বিজেপি চোখে মুসলমানরা

(ডিসক্লেমারঃ এই পোস্টের বিষয় বস্তু এবং তথ্য সাংবাদিক ও গবেষক আলতাফ পারভেজের সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রন্থ ‘মউত কা সওদাগর’ থেকে উদ্ধৃত।বইটি প্রকাশ করেছে ঢাকার তরফদার প্রকাশনী)

আসন্ন ৩১ মে ভারতের লোকসভা মেয়াদ শেষ হবে।বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক এই নির্বাচন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা বাংলাদেশ এবং সেখানকার মুসলমানদের বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য বটে।আর সেই নির্বাচন পূর্ব বেসরকারি ইঙ্গিত দিচ্ছে ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন ভারতীয় জনতা পার্টি আলোচিত সমালোচিত চরিত্র নরেন্দ্র দমোদর দাস মোদী।যদিও মোদীকে নিয়ে রয়েছে নিজ দেশ বিদেশ তীব্র বিতর্ক।গুজরাট রাজ্যে মোদীর শাসনতান্ত্রিক সফলতা এল কে আদভানি মত সিনিয়র নেতাকে ডিঙ্গিয়ে কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রীত্বে তার দাবিকে শক্তি যুগিয়েছে।আর এই প্রধানমন্ত্রীত্ব  দাবিকে শক্তি যুগিয়েছে বিজেপি আদর্শিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক যাকে আরএসএস নামে চিহ্নিত।অভিযোগ রয়েছে ২০০২ শালে গুজরাট রাজ্যে মুসলমানদের উপর গণহত্যা চালিয়ে আরএসএস কাছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেন।এবং সেই সাথে কথিত গুজরাটের অর্থনীতিক সাফল্য  প্রধানমন্ত্রীত্ব দাবিকে শক্ত ভিত্তি উপর দাঁড় করিয়ে দেয়।আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের মোদীর উত্থান দক্ষিণ এশিয়া হিন্দুত্ববাদের অগ্রযাত্রা এবং মুসলমান কি পরিণতি বয়ে আনতে পারে সেটা দেখার অপেক্ষার পালা।

বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদের আলোকে মুসলমানদের অবস্থান

গত একটি পোস্টে “ভারতে মুসলমানদের অবস্থা” শিরোনামে ভারতের  মুসলমানদের বহুমুখী দুরবস্থা সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল।আর সেটাকে ভারতের দুই তিন প্রদেশের সাধারণ  প্রশাসনিক বঞ্চনা বা শাসন সংকট কিংবা ধর্মীয় বৈষম্য হিসেবে দেখার সুযোগ নেই সেটা উল্লেখ করা হয়েছে। বাস্তবে সেখানে মুসলমানদের প্রতি আর্থ-সামাজিক বঞ্চনার গভীরতর দার্শনিক, ধর্মীয় তথা মতাদর্শিক ভিত্তি তৈরি করা হয়েছে এবং লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এসব উপর ভর করে রাজনৈতিক সফলতা পাচ্ছে বিভিন্ন দল।বলাবাহুল্য,বিজেপি এ ক্ষেত্রে সবার চেয়ে এগিয়ে  এবং মোদীর উত্থান তার চমকপ্রদ এক প্রকাশ।কেবল মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা বিদ্বেষ প্রকাশ এবং প্রসার এবং সংকীর্ণ  এক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মাদনাকে পুঁজি করে সর্বভারতীয় অর্থে বিজেপি এখন ভারতের সবচেয়ে বড় দল। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি সচেতন প্রিয় মানুষ মাত্রই জানে,এই দলের আদর্শ হিন্দু জাতীয়তাবাদ।আর এই  হিন্দু  জাতীয়তাবাদের দার্শনিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি হিসেবে নিম্নোক্ত লেখাটি রয়েছে বিজেপি ওয়েব সাইটে: Hindutva The Great National Ideology[১]

আজকের ভারতকে বোঝার এই মৌলিক লেখাটি হলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক মাধ্যম যাকে অনেকটা বিজেপি অফিসিয়াল ভাষ্য বলা হয়।এতে পুরো ভারতের শাসক শ্রেণীর চিন্তার মুল খুঁজে পাওয়া সম্ভব।এই লেখাটি আমরা সমকালীন ভারতের মুসলমানদের প্রতি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আচরণের মৌলিক ভিত্তির বোঝার চেষ্টা করতে পারি।দুই হাজার তিনশত আশি শব্দের  উপরোক্ত লেখায় বিজেপি নিমোক্ত অনুসিদ্ধান্ত সমূহ হাজির করেছে।

(ক) ভারতের মুসলমানরা হলো আগ্রাসী শক্তি; ভারত হলো হিন্দু দেশ।বিজেপি ভারতকে ‘হিন্দুস্থান’ নামে অভিহিত করতেই অধিক আগ্রহী।এই ‘হিন্দুস্থানের’ সীমানা বিজেপি মনে করে আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত।এই পুরো ভূখণ্ডে মুসলমানরা হলো বিজেপি কাছে invader যেহেতু মুসলমানরা হলো বিদেশি আগ্রাসী শক্তি -সেকারণে স্বাধীন ‘হিন্দুস্থান’ ঐ আগ্রাসী শক্তির কোন সাংস্কৃতিক চিহ্ন থাকতে পারে না।ইসলামের সাংস্কৃতিক চিহ্ন এখানে আগ্রাসী শক্তির ‘বিদেশির ধ্যান-ধারনা’ কাজেই এটা উপড়ে  ফেলতে হবে।এখানে প্রার্থনা স্থল থাকবে কেবল মন্দির; ধর্ম গ্রন্থ থাকবে কেবল গীতা ও বেদ;সাহিত্য কেবল রামায়ণ ও মহাভারত ;এখানে (স্বাধীন ‘হিন্দুস্থানের’)উপাসনা যোগ্য ব্যক্তি হবেন রাম,কৃষ্ণ,শকরাচারয,তুলিদাস,স্বামী বিবেকনন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। এসব হবে বিজেপি মতে ভারতের বাসিন্দাদের ” guiding principle”

(খ) বিজেপি  মনে করে জার্মানিতে যেভাবে ইহুদিদের ওপর নির্যাতন নিপীড়ন চালানো হয়েছে অতীতে  ভারতে হিন্দুদের ওপর মুসলমান সেভাবে নিপীড়ন চালিয়েছিল।তারা হিন্দুদের জোর করে ধর্মান্তরকরণ করেছে।মুসলমানরা এবং তাদের ধর্মীয় স্থাপনা হলো আগ্রাসনের ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক।এখন যেহেতু দেশ স্বাধীন হয়েছে সেহেতু নিপীড়কদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার সময় হয়েছে। ভারতীয়দের জন্য এগুলো হলো Marks of curel slavery. সুতরাং এগুলো গুড়িয়ে দিয়ে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে হবে। যাকে বিজেপি বলেছে ‘হিন্দু জাগৃতি’ তথা mental freedom।ঐ হিন্দু জাগৃতির আলোকে বিজেপি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দার্শনিক ব্যাখ্যা করে উল্লিখিত লেখায় স্পষ্ট বলেছে: “the freedom (of india) could have been achieved if a temple to Rama was built and the symbol of foreing rule was moved to another site or domlished.the battle was never really for another temple Another temple could heve been built anywhere in india . the humble and fair demand for Rama janmabhoomi could have result in a freedom from the intellcetual slavery that so dominated india.this freedom would have meant that all indians regardless of religion, language, caste, sex, or color would openly show respect for the preson that from ancient times was considered the greatest hero to people of hindustan..the destruction of the relesae of the history that indians had not fully come term with.Thousand of year of anger and shame, so diligently bottled up by these same interest ,was released when the first piece of the so called Babri masjid was torn down .it is a fundamental concept of hindu Dharam that has on:righteoness”

অর্থাৎ একে (অযোধ্যার মসজিদকে) বিদেশী উপনিবেশিক শাসকদের প্রতীক  হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং তা অন্যত্র সরানো বা ধ্বংস সাধন করে সেখানে রাম নামে একটি মন্দির নির্মাণ মাধ্যমেই কেবল ভারতের তার স্বাধীনতা হাসিল করতে পারতো।এই সংঘাত কেবল আরেকটি মন্দির নির্মাণে চেষ্টা হিসেবে ভাবনা হলো ভাবনাটা ভুল। ভারতের অন্যত্র যেকোন স্থানে আরেকটি মন্দির নির্মাণ করা যেত।কিন্তু তার সাথে ভারতের স্বাধীনতা প্রশ্ন এত ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল না -যেমনটি ছিল রাম জন্মভূমির সাথে।এই ন্যায দাবি সাথে জড়িয়ে ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব থেকে মুক্তির প্রশ্ন। যে বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব খবরদারিত্বে ভুগছ ভারতে দীর্ঘদিন। প্রাচীনকাল থেকে হিন্দুস্থানে নবস্য হলেন রাম।অযোধ্যার সংঘাত বিজয়ের মধ্যদিয়ে ভারত যদি স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে তা প্রমানিত হতো ধর্ম -বর্ণ ভাষা- লিঙ্গ ভেদে তাদের সর্বোত্তম নমস্যকে প্রকাশ্যে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে, বা জানাতে পারছে।তার মানে অযোধ্যার অবকাঠামো (মসজিদ) গুড়িয়ে দেয়ার মানে ছিল অবদমিত ইতিহাসের মুক্তি ।যে অবদমিত ইতিহাস ভারতের সাথে মানানসই ছিল না।এই ইতিহাস হলো হাজার বছরের ক্ষোভ পুঞ্জিভূত লজ্জার ইতিহাস ।তথাকথিত বাবরি মসজিদের প্রথম ইটটি খসে পড়ার সাথে সাথে সেই ইতিহাসের স্বতঃস্ফুত অবমুক্তি ঘটে গেছে।এর  মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্মের সেই ধারনাটির বিজয় হলো, আমি সঠিক।

উপরোক্ত বয়ানে বিজেপি ভারতের ইসরাইল রাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত অনুসরণ মাধ্যমে সৃষ্ট সাফল্যের কথা উল্লেখ করে বলেছে, ভারতের হিন্দুত্বের আদর্শ ইসরাইল রাষ্ট্রের নীতি অনুসরণ করেছে এবং ঐ দেশটির সফলতা এখানে কায়েম করতে পেরেছে; অর্থাৎ ইসরাইল যেভাবে আরব বিপক্ষে স্থায়ী নিষ্ঠুরতা নীতির মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য সদম্ভ অবস্থান বজায় রাখছে বিজেপি মনে করে ভারতেকেও তারা সেভাবে মুসলমানদের বিপক্ষে গড়ে তোলার মাধ্যমে সফলতা পেয়েছে।

উপরোক্ত দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বিজেপি এখন প্রায় পুরো ভারতের প্রধান প্রধান ঐতিহাসিক মসজিদ উচ্ছেদ দাবি জানাচ্ছে।তাদের কাছে এটা স্বাধীনতা’কে  অর্থবহ করার ব্যাপারে;’সেক্যুলারিজম’কায়েম করার ব্যাপার।বিজেপি মনে করে ‘সেক্যুলারিজম’ মানে বহুত্ববাদি সংস্কৃতি নামে আপোষ নয় – বরং ‘সেক্যুলারিজমের’ সঠিক অর্থ  হতে হবে হিন্দু সংস্কৃতি সঙ্গে অন্যান্য সকল সংস্কৃতির তরফ থেকে আপোষ।বিজেপি কাছে ‘হিন্দুত্ববাদ’ই’ হলো সেক্যুলারিজম।এটা একই একই সঙ্গে একটা নতুন বিশে ব্যবস্থা বটে ( A new world order)

সেক্যুলারিজেমের উপরোক্ত ব্যাখ্যার আলোকে বিজেপি মনে করে হিন্দুরা হলো সহনশীলতা প্রতীক।প্রচুর নিপীড়নের পরও তারা সহনশীলতা পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে।অন্যদিকে, মুসলমানরা কখনোই তাদের মনোভাব পরিবর্তন করেনি।জন্মগত ভাবেই তারা পরিবর্তেনে অক্ষম সুতরাং হিন্দুস্থানে সেক্যুলারিজেমের বিপদ আসছে মুলত মুসলমানদের উপস্থিতির মধ্যদিয়ে।মুসলমানদের কারণেই ভারতেই ভেঙেছে।তারা ভারত ভাঙ্গার জন্য দায়ী। পাকিস্থান  সৃষ্টির পর সেখানে মুসলমানরা হিন্দুদের ওপর অত্যাচার নিপীড়ন করলেও ভারতের হিন্দুরা মুসলমানদের ওপরটা করেনি।হিন্দুরা তাদের সেক্যুয়ালারিজমের আদর্শই অনুসরণ করেছে!

বলাবাহুল্য এরূপ ‘সেক্যুলারিজম’ ভারতের মুসলমানদের উপহার দিয়েছে বঞ্চনাদগ্ধ এক জীবন। কেবল নিপীড়ন বা হত্যার হুমকি নয়-মানসিকভাবেও সার্বক্ষণিক পীড়নের মধ্য রাখা হয় তাদের।আরএসএস ,বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের অন্যান্য সংগঠনের তরফ থেকে প্রতিনিয়ত মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ানো,মুসলমানদের কটাক্ষ করা,সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে রাজনৈতিক প্রচারণা বিজেপি হামেশা এমন একটি পোস্টার ছাপে যেখানে মোদীর ছবি ও পাকিস্তানের মানচিত্র দিয়ে ভোটার কাছে প্রশ্ন রাখা হয় ‘আসন্ন নির্বাচনে আপনি কাকে ভোট দিবেন?’ আবার নির্বাচনী জনসভায় হিন্দুদের আমোদিত করার জন্য মুসলমানদের নিয়ে অপমানকর কটাক্ষ করা হয়। যেমন গুজরাট দাঙ্গার পর সেখানে হাজার হাজাত মুসলমান ঠাই হয় রিলিফ ক্যাম্প বা লঙ্গর খানায়ে। মোদি এক পর্যায়ে এসব লঙ্গর খানার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে থাকেন এভাবে যে,”এগুলো প্রজন্নকেন্দ্র ছাড়া আর কিছু নয়”

মোদীর এসব বক্তব্য এবং গুজরাট মুসলমান নিধন সমগ্র ভারতের হিন্দু সমাজে তার ভাবমূর্তি অনেক উজ্জল করেছে। এসময় গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ বলতে থাকেন ” He(Nerendra modi) has salvaged the party’s credibilty and honour in way no one has done afther we came to power in the center”[2]

মোদীর প্রশংসার পাশাপাশি এসময় মুসলমানদের প্রতি সমানভাবে হুমকি ও কটাক্ষ বর্ষণ চলছিল এবং চলছে।গুজরাট গণহত্যার পরই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভাপতি অশোক সিংগাল বলেন ‘গুজরাট নিরীক্ষাটি সফল। ২০০২ সালের ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি আমরা ৫০ লাখ হিন্দুকে রাস্তায়ে নামাতে পেরেছিলাম।প্রয়োজনে এই মডেলের পরীক্ষা দেশের অন্যত্র চালানো হবে”[৩]।হিন্দু পরিষদের আন্তর্জাতিক সম্পাদক প্রবীণ ভাই তোগড়িয়া বলেন “এরুপ পরীক্ষা ভারতের বাইরেও করার আকাংকা ব্যক্ত করেছেন [৪]।

সূত্র ” [১] http://www.bjp.org/index.php?option=com_content&view=article&id=369:hindutva-the-great-nationalist-ideology&catid=92&Itemid=501?option=com_content&view=article&id=369:hindutva-the-great-nationalist-ideology&catid=92&Itemid=501
[২] A union minister from the BJP ,not identifid by name quoted in the telegraph, march 6, 2002.
[3] the indian Express, sept 4 2002.
[4] the times of india ,sept 15, 2002

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *