বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে!

মাতৃভূমির ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য প্রতিটি নাগরিককে বেদনা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না। এতে আনন্দের ঢেঁকুর তোলার কী আছে! কিন্তু না, অনেকে এর মধ্যেও আনন্দ খুঁজে পায়। এদেশের সচেতন নাগরিকদের স্মরণে থাকার কথা, ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত আমাদের দেশের একশ্রেণীর সুশীল, বুদ্ধিজীবী, কতিপয় মিডিয়া ও পত্রপত্রিকা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে ব্যর্থ সরকার আর বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র প্রমাণ করতে অনেকটা আদাজল খেয়ে নেমেছিল। তারই অংশ হিসেবে সে সময় বাংলাদেশ সফরে আসা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের আজগুবি গল্পের দলিল বস্তা তৈরি করে হাতে তুলে দেয়ার আত্মঘাতী কাজটি করেছিল আওয়ামী লীগ। এতে অবশ্য আওয়ামী লীগের দেশপ্রেমের ঘাটতি হয় না! কিন্তু বর্তমান সময়ে দেশে যখন গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত, তখন এই শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া, সুশীল সমাজকে দু-একটি বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে সরকারের সমালোচনায় সীমাবদ্ধ থাকতে দেখছি। অনেকেই আবার টুঁ শব্দটি পর্যন্তও করছে না। আমরা এখন আর কাউকে অকার্যকর রাষ্ট্রের জিগির তুলতে দেখছি না। তাহলে কেন এই বে-ইনসাফি? সমাজের নষ্ট রাজনীতি আমাদের বিবেককে এতটাই ইতর বানিয়ে ছাড়ল যে বিবেক, অন্যায়, অসত্য আর অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সামর্থ্য না থাকলে অন্তরের নীরব প্রতিবাদ আর ঘৃণাটুকুও অবশিষ্ট থাকে না। এ ঈমানের আবার মূল্য কোথায়। জালেম শাসকের সামনে সত্য কথা বলাই তো সর্বোত্তম জিহাদ। রাসুলের অমিয় বাণীগুলো আমরা এমনিই ভুলে গেছি।
গত ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ গণতন্ত্র নিয়ে যখন শঙ্কা আর আলোচনা-সমালোচনার ঝড় চলছে, বিশ্ব মিডিয়ায় বাংলাদেশ যখন সংবাদের শিরোনাম, তখন আমরা একটু মিলিয়ে দেখি বিশ্বের অন্যতম বুদ্ধিজীবীদের একজন নোয়াম চমস্কির ব্যর্থ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে বাংলাদেশকে নোয়াম চমস্কি বর্তমান বিশ্বে প্রথাবিরোধী ব্যতিক্রমী বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব। তার জ্ঞানগর্ভ লেখাগুলো সারা বিশ্বব্যাপী পঠিত এবং আলোচিত। বিশ্ব রাজনীতি, জাতিসত্তা, বৃহত্ শক্তিগুলোর আচরণ, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, যুদ্ধ সন্ত্রাস, মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব, জাতীয় স্বার্থ, কৌশল ইত্যাদি ছিল তার লেখার মূল আলোচনা। ২০০৬ সালে প্রকাশিত তার ফেইল্ড স্টেটস বিশ্বব্যাপী একটি বহুল আলোচিত গ্রন্থ। সেই গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ব্যর্থ রাষ্ট্রের প্রাথমিক কিছু বৈশিষ্ট্য সহজেই চিহ্নিত করা যায়। একটি হলো সহিংসতা ও ধ্বংস থেকে জনগণকে রক্ষা করার অক্ষমতা বা অনিচ্ছা। আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ আইনের ঊর্ধ্বে নিজেদের বিবেচনা করা এবং ফল হিসেবে যে কোনো আগ্রাসন ও সহিংসতা ঘটানোর অধিকার বোধ করা।’
তাহলে কি এখন সত্যিই ব্যর্থ রাষ্ট্রের সব বৈশিষ্ট্যই এখানে বিদ্যমান। মিডিয়া সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় সবকিছু প্রকাশ করার অধিকারও আজ সঙ্কুচিত। কিন্তু কিছু বিষয় উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। ব্রিটিশ প্রভাবশালী মিডিয়া দ্য হাফিংটন পোস্টে গত ১৩ জানুয়ারি অনলাইন সংস্করণের ব্লগে ‘ইজ বাংলাদেশ টার্নিং ইনটু এ ফেইল স্টেট’ শিরোনাম প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যর্থ রাষ্ট্রের সব বৈশিষ্ট্য ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার সব বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের রয়েছে। মারাত্মক রাজনৈতিক এক মেরূকরণ, সাম্প্রতিক নির্বাচনী প্রহসন ও ধারাবাহিক সহিংসতা মিলিয়ে বাংলাদেশে ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার সব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান বলে উল্লেখ করেছে। সর্বশেষ ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন, বিরোধী দলের নেতাদের দমন-পীড়ন এমনকি খোদ বিরোধী নেতা খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দি, নির্বাচনকেন্দ্রিক টানা সহিংসতা ও ভোট জালিয়াতির কথা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, যে যাই বলুক, সর্বশেষ ভোটে কেবল ১০ ভাগ ভোট পড়েছে। নজিরবিহীনভাবে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার পরও আওয়ামী লীগের ভোট জালিয়াতির ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয় বাকশাল কায়েমের কথা তুলে ধরে বলা হয়, সে সময় শেখ মুজিব নিষ্ঠুর একনায়কতন্ত্র কায়েম করেন। হাজার হাজার বিরোধী নেতা গুমের শিকার হন। বিরোধী দলগুলো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। এ নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা ২০১১ সালে বাতিল করে দেয় বর্তমান সরকার। ফলে বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে। ফলাফল বিরোধী দলবিহীন হাস্যকর একটি সংসদ পেল বাংলাদেশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে একমাত্র ভারত ছাড়া কোনো দেশ ও বিদেশি সংস্থার সমর্থন ছিল না। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কমনওয়েলথের কার্যকর প্রচেষ্টার পরও দুই দলকে একসঙ্গে করে কার্যকর সংলাপ করা যায়নি। ফলে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠায়নি কেউ। এতে বলা হয়, বিবিসির অলস সাংবাদিকতা ছাড়া বিশ্ব মিডিয়া এ নির্বাচনের কঠোর সমালোচনা করেছে। একে অগ্রহণযোগ্য ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকির নির্বাচন বলে অভিহিত করেছে। একটি বিদেশ নীতিবিষয়ক সংস্থা বিশ্বকে হুমকির মুখে ফেলতে যাওয়া ১০ দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। পাশাপাশি মারাত্মক রাজনৈতিক একমেরূকরণ, সাম্প্রতিক নির্বাচনী প্রহসন ও ধারাবাহিক সহিংসতা মিলিয়ে বলা যায়, ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার সবকটি বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি, মানুষের জীবনহানি, সম্ভ্রমহানি ও আইনের শাসনের বোধের উপলব্ধির অভাব দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের কাছাকাছি পৌঁছিয়ে দিয়েছে। আমরা যেন অগ্নিকুণ্ডের কিনারে দণ্ডায়মান। এক ব্যক্তির খেয়াল-খুশি যেন ১৬ কোটি মানুষের জীবন নিয়ে তামাশা। এই রশিকতা মানুষের জীবন, সম্ভ্রম, নিরাপত্তা আর বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন আশরাফুল মখলুকাত হিসেবে। তার অধিকার, মর্যদা আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত। এটি কারো করুণা নয়। আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে সে প্রয়োজনবোধে জীবন দেবে, কিন্তু অন্যায়-অবিচার, জুলুম আর অবিচারের কাছে মাথা নত করবে না। যে বান্দা কপাল দিয়ে এক আল্লাহকে সিজদা করে, সেই সৈনিক এক আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে মাথা নত করে না।
পাহাড়সম দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, সহিংসতা, আগ্রাসন, নাশকতা ও রাজনৈতিক স্বার্থে মিথ্যা নাটক জনসমর্থনহীন এই সরকারের ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার শূন্যের কোঠায় সঙ্কুচিত করেছে। বিরোধীদলীয় জোটের আহ্বানে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনে এদেশের ৯৫ ভাগ মানুষের সাড়া আর উপজেলা নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন সরকারকে ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুকতর জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। একের পর এক সরকারের অপকৌশল বুমেরাং হচ্ছে। নিজের অপরাধের বোঝাই এখন জন্য অসহনীয়। আওয়ামী লীগ মানবাধিকার লঙ্ঘন, দমন-নিপীড়ন, গণহত্যা, দুর্নীতি, তথাকথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর সর্বশেষ একদলীয় নির্বাচনের আয়োজনের কারণে বাংলাদেশে এখন বিশ্ব মিডিয়ার খোরাক।
যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সংবাদপত্র ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসে গত ১৩ জানুয়ারি ভিক্টর মালের লেখা ‘ফিয়ার্স ফর বাংলাদেশী ডেমোক্রেসি রাম্বল অ্যাক্রোস রিজিয়ন (বাংলাদেশে গণতন্ত্রের আশঙ্কা ধ্বনিত হচ্ছে পুরো অঞ্চলে)’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘হয়তো মৃত নয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন গুরুতর অসুস্থ হয়েছে। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া যেমনটা বলছেন যে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন মৃত, তা হয়তো নয়। কিন্তু এখানে জালিয়াতির যে নির্বাচনের মঞ্চায়ন হয়েছে তাতে এটা নিশ্চিত যে এখানে গণতন্ত্র গুরুতর অসুস্থ।’ ব্যর্থ গণতন্ত্রের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আদর্শিকভাবে বিভ্রান্ত দলগুলো পরিবারতন্ত্র আঁকড়ে ধরে রেখেছে। এর ফলে সেখানে বিচার ব্যবস্থার মতো প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে পড়েছে আর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে পারিবারিক সম্পর্ক। এই নির্বাচনে বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষ অসন্তুষ্ট এবং খুশি হতে পারেনি বিদেশি সরকারগুলোও, যারা চায় বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম মুসলিম দেশটিতে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হোক। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মতো এশিয়ার রাজনীতিকরা ক্ষমতা ও সুবিধার মোহের কারণে গণতন্ত্রের আক্ষরিক অর্থ ও চেতনাকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন। কাজেই সত্যিই গণতন্ত্রের মৃত্যু হলে দায় তাদেরই।’
গণতন্ত্রের বিপরীত শাসন একনায়কতন্ত্র। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভিউম্যানের মতে, ‘একজন বা কতিপয় ব্যক্তি যখন দেশের সব ধরনের শাসনক্ষমতা অধিকার এবং তা প্রতিরোধহীন ব্যবহার করে, তখন তাকে একনায়কতন্ত্র বলে অভিহিত করা যায়।’ এ সরকার স্বেচ্ছাচারী এবং জনমতের কোনো গুরুত্ব প্রদান করে না। এক দেশ, এক নেতা এবং এক দলে (One state, one leader and one party) বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। বিরোধী দলের কার্যপ্রক্রিয়া এখানে প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ তার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই চেতনাকে লালন করে আসছে। ফলে দেশ হয়েছে গণতন্ত্রহীন আর দলের মধ্যে ব্যক্তি হয়ে পড়েন ক্ষমতার একক নায়ক তথা স্বৈরাচারী। আগে ছিল বাবা আর এখন মেয়ে যেন একই পথ ধরে হাঁটছে। এরই মধ্যে দিয়ে জাতির কাঁধে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল একদলীয় বাকশাল। এখন ৪২ বছর সেই আবহ লক্ষ করছে বাংলার মানুষ। এখন শুধু ঘোষণাটিই যেন অবশিষ্ট। এই স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতার কারণেই শেখ মুজিবুর রহমানের মতো আকাশচুম্বী জনপ্রিয় নেতাকে নামিয়ে আনল মানুষের ভালোবাসার শূন্যের কোঠায়। শেখ মুজিব যখন বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন তখন লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফে পিটার গিল লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তার দেশ থেকে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের শেষ চিহ্নটুকু লাথি মেরে ফেলে দিয়েছেন। মাত্র এক ঘণ্টা স্থায়ী অধিবেশনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছে এবং একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে ক্ষমতা অর্পণ করেছে। অনেকটা নিঃশব্দে গণতন্ত্রের কবর দেয়া হয়েছে। বিরোধী দল দাবি করেছিল, এ ধরনের ব্যাপক শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের ব্যাপারে আলোচনার জন্য তিন দিন সময় দেয়া উচিত। জবাবে সরকার এক প্রস্তাব পাস করলেন যে, এ ব্যাপারে কোনো বিতর্ক চলবে না। শেখ মুজিব এমপিদের বললেন, পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র ছিল ‘ঔপনিবেশিক শাসনের অবদান’।
লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফে ৪২ বছর আগে পিটার গিল আওয়ামী লীগ সম্পর্কে যা লিখেছিলেন, তা যেন এত বছর পর এসেও তাদের শাসনামলের বাস্তব রূপ। পত্রিকাটি লিখেছে, শেখ মুজিবুর রহমান দেশের স্বাধীন আদালতকে ‘ঔপনিবেশিক ও দ্রুত বিচার ব্যাহতকারী’ বলে অভিযুক্ত করলেন। আজকের দিনে ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের চতুর্থ প্রতিবেদনে এ চিত্র পাওয়া গেছে। নিউইয়র্কে সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক গ্র্যাজুয়েট সেন্টারে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়— ‘আইনের শাসনে কেনিয়া মিয়ানমার : উগান্ডার চেয়েও পিছিয়ে বাংলাদেশ’। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গুয়াতেমালা, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, মিয়ানমার, উগান্ডা এবং কম্বোডিয়ার চেয়েও পিছিয়ে রয়েছে। সরকারের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতিমুক্ত সরকার, মৌলিক অধিকার, আইনশৃঙ্খলার নিরাপত্তা, নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব, ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিচার ব্যবস্থাকে মানদণ্ডে ধরে জরিপটি পরিচালনা করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আইনের শাসনের নিশ্চিত করার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়েছে। দুর্নীতি বিস্তৃত হয়েছে পুলিশ ও সেনাবাহিনীতেও। সরকারের জবাবদিহির নিশ্চয়তাও দুর্বল, প্রশাসনিক সংস্থা ও বিচার ব্যবস্থা দুর্নীতিতে আক্রান্ত। পাশাপাশি রয়েছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং পুলিশের নির্যাতনকে বাংলাদেশে একটি প্রধান সমস্যা হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং আওয়ামী লীগের পক্ষে আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের দাবি যে কতটা মেকি, সেটির প্রমাণ তারা এভাবেই সেদিন দিয়েছিল, আজও দিচ্ছে।
পৃথিবীতে এখনও গণতন্ত্র থেকে আপাতত কোনো শান্তিপ্রিয় ও উত্তম ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। সুতরাং গণতান্ত্রিকতার সীমানা আঠারো দলীয় জোটের রোড ফর ডেমোক্রেসি ছিল ‘টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। এই কর্মসূচি সর্বমহলে সমাদ্রিত হয়েছে। শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগ এবং পুলিশের পেটোয়া বাহিনী সারা দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে আবার প্রমাণ করেছে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। হাইকোর্টে আইনজীবী, ঢাবিতে শিক্ষক এবং প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের ওপর হামলা করে আবারও প্রমাণ করেছে পরমতসহিষ্ণুতায় আওয়ামী লীগ জিরো টলার্যান্স নীতির অনুসারী। সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিদের ওপর হামলা নির্যাতন করে সরকার প্রমাণ করেছে, এ দেশের কোনো পেশার মানুষই এই সরকারের আমলে আর নিরাপদ নয়। বাংলাদেশের তিন বারের প্রধানমন্ত্রী, স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পত্নী, তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে দেশবাসীর জন্য যে বার্তাটি নিশ্চিত করেছে এই সরকার, তা হলো, সরকারের চিন্তার বাইরে কোনো শক্তিকেই সরকার ছাড় দেবে না। বন্দুকের নলই হবে আলোচনার ভাষা। সুতরাং দেশবাসী সাবধান! দেশে এখন চলছে একদলীয় স্বৈরাচার, এক ব্যক্তির বাকশালী শাসন। এটি এখন শুধু বক্তব্য নয়, বাস্তবতা।
লেখাটির ইতি টানব নোয়াম চমস্কির ফেইল্ড স্টেটস গ্রন্থের দুটি লাইন দিয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘যে কারও জন্য অন্যতম কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো নিজের চেহারা সততার সঙ্গে আয়নায় দেখা। যদি আমরা তা করি, তাহলে আমাদের দেশের ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রের’ বৈশিষ্ট্যগুলো অবলোকন করতে মোটেও বেগ পেতে হবে না। যারা নিজেদের দেশ ও ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে নিয়ে চিন্তা করেন, তাদের জন্য এই অনুধাবন দুর্ভাবনার কারণ। আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মের কথা ভেবে রাজনীতিবিদরা কি সেই কাজটি করবেন প্লিজ। কিন্তু সরকার একদলীয় শাসন কায়েম করে গণতন্ত্র, শিক্ষা, সাংস্কৃতি, অর্থনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের স্বার্থ একবারেই জলাঞ্জলি দিয়ে চলছে আরেকটি দেশের স্বার্থে। তখন একশ্রেণীর সংবাদপত্র সরকারের সমালোচনা তো দূরের কথা, বরং এসব নোংরা ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের দালালিতে ব্যস্ত রয়েছে। এটি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য বড়ই অশুভ। দেশের অভ্যন্তরীণ সব ব্যাপারে এখন ভারতের হস্তক্ষেপ অনেকটাই প্রকাশ্য। এমনি প্রেক্ষাপটে আজ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে—এদেশে কি আদৌ গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার অক্ষুণ্ন আছে? রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আদৌ কি নিরাপদ? এসব প্রশ্নগুলোর যথার্থ উত্তর পেতে আমাদের করতে হবে নিরন্তর লড়াই। গড়ে তুলতে হবে জাতীয় ঐক্য।

(পূর্ব প্রকাশিত)

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *