বিবর্তন আসলে পৃথিবীর প্রতিটি সৃষ্টির মাঝে বিদ্যমান এবং সে প্রক্রিয়া চলে আসছে প্রকৃতির সৃষ্টির শুরু থেকে । বিবর্তন বিদ্যমান অণু-পরমাণুতে যা অবিশ্বাস করার উপায় নাই জ্ঞানীদের পক্ষে। এমন কি ভাইরাসের মাঝেও বিবর্তন হয় যেমন আজকাল চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন,করোনা ভাইরাসটি মানুষের দেহকোষের ভেতরে ইতোমধ্যেই “মিউটেট করছে” অর্থাৎ গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিচ্ছে !
নীতিগতভাবে ইসলাম বিবর্তনকে অস্বীকার করেননা এবং বিবর্তনের সাথে কোন সংঘর্ষ নাই ।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বিবর্তনের পদ্ধতি বা বিষয়টাকে বিশেষ মহলের পক্ষ থেকে যে ব্যাখ্যা দেয়া হয় বিশেষ করে চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের ধারণা বা সে থিওরির ভিত্তি পুঁজি করে নাস্তিকরা মানুষকে যা বিশ্বাস করাতে চায় সে বিষয়ে আপত্তি আছে ইসলামে । যদিও নাস্তিকরা তাদের যুক্তিকে ” বৈজ্ঞানিক সত্য ” বলে যেভাবে প্রচার করতে চায় তার বিপরীতে অনেক সত্যিকার বিজ্ঞান ও বিবেক সম্মত যুক্তি আছে যা তাদের কথাকে মিথ্যা প্রমাণ করে।
আধুনিক নাস্তিকতাবাদের অন্যতম গুরু রিচার্ড ডাওকিন্স – “দ্য গড ডিলিউশন” গ্রন্থের লেখক এর আপত্তি হল ধর্মই হচ্ছে সকল সমস্যার মূল । “ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষকে স্বাধীন চিন্তায় নিরুৎসাহিত করে বা বিরত রাখে এটি বিভেদ সৃষ্টিকারী এবং ভয়ঙ্কর ।”
কিন্তু তাকে যখন বলা হয় হিটলার,পলপট, মাওসেতুং কিংবা লেলিন,ষ্টেলিন এরা সবাই তো নাস্তিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন তাহলে তারা কেন এত মানুষ হত্যা করল? পৃথিবীর দুটি বৃহৎ যুদ্ধ হল যাতে শত শত মানুষ মরল সেগুলো কি ধর্মের কারণে হয়েছিল? সেখানে কেন এত মানুষ হত্যা করা হল? তখন তারা বলে ঐ লোগুলো নাস্তিক হলেও এরা নাস্তিকদের মধ্যে ব্যতিক্রম এবং এদের কাজগুলো কয়েকটি বিক্ষিপ্ত উদাহরণ যার সাথে মূলধারার নাস্তিকের কোন সম্পর্ক নাই। কিন্তু আমরা যখন বলি ধর্মীয় জঙ্গিবাদও আমাদের মূল ধারার ইসলাম বা ধর্মে নাই তাহলে এখানে সেটাকে ধর্মের দুষ কেন বলা হচ্ছে? সে প্রশ্নের উত্তরে তারা নিরব থাকে!
রিচার্ড ডাওকিন্স -“দ্য গড ডিলিউশন” বইটি পড়লে বুঝার কথা যে লেখক এক সময় ক্রিষ্টান ধর্মের ক্যথলিক ঘরানার মানুষ হয়েও কেন তিনি ধর্ম ত্যাগ করে নাস্তিক হয়েছেন। সে ধর্মের পাদ্রী ও যাজকদের বিভিন্ন কূকর্ম, কিশোর বালকদের সাথে যৌন অপরাধ ও সংকীর্ণ চিন্তাধারা, কুসংস্কার, ধর্মের নামে কুযুক্তিক,কাল্পনিক পুরাকথা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার ধর্মীয় পদ্ধতি ও ধর্ম ব্যবসায় বিক্ষুব্ধ হওয়টা যে রিচার্ড ডকিন্সের “দ্য গড ডিলিউশন” বইটি লিখার অন্যতম কারন তা বুঝা যায়।
তবে তার বইয়ে ইসলাম সম্পর্কে বিশেষ কোন কিছুর উল্লেখ না থাকলেও পরবর্তী কালে সে বইয়ের উপর একটি ভিডিও উপস্থাপনায় ইসলামকেও আক্রমন করতে ছাড়েন নাই যখন দেখেছেন তথাকথিত ইসলামের নামে আত্মঘাতী বোমা হামলা ও জঙ্গিবাদের উত্তান ঘটতে। ইসলামের ব্যাপারে তার সমালোচনা মূলত মুসলিম নামধারী সন্ত্রাসীদের কর্মকান্ড থেকেই এসেছে বলা যায়। তবে তিনি খোলা মনে নির্মোহভাবে ইসলামকে অধ্যয়ন করার সুযোগ ও সৌভাগ্য যে পাননি বা তার কপালে জুটেনি তা শতভাগ সত্য।
রিচার্ড ডাওকিন্সের দাবী বিজ্ঞান ও ধর্ম এক সাথে পাশাপাশি থাকতে পারে না। তিনি বলেন, Quote “বিজ্ঞানের কাজ হচ্ছে একটি ধারণা বা অনুমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সেটিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মাধ্যমে যাচাই করা তথা তার ভুল বা সত্যকে বহির করা। তাই বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকেন প্রশ্ন করতে ও তার জবাব বা সমাধান খুঁজতে গবেষনায় । আর ধর্ম হল তার পুরো বিপরীত। ধর্মের কাজ হচ্ছে জ্ঞান ও critical thinking তথা সমালোচনার চিন্তাকে স্থগিত করন বা বিসর্জন”!
সন্দেহ নাই আপাত দৃষ্টিতে ধর্মীয় কুসংস্কারের প্রেক্ষিতে তার কথাগুলা খুবই সুন্দর শোনায় বিশেষ করে ভিডিওটি উচ্চমানের গ্রাফিক ও ব্যকগ্রাউন্ড মিউজিক মিশ্রিত পরিবেশনায়।
তবে নাস্তিকদের কাছে যে ব্যক্তির মতবাদ বা থিওরি সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব রাখে এবং তাদের বিশ্বাসের জীবনী শক্তি হিসাবে কাজ করে তিনি হচ্ছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন। যিনি বিবর্তনবাদের তত্ত্ব দেন। অন দ্য অরিজিন অফ স্পেশিস নামে চার্লস ডারউইনের বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৫৯ সালে। তার এই তত্ত্বে দেখানো হয়েছে প্রাণীরা সময়ের সাথে সাথে প্রাকৃতিক নিয়মে ধীরে ধীরে কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। তার এই প্রক্রিয়াকে ইংরেজিতে বলা হয় ন্যাচারাল সিলেকশন বা প্রাকৃতিক নির্বাচন যার মাধ্যমে একটি প্রাণীর জনগোষ্ঠী থেকে নতুন প্রজাতির উদয় ঘটে। তিনি বিবর্তনবাদকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছেন,এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে কোনো প্রাণী ক্রমাগত অভিযোজনের ফলে আপন পরিবেশের জন্যে বিশেষায়িত হতে হতে এক সময় নতুন একটি প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে গত বছরঅর্থাৎ ২০১৯ সালের মার্চ মাসে দুই তারিখ বিবিসির এক প্রতিবেদনে দেখা যায় ডারউইনের প্রায় ১০০০ বছর আগে বিবর্তনবাদের তত্ত্ব দিয়েছিলেন এক মুসলিম দার্শনিক যার নাম ছিল আল-জাহিজ। (নিবন্ধটি এখানে) যাক সে অন্য প্রসঙ্গ।
রিচার্ড ডাওকিন্সের অভিযুগ সকল ধর্ম, মুক্ত চিন্তায় বাধা দেয়। তবে সে প্রসঙ্গে কুরআনে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। কুরআন মানুষকে চিন্তা করতে উৎসাহিত করছে বার বার। সেখানে দেখা যায় আল্লাহ বিভিন্ন চিন্তাসূচক শব্দের মাধ্যমে আমাদের চিন্তার ধারাকে শানিত করে উপলব্ধির জন্য আহবান জানাচ্ছেন। যে আরবী শব্দগুলো ব্যবহার হয়েছে তা সেটি প্রমান করে যেমন, সমস্ত কুরআন জুড়েই শত শত আয়াতের শেষেই দেখতে পাবেন তা’কিলুন, তাযাক্কারুন, তাফাক্কারুন, তাদাব্বুরুন শব্দগুলো…প্রায় প্রত্যেক বড় বড় সূরাতেই আছে। তাদাব্বুর করা মানে সর্বোচ্চ লেভেলের চিন্তা-গবেষণা করা যা মানুষকে প্রজ্ঞার কাছে নিয়ে যায়। that makes an person really wise with humbleness.
নাস্তিকদের মাইন্ড সেট হচ্ছে স্রষ্টাকে উপলব্ধি করতে বা তাকে খুঁজতে চিন্তা গবেষণাকে মুক্ত চিন্তা বলা যায় না। তাদের কাছে মুক্ত চিন্তা হচ্ছে স্রষ্টাকে অবিশ্বাস করতে যত সম্ভব যুক্তি চিন্তা ভাবনা করাটাই হচ্ছে মুক্তচিন্তার প্রতীক।
এখন দেখা যাক স্রষ্টাকে জানতে বিজ্ঞানের যুক্তি কি হতে পারে?
বিজ্ঞানের সংজ্ঞা কি?
বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য,পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য, তার সুশৃঙ্খল, নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা ও সেই গবেষণালব্ধ জ্ঞানভাণ্ডারের নাম বিজ্ঞান। অন্য কথায় প্রাকৃতিক বিশ্বের কাঠামো এবং আচরণের পদ্ধতিগত অধ্যয়ন,পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান।
বিজ্ঞানের ক্ষেত্র মূলত দুটি: সামাজিক বিজ্ঞান এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞান। জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নসহ এ ধরনের সকল বিজ্ঞান প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে মানুষের আচার-ব্যবহার এবং সমাজ নিয়ে যে বিজ্ঞান তা সমাজ বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। তবে যে ধরনেরই হোক,বিজ্ঞানের আওতায় পড়তে হলে উক্ত জ্ঞানটিকে সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণিত হতে হবে।
… চলবে ২য় পর্বে
বি:দ্র:
এ বিষয়ে একটি ভিডিও উপাস্থাপনা আছে চাইলে শুনতে পাবেন এখানে।