বিপন্ন রোহিঙ্গা বিপন্ন মানবতা

শতাব্দীর নৃশংসতম, নিষ্ঠুর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাহিনী শুনতে হচ্ছে নির্যাতিত আরাকানি নারী-পুরুষের কণ্ঠ থেকে। সু চির নীরব ভূমিকায় মিয়ানমারে উগ্র সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সহযোগিতায় বর্মী বাহিনী গলা কেটে, জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করছে নিরপরাধ রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের। তাদের অপরাধ তারা রোহিঙ্গা মায়ের সন্তান, তারা নাকি বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলমান তাই নাকি তারা অপরাধী, সন্ত্রাসী এবং কঠিন শাস্তির যোগ্য। তাদের প্রাপ্য শাস্তিই তাদের দেয়া হচ্ছে বলে নোবেল বিজয়ী ‘মহান’ নেত্রী সবাইকে আশ্বস্ত করছেন! শত শত রোহিঙ্গা নারীর সম্ভ্রমহানির অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছেন Doctors Across the Border সংগঠনের কর্মীরা। ফোরটিফাই রাইটসের প্রতিষ্ঠাতা ম্যাথিউ স্মিথ মনে করেন, মিয়ানমারের সেনারা নৃশংস অপরাধ করেছে এবং সু চির দেখানো পথে তদন্ত কমিশন তা লুকানো বা অস্বীকারের পথ অনুসরণ করেছেও। তারা লজ্জাজনক প্রচারণা কৌশল গ্রহণ করেছেন!

সু চি ও সামরিক জান্তার কূট যুক্তি

০১. রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাঙালি, তারা বহিরাগত এবং মূলত বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অধিবাসী।

০২. এই জনগোষ্ঠী সন্ত্রাসী তাদের শায়েস্তা করা আমাদের আইনগত অধিকার ও কর্তব্য।

০৩. রোহিঙ্গা নির্যাতন বা সন্ত্রাস দমন কার্যক্রম এ দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

‘অবৈধ বসবাসকারী বাঙালি’ যুক্তিটি অসার। কারণ রোহিঙ্গাদের বড় এক অংশ বাঙালি বংশোদ্ভূত হলেও তারা আরাকানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে কয়েক শ’ বছর আগেই। এমনকি এদের ভেতর যারা আরব ও পারস্য বংশোদ্ভূত, তারা নবম শতকের আগেই আরাকানে বসতি স্থাপন করে। অনেকে বাঙালি বংশোদ্ভূত হলেও তারা কোনো ক্রমেই বাংলাদেশের নাগরিক নয়। আজকের আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসীরা একই ইংরেজি ভাষায় কথা বলে, তাদের পূর্বপুরুষ ইংল্যান্ডের অধিবাসী বলে তারা কি আমেরিকার নাগরিক নয়? ভারতীয় অঞ্চলে যারা ‘নাগা’, তারাই আবার ‘কাচিন’ নামে পরিচিত মিয়ানমারে। ইতিহাসের ‘মগ’ জনগোষ্ঠী আরাকানে ‘রাখাইন’ এবং বাংলাদেশে ‘মারমা’ নামে পরিচিত। কাজেই বাঙালি বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে রোহিঙ্গারা আরাকানের বৈধ নাগরিক নয়, এমন বক্তব্য অসার বৈ কি।
এখন আসি সু চির ‘সন্ত্রাস’ দমন যুক্তিতে। কিছু দিন আগে ভারতের সেনা চৌকিতে সশস্ত্র হামলায় কিছু ভারতীয় সেনা নিহত হন। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারত সরকার সন্ত্রাস দমনের নামে ওই এলাকার সব মুসলমানকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের হত্যা, অগ্নিসংযোগ শুরু করেছিল! বাংলাদেশে শান্তিচুক্তির আগে চাকমা সশস্ত্রবাহিনীর চোরাগোপ্তা হামলায় অনেক বাঙালি জওয়ান নিহত হয়েছেন। এই ‘সন্ত্রাসী’ কাজের জবাবে, চাকমা জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশ কি কখনো নির্বিচার হত্যা, অগ্নিসংযোগ করে তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল? অপরাধী যেই হোক, নিরাপত্তা বাহিনীর উচিত তাদের খুঁজে বের করা এবং কেবল তাদের বিরুদ্ধেই আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া, গোটা জাতির বিরুদ্ধে নয়। মিয়ানমারে কারেনসহ অন্যান্য সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপ দুর্বল রোহিঙ্গাদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। তাহলে কোন প্রমাণের ভিত্তিতে বিশ্বাস করব রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযোগকে? শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কেবল দুর্বলপক্ষের বিরুদ্ধে নেয়া হচ্ছে কেন, তারা বৌদ্ধ নয় বলে?

সু চির আরেক যুক্তি:

রোহিঙ্গা নির্যাতন বা খতমপ্রক্রিয়া তার দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ইহুদি হত্যাকাণ্ড ছিল যেমন হিটলারের জার্মানির কথিত অভ্যন্তরীণ বিষয়। ১৯৭১ সালে বাঙালি হত্যাকাণ্ড যেমন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু তার দেশের অত্যাচারিত জনগণ যখন জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত ও পাকিস্তানে আশ্রয় গ্রহণ করে যাতে এক অমানবিক উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হয়, তখন তা কি আর অভ্যন্তরীণ বিষয় থাকে?

সমাধান কোন পথে

০১, এইচ টি ইমাম, ইঞ্জিনিয়ার মোবাশ্বের হোসেন, প্রফেসর আমেনা মোহসিন প্রমুখ মনে করেন, কঠোর অবরোধ আরোপের মাধ্যমে মিয়ানমারের অত্যাচারী সরকারকে সংযত করা যায়।

০২. অর্থনৈতিক অবরোধ কার্যকর না হলে, আরাকানে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর পক্ষে মত দিলেন জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ মোমেন। এ জন্য কসোভোর বিষয়ে গৃহীত ব্যবস্থাও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিবেচনায় আনতে পারে বলে এই বিশেষজ্ঞের অভিমত।

কবিগুরুর ভাষায়:
নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে
বিষাক্ত নিঃশ্বাস,
শান্তির ললিত বাণী
শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।
লেখক : মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, বিএসএমএমইউ

পূর্ব প্রকাশিত: নয়া দিগন্ত

Comments are closed.