বৃদ্দাশ্রমঃ মানবতার প্রতি বৃদ্দাঙ্গলি প্রদর্শন

 

বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা কমবেশি আমাদের সবার ভেতরই আছে। আমরা সবাই বাবা-মাকে ভালোবেসে সুখ পাই। মনের গহিণে আনন্দ অনুভব করি। মমতাময়ী মায়ের আঁচলই আমাদের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। বাবা-মা আমাদের নিজের জীবনের রক্তবিন্দু দিয়ে তিল তিল করে বড় করে তুলেছেন। শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে আমাদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মা ১০ মাস কষ্ট সহ্য করে আমাদের গর্ভে ধারণ করে চিরঋণী করেছেন। সেই ঋণ শোধ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তো কবি বলেছেন, মায়ের একধার দুধের দাম/কাটিয়া গায়ের চাম/ পাপস বানাইলে ও ঋণ শোধ হবে না/এমন দরদী ভবে কেউ হবে না আমার মা…..।
সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের যে ভালোবাসা, তা পৃথিবীর একমাত্র নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। সন্তানের জন্য বাবা-মা নিজের জীবন উৎসর্গ করতে ও কুন্ঠাবোধ করেন না। তাই তাদেরকে সম্মান করা, ভালোবাসা ও তাদের প্রতি কর্তব্য পালন করা আমাদের সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু তিক্ত সত্য হলো, কালপরিক্রমায় আমরা হয়ে উঠি অতি নিমর্ম। প্রকাশ পায় বাবাÑমায়ের প্রতি চরম অবহেলা ও অবজ্ঞা। বাবা-মা যখন বৃদ্ধ হয়ে যান, তখন তারা সন্তানের উপার্জনের ওপর নির্ভশীল ও চরম অসহায় হয়ে পড়েন। আর তখন থেকেই আমরা তাদের প্রতি প্রদর্শন করি ঔদাসিন্য ও অবহেলা। তাদেরকে ভাবতে থাক পরিবারের বোঝাস্বরপ। এই ভোগবাদী মানসিকতা থেকেই আমরা তাদেরকে জোর করে পাঠিয়ে দেই বৃদ্দাশ্রমে। স্বামী-স্ত্রী ও আদরের ছেলে-মেয়ে নিয়ে গড়ে ওঠে সুখের সংসার। আর বৃদ্দ বাবা-মায়ের ঠাঁই হয় বৃদ্দাশ্রমে। পরিবার-পরিজন, ছেলে-মেয়ে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক চরম অসহায় জীবনযাপন করেন তারা। ভাগ্যের কি নিমর্ম পরিহাস, যে সন্তানকে মানুষ করার জন্য বাবা-মা সারা জীবন কষ্ট করেছেন, যে সন্তানের সুখের দিকে তাকিয়ে বাবা-মা নিজের সুখ বিসর্জন দিয়েছেন, সেই নরাধম সন্তানের দ্বারাই বাবা-মা নিগৃহীত হচ্ছেন।
আমরা একবার ও ভাবি না যে, আমাদের সন্তান আমাদের কাছে যেমন, আমরা ও আমাদের বাবা-মায়ের কাছে তেমন। আমরা আমাদের সন্তানকে যেমন আদর-সোহাগ করি, মায়া-মমতা দিয়ে পরম যতেœ লালন-পালন করি, আমাদের বাবা-মা ও আমাদের মায়া-মমতা দিয়ে, আদর -স্নেহ দিয়ে বড় করেছেন। বাবা-মা নিজে না খেয়ে আমাদের খাইয়েছেন। নিজের সুখ-শান্তি বিসজর্ন দিয়ে আমাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। আমাদের সুখের দিকে তাকিয়ে তারা আরামের ঘুম হারাম করেছেন। আামদের মুখে দ’ুমুঠো খাবার তুলে দেয়ার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন। আমদের লালন-পালনে কষ্ট মনে করে কোনো শিশু আশ্রমে আমাদের পাঠিয়ে দেননি।
ইসলাম বাবা-মায়ের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। তাদের সেবা-যতœ করা, তাদের সঙ্গে সদাচারণ করার নিদের্শ দেয়া হয়েছে। তাদের কথা মান্য করা ইসলামের দৃষ্টিতে ফরজ। বাবা-মাকে কষ্ট দেয়া, তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, তাদের কথা অমান্য করা নিঃসন্দেহ অনেক বড় গুনাহ। আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন, তিনি ছাড়া অন্য কার ও ইবাদত না করতে ও বাবা-মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করতে’ (সুরা বনি ইসরাইল ২৩Ñ)
হাদিস শরিফে এসেছে, একবার জনৈক সাহাবি নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে জিহাদে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা প্রকাশ করলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার বাবা-মা কেউ কি জীবিত আছে, সাহাবি হ্যাঁ সূচক জবাব দিলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বাড়িতে গিয়ে তাদের সেবা কর। (বুখারি শরিফ, হাদিস নং ২৮৪২) অন্য হাদিসে আছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় তার বাবা-মা উভয়কে অথবা তাদের একজনকে পেল , অথচ সে জান্নাত আদায় করতে পারল না, তার চেয়ে দুর্ভাগা আর কে হতে পারে?
বাবা-মা যখন বার্ধক্যে উপনীত হন তখন তাদের প্রতি দায়-দায়িত্ব আর বেড়ে যায় , তাদের সেবা –শুশ্রƒসার আর ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ মানুষ যখন বৃদ্দবয়সে উপনীত হয় তখন সে আবার শৈশবে ফিরে যায়। বিখ্যাত কবি ও দার্শনিক সেক্রপিয়র বার্ধক্যকে আখ্যায়িত করেছেন দ্বিতীয় শৈশব হিসেবে। তাই তখন তার বেঁচে থাকার জন্য শিশুকালের মতো আদর-স্নেহ, মায়া-মমতার প্রয়োজন হয়। বার্ধক্যের কারণে বাবা-মায়ের মেজাজ কিছুটা খিটখিটে ধরণের হয়ে যেতে পারে, সামান্য বিষয় নিয়ে তুলকালাম কান্ড ঘটাতে পারেন। তাই তাদের অস্বাভাবিক আচরণকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার নিদের্শ রয়েছে ইসলামে। আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তাদের একজন বা উভয়েই জীবদ্দশয়ায় বাধর্ক্যে উপনীত হলে তাদের উফ বলো না। তাদেরকে ধমক দিও না, তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বলো। (সুরা বনি ইসরাইল- ২৩)
সন্তানের জন্য বাবা-মা উভয়েই কষ্ট করেন। তথাপি বাবার তুলনায় মায়ের হক অনেক বেশি। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি নবী নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কোন ব্যক্তি আমার সর্বাধিক সদাচরণ পাওয়ার অধিকারী ? তিনি বলেন, তোমার মা। লোকটি বললেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বললন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমরা মা। লোকটি বললন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার বাবা। (মুসলিম শরিফ,
সর্বোপরি মনে রাখতে হবে, কালেন বির্বতনে আমরা ও এক সময় বার্ধক্যে উপনীত হব। আমাদের সঙ্গে বৃদ্দাবস্থায় তেমন আচরণ করা হবে, যেমন আচরণ আমরা আমাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে করব। অন্তত এই দিকটি বিবেচনায় রেখে আমাদের উচিত বাবা-মায়ের সঙ্গে সদাচরণ করা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফিক দিন। আমীন।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *