বিশ্বাস ও সভ্যতা

পশ্চিমা সভ্যতা এখন আর পশ্চিমে আবদ্ধ নেই, সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে। বতর্মান সভ্যতার নৈতিক ভিত্তি বলতে কিছু নেই, জীবনের কোনো মূল্য এই সভ্যতায় নেই। স্বার্থবাদ আর ভোগবাদে মোড়ানো এই আধুনিক সভ্যতা।

এ কথা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, পাশ্চাত্য জগতে, যেখানে সূর্য উদিত হয় না শুধু অস্ত যায়, নবুয়তের আলোক বিন্দুর ছোঁয়া লেগেছে খুবই কম। ওখানে আসমানী আলোকরশ্মির চিত্রায়নের চেষ্টা করা হয়েছে মানবমস্তিস্ক প্রসূত আলোক রশ্মি দিয়ে। নবীদের কোন কোন শিক্ষা ও বাণী তাদের শ্রুতিগোচর হয়েছিল অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু তার সাহায্যে পথ চলার মত সেটা যথেষ্ট ছিল না।

পাশ্চাত্য সভ্যতাকে বিভিন্ন কৃত্রিম রঙে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এ বস্তুবাদী সভ্যতার কোনো রং নেই, না আছে এর কোনো আদর্শিক মানদন্ড।
এ শতাব্দীর মানুষ হল আত্মবিস্মৃতির পরিপূর্ণ মডেল। সে একেবারেই ভুলে গেছে তার মূলসত্ত্বা, ব্যতিক্রমি বৈশিষ্ট্য পশু ও মানবের পার্থক্য, জীবন ও জন্মের মূল উদ্দেশ্য। আল্লাহর নিকট থেকে জ্ঞান নেবার প্রয়োজনবোধ করে না বলে তারা নফসের গোলাম হতে বাধ্য। নফস মানেই দেহের দাবির সমষ্টি। দেহের যাবতীয় দাবি পূর্ণ করতে তারা বিনা বাধায় তৎপর হয়। দেহের কোনো নৈতিক চেতনা না থাকায় তারা নৈতিক বন্ধন থেকে মুক্ত অবস্থায় বস্তুজগতকে ভোগ করতে থাকে।

পার্থিব জীব ও জাগতিক বস্তুর স্বাদ আস্বাদন, ভোগ বিলাস এক চরম উন্মাদনা আর অবিচ্ছেদ্য পীড়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। পাশ্চাত্য সভ্যতার পরতে পরতে ভোজন আর ভোগ বিলাসের ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে।
মহান আল্লাহ তাআলা এদের ব্যাপারে বলেছেন-
‎ذَرْهُمْ يَأْكُلُوا۟ وَيَتَمَتَّعُوا۟ وَيُلْهِهِمُ ٱلْأَمَلُۖ فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ
তাদেরকে ছেড়ে দাও, আহারে ও ভোগে তারা মত্ত থাকুক এবং আশা তাদেরকে গাফেল করে রাখুক, আর অচিরেই তারা জানতে পারবে। [১৫:৩]

তরবারির তেজ, যুক্তির বল, বিজ্ঞানের সাক্ষ্য প্রমাণের সমর্থন এবং চোখ ধাঁধানো রূপ-সৌন্দর্যসহ যে ধ্যান-ধারণা, মতাদর্শ ও রীতিনীতি পাশ্চাত্য থেকে এলো, আরামপ্রিয় মস্তিস্ক ও পরাভূত মানসিকতা তাকে একেবারে ঈমানের মর্যাদা দিয়ে বসলো। আর চেতনাহীনতার এ পথে লোকদের মন মগজে এই ধারণা বৃদ্ধমূল হয়ে গেল যে, পাশ্চাত্য থেকে যা কিছু আসে তাই সত্য এবং তাই হচ্ছে সত্যতা।
কিন্তু বাস্তবতা হলো পশ্চিমের নিজেদের মনেই এই বস্তুবাদী সভ্যতায় শান্তির কেনো ছিঁটেফুটে নেই, যেই সভ্যতা বিশ্বাসকে পাশ কাটিয়ে গড়ে উঠে তার কি সতন্ত্র কিছু থাকে?
অ্যালেক্সিস ক্যারেল তার Man the Unknown গ্রন্থে বলেন-
“আধুনিক শহরের নাগরিকেরা যেসব যন্ত্রনা-উৎকন্ঠায় ভুগছে, তা মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি-কৌশলের কারণেই ঘটছে। মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি যে পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, তা মানুষের সংগে সামাঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ, তা মানবিক সত্ত্বাকে অগ্রাহ্য করেই গড়ে উঠেছে।”

আল্লামা ইকবাল বলেন- ‘এই বিলাসবহুল জীবন, এই রাজত্ব, এই ব্যাবসা, আলোবিহীন বক্ষে শান্তি হতে বঞ্চিত। ফিরিঙ্গীরা মিশিনের ধোয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন।’

বিশ্বাসের পার্থক্যের কারণেই বিভিন্ন রকম জীবনাচরণ, সামাজিক রীতিনীতি, জীবন-যাপনের পদ্ধতি গড়ে উঠেছে। বিশ্বাসের বাহ্যিকরূপই সংস্কৃতি বা সভ্যতা। সভ্যতা হলো মূল কাঠামো, সংস্কৃতি এর বাহ্যিক প্রকাশ।

ইসলাম হচ্ছে মানুষের জীবন বিধান, আর এ বিশ্বাসের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠে ইসলামের সভ্যতা! ইসলামের গোটা সভ্যতাই ওহী ও রিসালাতের উপর প্রতিষ্ঠিত।
ঈমান হচ্ছে মুসলিমদের সভ্যতার মূল ভিত্তি, যে ভিত্তির উপর গড়ে উঠে মুসলিমদের জীবনাচরণ। কিন্তু পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সভ্যতার পাল্লায় পড়ে মুসলিম সমাজে ঈমান তথা বিশ্বাসকে সভ্যতা থেকে আলাদা করে দেয়া হয়েছে। সেক্যুলার রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা মুসলিমদের মধ্য সভ্যতার নামে এক বর্বরতা ছাপিয়ে দিয়েছে।

সভ্যতা-সংস্কৃতির শিকড় মানুষের মন মানসিকতা যা জাতির উদ্দীপনা ও অনুভূতির গভীরতা পর্যন্ত পৌছে থাকে। কোন জাতিকে তার বিশেষ সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া মানে তার জীবন-যুদ্ধ হতে তাকে সরিয়ে দেয়া। এ বিচ্ছিন্নতার ফলে তাদের কাজকর্ম, বিশ্বাস ও ইবাদাত কিছু রেওয়াজ ও প্রথার মধ্য সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। বস্তুত তাই হয়েছে ইসলামি সভ্যতার সাথে, প্রতিটি পদেক্ষেপে সভ্যতাকে বিশ্বাস থেকে তুলে দেয়া হয়েছে। পাশ্চাত্য সভ্যতার নামে উম্মতের ওপর এক অপরিচিত রং চড়িয়ে দিয়েছে।

যে ক্রোড়ে মুসলিম শিশু প্রতিপালিত হয়, সে ক্রোড়টি অন্তত কুফুর ও ভ্রষ্টতা অর্থনৈতিক ও কদাচার থেকে নিরাপদ থাকা দরকার। যে দোলনায় মুসলিম সন্তানের জীবনের প্রারম্ভিক স্তরগুলো অতিক্রান্ত হয়, তার চারপাশে অন্তত খালেস ইসলামী পরিবেশ বিরাজ করা প্রয়োজন। যে চার দেয়ালের মধ্য মুসলিম শিশুর সরল মন-মগজে শিক্ষা-দীক্ষা ও অভিজ্ঞতার প্রাথমিক চিত্র অংকিত হয়, সেটি অন্তত বহি:প্রভাব থেকে নিরাপদ থাকা আব্যশক। যে বুক থেকে মুসলিম শিশু দুগ্ধ পান করে, অন্তত সেই বক্ষদেশটি বিশ্বাসের সভ্যতায় উদ্ভাসিত থাকা প্রয়োজন।

আমাদের সভ্যতা প্রতি রঙে রঙীন হওয়া রঙহীনদের জন্য আসেনি, আমাদের সভ্যতা একটি রঙে রঙিন হওয়ার জন্য এসেছে। সেই রং আমাদের রব আমাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

‎صِبْغَةَ ٱللَّهِۖ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ ٱللَّهِ صِبْغَةًۖ وَنَحْنُ لَهُۥ عَٰبِدُونَ
আমরা আল্লাহর রং গ্রহণ করলাম।আর রং এর দিক দিয়ে এটাই উত্তম।আর আমরা তাঁরই ইবাদাতকারী।[২:১৩৮]

যারা আল্লাহর রঙকে দুনিয়ার সকল রঙের চাইতে বেশি ভালবাসে, এবং সেই রঙেই যারা গোটা দুনিয়াকে রাঙাবার স্বপ্ন দেখে, তাদের জন্যই এই সভ্যতা।

আমাদের প্রত্যাশা আল্লাহর রঙয়ে রঙিন হওয়া।আমাদের বিশ্বাস, আমাদের সভ্যতা।

•সহায়ক গ্রন্থাবলী:

রিসালাতে মুহাম্মাদী ও বর্তমান পশ্চিমা বিশ্ব- আবুল হাসান নদভী রাহিমাহুল্লাহ
ইসলামী সভ্যতা বনাম প্রাশ্চাত্য সভ্যতা- গোলাম আযম রাহিমাহুল্লাহ
মুসলিম বিশ্বে ইসলাম ও প্রাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ-আবুল হাসান নদভী রাহিমাহুল্লাহ
ইসলাম ও প্রাশ্চাত্য সভ্যতার দন্দ- আবুল আ’লা মওদুদী রাহিমাহুল্লাহ
আগামী দিনের পৃথিবী- শহীদ আব্দুল্লাহ আযযাম রাহিমাহুল্লাহ
প্রাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি- মাওলানা আব্দুর রহিম রাহিমাহুল্লাহ

বিশ্বাস ও সভ্যতা
-নাঈম হোসাঈন

Comments are closed.