জীবন ব্যবস্থা ইউরোপীয় সামন্তবাদী (রাজা-নৌবিলিটি-বেরোন, লর্ড- , সার্ফ) ব্যবস্থার তুলনায় আকাশ পাতাল দেখা দেয়। জেরুজালেমের আশে পাশের অঞ্চলে মুসলিম ব্যবস্থার নিয়ম-নীতি পরিলক্ষিত হয়। মুসলমানরা রাজা শাসিত হলেও তাদের সমাজ ব্যবস্থায় জনগণের স্বাধীনতা, বিচরণ, অধিকার, ন্যায়-নিরাপত্তা অধিক ছিল। বস্তুত মুসলিম আইনের ভিতরে থেকেও অমুসলিম সম্প্রদায় (খৃষ্টীয়ান/ইয়াহু ইত্যাদি) তাদের নিজেদের আইন/ধর্মীয় আইন মেনে চলার অধিকার ছিল। এই ব্যবস্থাটি ছিল অনেক অগ্রবর্তী। দেশের ভিতরে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর এক ধরনের সেমি-স্বায়ত্ত শাসন, যা আজ পর্যন্ত ইউরোপ সংখ্যা লঘুদের ব্যাপারে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়নি। ২০০৬ সালে রওয়ান উইলিয়াম (তখন আর্চবিশপ অফ কেন্টারবারি) মুসলমানদের পারিবারিক আইনের স্বীকৃতি দেয়ার কথা প্রস্তাব করলে নাস্তিক, সেক্যুলারিষ্ট পক্ষ চিৎকার করে আকাশ বাতাস মুখরিত করেছিল।

মুসলিম সমাজের বাস্তবতা সেদিন ইউরোপিয়ানদের চোখে পড়ার মত ছিল। তাছাড়া আরবের বিভিন্ন অঞ্চলাদি তাদের গোত্রীয় কাঠামোই বিরাজ করছিল। কোথায় কেউ নতুন রাজা হলে সে তার প্রাদেশিক ওয়ালী নিয়োগ দিত কিন্তু এটা সাধারণত শহুরে জীবনের বাস্তবতা ছিল। দূরের গ্রামীণ পরিবেশে এসবের কোন পরিবর্তন অনুভূত হত না। কে রাজা হল আর কে রাজত্ব হারালো এগুলো গণ-জীবনে তেমন প্রভাব ফেলত না।

সব চেয়ে বড় কথা ছিল যে ইউরোপ মুসলমানদেরকে বিজ্ঞান ও শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অনেক অগ্রবর্তী দেখতে পায়। আরও দেখতে পায় যে মুসলমান রাজা বাদশাহদের মধ্যে টানাহেঁচড়া ও ইসলাম ধর্মের ভিতরে নানা গ্রুপ থাকলেও তাদেরকে কিছু মৌলিক উপাদান ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছিল। যারা ধর্মীয় উন্মাদনার ঊর্ধ্বে উঠে চিন্তা করতে পারতেন তারা ইউরোপীয় ও মুসলিম শাসন ব্যবস্থা ও সমাজ দর্শনে উদ্বুদ্ধ হন। ইউরোপকে এগুলো পরবর্তীতে প্রভাবিত করবে। আমাদের পরবর্তী প্রবন্ধ ইউরোপে মুসলিম জ্ঞান বিজ্ঞান ও সমাজ দর্শনের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করবে।

References
_______________________________________________

[১]  Wiki. William the Conqueror. [Online] Available at:  http://en.wikipedia.org/wiki/William_the_Conqueror [Accessed04/01/2012]

[২]     ডুমসডে বইটির বানান ইংরেজিতে doomday এবং domesday উভয়-ভাবে লিখা হয়। সামুয়েল জনসন (১৭০৯-১৭৮৪) কর্তৃক ইংলিশ ডিকশনারি প্রণয়নের আগ পর্যন্ত শব্দের বানানের ভিন্নতা প্রচলিত ছিল কেননা তখনও একেক এলাকায় অনেক শব্দের বানান একেক রকমেরই ছিল।

[৩]     Domesday Book Online. Frequently Asked Questions. [Online] Available at:  http://www.domesdaybook.co.uk/faqs.html#2 [accessed 04/01/2012]

[৪]     Random history. The Black Death. [Online] Available at:

http://facts.randomhistory.com/2009/06/09_black-death.html[Accessed 25/05/2012]

[৫]  Crusades: The Crescent and the Cross. (2011). TV Programme, Military Channel (531), UK, 5 December. 22:00 hours.

[৬]  Wiki. Crusades. [Online] http://en.wikipedia.org/wiki/Crusades [Accessed 11/05/2012]

[৭]  The Wordsworth Pocket Encyclopedia, (1993). Wars and Battles.Hertfordshire: Wordsworth Editions Ltd. p.14-15.

[৮]  Military History.  Hundred Years’ War: Battle of Sluys. [Online] Available at:  http://militaryhistory.about.com/od/navalbattles12001400/p/sluys.htm[Accessed 25/05/2012]

[৯]  “Thirty Years’ War”. Encyclopædia Britannica. Encyclopædia Britannica [Online] Encyclopædia Britannica Inc., 2012. Web. 15 May. 2012
<http://www.britannica.com/EBchecked/topic/592619/Thirty-Years-War>.]

[১০] The Wordsworth Pocket Encyclopedia, (1993). Wars and Battles.Hertfordshire: Wordsworth Editions Ltd. p.14-15.

নোটঃ ছবির বেশীর ভাগ ক্লিপ আর্ট এবং ইউকি সূত্রে গুললে আসা ছবি।

About এম_আহমদ

প্রাবন্ধিক, গবেষক (সমাজ বিজ্ঞান), ভাষাতত্ত্ব, ধর্ম, দর্শন ও ইতিহাসের পাঠক।

Comments are closed.