বিশ্বাসের পিছনের সত্তা: মুমিন, মুনাফিক, কাফির, নাস্তিক

মানুষ যখন কোনো একটি বিশ্বাসে উপনীত হয়, তখন তা হঠাৎ করে হয়ে যায় না। তার জীবনের অনেক ঘটনাবলী, তার চলার পথের আঁকা-বাঁকা রূপ, তার হোঁচট, তার বুঝ ও সমঝ, তার নানান পাঠ এর পিছনে থাকে। এর পিছনে থাকে তার সুখ-দুখ, জীবনের নানান সমস্যা ও জটিলতা। প্রত্যেক ঘটনা, প্রত্যেক সুখ-দুখের স্থান, প্রত্যেক জটিলতার সন্ধিক্ষণ থেকে উদ্ভূত কিছু অভিজ্ঞতা, চিন্তা-চেতনা, আশা-নিরাশা, পাওয়া, না-পাওয়ার পরশ। আবার এগুলোই দিয়ে যায় পুঞ্জিভূত ‘অর্থের’সার-নির্যাস।

অনেক ঘটনার ‘অর্থ’ অপরাপর ঘটনার ‘অর্থের’ সাথে অন্বয় সৃষ্টি করে যেতে পারে বা সাধারণত করেই যায়। আর এভাবে জীবনের ‘অর্থগত’ ধারা বর্ধিত হতে থাকে, গড়ে ওঠতে থাকে পুঞ্জিভূত অর্থের সমাহার। অনেক ঘটনা স্মৃতি-বিচ্যুত হয় বটে তবে সেগুলোর ‘অর্থের নির্যাস’মনের রন্ধ্রে, অনুভূতির কোমলে রেখে যায়।

যারা বিশ্বাসে স্বস্তি পেয়েছেন, আর যারা বিশ্বাস ত্যাগ করেছেন, আর যারা বিশ্বাসকে খেলার হাতিয়ার করেছেন (মুনাফিক) তারা উল্লেখিত নানান ধারা ছুঁয়ে-পরশেই নিজেদের স্থানে উপনীত হয়েছেন। যে ব্যক্তি বিশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি আগে বিশ্বাসী ছিলেন। কেননা ‘ত্যাগ’ করাটাই পূর্ব-বিশ্বাস ইঙ্গিত করে। এক সময় তিনি যা বিশ্বাস করতেন, বাস্তবে কোথাও যেন সেই বিশ্বাসের উল্টাটাই পেয়েছেন -আশার প্রত্যয়ে নিরাশ হয়েছেন। তার মনের ‘বিশ্বাসী-ছবি’ যেন মলিন হয়েছে। তার আবেগের অনুভূতি যেন প্রতারিত হয়েছে। তবে, তিনি কেন প্রতারিত হবেন? খোদা যদি থাকবেন, তবে তিনি কেন তার আশা পূরণ করে দিতে পারলেন না? তিনি কেন বিপদ-মুসিবত থেকে রক্ষা করে দেন নি? এভাবে তার চেতনার বিদগ্ধ অনুভূতি ধীরে ধীরে এক বড় বেষ্টনী তৈরি করে থাকে। ওখানে অনেক অনেক ‘অর্থ’ বিজড়িত হয়। ওখানে এক কথা থেকে দশ কথায় যাওয়ার পরিসর সৃষ্টি হয়, এক ব্যর্থ অনুভূতি থেকে দশ অনুভূতিতে যাওয়ার স্থান আসে। তার গোটা স্মৃতির রাজ্য এই ‘নাই-নাই’ ধারায় সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। তিনি তার পথ এই ধারাতেই পেয়ে যান। এমন ব্যক্তির জন্য এখন তার পূর্ব বিশ্বাসে ফিরার পথ নেই, যদি না আল্লাহ একটা কিছু ঘটিয়ে না দেন। যারা কাফির, নাস্তিক, মুনাফিকদের সাথে যুক্তি তর্ক করেছেন, তারা দেখে থাকবেন যে কীভাবে এই শ্রেণীর লোকজন এক ডাল থেকে অন্য ডালে বিচরণ করে। এই বিচরণের উৎস হচ্ছে সেই পুঞ্জিভূত চিন্তাজাল। সেই জালে আছে অনেক গিট। ওগুলো তারা খুলতে পারে নি। আলোচনায় তাই এক স্থান থেকে তারা অপর স্থানেই বিচরণ করেন। কেননা ওগুলোতেই তাদের বিশ্বাস ও ‘অর্থ’ (তার রূপ যেটাই হোক) বিস্তৃত হয়ে আছে। কোনো কোনো আলোচনাতে এই ভাব প্রকাশ পায় যে তারা যদি সেই গিটগুলো সামনে হাজির করতে পারে, তবে সম্ভবত বিশ্বাসীরা তাদের মতোই বিশ্বাসের অসারতা বুঝতে পারবেন। কিন্তু তাদের এই ধারণা নেই যে তাদের মনের ‘জঙ্গলে’ যেসব পথ তারা যেসব ধারায় অতিক্রম করে এসেছেন, অপর লোকজন হয়ত সেইসব পথ অন্যধারায় ও পদ্ধতিতে অতিক্রম করে এসেছেন যে কারণে তাদের গিটগুলো ওদের কাছে অত্যন্ত মামুলী। ওদের কাছে পাওয়া না-পাওয়া, বিপদ-মুস্কিল, জীবনের জয়-পরাজয় অন্যভাবে সমঝে এসেছে। তারা জীবন মৃত্যুর ঘেঁষা-ঘেঁষিতে অন্য ধরণের ‘অর্থ’ দেখতে পেয়েছেন।

