প্রকৃতি ও পরিবেশ: “বদলে যাচ্ছি আমিঃ ———”

আমার আজকের শিরোনামের অর্ধেকটা লিখলাম, বাকিটা আপাততঃ উহ্য রইল। পাঠকগণ লেখাটা পড়তে থাকুন। ততক্ষণে আমি চিন্তা করে নেই কি দিয়ে শিরোনামের শূন্য স্থান পুরণ করা যায়। “বদলে যাচ্ছি আমিঃ” বলতে মহাজোট সরকারের দিন বদলের কথা বলছি না। এ আমার একান্তই নিজের কথা, মনের কথা, অনুভূতির কথা, ব্যক্তিগত কথা। আমার গল্পের সঙ্গে আপনাদের মনের মিল হলে হতেও পারে, নাও হতে পারে। এতে কিছু যায় আসে না। গল্প তার আপন গতিতে চলবে। চলতে চলতে কোনো এক দূর্বল মহূর্তে আপনাদের হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারে, আবার ব্যর্থও হতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত যদি আমার চলার পথে আপনাদের ধরে রাখতে পারি সেটাই হবে আজকের নিবন্ধের আসল সার্থকতা। এবার শুরু করা যাক গল্পটি।

ঊনিশ শ’ পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের কোনো এক অজপাড়া গাঁয়ে আমার জন্ম। যদিও সার্টিফিকেটে আমার একটি জন্ম তারিখ আছে, তথাপি বড় হয়ে বুঝতে পারলাম আরো লক্ষ কোটি বাংলাদেশির মত আমিও আমার জন্মের সনতারিখ দিনক্ষণ জানি না। আমার মা-বাবারা যে অশিক্ষিত ছিলেন তা কিন্তু নয়। জন্মের সময় লিখে রেখেছিলেন সবই, কিন্তু কালের আবর্তে খাতাটি হারিয়ে যায়। মার কাছ থেকে শোনা, ‘বাবার এক বন্ধুর ছেলের জন্মের এক সপ্তাহ আগে কোনো এক শুক্রবারে নাকি আমি ভূমিষ্ট হয়েছিলাম’। সেই সূত্র ধরে ইউনিভার্সাল ক্যালেন্ডার ঘাঁটাঘাঁটির পর অনেক কোশেশ করে আমার একটি জন্ম তারিখ বের করেছি বটে, কিন্তু এর বিশুদ্ধতায় শতভাগ নিশ্চিত নই বলে সেটা আর আপনাদের কাছে প্রকাশ করছি না। জন্ম তারিখ জানি না বলে আমার মনে কোনো দুঃখ নেই, আফসোস্ নেই, নেই মা-বাবার ওপর কোনো রাগ-অভিমানও। কিন্তু এ ব্যাপারে, বিদেশে জন্ম নিয়ে বড় হওয়া আমার ছেলেমেয়েরা যখন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে, তখন আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরি আমার প্রাণপ্রিয় সন্তানদের। আত্মতৃপ্তির সঙ্গে তাদের বলি, ‘এমন বাবা কোথায় পাবি, যে তার জন্ম তারিখের বিনিময়ে ছেলেমেয়েদের মুখে ফুটিয়ে তুলে এমন নির্মল হাসি’।

ছেলেবেলা আমি চেয়ারটেবিলে বসে রুটি-মাখন-ডিম-দুধ সহ নাস্তা খাইনি। রান্নাঘরে মাটির মেঝেতে বসে টিনের প্লেটে ডালভাত খেয়েছি। জুতো-মোজা পরে গাড়িতে চড়ে, কিংবা শহরের পাকা পথে ড্রাইভার অথবা ঘরের কাজের ছেলেমেয়ের হাত ধরে ধরে স্কুলে যাইনি। খালি পায়ে ছাতা মাথায় বই বগলদাবা করে বাঁশের সাঁেকা পেরিয়ে কাদাপানি মাড়িয়ে ৬ মাইল হেঁটে রোজ স্কুলে যাওয়া আসা করেছি। এ আমার গৌরব নয়, অহঙ্কার নয়, তবে লজ্জাও নয়। এ আমার জীবনের এক বিশেষ অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ, ও পরীক্ষা। কলেজে যাওয়ার আগে ভাগ্যে এক জোড়া জুতো ও একটা ফুল প্যান্ট জোটেনি। কাঠের খড়ম, বড়জোর দুই ফিতার ফ্লিপফ্লপ স্যান্ডেল, হাফ প্যান্ট, এবং লুঙ্গি-পাজামা পরেই কেটেছে পুরো শৈশব ও কৈশর। এগুলো আমার জীবনের কঠোর বাস্তবতা। ছোটবেলা টানাটানির সংসারে বেড়ে ওঠা আমাকে অনেক শক্ত করে গড়ে তুলেছে জীবন সংগ্রামে বন্ধুর পথে হাঁটাচলার জন্য। ওই দিনগুলোর কথা ও অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে দেশ বিদেশে আমার মনে অনবরত সাহস যুগিয়েছে, জীবন যুদ্ধে আমাকে কখনো পরাজিত হতে দেয়নি। এর ফলে পর্বত প্রমাণ অসুবিধাকে আমার কাছে অসুবিধা বলে মনে হয়নি। দুনিয়ার তাবত ভয়কে সহজেই জয় করতে পেরেছি। শত প্রতিকুলতার পাহাড় ডিঙিয়ে কর্মক্ষেত্রে সফলতার দিকে এগিয়ে গেছি। দারিদ্রের মাঝে জন্মেছি। এ আমার দূর্বলতা নয়। এ আমার শক্তি – চিরদিনের শক্তি।

একটু একটু করে যখন বড় হয়েছি, তখন নিজের চারপাশকে দেখতে শিখেছি, বুঝতে শিখেছি।
মা-বাবা-পরিবারের মায়া-মমতার গন্ডি পেরিয়ে আশপাশের মানুষ, প্রকৃতি, পরিবেশ, ও পারিপার্শিকতাকে অনুভব করেছি। তখন আবিস্কার করেছি এক নতুন জগত। পৃথিবী আস্তে আস্তে অবগুন্ঠন খুলে ধরা দিয়েছে আমার কাছে। পাশের মানুষগুলোকে দেখেছি, তাদের সাথে ভাবের আদান প্রদান করেছি। দেখেছি তারা অতি সাধারণ, নিতান্তই সহজ সরল। সাধারণ তাদের কাপড় চোপড়, বেশ-ভূষা। গ্রামের মানুষগুলোর জীবন একেবারেই সাদাসিধে, সাদামাটা। তাদের মুখে দেখেছি সদা হাসি লেগেই থাকত। তাদের বুক ভরা মায়া মমতা আর অসীম দরদী মনের ছোঁয়া পেয়ে তাদের মাঝেই আমার বড় হওয়া। দু’চোখ ভরে দেখেছি চারপাশের আলো, হাওয়া, মাটি, পানি, গাছপালা, লতাগুল্ম, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, ফুলফল, ইত্যাদি। মন ভরে উপভোগ করেছি তাদের রূপ মাধুর্য। সবই মনে হয়েছে সুন্দর, নির্মল, পরিপাটি, সাজানো গোছানো। সবকিছুকেই মনে হয়েছে মা-বাবার মতই আপন, মমতাময়। সব কিছুকেই মনে হয়েছে নিজ পরিবারেরই অংশ। মন দিয়ে ভালোবাসতে শিখেছি পরিবেশ, প্রকৃতি, ও পারিপার্শিকতার সব কিছুকে।

যখন আরেকটু বড় হয়েছি, স্কুলে যেতে শুরু করেছি। স্বর বর্ণ ব্যঞ্জণ বর্ণ শিখেছি, নামতা পড়েছি, ছড়া কবিতা মুখস্ত করেছি, মনের অজান্তে নিজের মগজে জ্ঞানের ছাপ পড়তে শুরু করেছে। একটু একটু করে নতুন নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, জ্ঞান আহরণ করেছি। এতে পেয়েছি অগাধ আনন্দ, উত্তেজনা, আর উত্সাহ। ওই রকম সময় বর্ষা হলে নৌকো করে মায়ের সাথে নানার বাড়ি নাইয়র যেতাম – নদী, খাল, বিল, হাওর পেরিয়ে। নানা বাড়ি যাওয়া আসার পথে খাল বিলে কোথাও দেখতাম জেলেরা জাল দিয়ে মাছ ধরছে। কোথাও দেখতাম মরাগরু পানিতে ভেসে যাচ্ছে আর মৃতদেহের পিঠে বসে চলতে চলতে কাক তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। মাঝির বৈঠার টানে কলকল পানির শব্দ সঙ্গীতের মত কানে এসে বাজত। হাকালুকি হাওরে দেখতাম থৈথৈ পানি ঢেউ খেলছে। বর্ষায় ভরা হাওরের পানিতে ফুল ফোটা হিজল গাছের শধুু উপরের ডাল আর পাতা দেখা যেত। বাকি পুরো গাছ ডুবে থাকত পানির নিচে। কচুরিপানা দেখতাম কোথা থেকে ভেসেভেসে আসছে কোন অজানা ঠিকানায় কতদূর যাবে, শত ভেবেও এর কোনো হদিস পেতাম না! মাঝে মাঝে দেখা যেত দলছুট বড় বড় দেশি জাতের পাখি। বাবা নৌকো থেকে বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করতেন। না জানিয়ে না শুনিয়ে সারাদিন নাও চড়ে বিকেলে গিয়ে যখন হঠাত্ নানা বাড়ির আঙ্গিনা মাড়িয়ে উঠতাম। সে কী উত্তেজনা! সে কী আনন্দ! ভাষায় প্রকাশ করার মত শব্দ ভান্ডার আমার নেই। এভাবে আত্মীয় স্বজন, বৃহত্তর পরিবেশ, ও প্রকৃতির সঙ্গে শুরু হয় আমার জানাশোনার গভীরতা।

আমাদের এক ফুফুর বাড়ি ছিল পাথারিয়া পাহাড়ের গাঁয়ে বড়লেখার মামদ নগর গ্রামে। শীতকালে যখন ফুফুর বাড়ি বেড়াতে যেতাম, পাহাড়কে অনেক কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেতাম। ফুফা লোক নিয়ে জাল দিয়ে ঝাকা ভর্তি মুনিয়া পাখি ধরে আনতেন, পাথারিয়া পাহাড়ে গিয়ে বন্দুক দিয়ে হরিণ শিকার করতেন। আমরা খুব মজা করে পাখি আর হরিণের গোশ্ত খেতাম। রাত্রি বেলা কাঁচা মুলি বাঁশের ভেতর বনের পাতা পেঁচিয়ে চাল ভরে পানি ঢেলে খড় দিয়ে উঠোনে আগুন জ্বেলে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী চোঙ্গা পিঠা পোড়া হত। তারপর হৈ হুল্লোড় করে সবাই মিলে গোশ্ত দিয়ে আবার কোনো কোনো সময় ঘন আখের রস দিয়ে গরম গরম পিঠা খেতাম।

আরেক ফুফু থাকতেন আরেকটু দূরে শাহ্বাজপুরের আতুয়ায়। তাঁর বাড়িতে যখন ট্রেনে চড়ে যেতাম তখন ঝমাঝম রেলগাড়ির আওয়াজ আর দোলার সাথে সাথে আনন্দে নিজের মনটাও দুলত। গাড়ির আওয়াজ শোনে রেল সড়কের দু’ পাশে মাঠের গরু ছাগল পাগলের মত ছোটাছুটি করত। ট্রেনের গতির সাথে পাখিগুলো উড়ে উড়ে যেত। মনে হত আমি ট্রেনের কামরায় স্থির বসে আছি, আর গাছপালা, ঘরবাড়ি, মাঠঘাট, গ্রামগুলো ট্রেনের গতিতে এঁকেবেঁকে দূরে সরে সরে যাচ্ছে। আমার জন্য এসব ছিল এক নতুন অনুভূতি, নতুন অভিজ্ঞতা, ও ভীষণ উত্তেজনাকর বিষয়। এভাবেও প্রকৃতিকে দেখতে পেতাম নিবিড়ভাবে, তাকে উপভোগ করতাম গভীরভাবে! ছোটবেলা এরূপ মায়া মমতা ও ভালোবাসার মধ্যে প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে হয় আমার পরিচয়, আমার জানাশোনা। অমি আমার মা-বাবা ভাই বোনদের যেভাবে দেখেছি, যেভাবে ভালোবেসেছি, আমার চারপাশের পরিবেশ ও প্রকৃতির সাথে সেভাবেই আত্মার সম্পর্ক গড়ে তুলেছি। হৃদয়ের পরতে পরতে আজও আঁকা রয়েছে ছোটবেলার সেইসব মধুর স্মৃতি।

বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমরা ভালোবাসার অনেক পরীক্ষা দিয়েছি। আমরা দেশকে ভালোবেসেছি, দেশের মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি, ও ধর্মকে ভালোবেসেছি, মাতৃভাষাকে ভালোবেসেছি, দেশের স্বার্থকে ভালোবেসেছি, অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে দেশকে স্বাধীনও করেছি। কিন্তু শুধু একখন্ড মাটিই তো আর দেশ নয়। দেশ বলতে আরো অনেক কিছু বোঝায়। দেশের মানুষ, সমাজ, আলো, হাওয়া, প্রকৃতি, আর পরিবেশ সব মিলিয়েই তো দেশ। এ সবকিছুকেই মনে হয়েছে মা-বাবার মতই সুন্দর, আপন। সবকিছুকেই মনে হয়েছে পরিবারেরই অংশ। ছেলেবেলা দেশপ্রেম ও দেশের ভালোবাসা বলতে আমি এটাই বুঝতাম। সেদিনও দেশের ভালোবাসা বলতে এই ছিল আমার ধারণা। তখন আমার অভাব ছিল বেশি, কিন্তু মন ছিল নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ, স্বভাব ছিল সুন্দর।

আজ আমি বড় হয়েছি। আমিত্বে আমার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। হয়তবা আমার পরিচিতি হয়েছে, নামডাকও হয়েছে, আমার ক্ষমতা হয়েছে, অর্থবিত্ত হয়েছে। এখন আমি দ্রুত বদলে যাচ্ছি। এখন আমি শুধু আমাকেই ভালোবাসি, শুধু টাকাকে ভালোবাসি। মুখে বলি শতবার, কিন্তু আসলে দেশকে যেভাবে ভালোবাসা উচিত্ সেভাবে বাসি না, দেশের পরিবেশ, প্রকৃতি, পারিপার্শিকতার তো প্রশ্নই উঠে না। আমি তাদের রীতিমত ভুলতে বসেছি। এখন আর তাদের চিনি না, তাদের জন্য মায়া হয় না, তাদের জন্য আমার প্রাণ কাঁদে না। দেশের আলো, হাওয়া পানি, ফুলফল, গাছপালা লতাপাতা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, ইত্যাদি কাউকে ভালোবাসি না। ভালোবাসি কেবল টাকা আর টাকা, বাড়ি গাড়ি, শান শওকত, ইত্যাদিকে। তাই বড় বাড়ি বানাবার জন্য শহরের আশেপাশে যেখানে নদী নালা, খাল বিল, জলা পুকুর, হাওর বাওর দেখি সেখানেই মাটি ফেলি, বালু ফেলি, ভরাট করি, সমতল জমি বানাই, প্লট বানাব, বাড়ি বানাবো, বিল্ডিং বানাব বলে। উঁচু উঁচু দালান বানাতে চাই, ফ্ল্যাট বানাতে চাই অসংখ্য। এগুলো বিক্রি করে ঘরে টাকা তুলে আনব বস্তা ভরে। আজ আমি আর সেই আমি নেই। আমি আমার চারপাশের পরিবেশকে আগের মত আর ভালোবাসি না। পরিবেশ এখন আমার শত্র“। তাকে কেটে ছিঁেড় ধ্বংস করতে আমার বিবেকে একটুও আর বাধে না। আমি একদিকে বুলডোজার দিয়ে পরিবেশ ধ্বংস করছি আর আরেক দিকে তরতর করে স্ফীত হয়ে উঠছে আমার ব্যাংক ব্যালেন্স। আমি মেতে উঠেছি এক উন্মত্ত খেলায়, পাশবিক উন্মাদনায়। এর শেষ কোথায়? কেউ জানে না আমিও জানি না। অবশেষে বলতে ইচ্ছে করে, ‘বদলে যাচ্ছি আমি। না! বদলে গেছি আমি – ভালোবাসি শুধু টাকা, মাটি, আর জমি’। পাঠকদেও প্রতি সব শেষে আমার প্রশ্ন, ‘কে এই আমি’?

লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক – টেনেসী স্টেইট ইউনিভার্সিটি;
এডিটর – জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ।

Loading


Comments

প্রকৃতি ও পরিবেশ: “বদলে যাচ্ছি আমিঃ ———” — 1 Comment

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *