ভারতের মুসলমানদের অবস্থান

(ডিসক্লেমারঃ এই পোস্টের বিষয় বস্তু এবং তথ্য সাংবাদিক ও গবেষক আলতাফ পারভেজের সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রন্থ ‘মউত কা সওদাগর’ থেকে উদ্ধৃত।বইটি প্রকাশ করেছে ঢাকার তরফদার প্রকাশনী)

মুসলমানরা ভারতের দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় জনগোষ্ঠী। ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের পরই সর্ববৃহৎ মুসলমান জনগোষ্ঠী রয়েছে ভারতে। ২০০১ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশটির ১০৩ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ১৪ কোটি মুসলমান। পরবর্তী শুমারিতে (২০১১) তা ১৭ কোটিতে দাঁড়িয়েছে।পুরো জনসংখ্যার হিসাবে তা প্রায় ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ। ভারত অন্তর্ভুক্ত যেসব জনপদে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি, এর মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছে লাক্ষাদ্বীপ (প্রায় ৯৫ শতাংশ), জম্মু ও কাশ্মীর (৬৭ শতাংশ), আসাম (৩১ শতাংশ), পশ্চিম বাংলা (২৫ শতাংশ) ও কেরালা (২৫ শতাংশ)।

উল্লেখ্য, সংখ্যার বিচারে উল্লেখযোগ্য হলেও ভারতের মুসলমানরা বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত জনগোষ্ঠী এখন।বিশেষ করে গত ৬০ বছরে তাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক নিপীড়ন ও গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে। এর কিছু দৃষ্টান্ত ইতোমধ্যে তুলে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে নির্মম অবস্থা কাশ্মীরে।সেখানে ১৯৪৭ সালের পর থেকে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর হাতে প্রায় ৪০ হাজার মুসলমান মারা গেছেন।একই সময়ে ভারতজুড়ে হাজারোবার ‘দাঙ্গা’ হয়েছে,বিশেষত উত্তর ও পশ্চিমাংশে।এর মধ্যে বিহার,আসাম ও গুজরাটে যথাক্রমে ১৯৪৬, ১৯৮৩ ও ২০০২ সালের ঘটনাবলি ছিল ‘পদ্ধতিগত গণহত্যা’।পুরোপুরি রাজনৈতিক ভাবাবেগ তাড়িত,পরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি আকারেই এগুলো ঘটেছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের আলোকেই এসব পরিচালিত হয় সেখানে।ওই জাতীয়তাবাদের কেন্দ্রীয় প্রচারক ছিল ও আছেÑ তা হলো আরএসএস এবং এর অঙ্গ সংগঠন বিজেপি, জনসংঘ, বজরং দল ইত্যাদি।এক হিসাবে দেখা গেছে, উপরোক্ত সংগঠনগুলো ১৯৫৪ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে ভারতের বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের ওপর ৬ হাজার ৯৩৩ বার হামলা করেছে[১]।এই হিসাবে বিহার, আসাম ও গুজরাটের ১৯৪৬, ১৯৮৩ ও ২০০২ সালের হামলায় নিহতদের সংখ্যা বাদ রাখা হয়েছে। অনেকেরই জানা,১৯৪৬ সালের অক্টোবরে বিহারে এক আক্রমণেই আট হাজার মুসলমান নিহত হয়। তা সত্ত্বেও পুলিশকে আক্রমণ বন্ধের অনুমতি দিতে হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী অস্বীকৃত ছিলেন। আসামের নেল্লাইয়ে ১৯৮৩ সালের গণহত্যাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘গণহত্যার সবচেয়ে ভয়ানকতম কর্মসূচি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়[২]।এখানে প্রায় পাঁচ হাজার নিহতের অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু।‘অবৈধ বাংলাদেশি’ আখ্যা দিয়ে তাদের মারা হয়। কিন্তু তারা সবাই ছিলেন আসামের মুসলমান।বিস্ময়কর ব্যাপার হলো,এই হত্যাযজ্ঞের কোনো তদন্তও হয়নি।তবে সেই স্মৃতিও ম্লান করে দিয়েছে ২০০২ সালের গুজরাট।গুজরাটে ১৯৬৯, ১৯৮০ ও ১৯৮৯ সালেও তিন দফায় প্রায় পাঁচ হাজার মুসলমান মারা যান তথাকথিত ‘দাঙ্গা’য়।এসবই একটি চূড়ান্ত রূপ নেয় ২০০২ সালে। হিন্দু তীর্থযাত্রীদের একটি ট্রেনে অগ্নিকান্ড- কেন্দ্র করে এর সূচনা ঘটলেও প্রদেশটির পুরো প্রশাসন এতে জড়িয়ে পড়ে। দেখা গেছে, পুরো রাজ্যের মুসলমানদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দিয়ে উন্মত্ত হিন্দুদের সহায়তা করেছে খোদ পুলিশের সদস্যরা।আবার কয়েকটি স্থানে হামলাকারীদের থামাতে সফল ভূমিকার কারণে অনেক পুলিশকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়[৩]।গুজরাটের গণহত্যা নিয়ে ভারতের বিখ্যাত ম্যাগাজিন তেহেলকা সাড়া জাগানো ‘দ্য ট্রুথ : গুজরাট ২০০২’-এ সামগ্রিক তথ্য উপস্থাপন শেষে জানিয়েছিল, কর্মসূচিটি ছিল পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।

ভারতীয় গণমাধ্যমে এসব হামলাকে সচরাচর ‘দাঙ্গা’ হিসেবেই অভিহিত করা হয়।গবেষক পল ব্রাস, জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে প্রমুখ অবশ্য এটিকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও পরিকল্পিত গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করেছেন[৪]।কারণ এসব কথিত ‘দাঙ্গা’য় নিহত মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুদের সংখ্যা ছিল নিতান্তই নগণ্য।মুসলমানদের ওপর এরূপ পদ্ধতিগত হামলাকে হিন্দুত্ববাদী দলগুলোর নির্বাচনী কৌশল হিসেবে অভিহিত করেছেন কোনো কোনো গবেষক। দেখা গেছে, বিজেপি যখনই কোনো এলাকায় নির্বাচনকালে শক্ত বিরোধিতার মুখে পড়েছে, সেখানেই বেশি হামলা হয়েছেÑ যেখানে সে শক্তিশালী, এর তুলনায়। সরাসরি মুসলমানবিরোধী প্রচারণার পাশাপাশি বিজেপির আরেকটি নির্বাচনী কৌশল হলো মসজিদবিরোধী প্রচারণা চালানো। বাবরি মসজিদের পর তারা এখন বেনারসের কাশি ও মথুরা মসজিদ ভাঙার ডাক দিচ্ছে।

হামলা যেখানেই ঘটুক বা যে কারণেই ঘটুক, সর্বত্র হামলাকারীরা ‘ভারতবিরোধী’ শক্তিকে দমনের জন্য বীরের মর্যাদা পেয়েছে। হিন্দুত্ববাদীদের সার্বক্ষণিক ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’-এর প্রচারণা এভাবে সহিংসতাকে পূজনীয় করে তুলেছে। দেশটিতে সাধারণভাবে প্রায় সর্বত্র মুসলমানদের দেশপ্রেম ও ভারতের প্রতি আনুগত্যকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। গণমাধ্যম ও প্রশাসনের তরফ থেকে হামেশাই তারা ‘সম্ভাব্য জঙ্গি’ হিসেবে চিহ্নিত।

এছাড়া প্রতিনিয়ত সাংস্কৃতিক কটাক্ষও মুসলমানদের নিত্যসঙ্গী। ২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যার পর নির্বাচনী প্রচারকালে মোদি সেখানকার গণহত্যার পক্ষে এই বলেও সাফাই গানÑ মুসলমানদের জন্মহার এত বেশি যে, ভারতজুড়ে হিন্দুরা ভীত। এমন অশোভন কটাক্ষ, সন্দেহ, অবিশ্বাস ও লাগাতার নিগ্রহের কারণে জনগোষ্ঠী হিসেবে মুসলমানদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড- ভেঙে গেছে। ফলে তারা ভারতীয় সমাজের নিচুতলার বাসিন্দা হিসেবেই স্থায়ী আসন করে নিয়েছে।মুসলমানদের অধিকারহীনতার প্রধান একটি ক্ষেত্র হলো রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে প্রায় চূড়ান্ত প্রান্তিকীকরণ।যেমনÑ সদ্য সমাপ্ত হওয়া ১৫তম লোকসভায় সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ৫৪৩ সদস্যের মধ্যে মুসলমান ছিলেন ৩০ জন (৫.৫ শতাংশ)। এই সংখ্যা ১৪তম লোকসভার চেয়েও ৯টি কম।অথচ জনসংখ্যার অংশীদারিত্বকে বিবেচনায় নিলে লোকসভায় মুসলমান সদস্য থাকার কথা বর্তমানে কম-বেশি ৭২ জন। যদিও বিজেপি এবং মূলধারার ভারতীয় মিডিয়া ক্রমাগত ‘ভারতে মুসলমান’ জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে বলে ঘৃণামূলক প্রচারণা চালাচ্ছে, তবুও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে এর পিছু হটা সম্পর্কে তারা একেবারেই নীরব। মুসলমানদের রাজনৈতিক ক্ষমতাহীনতার পেছনে অবশ্য তাদের ভোটব্যাংক-সুলভ সচেতনতা না থাকাও এক বড় কারণ। অথচ লোকসভার সরাসরি ভোটের ৫৪৩টি আসনের মধ্যে অন্তত ৩৫টিতে তাদের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশের বেশি।এর অতিরিক্ত ৩৮টিতে তাদের সংখ্যা ২১-৩০ শতাংশ এবং আরও ১৪৫টিতে তারা রয়েছে ভোটের হিসাবে ১১-২০ শতাংশের মতো। এবার ১৬তম লোকসভা নির্বাচন ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদির বিজয়ের বিপদকে সামনে রেখে মুসলমান সমাজের নেতৃবৃন্দ মতামত গঠনের চেষ্টা করছেনÑ যাতে ‘সকল আসনে মুসলমানরা বিজেপি ও এর মিত্রদের বিরুদ্ধে ভোট দেয়।এতে যে দলের পক্ষেই ওই ভোট যাক না কেন।