অনেক বড় বড় নাস্তিকদের জীবনে অনেক সামাজিক জটিলতা, দুঃখ দুর্গতি পোহাতে দেখা যায়। কেউ কেউ সেগুলো উল্লেখ করে বলতে দেখা যায় যে খোদা যদি থাকবেন তবে এমনটি কেন হয়ে থাকবে? কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, কোনো প্রাণীর জন্যই মূলত বেঁচে থাকা একদম সহজ ব্যাপার নয়। এই জগতে রোগ আছে, দুর্ঘটনা আছে, নির্যাতন করা ও নির্যাতিত হওয়ার স্থান আছে। সুখ আছে, দুঃখ আছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় আছে। ব্যাপারটা কী এমন হবে যে আল্লাহ আমাদেরকে ও আমাদের পরিবারকে বিপদমুক্ত রাখলে আল্লাহ ‘আছেন’ আর না রাখলে তিনি ‘নেই’? এটা কী এভাবে ভাবা হবে যে যদি ভূমিকম্প হল, যদি সুনামি হল, যদি ওখানে হাজার হাজার মানুষকে বাঁচানো হল না, তবে তিনি আছেন কীভাবে? এখানে খোদার অস্তিত্বের যুক্তি আসছে ‘মানুষ’ নামের প্রাণীর বেঁচে থাকার পরিপ্রেক্ষিত থেকে। এমন ধারার আলোচনা এবং অনুসন্ধিৎসা যুক্তিহীন।

যারা বিশ্বাস হারিয়েছেন অথবা ‘ভিন্ন-অর্থে’ উপনীত হয়েছেন, তারপর নিজেদের ‘অর্থের’ দর্শন অন্যদের লেখায় প্রতিফলিত হতে দেখেছেন এবং তাদের নিজেদের চিন্তার এক সমাজ-শ্রেণীর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন, অর্থাৎ যারা সমমনা, তারা তখন সেই প্রাপ্ত সমাজে ও শ্রেণীতেই আত্মিভূত হয়েছেন। এই পর্যায়ে আসার পর, বিশ্বাসে ফিরার পথ আরও রুদ্ধ। এখানে ব্যক্তি তার বৈক্তিক স্থান থেকে সমাজে উপনীত। ব্যক্তি তার সমমনা সমাজেই তার পরিপূর্ণ অস্তিত্ব-প্রাপ্ত। এই ধারাগত ও স্রোতজাত ‘অর্থের দিক’ আস্তিক, নাস্তিক, কাফির ও মুনাফিক সকলের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য।

নাস্তিকদের অনেকের জীবন অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে যে বাদ-বাকি মানুষের মত তাদের অনেকের স্বাস্থ্যে জটিলতা ছিল, অথবা পারিবারিক দুর্ভোগ ছিল অথবা কিছু চরম-ঘটনার বা দৃশ্যাবলীর মুখামুখি হয়ে তাদেরকে অপ্রকৃতিস্থ সমস্যায় পদার্পণ করতে হয়েছিল যেখানে আশা-আকাঙ্খা ও প্রত্যয়ে ‘প্রতারিত’ চিন্তার মুখামুখি হতে হয়েছিল। কার্ল মার্ক্সের পরিবার খৃষ্টিয়ানদের নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছিল এবং মার্ক্সের ছোটবেলায় তার পরিবার খৃষ্টীয়ান হতে হয়েছিল। স্পিনোজার পরিবারও নিপীড়িত হয়েছিলেন এবং তার শারীরিক রোগগ্রস্থতা ছিল। হকিং-এর জীবন দেখুন। এভাবে একটা একটা করে দেখতে থাকলে সেই স্থানগুলো স্পষ্ট হয়ে দেখা দেবে। তবে সকল বিষয়ে নানা ব্যতিক্রম থাকে। এখানেও তাই। অনেক নাস্তিক জন্ম-সূত্রেই নাস্তিক। এটা জন্ম-সূত্রে আস্তিকের মতই। আমরা জন্ম-সূত্রের শ্রেণীকে হয়ত আলাদা করে দেখতে পারি।

নাস্তিকদের একটি অংশকে ‘ফ্যাশনের’ নাস্তিক হিসেবেও দেখা যেতে পারে। সমাজে কিছু লোক এমন আছেন যারা যা-কিছু নতুন দেখেন তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কেউ নাকে ছিদ্র দেয়, কানে ছিদ্র দেয়, চামড়ায় টাটু আঁকে, চুলের কাটিংগে নানান আকৃতি দেয়, ভিন্ন ধরনের কাপড় বেছে নেয়, নতুন পদ্ধতিতে চলাফেরা করে। এতে সে অন্য ধরণের পরিচিতি খুঁজে। এসবের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। এই শ্রেণীর লোকজন যখন তাদের নব্য-ধারিত জীবনে অভ্যস্ত হয় তখন তাতে সে তার কাজ ও জীবনের যুক্তি ও ব্যাখ্যা লাভ করে। যুক্তি হচ্ছে সকল হাতিয়ারের (tools) মত একটি হাতিয়ার যার রূপ ও প্রকৃতি হচ্ছে ভাষিক, যে হাতিয়ার তার অবস্থানের ‘অর্থ’ প্রকাশে সাহায্য করে। হাতিয়ারকে যেমন বিভিন্ন কাজের আঞ্জাম দিতে তৈরি করা যায়, এই হাতিয়ারও তদ্রূপ। আস্তিক নাস্তিক এভাবেই তাদের যুক্তির হাতিয়ার তৈরি ও ব্যবহার করেন। ফ্যাশনের নাস্তিকও এক সময় অপরের কাছ থেকে যুক্তির ভাষা আত্মস্থ করে এবং সেই ভাষায় তার নিজ অবস্থান ব্যক্ত করে।

এবারে আসি উপরে যে ছবিটি এঁকেছি তার ব্যাখ্যায়। ওখানে আমি চারটি রঙের সুতোয় মানুষ তার জীবনের যাত্রা পথে কীভাবে নানান সমস্যার গিটে আটকা পড়েন এবং কীভাবে সেইসব জটিলতা অতিক্রম করে থাকতে পারেন তার একটি অর্থ দেখাতে সাজিয়েছি। আমাদের মস্তিষ্কের নিউরোলজিক্যাল কানেকশনকেও এর সাথে মনে মনে সমান্তরাল ভাবা যেতে পারে। আমরা ব্যক্তি হিসেবে ভিন্নতার অনেক স্থান থাকে। যেমন আমাদের ফিঙ্গার-প্রিন্ট, কণ্ঠস্বর, চোখের স্বাতন্ত্র্য, নিউরোলজিক্যাল কানেকশন ইত্যাদি। এই স্বাতন্ত্র্য আমরা ‘নিজেরা’ সৃষ্টি করি নি, অর্জনও করিনি। এমনিভাবে আমাদের অনেক চিন্তা, অভিজ্ঞতার উৎস আমাদের ‘অর্জিত’ (attained) নয়, ‘প্রাপ্ত’ (given/received)। তাছাড়া আপনার জন্ম, আপনার পরিবার, আপনার সমাজ ও কাল –এগুলো আপনার অর্জিত নয়, আপনার সিদ্ধান্তের আওতাভুক্ত নয়। কিন্তু ওগুলোতে আমাদের জীবনের অনেক বিষয়ের সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। আমাদের জীবনের অনেক বিষয় চিন্তার আহবান করে।

আমরা যখন জীবনে পদার্পণ করি এবং যে পরিবেশে বড় হই, যে ‘মানসিক স্বভাব ও প্রবণতা’ (mental disposition) প্রাপ্ত হয়ে অগ্রসর হই, যে শ্রেণীতে ওঠা বসা করার মওকা পাই, যে পথে শিক্ষা নেয়ার সুযোগ উন্মোচিত হয়, যে আদর্শের লোকদের সাথে সামাজিকতা করে সামাজিক ও প্রত্যয়-কেন্দ্রিক আদর্শে ‘আদর্শবান’ হই, সেই ‘শৃঙ্খল’ই (chain) আমরা যা হই তার প্রধান উৎস। এগুলোতে আমাদের সিদ্ধান্ত কতটুকু কার্যকর?

উপরের অঙ্কিত সুতোয় দেখানো নানান জটিল যাত্রা পথে আস্তিক, নাস্তিক, কাফির ও মুনাফিকের অভ্যন্তরীণ চলার পথ দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। চলার পথে মানুষ তার গিটগুলো যখন অতিক্রম করে, তখন প্রকৃতিগত প্রবণতা, তার রূহানিজাত চরিত্র উপস্থিত থাকে, অর্থের সমন্বয় ঘটায় –এটাই বুঝাতে চেয়েছি। সে যা হয়েছে তা হঠাৎ করে হয়ে যাওয়া কিছু নয়।

তবে আপাতদৃষ্টে কাউকে ‘হঠাৎ’ তার ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়ে যাওয়া দেখে কিছু আকস্মিকতা অনুভূত হতে পারে। কিন্তু তাতেও প্রকৃতিস্থ প্রবণতা কাজ করে। এই বিষয়টি দীর্ঘ আলোচনার আহবান করে কিন্তু সেই অবকাশ এখানে নেই তাই ওঠা বাদ দেয়া যাক। ঝর্ণার পানি হঠাৎ কোনো পাথরে বাধাগ্রস্ত হয়ে ভিন্ন স্রোতে প্রবাহিত হতে পারে। আপাতদৃষ্টে হঠাৎ দেখালেও সেই পাথরের অবস্থান, ঝর্ণার পূর্ব-ধারার ইতিহাস, অপরাপর বাধা-বিঘ্নতা ইত্যাদি এসব কারণ-ধারায় (causations) বিবেচনা করা যেতে পারে এবং সেই বিবেচনায় ‘হঠাৎ’ ঘটনার পিছনেও অপরাপর কারণ দেখা যেতে পারে।

কোরান মানুষকে সহজভাবে মুমিন, কাফির ও মুনাফিক হিসেবে দেখে। এর প্রত্যেক শ্রেণীতে এক ধরণের মানসিক স্বভাব ও প্রবণতা থাকে। এদের মধ্যে মুনাফিকই কোরানের দৃষ্টিতে সবচেয়ে মন্দ, তাই এই শ্রেণী নিয়ে দু/চারটি কথা সামনে আনি। মুনাফিক খুবই সতর্ক প্রাণী। বিশ্বাসীদের যাত্রা পথে এরা এক চরম অন্তরায়। মুনাফিক মুসলিম সমাজের ও পরিবারের ও গোত্রের মধ্যেই থাকে। কিন্তু কোরান তাকে কাফিরের চেয়েও হীন স্থানে দেখে। এরা কখনো বিশ্বাসের সমাজ ব্যবস্থাকে (দ্বীনকে) পরিপূর্ণরূপে ও বিজয়ীরূপে দেখতে চায় না। ইসলামের পরিপূর্ণতা (কামালিয়াত) তাদের দৃষ্টির বাইরে। ইসলাম মাতৃভূমির ভালবাসা অস্বীকার করে না বটে তবে নির্দিষ্ট এলাকাকে দেব-দেবীতে (deification) রূপান্তরিত করার বিপক্ষে অর্থাৎ ভূমির উপাসনায় নেই (কথাটি homage অর্থে)। মুনাফিক টেরিটরিয়াল। আব্দুল্লাহ বিন উবাই মদিনার সমস্যার সমাধান করে নেতৃত্ব দেখাতে পারেনি কিন্তু নবী (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করেন, এই জনপদের নেতা হন, তাদের মধ্যকার সুদীর্ঘ কালের সমস্যাদির সমাধান দেন, আওস ও খাজরাজের যুদ্ধাংদেহি অবস্থানের অবসান ঘটান তখন আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা বুঝতে পারে যে দ্বীন এখানে, তাদের এই ‘মাটিতে’ প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই দ্বীনে শিক্ষা, সমাজ, বিচার, ব্যক্তি ও সামাজিক আধ্যাত্মিকতা, ব্যক্তি ও সমাজের নিয়ন্ত্রণ -সবই এই দ্বীনের আওতাভুক্ত: কিছুতেই গাইরুল্লাহর (আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর) স্থান নেই; এই সমাজের মানুষকে আলাদা আনুগত্যে আনার স্থান নেই। তাই মক্কাবাসীদের (মুহাজিরদেরকে) প্রতি তাদের বিরূপভাব জাগ্রত হয় এবং আব্দুল্লাহ এক সময়, সুযোগ-মত, মুজাহিরদের ‘তাড়িয়ে’ দিতে বলেছিল, যাতে নেতৃত্ব তাদের অধিকারভুক্ত হয় এবং ক্ষমতা তাদের অনুকূলে আসে। তবে আমার পাঠমতে কিছু মুনাফিক আবার সঠিক ধর্মে ফিরার সম্ভাবনা রাখে বলে অনুভূত হয়, কিন্তু কিছু মুনাফিকের ফিরার পথ রুদ্ধ। এগুলো পূর্ব সিদ্ধান্তকৃত -আসা ও না আসা। মদিনায় মুমিনগণ মুনাফিকদের কাজে কর্মে এবং কাফিরদের সংশ্লিষ্টতায় চিনতেন। বাস্তবতা যে কথাটি বলে যায় সেই কথা ‘মুখের কথা দিয়ে’ ঘুচিয়ে দেয়া যায় না। একজন মাফিয়ার লোক মাফিয়াদের সাথেই আছে, মাফিয়ার পক্ষে কথাবার্তা বলছে আবার প্রয়োজনে সে মাফিয়া নয় এমন দাবীও করছে -এমন বাস্তবতা চিরদিনই দেখা যায়। তবে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বাস্তবতা হল এই যে এখানে কেউ কাউকে মুমিনও বানাতে পারেনা আবার মুনাফিকও বানাতে পারে না। বাস্তবতা সে যা তা’ই বানিয়ে যায়, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে কিছু যায় আসে না।

আল্লাহ কাকে কোন্‌ প্রকৃতিতে সৃষ্টি করেন –তার কোনো জবাব কারো কাছে নেই। তিনি যা ইচ্ছে তাই সৃষ্টি করেন, এটাই হচ্ছে ‘সার্বভৌম’ সত্তার এক বৈশিষ্ট্য। তাঁকে কেউ কারণ জিজ্ঞেস করতে পারবে না, তাঁকে কারো কাছে জবাব দিতে হবে না। আমাদের মঙ্গল কেবল তার আনুগত্যেই নিহিত। এখানে আর কোনো কথা নেই। এই আনুগত্যের অবস্থান থেকেই আমরা আমাদের ভাষার হাতিয়ার, যুক্তির হাতিয়ার খুঁজতে পারি। এখানের প্রাচুর্যপূর্ণ ‘অর্থ’ চরম অর্থ।

মানুষের এই বিশাল সমুদ্র এক বৈচিত্র্যময় বাস্তবতা। এখানে কে কী হয় –আস্তিক, নাস্তিক, কাফির না মুনাফিক, তার এক বিরাট অংশ ব্যক্তির নিজ অধিকারে বা নিয়ন্ত্রণে নয়। এই কথাটি এক ‘অবোধগম্য’ ধারণা ও অর্থ বহন করে। চিন্তার উদ্রেক করে। তাই আমরা যে যেখানে যে পরিসরে থাকি সেখান থেকে আল্লাহকে স্মরণ করা ছাড়া মুক্তির কোনো পথ নেই। উপরের অঙ্কনের একেকটি লাইন নানা পথ অতিক্রম করে যেখানে গিয়ে অস্তিত্বের-ফুল হয়ে বেরিয়ে এসেছে সেই স্থানের আশে-পাশে আরও কিছু সম্ভাবনাময় লাইন অঙ্কন করেছি। এটা এই অর্থ দেখেতে যে তার যাত্রা এখনো শেষ হয় নি, তার তকদিরে কী আছে সে এখনো তা জানে না। তার তকদির আল্লাহর হাতে। সে যদি আস্তিক হয় তবে এতে নিজের কৃতিত্ব ভাবার কিছু নেই। এটা আল্লাহর এক নেয়ামত। তিনি তা যাকে ইচ্ছে তাকে দান করেন। আর শেষ পরিণতিই হচ্ছে বড় পরিণতি। জন্মের সময় থেকে মৃত্যুর সময় পর্যন্ত লাইনের দুই প্রান্ত একত্র করলে যে রিং (খাতম) তৈরি হয়, সেই খাতমের শেষাংশটি যদি আল্লাহর আনুগত্য ও ইমানের উপর হয় তবেই সার্থকতা।

একজন দোজখি লোক হয়ত জীবনের শেষভাগে এসে বেহেস্তের কাজ শুরু করে দিতে পারে আর এতেই সে বেহেস্তবাসীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারে। আবার আপাতদৃষ্টে বেহেস্তি লোক জীবনের শেষভাগে এসে দোজখি কাজ শুরু করে দিতে পারে এবং দোজখের বাসিন্দা হইয়ে যেতে পারে। এগুলো পূর্ব-নির্ধারিত। যে তকদীরে বিশ্বাস করতে পারে না, সে মুমিন হতে পারে নি।

কোনো আস্তিক, নাস্তিক, মুনাফিক ও কাফিরের বাস্তবতা ঝর্ণার পানির মত আগামীতে কোন ধারায় ছুটবে –তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জ্ঞাত নন। তিনি কার ধারা কোন দিকে ফিরিয়ে নেন সেটা বলার শক্তি কারো নেই। এই মহান সার্বভৌম সত্তার কাজ ও ইচ্ছা নিয়ে যতই চিন্তা করা হবে, ততই তার প্রতি ভীতি ও আশা এবং একই সাথে তার প্রতি ‘আনুগত্যের’ মাত্রা বাড়তে থাকবে। এই চলার পথে ‘বুদ্ধি’ বড় বিষয় নয়, যুক্তি বড় বিষয় নয়, সমঝও তেমন বড় কিছু নয়। আনুগত্যের স্পৃহাই বড়। যাকে এই স্পৃহা দেয়া হয়েছে তার জন্য এক মহিমাময় পথ খুলে দেয়া হয়েছে।

আমি এখানে যে মর্মের কিছু কথা বলেছি ঠিক সেই একই মর্মের কিছু অতি মূল্যবান কথা এই ভিডিওতে এসেছে। যারা ভিডিওটি দেখেননি তাদেরকে তা দেখতে অনুরুধ করব। ভিডিও দেখতে এখানে ক্লিক করুন।

About এম_আহমদ

প্রাবন্ধিক, গবেষক (সমাজ বিজ্ঞান), ভাষাতত্ত্ব, ধর্ম, দর্শন ও ইতিহাসের পাঠক।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *