ফেসবুককে নৈতিকতার সেন্টার হিসেবে ভাবা

বাংলাদেশের রাষ্ট্রের বর্তমান সময়ের সব চেয়ে ইন্টেরেস্টিং প্রবনতা গুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে, ফেসবুকের একটা স্পেসিফিক গ্রুপের ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষের নিজেকে রাষ্ট্র ক্ষমতার, ক্ষমতার নৈতিকতার সেন্টার হিসেবে ভাবা।
এই ভ্রান্তি বিলাসের প্রবলেমটা খুব টেকনিকাল এবং এলগোরিদম ভিত্তিক। তাই বিষয়টা খুব টেকনিকালি দেখতে হবে।
এই গ্রুপের মধ্যে আমিও আছে খুব সম্ভবত আপনি যদি আমার স্ট্যাটাসটা পরে থাকেন তবে আপনি আছেন।

প্রবলেম টা আগে তুলে ধরি।

প্রবলেমটা হচ্ছে ফেসবুক পাব্লিক মিডিয়া নয় সোশ্যাল মিডিয়া।
ফেসবুক যে পাব্লিক মিডিয়া না, এইটা একটা বিশাল ডিক্লারেশান।

যারা সাংবাদিকতা এবং গনযোগাযোগ পড়েন- তাদের কাছে পাব্লিক স্ফিয়ারের ধারণাটা খুবই গুরুত্তপুরন।

ফ্রাঙ্কফুট স্কুলের ইয়রগেন হবারমাস তার স্ট্রাকচারাল ট্রান্সফরমেশান অফ দা পাব্লিক স্ফেয়ার গ্রন্থে পাব্লিক স্ফিয়ারকে ডিফাইন করছিলেন এই বলে যে “made up of private people gathered together as a public and articulating the needs of society with the state” (বাই দা ওয়ে , এই বইটা আমি পড়ি নাই। গুগ্লাইছি। যাক গিয়া।।)

তো পাব্লিক স্ফিয়ারের কনসেপ্ট টা গুরুত্তপুরন।

রাষ্ট্রের সব পাব্লিক পাব্লিক স্ফিয়ার থাকেনা। পাব্লিক স্ফিয়ারেও দুই ধরণের মানুষ। একজন ভোক্তা একদল বক্তা।
মনে করেন, একজন টক শো হোস্ট বা একজন কলামিস্ট বা একজন সাংবাদিক বা একজন রেডিও আর যে- পাব্লিক স্ফিয়ারের একজন গুরুত্তপুরন বক্তা। তাদেরকে কঞ্জিউম করেন যারা তারা ভোক্তা।

(বাই দা ওয়ে এইটা হবারমাসের কন্সেপ্ট না আমার কন্সেপ্ট। কিন্ত কনসেপ্ট হিসেবে কনসেপ্টটা ভালো, সো বিতর্ক কইরেন না। আগান…)

তো এই পাব্লিক স্ফিয়ারে এই বক্তা এবং ভোক্তার কন্সেপ্টে গিয়ে একজন টকশো হোস্ট , একজন জনপ্রিয় কলামিস্ট বা একজন রেডিও আর যে গুরুত্তপুরন একজন ব্যক্তি। কারণ সে পাব্লিকের মনকে ইনফ্লুয়েন্স করার ক্ষমতা রাখে।

কিন্ত আমি যেইটা পয়েন্টটা শুরুতে বলতে চাইতেছিলাম যে, সোশ্যাল মিডিয়াতে এই ৫ থেকে ৮ হাজার মানুষ(সি আগে ৮ থেকে ১০ বলছিলাম, এখন কমায় ফেলছি। মানে আমি সিউর না।)- নিজেকে পাব্লিক স্ফিয়ারের গুরুত্তপুরন বক্তা মনে করলেও, যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়া পাব্লিক স্ফিয়ার না, তাই সোশ্যাল মিডিয়ার গুরুত্তপুরন বক্তারা ফেসবুকের সোশ্যাল স্ফিয়ার হওয়ার কারণে খুবই অল্প ইম্প্যাক্ট রাখতেছে।

কিন্ত, নিজেকে সে ওভার ইম্ফ্যাসিস করতেছে এবং ভাবতেছে সে ক্ষমতার কেন্দ্রে বা ক্ষমতার নৈতিকতার প্রশ্নে গুরুত্তপুরন কেউ কিন্ত বাস্তবতা হইলো বাংলাদেশে রাষ্ট্রে প্রাক্টিকালি তার কোন বেইল নাই -কারণ এই রিপিট সোশ্যাল মিডিয়া মানে ফেসবুক পাব্লিক স্ফিয়ার না সোশ্যাল স্ফিয়ার।

এবং এর ফলে সে একটা ডিলিউশানের মধ্যে আছে যেই ডিলিউশান নিয়ে তার সেচেতনতা খুবই অল্প।

এই লিস্টে আমিও ইঙ্কলুডেড।

এবং এইটা কাউকে ছোট করার জন্যে বলছি না। এই প্রবলেমটা টেকনিকাল এবং এলগরেদিমিক।

আচ্ছে। আসেন এই বার ব্যখা করি।

প্রথমে আমি ব্যাখ্যা করি, কেন আমি বলছি, ফেসবুক পাব্লিক স্ফিয়ার না।

কারণ জুকারবারগ চায় না। সিম্পল।

মনে করেন, টুইটার পাব্লিক স্ফিয়ার। মনে করেন সামু ব্লগ পাব্লিক স্ফিয়ার । মনে করেন প্রথম আলো পাব্লিক স্ফিয়ার। মনে করেন, দৈনিক করতোয়া পাব্লিক স্ফিয়ার, তৃতীয় মাত্রা, পাব্লিক স্ফিয়ার – কিন্ত ফেসবুক পাব্লিক স্ফিয়ার না।

কখনো নিজেকে প্রশ্ন করছেন, ফেসবুক কেন ৫০০০ এর বেশী ফ্রেন্ড নিতে দেয় না ?

ইটস সিম্পল। আপনার ৫০০০ জন ফ্রেন্ড হইতে পারেনা। সিম্পল। এইটা ফেসবুক জানে। এইটা বেসিক সাইন্স।

এই টার মূল কারণ আসছে, নিউরো সাইন্সের একটা আবিস্কার থেকে যেইটা ডানবার নামবার বলে।

ডানবার নামবার বলে, আপনি কখনোই একই সাথে ১৫০ থেকে ১৬০ জনের বেশী মানুষের সাথে ফাংশনাল রিলেশানশিপ রাখতে পারবেন না।
এইটা কোন আরবিট্রারারি নামবার না।

আপনার মস্তিষ্কের যে অংশ গুলো, মানুষের সাথে সম্পর্কের ইস্যু গুলো ধারন করে সেই অংশের নিউরনের যে সাইজ তার ভিত্তিতে এই নামবারটা মিস্টার ডানবার সাহেব আবিস্কার করছে। তাই এই নামবারটার নাম ডান্বার নামবার।

তো আপনি বলতে পারেন, আমার মোবাইলে তো ৩০০০ সেলফোন নামবার আছে, যাদের সবার সাথে আমি বিভিন্ন সময়ে কানেক্টেড ছিলাম।
ওয়েল, বিষয়টা হইলো আপনি একই সাথে পারবেন না।
ডানবার নামবার এতো গুরুত্তপূর্ণ যে এই জন্য আর্মির একটা কোম্পানির সর্বোচ্চ সাইজ সাধারণত ১৫০।

এইটা ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানিং এ গুরুত্তপুরন ন।

নাউ, আর একটা ইস্যু আছে, এইটা আমি কোথাও একবার পড়ছিলাম সেইটা হইলো আপনি একই সাথে ৮ থেকে ১০ জনের বেশী মানুষের সাথে ফানশনাল সম্পর্ক ও রাখতে পারবেন না। সেম ডানবার সাহেবের দেয়া লিমিটেশান।
নাও, জুকারবারগ এইটা জানে।

এই জন্যে সে বিভিন্ন ভাবে সিস্টেম করে, আপনাকে ৫০০০ এর বেশী ফ্রেন্ড নিতে দিবে না। কারণ জুকারবারগ ফেসবুককে বানাইছে,

হাই, আমার ছবি দেখো ? এই যে আমার বেবি। এই যে দেখো, আমার লাইফ কত সুন্দর, আমার সেলফি। হাই আমি ব্যাঙ্ককে। হাই আমার প্রমশান হহইছে। আমার নতুন গার্ল ফ্রেন্ড, আই লাবু মাই জান। এই সব করার জন্যে।
জুকারবার ফেসবুককে পাব্লিক ডিস্করসের জন্যে বানায় নাই।

যদিও আমরা এই কাজে ব্যবহার করি, কিন্ত জুকারবারগ বিভিন্ন ভাবে আপ্নেকে আটকায় দেয়, আপনার সোশ্যাল স্পেয়রের বাহিরে লেখা প্রমোট করে না।

জুকারবারগ বিভিন্ন এলগোরিদম দেয়, যার ফলে, কেউ যদি আপনার লেখায়, লাইক , ট্যাগ, কমেন্ট না দেয়, সে আপনার লেখা পাবেনা। কারণ সে লোক সোশালি আপনার সাথে কানেক্টেড না।

এখন মনে করেন, আপনি একজন এন্টি শাহবাগ মানুষ । আপনি ইমরান সরকারকে দেখতেই পারেন না। কিন্ত উনার প্রতি আপনার একটা নেগেটিভ এট্রাকশান আছে। ফলে উনি কি বলে সেইটা জানার জন্যে আপনি উনার লেখা পড়তে চান। কিন্ত কখনোই লাইক কমেন্ট শেয়ার দিবেন না। স্লোলি, ফেসবুক আপনার কাছ থেকে ইমরানকে দূরে সরাইতে থাকবে। এখন হয়তো, আপনি উনাকে এতোই অপছন্দ করেন, ঊনার ওয়ালে গিয়ে আপনি পড়ে আসেন। সেইটা অন্য বিষয়।

কিন্ত ফেসবুকের এইসব এলগোরিদ্মের কারণে, ফেসবুককে বৃহৎ পরিসারে পাব্লিক স্পেয়ার হিসেব ধরলে এর বিভিন্ন যে সব চরিত্র আছে তাদের কাছ থেকে আপনি দূরে সরাতে থাকবে, এবং ফেসবুকে ক্রমাগত আপনাকে আপনার লাইক মাইন্ডেড লোকের একটা ইকো চেম্বারে ঢুকায় দিতে থাকবে।

ফলে কি হবে জানেন ? ধীরে ধীরে আপনি যে আইডিওলজির সেই আইডিওলজির বাহিরের লোকের সাথে আপনার কানেকশান হবেনা, ওরা আপনাকে চিনবেনা।

সো, ৭১ টিভি যেই ভাবে ব্রডকাসট হয়ে পক্ষের বিপক্ষের সবাই পায়, ফেসবুকে আপনার লেখা সেই ভাবে কখনোই সবাই পাবেনা।

হয়তো কিছু দিন পাবে, তো আরেক এলগোরিদমের ধাক্কায় আবার চেঞ্জ হয়ে যাবে।

লম্বা হচ্ছে, সো শেষ করি।
সো পয়েন্ট টা হইলো এই সব কারণে, ফেসবুক মূলত একটা সোশ্যাল স্পেয়ার হিসেবে আছে, এইটা কোন মতেই পাব্লিক স্ফেয়ার হইতে পারে নাই।

তো আমার পয়েন্ট টা হইলো, ফেসবুকে যারা সেলেব্রিটি। এবং তাদেরকে ঘিরে যে সোশ্যাল স্পেয়ার তারা অনেক সময়ে ভাবে তারা সাম্থিং , তারা পাব্লিক স্পেয়ারে গুরুত্তপুরন বক্তা । তাদের মন্তব্য ম্যাটার করে। এবং তারা রাষ্ট্র যন্ত্রের মরাল জায়গায় একটা গুরুত্তপুরন ভুমিকা পালন করতেছে।

কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা সবাই জুকারবারগের তৈরি করা, একটা ইকো চেম্বারের মধ্যে আছে যেই খানে, এক গ্রুপের খবর আরেক গ্রুপে যায় না। এই খানে জুকারবারগ মামা, অনেক দেয়াল তৈরি করতে রাখছে। যেই দেয়াল ভাঙ্গতে হইলে, আপনাকে লাখ লাখ টাকা খরছ করে ফেসবুকে এদ্ভারট দিতে হবে। তাইলে আপনি ফেসবুকরে পাব্লিক স্পেয়ারের চরিত্র পারতে পারেন, তাও পারবেন না।

তো, পরথমে যেই বিশাল বড় একটা দাবী করছিলাম যে, ফেসবুকের ৪০০০ থেকে ৫০০০ লোকের (সি আরো কমায় ফেলছি) একটা ভ্রান্তি বিলাসের সেইটা কেন ?

কারণ, আমি দেখছি ঢাকা কেন্দ্রিক এবং সেলিব্রিটি কেন্দ্রিক একটা ফেসবুক আইডিয়ার ধাক্কা আছে, যেইটা একটা সোশ্যাল স্পেয়ার যেই স্পেয়ারে আসলেই একটা – ক্ষমতার এবং ক্ষমতার নৈতিকতা ধারন করার ভাব বক্তা এবং স্রোতা সবার আছে।
কিন্ত এরা বোঝে না এরা কেউ না।

এরা ভাবে জিয়া হাসান বিশাল বড় ইন্টেলেকচুয়াল । বাস্তবতা হইলো, জিয়া হাসান নিজের লেঙ্গুট সাম্লানো একটা সাধাসিধা লোক যার লেখা বড় নিউজ পেপারে দিলেও ছাপায় না। লবিং করতে হয়।

এরা ভাবে, কল্লোল মুসতফা বিশাল বড় বাম এনভায়রন্মেন্টাল সাইন্টিস্ট। কিন্ত কল্লোল মুস্তফা একজন টেলকো ম্যানেজার যে বুর্জোয়া জীবনের স্ত্রাগল নিয়ে দিনাতিপাত করতেছে।

এরা ভাবে, ওয়াহিদুজ্জামান বিশাল বড় একটা বিএনপি নেতা, কিন্ত ওয়হিদুজ্জামান কোন মতে এই বার একটা পদবি পাইছে, অনেক মামলা ফামলা খাওয়ার পুরস্কার হিসেবে

এরা ভাবে, পিনাকিদা বাংলাদেশের বিশাল বড় একজন বিপ্লবী, কিন্ত উনি আসলে … আচ্ছা থাক। পিনাকি দার ব্যাপারটা আলাদা। 😛

তো কি বলতেছিলাম, তো এদের কাছে – যে ফেসবুকে নাই। সে কেউ না ।এদের কাছে, যার যত ফলোয়ার সে তত বড় হেন। তত বড় তেন।

বাস্তবতা হইলো, ফেসবুকের বিশাল একজন কবির স্ট্যাটাস দেখছিলাম, বই মেলায় ২৭ কপি বই বিক্রির টাকা প্রকাশক দেয় নাই বলে ক্ষোভ। সারা মেলাতে ২৭ কপিই বিক্রয় হইছিল।

সো কি বলতাছি তালগোল হারায় ফেলছি

সো, বেসিকালি এই গ্রুপটার নিজেদেরকে নিজে আত্মগরিমা আছে সেইটার সব চেয়ে বড় সমস্যা তাদের কোন গুণ নাই, বা তাদের কোন বেইল নাই তা না- তারা সবাই ফেসবুকের সোশ্যাল স্ফিয়ারে নিজেকে এক্সপ্রেস করছেন। পাব্লিক স্ফিয়ারে যাইতেছেন না।

দুইটার চরিত্রই আলাদা।

আমি মনে করি, সামান্য একটা অখ্যাত নিউজপারের কলাম্নিস্টেরো, ১ লক্ষ ফলোওয়ার ওয়ালা সেলেব্রিটির থেকে ইম্প্যাক্ট বেশী। সেই ইম্প্যাক্টটা দেখা যায় না কারণ সেইটা দুই মুখী না। এই খানে এক লেখায় ৫০ কমেন্ট পড়লেই মনে হয়, একটা ভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। কিন্ত আসলে সেইটা কিছু না।

হে মাবুদ, ফেসবুকিয় এই ভ্রান্তি বিলাস থেকে আমি সহ সবাইরে বের হওয়ার সুযোগ দাও।

আমিন।

( বি:দ্র: লেখকের ফেইস বুকে লিখাটি পূর্ব প্রকাশিত হয়েছে)

জিয়া হাসান

About জিয়া হাসান

লেখক: প্রাবন্ধিক। প্রকাশিত গ্রন্থ : শাহবাগ থেকে হেফাজত: রাজসাক্ষীর জবানবন্দি -

Comments are closed.