’ রাজনৈতিক ক্ষমতায় চরম দুর্বলতার পাশাপাশি ভারতের প্রশাসনেও মুসলমানরা পদ্ধতিগত বঞ্চনার শিকার।সাচার কমিটির[৫] প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আইএএসে মুসলমানদের সংখ্যা ৩, ফরেন সার্ভিসে ১ দশমিক ৮ ও পুলিশ সার্ভিসে ৪ শতাংশ।গুরুত্বপূর্ণ এসব সার্ভিসের পাশাপাশি সাধারণ সরকারি চাকরিতেও মুসলমানদের অন্তর্ভুক্তি নগণ্য। ভারতীয় রেলের বিশাল কর্মী বাহিনীতে মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র ৪ দশমিক ৫ শতাংশ।এর মধ্যে ৯৮ শতাংশই একেবারে নিচের পদগুলোয়। ভারতীয় পুলিশের কনস্টেবল পদে মুসলমান আছে মাত্র ৬ শতাংশ।এই বঞ্চনা ও প্রান্তিকতা দেখা গেছে রাজ্য পর্যায়ের চাকরিতেও, এমনকি সেক্যুলার বলে দাবিদার বামপন্থি-শাসিত রাজ্যগুলোয়ও।যেমনÑ প্রায় কয়েক দশক কমিউনিস্ট পার্টি-শাসিত পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যসরকারের বিভিন্ন চাকরিতে মুসলমানদের হিস্যা মাত্র ২ দশমিক ১ শতাংশ, এমনকি তা খোদ গুজরাটের থেকেও বহু কম।গুজরাটে তা ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ পশ্চিম বাংলায় জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ মুসলমান। এ পর্যায়ে উল্লেখ্য, ভারতে শিখ ধর্মের অনুসারী জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশেরও কম হওয়া সত্ত্বেও কেবল সেনাবাহিনীতে তাদের অংশীদারিত্ব রয়েছে অফিসার পদে প্রায় ২০ এবং সৈনিক পদে প্রায় ১৫ শতাংশ। অথচ জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ হয়েও ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ এক শতাংশেরও কম[৬]।

উল্লেখ্য,সরকারি চাকরিতে পদ্ধতিগতভাবে বঞ্চিত করার পটভূমি হিসেবে সাধারণ দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় ভারতীয় মুসলমানদের নিয়ে এই প্রচারণা চালানো হয় যে, তারা সন্তানদের মাদ্রাসায় পড়ায়। তাই তাদের উচ্চতর সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেয়া যায় না। সে রকম প্রার্থীই পাওয়া যায় না। বাস্তবে এ প্রচারণাটিও প্রশ্ন সাপেক্ষ।যদিও প্রায় ২৫ শতাংশ মুসলমান শিশুই বিভিন্ন আর্থসামাজিক কারণে স্কুলে যায় না বা ড্রপ আউট হয়ে যায় তবুও (সাচার কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী) বিদ্যালয়ে গমনকারী মুসলমান শিক্ষার্থীদের মাত্র ৪ শতাংশ মাদ্রাসায় পড়ে। সুতরাং গণমাধ্যমে ভারতীয় মুসলমান শিক্ষার্থী মাত্রই মাদ্রাসাপড়–য়া হিসেবে যেভাবে চিত্রিত করা হয়,তাও বিশেষভাবে পরিকল্পিত এবং পদ্ধতিগত বঞ্চনাকে যৌক্তিকতা দেয়ার লক্ষ্যেই।

তথ্য আহরণঃ ১।Brass, Paul R. (2005). The Production of Hindu-Muslim Violence in Contemporary India. University of Washington Press, p. 60. (retrieved on 1st January 2014)

২। http://en.wikipedia.org/wiki/Anti-Muslim_violence_in_India#CITEREFDhattiwala2012 (retrieved on 5th January 2014)

৩।Eckhert, Julia (2005). Austin Sarat, Christian Boulanger, ed. The Cultural Lives of Capital Punishment: Comparative Perspectives. Stanford University Press, p.225. (retrieved on 15th January 2014)

৪।Pandey, Gyanendra (2005). Routine violence: nations, fragments, histories. Stanford University Press, p.188. (retrieved on 10th January 2014)

৫।http://zakatindia.org/Files/Sachar%20Report%20(Full).pdf (retrieved on 29th December 2013)

৬।http://www.dawn.com/news/842925/muslims-in-indian-army (retrieved on 3rd January 2014)

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *