ভাবনার জন্য কিছু প্রশ্ন, কিছু উত্তর

ভারত কী নিয়ে ব্যস্ত?

ভারত ব্যস্ত নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনূসকে সম্মান জানাতে; তার ক্ষুদ্র ঋণসম্পর্কিত এবং সামাজিক ব্যবসায় সম্পর্কিত ধারণা দু’টিকে ধারণ করতে, উৎকর্ষিত করতে। ভারত ব্যস্ত কয়েকটি প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশটি হলো উত্তর প্রদেশ। উত্তর প্রদেশে যিনি এখন সমাজবাদী পার্টির নেতা তার নাম অখিলেশ যাদব। বাবা মুলায়ম সিং যাদব। বাবা এবং ছেলের মধ্যে নেতৃত্বের ঝগড়া হয়েছিল; কেউ বলে পাতানো, কেউ বলে আসল। ওই প্রতিযোগিতায় ছেলে অখিলেশ জিতে গিয়েছে। অখিলেশের সাথে জোট বেঁধেছে রাহুল গান্ধী তথা কংগ্রেস। ভারত ব্যস্ত বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে। ভারত ব্যস্ত আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট যদি বহিরাগতদের বের করে দেয় তাহলে কী হবে সেটি সামলানোর জন্য নীতিনির্ধারণে। ভারত ব্যস্ত মহাকাশে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে। ভারত ব্যস্ত পাকিস্তান এবং চীনের সাথে অস্ত্রের আধুনিকতায় প্রতিযোগিতা করতে। ভারত ব্যস্ত আমেরিকার সাথে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে চায়না ঠেকানোর। ভারত ব্যস্ত বাংলাদেশকে নিজের মতো করে আপন করে নেয়ায়; বাংলাদেশের পছন্দমতো নয়।

আমেরিকা কী নিয়ে ব্যস্ত?

আমেরিকা ব্যস্ত, তার নিজের প্রেসিডেন্টকে নিয়ে। কেউ বলছে বুড়ো পাগল, কেউ বলছে পাগলা বুড়া, কেউ বলছে ক্ষ্যাপাটে বুড়া, কেউ বলছে হুঁশের পাগল, কেউ বলছে মুসলমানবিদ্বেষী, কেউ বলছে আমেরিকাবান্ধব, কেউ বলছে যুদ্ধবাজ, কেউ বলছে ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্ট, কেউ বলছে বেপরোয়া এবং লাগামহীন প্রেসিডেন্ট ইত্যাদি। বিচার বিভাগের সাথে তার অঘোষিত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ডোনাল্ড ট্রাম্পবিরোধী যত প্রতিবাদ বা মিছিলই হোক না কেন, তার থেকে বহু বেশি হয়েছে আমেরিকার ভেতরেই। আমেরিকা ব্যস্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সামলাতে; চায়নাকে সামলাতে। আমেরিকানেরা ব্যস্ত বিভিন্ন দেশে যুদ্ধরত আমেরিকান সৈন্যদের কিভাবে ফেরত আনবে সেটি নিয়ে। আমেরিকা ব্যস্ত উত্তরের প্রতিবেশী কানাডাকে সামলাতে, দক্ষিণের প্রতিবেশী মেক্সিকোকে শায়েস্তা করতে। আমেরিকা ব্যস্ত তার অস্ত্র বিক্রির ব্যবসায় বৃদ্ধি করতে। আমেরিকা ব্যস্ত পৃথিবীর যত জায়গায় যত প্রকারের তেলের খনি আছে সেই অঞ্চলগুলোর ওপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। আমেরিকা ব্যস্ত মুসলমান দেশগুলোয় গণ্ডগোল লাগিয়ে দিতে। আমেরিকা ব্যস্ত ধনী মুসলমানদের বন্ধু বানিয়ে, তাদের টাকা-পয়সা আমেরিকায় গচ্ছিত করাতে বা রাখতে এবং পরবর্তী কোনো-না-কোনো উছিলায় সেগুলো ফ্রিজ করতে বা সেগুলো বাজেয়াপ্ত করতে।

 চীন কী নিয়ে ব্যস্ত?

চীনের মহামান্য রাষ্ট্রপতির নাম শি জিনপিং। চীনের প্রেসিডেন্টের মধ্যে বেশির ভাগই মেধাবী ছিলেন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন এবং উদ্বিগ্ন ছিলেন নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে যেতে। তবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট যে প্রকল্প হাতে নিয়েছেন এটি মিলেনিয়ামের মধ্যে সেরা প্রকল্প। দুই হাজার বছর আগের বা দেড় হাজার বছর আগের বা এক হাজার বছর আগের চীনের যেই অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য ছিল, সেই ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে, শি জিনপিং একবিংশ শতাব্দীতে প্রকল্প হাতে নিয়েছেন নতুন সিল্করোডের। সিল্ক মানে রেশম, রোড মানে রাস্তা। অতএব সিল্করোড মানে রেশমের রাস্তা। মানে দাঁড়াল : চীনের অন্যতম প্রসিদ্ধ উৎপাদিত দ্রব্য ছিল রেশম এবং সেটিই চীন থেকে পৃথিবীর বহু দেশে স্থলপথ দিয়ে, ঘোড়ায় টানা গাড়িতে বা উটে টানা গাড়িতে বা গাধায় টানা গাড়িতে বা জন্তুগুলোর পিঠে বোঝা হয়ে বা বরফাচ্ছাদিত নদীর ওপর দিয়ে বিভিন্ন দেশে যেত; অন্তত ইউরোপের পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত যেত। এই কথা মনে রেখেই শি জিনপিং নব-উদ্যমে একবিংশ শতাব্দীতে সিল্করোডকে পুনরুজ্জীবিত করছেন। ধারণাটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বাহন গুরুত্বপূর্ণ কম। এর সাথে যোগ করেছেন পানির ওপর দিয়ে রাস্তার কথা। অর্থাৎ মেরি টাইম সিল্করোড। যদি আপনি মানচিত্রের দিকে খেয়াল করেন, তাহলে দেখবেন এশিয়া মহাদেশের সর্বপূর্ব প্রান্তে বিরাট একটি অংশ, একটি রঙে রঞ্জিত; এটিই গ্রেট চায়না বা মহাচীন বা গণচীন। এই আধুনিক গণচীন থেকে সিল্করোড হিমালয় পর্বতমালার উত্তর দিক দিয়ে এবং কোনো কোনো জায়গায় হিমালয় পর্বতমালার ভেতর দিয়ে, আলাদাভাবে হিমালয় পর্বতমালার দক্ষিণ দিক দিয়ে, বিভিন্ন গন্তব্যস্থলে যাবে বা বঙ্গপসাগরের নীল পানি, আরব সাগরের নীল পানি, পারস্য উপসাগরের নীল পানি, লোহিত সাগরের নীল পানি, কাস্পিয়ান সাগরের নীল পানি, ভূমধ্য সাগরের নীল পানি, ইত্যাদিতে ঘাট নামাবে; তাদের বাণিজ্যিক জাহাজ নোঙ্গর করবে। আবার চীনের পূর্ব উপকূল থেকে অথবা চীনের দক্ষিণ উপকূল থেকে সমুদ্রের পানির ওপর দিয়ে রাস্তা চলে যাবে তথা নৌবহরের ছায়া যাবে বিভিন্ন উপকূলীয় বন্দর স্পর্শ করে; হংকং বন্দর, সিঙ্গাপুর বন্দর, নব নির্মিত (রাখাইন প্রদেশের উপকূলে) সিতওয়ে গভীর সমুদ্র বন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর, কলম্বো বন্দর, গোয়াধর বন্দর, বন্দর আব্বাস, জেদ্দা বন্দর, আলেকজান্দ্রিয়া বন্দর ইত্যাদি। চীনাদের আগ্রহে, বিশ্লেষকেরা নাম দিয়েছেন ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড। ইংরেজিতে শব্দগুলোর প্রথম অক্ষর নিলে দাঁড়ায় ওয়ান-এর ও, বেল্ট-এর বি, ওয়ান-এর ও এবং রোড-এর আর। অর্থাৎ ও-বি-ও-আর তথা ‘ওবোর’। চায়না এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। সামরিক শক্তি হিসেবে, প্রথম ১০টির একটি। চায়না ব্যস্ত নিজের অগ্রগতিকে কিভাবে ধরে রাখবে। চায়না ব্যস্ত আমেরিকার সাথে টেক্কা দিয়ে কিভাবে এক নম্বর অবস্থানে যাবে। চায়না ব্যস্ত প্রতিবেশী জাপানের সাথে সহ-অবস্থান বজায় রেখে, জাপানকে সব দিক দিয়ে ডিঙাতে হবে। চায়না ব্যস্ত ভারতের সাথে কৌশলগত বন্ধুত্ব রাখতে। চায়না ব্যস্ত বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশের সাথে অর্থনৈতিক কৌশলগত বন্ধুত্বের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের নীল পানির সাথে নিরাপদ যোগাযোগ রাখতে।

বাংলাদেশ সরকার কী নিয়ে ব্যস্ত?

বাংলাদেশ সরকার ব্যস্ত চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে; সাথের অবিচ্ছেদ্য দুর্নীতিকে যথাসম্ভব অপ্রকাশ্য রাখতে। বাংলাদেশ সরকার ব্যস্ত সুন্দরবনের কাছে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করতেই হবে এই সঙ্কল্প বাস্তবায়নে; নাগরিক সমাজের যেই অংশে এ প্রকল্পের বিরোধিতা করছে, তাদের পরাস্ত করতে। বাংলাদেশ সরকার ব্যস্ত পার্লামেন্টের গৃহপালিত বিরোধী দলকে অধিকতর গৃহবন্দী করতে এবং ময়দানের বিরোধী দলকে ময়দান ছাড়া করতে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকার ব্যস্ত পার্লামেন্টারি সরকারপদ্ধতির নতুন সংজ্ঞা লিখতে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকার ব্যস্ত বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে নিয়ে আইনকানুন বানানোয় এক্সপেরিমেন্ট করতে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকার ব্যস্ত বিজয় উদযাপন করতে; কিসের বিজয়; পছন্দের নির্বাচন কমিশন স্থাপন করার সাফল্য তথা বিজয়ে। বাংলাদেশ সরকার ব্যস্ত শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে। বাংলাদেশ সরকার ব্যস্ত শিক্ষার ক্ষেত্রে নিজেদের অগ্রগতিকে জাহির করার জন্য, উটপাখির মতো অন্ধ থেকে অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় দিতে। বাংলাদেশ সরকার ব্যস্ত অনৈতিকতার মাধ্যমে শিক্ষার উচ্চস্তরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক দখল প্রতিষ্ঠা করতে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকার ব্যস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিরূপণে এক্সপেরিমেন্ট করতে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকার ব্যস্ত নয়, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে যেন তারা নিজ নিজ গ্রামে, নিজ নিজ ইউনিয়নের নিজ নিজ থানার, মুক্তিযুদ্ধের শহীদগণকে চিহ্নিত করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকার ব্যস্ত সমাজকে বহুধাবিভক্ত করতে। সর্বজনীন একুশের বইমেলায়, কোন পোশাকে কে ঢুকবে বা ঢুকবে না এটি নিয়েও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বলে মনে হয়।

বাংলাদেশের উদ্বেগ!

বাংলাদেশ ব্যস্ত নিজের উদ্বিগ্নতা কাটাতে। কিসের উদ্বিগ্নতা; গন্তব্যস্থল নিয়ে। ধরা যায়, ছোঁয়া যায়, দেখা যায় এমন উন্নয়ন নিয়ে বেশি লোক উদ্বিগ্ন নয়। ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, দেখা যায় না এমন উন্নয়নের অভাব নিয়েই সবাই উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয় প্রচণ্ড এবং অকল্পনীয় দ্রুতগতিতে অবনতিশীল। বাংলাদেশের সমাজে মাদকের আগ্রাসন এত বেশি সর্বগ্রাসী রূপ এবং এত ব্যাপক বিস্তার পেয়েছে যে, শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো অঞ্চলই এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের সমাজে, মানুষের মনে মনে, তরুণদের মনে মনে, কিশোরদের মনে মনে, আগ্রাসী মনোভাব এমনভাবে জেঁকে বসেছে যে, মানুষ খুন করা একটি খেলার মতো হয়ে গেছে। টেলিভিশনে দর্শকেরা দেখে, গুম হয়ে যাওয়ার খবর, বেওয়ারিশ লাশ পড়ে থাকার খবর, স্বামী স্ত্রীকে খুন করার খবর, স্ত্রী স্বামীকে খুন করার খবর, নারীর ওপর অত্যাচারের খবর, কিশোরী অপহরণের খবর এবং এসব দেখতে দেখতে তাদের মন ডিসেনসিটাইজড অর্থাৎ অবেদনতায় আক্রান্ত হয়, অর্থাৎ কোনো বিমর্ষতায়ই তাদের মন বেদনায় ব্যথিত হয় না। মানুষের দেহে ক্যান্সার হলে যেমন হঠাৎ করেই ধরে পড়ে, বাংলাদেশের সমাজের ক্যান্সার এখন মাদক, পরকীয়া, কিশোর সন্ত্রাস। কিন্তু সরকারের কাছে এগুলোর কোনো অগ্রাধিকার নেই। সমাজের জন্যই রাজনীতি, মানুষের জন্য রাজনীতি। ওই রাজনীতি যদি সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অসুস্থতাকে চিহ্নিত করতে না পারে, তাহলে ওই রাজনীতি অবশ্যই অসম্পূর্ণ। মানুষের শরীরের অভ্যন্তরের ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য যেমন কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশনথেরাপি প্রয়োগ করতে হয়, সেরূপ সমাজে বিরাজমান ক্যান্সারের জন্যও থেরাপি প্রয়োগ করতে হয়। সমাজের জন্য থেরাপি প্রয়োগকারী হলেন রাজনীতিবিদেরা। রাজনীতিবিদেরা যদি নিজেরাই রাজনৈতিক ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, সামাজিক ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, তাহলে তাদের চিকিৎসা কে করবে? এরূপ প্রেরণা থেকেই আমি নিজে একজন রাজনৈতিক কর্মী হয়েছি। এরূপ প্রেরণা থেকেই কল্যাণ পার্টি হাঁটি হাঁটি পা পা করে ৯ বছর কাটিয়েছে। এরূপ প্রেরণা থেকেই তরুণ সম্প্রদায়ের প্রতি বারবার আহ্বান জানাতে থাকি রাজনীতিবান্ধব হতে; রাজনীতিসচেতন হতে; দুষ্টু রাজনীতিবিদকে পরিহার করতে; রাজনীতির দুর্নীতিকে পরিহার করতে; কিন্তু রাজনীতিকে ভালোবাসতে।

বাংলা ভাষায় মাহাথিরের জীবনী

একজন বিদেশী জ্যেষ্ঠ বিশ্ববিখ্যাত রাজনৈতিক কর্মীর নাম মনে আসছে। বিনীতভাবে বলতে গেলে, তিনি একজন রাষ্ট্রনায়ক তথা স্টেটসম্যান ছিলেন। তার নাম মাহাথির মোহাম্মদ তথা, তুন ডাক্তার মাহাথির মোহাম্মদ। তিনি বই লিখেছিলেন যার নাম ছিল ‘এ ডক্টর ইন দ্য হাউজ : অটোবায়োগ্রাফি অব তুন ডাক্তার মাহাথির মোহাম্মদ।’ মালয়েশিয়া থেকে প্রকাশিত। বিরাট বই, ৮০০ পৃষ্ঠার বেশি, ইংরেজি ভাষায়। সংগ্রহ করা কষ্ট, পড়া কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। চট্টগ্রাম মহানগরের বিখ্যাত সুফিবাদ ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র, ‘বায়তুশ শরফ’-সংশ্লিষ্ট একজন বিদগ্ধ ব্যক্তি মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ এর নেতৃত্বে চারজনের একটি টিম ওই বইটির চুম্বক অংশ অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন বাংলায়। অনুবাদকৃত প্রকাশিত বইয়ের নাম : ‘আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রধান রূপকার ড. মাহাথির মোহাম্মদের আত্মজীবনী’। ৪০০ পৃষ্ঠা অফসেট কাগজে ছাপা, সুন্দর বাঁধাই। আশা করি আগ্রহী পাঠক সংগ্রহ করে পড়বেন। একটি প্রশ্ন করি : পাঠক আগ্রহী হবেন কেন? সম্ভবত ওই পাঠকই মাত্র আগ্রহী হবেন, যেই পাঠক বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিশ্লেষণ করবেন।

বিষয়টি কী? বিষয়টি হলো : মাহাথির কী নিয়মে তার দেশকে উন্নত করেছিলেন। মাহাথিরের নেতৃত্বের তারকাবৈশিষ্ট্যগুলো কী ছিল? মাহাথির মোহাম্মদ, ইংরেজি ভাষায় লেখা নিজের বইটির শুরুতেই একটি প্রশ্ন এবং তার উত্তর দিয়েছিলেন। প্রশ্নটি হলো, কেন বইয়ের নাম তিনি ওই রূপ দিয়েছিলেন। উত্তর হলো নিম্নরূপ। মাহাথির ছিলেন পেশাগতভাবে ডাক্তার বা চিকিৎসক। কিন্তু ব্যক্তি রোগীর চিকিৎসা না করে তিনি রাজনীতির মাধ্যমে তার দেশের ও সমাজের চিকিৎসা করার জন্য ব্রতি হয়েছিলেন। তিনি রাজনীতিতে আসেন; সংগ্রাম করে ওপরে ওঠেন। তিনি যা করেছেন সেটা হলো মালয়েশিয়ান সমাজ, মালয়েশিয়ান রাজনীতি, মালয়েশিয়ান অর্থনীতির অসুস্থতা দূর করার জন্য যেই সব চিকিৎসা বা থেরাপি প্রয়োজন ছিল তিনি সেগুলো দিয়েছেন; ২২ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে। অর্থাৎ একজন রাজনৈতিক-সামাজিক চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন। মালয়েশিয়ায় মাহাথিরকে কেউ আমদানি করেনি; তিনি মালয়েশিয়ার মাটিতেই জন্ম নিয়েছিলেন এবং মালয়েশিয়ার আবহাওয়ায়ই বড় হয়েছিলেন।

দেশী মাহাথির

বাংলাদেশেও কোনো রাজনৈতিক-সামাজিক চিকিৎসককে কেউ বাইরের থেকে আমদানি করবে না। বাংলাদেশের মাটিতে যেমন কলাগাছ হয়, বাংলাদেশের মাটিতে যেমন বটগাছ হয়, বাংলাদেশের মাটিতে যেমন পুঁইশাক হয়, বাংলাদেশের মাটিতে যেমন মুলা হয়, বাংলাদেশের পানিতে যেমন পাঙ্গাস মাছ চাষ হয়, বাংলাদেশের হাইস্কুলগুলোয় যেমন খুদে বিজ্ঞানীরা ছোট ছোট আবিষ্কার করে, বাংলাদেশের টেলিভিশনের পর্দায় যেমন খুদে গানরাজরা নিজেদের সঙ্গীতপ্রতিভা প্রস্ফুটিত করে, তেমনই বাংলাদেশের কোনো-না-কোনো রাজনৈতিক দল থেকেই একজন মাহাথিরকে বের করতে হবে। কোনো-না-কোনো রাজনৈতিক দল থেকে একজন মাহাথির বের হয়ে আসতে হবে; অথবা একজন লি কুয়ান ইউ বের হতেই হবে। অথবা একজন আহমেদি নিজাদ বের হতে হবে। বাংলাদেশের ছয় ঋতুর সাথে খাপ খাইয়ে, বাংলাদেশের নদীর পানির জোয়ার-ভাটার অভ্যাসের সাথে খাপ খাইয়ে কোনো-না-কোনো রাজনৈতিক নেতাকে আবির্ভূত হতেই হবে। তাহলেই বাংলাদেশের উদ্বেগ কাটবে; তাহলেই বাংলাদেশের চিকিৎসা হবে। তাহলেই বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে অধিকতর সম্মান পাবে। বাংলাদেশী মাহাথিরের বয়স চল্লিশও হতে পারে, পঞ্চাশও হতে পারে, ষাটও হতে পারে, সত্তরও হতে পারে, আশিও হতে পারে। বাংলাদেশী মাহাথির পুরুষও হতে পারে, মহিলাও হতে পারে। বাংলাদেশী মাহাথির, হুইল চেয়ারে আরোহী স্টিফেন হকিংয়ের মতো অদম্য হতে পারে, বাংলাদেশী মাহাথির সাত মহাদেশের শীর্ষচূড়াজয়ী বাঙালি পর্বতারোহী নিশাত মজুমদার, আবদুল মুহিত, ওয়াসফিয়া নাজনীনের মতো হতে পারে। বাংলাদেশী মাহাথির নোবেল বিজয়ী হতে পারে আবার নাও হতে পারে। বাংলাদেশী মাহাথির ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। বাংলাদেশী মাহাথির হবে কর্মঠ সৎ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী; চিন্তা করবেন ভালো বলবেন, ভালো লিখবেন, ভালো হাঁটবেন, ভালো দৌড়াবেন, ভালো বিশ্রাম নেবেন, ভালো প্রয়োজনে সীমান্ত রক্ষা করবেন ভালো।

পরগাছা এবং পৃষ্ঠপোষকতা

পরগাছা গাছ নয়; পরগাছা মানে অন্য গাছের ওপর নির্ভর করে যে ওপরের দিকে উঠতে চায়। সমাজে কোনো একজন দরিদ্র ব্যক্তি যদি ওপরের দিকে উঠতে চান তাহলে তার লাগবে নিজের সঙ্কল্প, নিজের পরিশ্রম, নিজের উদ্যম। তার যদি নিজের টাকা-পয়সা না থাকে তাহলে লাগবে কোনো জায়গা থেকে আর্থিক সহায়তা। বিপদসঙ্কুল সমাজে তাকে ছায়া দেয়ার জন্য লাগবে একজন পৃষ্ঠপোষক। পৃষ্ঠপোষক যদি গাছ হয়, তাহলে ওই ব্যক্তি হবে গাছের ওপর ভর করে বেড়ে ওঠা আরেকটি গাছ। পরগাছা নেতিবাচক শব্দ। আমি ব্যবহার করতে চাই না। রাজনীতিতেও একজন নতুন কর্মী বা একজন দুর্বল কর্মী যদি ওপরে উঠতে চান, তাহলে তারও একজন পৃষ্ঠপোষক লাগে। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার পৃষ্ঠপোষক ছিল। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পৃষ্ঠপোষক ছিল। চীনের তিন দশক আগের মহানায়ক দেং শিয়াওপিংয়েরও পৃষ্ঠপোষক ছিল। হিলারি ক্লিনটনেরও পৃষ্ঠপোষক ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেককেই পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। মাননীয় শেখ হাসিনা অনেককে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। মাননীয় হোসেইন মুহম্মদ এরশাদ অনেককে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। অতএব পৃষ্ঠপোষকতা চাওয়া, পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া এবং পৃষ্ঠপোষকতা করা কোনোটিই অবৈধ নয়। অবৈধ কোনটি তাহলে? পৃষ্ঠপোষকতা অবৈধ হলো, যদি উদ্দেশ্য খারাপ হয়। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সরকার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছেন এবং করেই যাচ্ছেন; প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে। ১৯৭০ বা ১৯৮০-এর দশকের পাকিস্তানের সরকারগুলো পৃষ্ঠপোষকতা পেত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বের প্রতিবেশী মিয়ানমারের সামরিক সরকার, এখন থেকে দুই বছর আগে পর্যন্ত, পৃষ্ঠপোষকতা পেত শক্তিধর রাষ্ট্র গণচীন থেকে। প্রশ্ন : মার্কিন সরকার, গণচীনের সরকার বা ভারতের সরকার কি বাংলাদেশে কোনো মাহাথিরের উত্থানকে পৃষ্ঠপোষকতা করবে? উত্তর আমি আজ আলোচনা করব না।

 কলাম এবং এর পাঠক প্রসঙ্গে

বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে কয়েকটির নাম প্রথম আলো, বাংলাদেশ প্রতিদিন, যুগান্তর, নয়া দিগন্ত, ইত্তেফাক, ইনকিলাব, কালের কণ্ঠ, দৈনিক আজাদী, দৈনিক পূর্বকোণ, দৈনিক করতোয়া ইত্যাদি। জন্মের মাস থেকে পরবর্তী বারো বছর দৈনিক প্রথম আলোয় প্রায় নিয়মিত কলাম লিখতাম। জন্মের মাস থেকে আজ অবধি যুগান্তরে প্রায় নিয়মিত লিখি। ইত্তেফাকে লিখতাম; পত্রিকাটির মালিকানা পরিবর্তনের পর লেখা হয় না। কালের কণ্ঠে লিখতাম; সময়ের অভাবে ইদানীং লিখতে পারছি না। মুদ্রণসংখ্যায় অন্য দুই-একটির তুলনায় কম হলেও অনলাইন পাঠকের আঙ্গিকে শীর্ষস্থানীয় চারটির মধ্যে একটি অন্যতম পত্রিকা হলো নয়া দিগন্ত। এই পত্রিকায় লিখি তিন-চার বছর ধরে। প্রথমে আমার সাপ্তাহিক কলামটি মঙ্গলবারে প্রকাশিত হতো, দুই বছর ধরে প্রতি বুধবারে প্রকাশিত হয়। কলাম লেখা আমার জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম নয়। কলাম লিখি মনের তাগাদা থেকে। কলাম লিখি উদ্দেশ্য নিয়ে। উদ্দেশ্য কী : দেশপ্রেম সৃষ্টিতে সহায়তা করা, দেশের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে সহায়তা করা, পাঠকের মনে জনকল্যাণমুখী চিন্তার সূত্রপাত করাতে সহায়তা করা, বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করা, বিশেষ করে দ্বীন ইসলাম ও বাংলাদেশের ঐতিহ্য এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করা। একটি কলাম ছাপানোর জন্য পত্রিকা কর্তৃপক্ষ যে স্পেইস বা জায়গা বরাদ্দ দেন, তাদেরও উদ্দেশ্য থাকে যেন পাঠক জানতে পারে, পাঠক যেন সমৃদ্ধ হয়। যেই পত্রিকা পাঠকের জন্য যত বেশি শক্তিশালী উপাদান উপস্থাপন করবে, সেই পত্রিকা তত বেশি পাঠকপ্রিয় হবে। যতটুকু অনুভব করি, পাঠক আমার লেখা কলামগুলো পড়েন, কিছুসংখ্যক গভীর মনোযোগের সাথে পড়েন; কিছুসংখ্যক পড়ার পর চিন্তা করেন।

উপসংহার আবেদন

এ মুহূর্তে এ কলাম বা এই পোস্ট যেই সম্মানিত পাঠক পড়ছেন, একমাত্র তিনি নিজেই বলতে পারবেন : তিনি ওই তিন ক্যাটাগরির মধ্যে কোনটিতে পড়েন। আমি আশা করব, কলাম লেখকের চেষ্টা, কলাম পাঠকের চেষ্টা এবং পত্রিকার পক্ষ থেকে চেষ্টায়, সমৃদ্ধ ও সচেতন পাঠকসমাজ গড়ে উঠবে। চিন্তা না করলে অবদান রাখার ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই আবেদন : চিন্তা করুন।

Comments are closed.