প্যারাডক্সিক্যাল_সাজিদ (তৃতীয় পর্ব)

⭐ আল-কুরআন কি মানব-রচিত?

বিরাট আলিশান একটি বাড়ি। মােগল আমলের সম্রাটেরা যেরকম বাড়ি বানাত, অনেকটাই সেরকম। বাড়ির সামনে দৃষ্টিনন্দন একটি ফুলের বাগান। বাগানের মাঝে ছােট ছােট কৃত্রিম ঝরনা আছে। এই বাড়ির মালিকের রুচিবােধের প্রশংসা করতেই হয়। ঝঞাট ঢাকা শহরের মধ্যে এটি যেন এক টুকরাে স্বর্গখণ্ড। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলাে, বাগানের কোথাও লাল রঙের কোনাে ফুল নেই। এতবড় বাগানবাড়ি; অথচ কোথাও একটি গােলাপের চারা পর্যন্ত নেই। বিস্ময়ের ব্যাপার তাে বটেই।

আমরা এসেছি সাজিদের এক দূর সম্পর্কের খালুর বাসায়। ঢাকা শহরে বড় ব্যবসা আছে উনার। বিদেশেও নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের শাখা-প্রশাখা ছড়িয়েছেন। ছেলেমেয়েদের কেউ লন্ডন, কেউ কানাডা আর কেউ সুইজারল্যান্ডে থাকে। ভদ্রলােক উনার স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকাতেই রয়ে গেছেন। শিকড়ের টানে, জন্মভূমির মায়ায়। তবে ঢাকায় নিজের বাড়িখানাকে যেভাবে তৈরি করেছেন, বােঝার উপায় নেই যে, এটি ঢাকার কোনাে বাড়ি নাকি মস্কোর কোনাে ভিআইপি ভবন। আমাকে এদিক সেদিক তাকাতে দেখে সাজিদ প্রশ্ন করল-“এভাবে চোরের মত এত এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিস কেন? আমি ভ্যাবাচেকা খাওয়ার মতাে করে বললাম-না, আসলে তাের খালুকে নিয়ে। ভাবছি। – উনাকে নিয়ে ভাবার কী আছে? আমি বললাম-‘অসুস্থ মানুষদের নিয়ে ভাবতে হয়। এটাও এক প্রকার মানবতা, বুঝলি? সাজিদ আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল-‘অসুস্থ মানে? কে। অসুস্থ? -“তাের খালু। -“তােকে কে বলল উনি অসুস্থ? আমি দাঁড়ালাম। বললাম-“তুই এতকিছু খেয়াল করিস, এটা করিসনি?” -কোনটা?-“তাের খালুর বাগানের কোথাও কিন্তু লাল রঙের কোনাে ফুলগাছ নেই। প্রায় সব রঙের ফুলগাছ আছে; লাল ছাড়া। এমনকি, গােলাপের একটি চারাও নেই। -তাে? -তাে আর কি? তিনি হয়তাে কালার ব্লাইন্ড। স্পেসেফিক্যালি, রেড কালার ব্লাইন্ড । সাজিদ কিছু বলল না। হয়তাে সে এটা নিয়ে আর কোনাে কথা বলতে চাচ্ছে না অথবা আমার যুক্তিতে সে হার মেনেছে। সাজিদ কলিংবেল বাজাল। ঘরের দরজা খুলে দিল একটি তের-চৌদ্দ বছর বয়সী ছেলে। সম্ভবত কাজের ছেলে। আমরা ভেতরে ঢুকলাম। ছেলেটি বলল-“আপনারা এখানে বসুন। আমি কাকাকে ডেকে দিচ্ছি।’ ছেলেটা একদম শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছে। বাড়ির মালিককে স্যার বা মালিক না বলে কাকা বলছে। সম্ভবত, উনার কোনাে গরীব আত্মীয়ের ছেলে হবে। যাদের খুব বেশি টাকাপয়সা হয়, তারা গ্রাম থেকে গরিব আত্মীয়দের বাসার কাজের চাকরি দিয়ে দয়া করে। ছেলেটা ভদ্রলােককে ডাকার জন্য সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। ঘরের ভেতরটা আরও চমক্কার। নানান ধরনের দামি দামি মার্বেল পাথর দিয়ে দেওয়াল সাজানাে। দুতলার কোনাে এক রুম থেকে রবীন্দ্রনাথের গানের সুর ভেসে আসছে-যদি তাের ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলাে রে…’ আমি সাজিদকে বললাম-“কি রে, তাের এরকম মােগলাই স্টাইলের একটা খালু আছে, কোনােদিন বললি না যে? সাজিদ রসকষহীন চেহারায় বলল-‘মােগলাই স্টাইলের খালু তাে, তাই বলা হয়নি। -“তাের খালুর নাম কী? -এম. এম. আলি। ভদ্রলােকের নামটাও উনার বাড়ির মতােই গাম্ভীর্যপূর্ণ। আমি জিজ্ঞেস করলাম-“এম. এম. আলি মানে কী?সাজিদ আমার দিকে তাকাল। বলল-মােহাম্মদ মহব্বত আলি। ভদ্রলােকের বাড়ি আর ঐশর্যের সাথে নামটা একদম যাচ্ছে না। এজন্যে হয়তাে মােহাম্মদ মহব্বত আলি নামটাকে শর্টকাট করে এম, এম, আলি করে নিয়েছেন। ভদ্রলােক আমাদের সামনের সােফায় পায়ের উপর পা তুলে বসলেন। মধ্যবয়স্ক মানুষ। চেহারায় বার্ধক্যের কোনাে ছাপ নেই। চুল পেকেছে, তবে কলপ করায় তা ভালােমতাে বােঝা যাচ্ছে না। তিনি বললেন-“তােমাদের মধ্যে সাজিদ কে?’ আমি লােকটার প্রশ্ন শুনে অবাক হলাম খুব। সাজিদের খালু, অথচ সাজিদকে চেনে না। এটা কী রকম কথা? সাজিদ বলল-“জ্বি, আমি।’ -হুম, I guessed that’, লােকটা বলল। আরও বলল-“তােমার কথা বেশ শুনেছি, তাই তােমার সাথে আলাপ করার ইচ্ছে জাগল। আমাদের কেউ কিছু বললাম না। চুপ করে আছি। লােকটা আবার বলল-প্রথমে আমার সম্পর্কে দরকারি কিছু কথা বলে নিই। আমার পরিচয় তাে তুমি জানােই, সাজিদ। যেটা জানে না, সেটা হলাে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে আমি একজন অবিশ্বাসী। খাঁটি বাংলায় নাস্তিক। রুবায়েত আজাদকে তাে চেনাে, তাই না? আমরা একই ব্যাচের ছিলাম। আমি নাস্তিক হলেও আমার ছেলেমেয়েরা কেউই নাস্তিক নয়। সে যাহােক, এটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। সাজিদ বলল-খালু, আমি এসব জানি।’ লােকটা অবাক হবার ভান করে বলল-“জানাে? ভেরি গুড। ক্লেভার বয়। -খালু, আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন কেন তা বলুন। -“ওয়েট! তাড়াহুড়াে কীসের?’, লােকটা বলল।। এর মধ্যেই কাজের ছেলেটা ট্রেতে করে চা নিয়ে এল। আমরা চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। লােকটাকে একটি আলাদা কাপে করে চা দেওয়া হলাে। সেটা চা নাকি কফি, ঠিক বােঝা যাচ্ছে না।। লােকটি বলল-“সাজিদ, আমি মনে করি, তােমাদের ধর্মগ্রন্থ, আই মিন আল কোরান, সেটা কোনাে ঐশী গ্রন্থ নয়। এটা মুহাম্মদের নিজের লেখা একটি বই। মুহাম্মদ করেছে কি, এটাকে জাস্ট স্রষ্টার বাণী বলে চালিয়ে দিয়েছে।এটুকু বলে লােকটা আমাদের দুজনের দিকে তাকাল। হয়তাে বােঝার চেষ্টা করল আমাদের রিঅ্যাকশান কী হয়। আমরা কিছু বলার আগেই লােকটি আবার বলল-‘হয়তাে বলবে, মুহাম্মদ লিখতে-পড়তে জানত না। সে কীভাবে এরকম একটি গ্রন্থ লিখবে? ওয়েল! এটি খুবই লেইম লজিক। মুহাম্মদ লিখতে পড়তে না জানলে কি হবে, তার ফলােয়ারদের অনেকে লিখতে-পড়তে পারত। উচ্চশিক্ষিত ছিল। তারা করেছে কাজটা; মুহাম্মদের ইশারায়। সাজিদ তার কাপে শেষ চুমুক দিল। তখনও সে চুপচাপ। লােকটা বলল-“কিছু মনে না করলে আমি একটি সিগারেট ধরাতে পারি? অবশ্য, কাজটি ঠিক হবে না জানি। আমি বললাম-“শিওর! এতক্ষণ পরে লােকটি আমার দিকে ভালাে করে তাকাল। একটি মুচকি হাসি দিয়ে বলল-“Thank You…’

সাজিদ বলল-খালু, আপনি খুবই লজিক্যাল কথা বলেছেন। কোরআন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিজের বানানাে হতেও পারে। কারণ কোরআন-যে ফেরেশতা নিয়ে আসত বলে দাবি করা হয়, সেই জিব্রাঈল (আঃ)কে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাড়া কেউই কোনােদিন দেখেনি। লােকটা বলে উঠল-এক্সাক্টলি, মাই সান।। -“তাহলে, কোরআনকে আমরা টেস্ট করতে পারি, কী বলেন খালু? -“হ্যাঁ হ্যাঁ, করা যায়…।’ বেশ উৎসাহী হয়ে উঠলেন তিনি। সাজিদ বলল-কোরআন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বানানাে কি, তা বুঝতে হলে আমাদের ধরে নিতে হবে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্রষ্টার কোনাে দূত নন। তিনি খুবই সাধারণ, অশিক্ষিত একজন প্রাচীন মানুষ। লােকটা বলল-“সত্যিকার অর্থেই মুহাম্মদ অসাধারণ কোনাে লােক ছিল না। স্রষ্টার দূত তাে পুরােটাই ভুয়া। সাজিদ মুচকি হাসল। বলল-“তাহলে এটাই ধরে নিই? -হুম।’, লােকটার সম্মতি। সাজিদ বলতে লাগল-খালু, ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, হজরত ইউসুফ (আঃ)-এর জন্ম হয়েছিল বর্তমান ফিলিস্তিনে। ইউসুফ (আঃ) ছিলেন হজরত ইয়াকুব (আঃ)-এর কনিষ্ঠতম পুত্র। ইয়াকুব (আঃ)-এর কাছে ইউসুফ (আঃ) ছিলেন প্রাণাধিক প্রিয়। কিন্তু, ইয়াকুব (আঃ)-এর এই ভালােবাসা ইউসুফ (আঃ)-এর জন্য কাল হলাে। তাঁর ভাইয়েরা ষড়যন্ত্র করে ইউসুফ (আঃ)-কে কূপে নিক্ষেপ করে দেয়। এরপর, কিছু বৃণিক কূপ থেকে ইউসুফ (আঃ)-কে উদ্ধার করে তাকে মিসরে নিয়ে আসে। তিনি মিসরের রাজপরিবারে বড় হােন। ইতিহাস মতে, এটি ঘটে খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের আমেনহােটেপের রাজত্বকালের আরও তিন শ বছর পূর্বে। খালু, এই বিষয়ে আপনার কোনাে দ্বিমত আছে? লােকটা বলল-নাহ। কিন্তু, এগুলাে দিয়ে তুমি কী বােঝাতে চাও? সাজিদ বলল-খালু, ইতিহাস থেকে আমরা আরও জানতে পারি, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্দশ শতকে চতুর্থ আমেনহােটেপের আগে যেসব শাসক মিসরকে শাসন করেছে, তাদের সবাইকেই ‘রাজা বলে ডাকা হতাে। কিন্তু, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে চতুর্থ আমেনহােটেপের পরে যেসব শাসক মিসরকে শাসন করেছিল, তাদের সবাইকে ‘ফেরাউন’ বলে ডাকা হতাে। ইউসুফ (আঃ) মিশরকে শাসন করেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের চতুর্থ আমেনহােটেপের আগে। আর, মূসা (আঃ) মিসরে জন্মলাভ করেছিলেন চতুর্থ আমেনহােটেপের কমপক্ষে আরও দু শ বছর পরে। অর্থাৎ, মূসা (আঃ) যখন মিসরে জন্মগ্রহণ করেন, তখন মিসরের শাসকদের আর রাজা বলা হতাে না, ‘ফেরাউন বলা হতাে। -হুম, তাে? -“কিন্তু খালু, কোরআনে ইউসুফ (আঃ) এবং মূসা (আঃ) দুজনের কথাই আছে। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, কোরআন ইউসুফ (আঃ)-এর বেলায় শাসকদের ক্ষেত্রে রাজা’ শব্দ ব্যবহার করলেও, একই দেশের, মূসা (আঃ)-এর সময়কার শাসকদের বেলায় ব্যবহার করেছে ‘ফেরাউন’ শব্দটি। বলুন তাে খালু, মরুভূমির বালুতে উট চরানাে বালক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতিহাসের এই পাঠ কোথায় পেলেন? তিনি কীভাবে জানতেন যে, ইউসুফ (আঃ)-এর সময়ের শাসকদের ‘রাজা’ বলা হতাে, মূসা (আঃ)-এর সময়কার শাসকদের ‘ফেরাউন’? এবং ঠিক সেই মতাে শব্দ ব্যবহার করে তাদের পরিচয় দেওয়া হলাে? মহব্বত আলি নামের ভদ্রলােকটি হাে হাে হাে করে হাসতে লাগল। বলল-“মূসা আর ইউসুফের কাহিনি তাে বাইবেলেও ছিল। মুহাম্মদ সেখান থেকে কপি। করেছে; সিম্পল। সাজিদ মুচকি হেসে বলল-খালু, ম্যাটার অফ সরাে দ্যাট, বাইবেল এই জায়গায় চরম একটি ভুল করেছে। বাইবেল ইউসুফ (আঃ) এবং মূসা (আঃ) দুজনের সময়কার শাসকদের জন্যই ‘ফেরাউন শব্দ ব্যবহার করেছে, যা ঐতিহাসিক ভুল। আপনি চাইলে আমি আপনাকে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে প্রমাণ দেখাতে পারি।’ লােকটা কিছুই বলল না। চুপ করে আছে। সম্ভবত, উনার প্রমাণ দরকার হচ্ছে না। সাজিদ বলল-“যে-ভুল বাইবেল করেছে, সে-ভুল অশিক্ষিত আরবের বালক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসে ঠিক করে দিলেন, তা কীভাবে সম্ভব; যদি না তিনি কোনাে প্রেরিত দূত হােন, আর কোরআন কোনাে ঐশী গ্রন্থ না হয়? লােকটি চুপ করে আছে। এর মধ্যেই তিনটি সিগারেট খেয়ে শেষ করেছে। নতুন আরেকটি ধরাতে ধরাতে বলল-“হুম, কিছুটা যৌক্তিক। সাজিদ আবার বলতে লাগল-খালু, কোরআনে একটি সূরা আছে, সূরা আলফাজর নামে। এই সূরার ৬ নম্বর আয়াতটি এরকম: তােমরা কি লক্ষ করােনি, তােমাদের পালনকর্তা ইরাম গােত্রের সাথে কীরূপ ব্যবহার করেছেন? ‘এই সূরা ফাজরে মূলত আদ জাতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। আদ জাতির আলাপের মধ্যে হঠাৎ করে ‘ইরাম’ নামে একটি শব্দ চলে এল; যা কেউই জানত না এটা আসলে কি। কেউ কেউ বললঃ এটা আদ জাতির কোনাে বীর পালােয়ানের নাম, কেউ কেউ বলল: এই ইরাম হতে পারে আদ জাতির শারীরিক কোনাে বিশেষ বৈশিষ্ট্য, কারণ এই সূরায় আদ জাতির শক্তিমত্তা নিয়েও আয়াত আছে। মােদ্দাকথা, এই ‘ইরাম’ আসলে কী, সেটার সুস্পষ্ট কোনাে ব্যাখ্যা কেউই দিতে পারেনি তখন। এমনকি, গােটা পৃথিবীর কোনাে ইতিহাসে ‘ইরাম’ নিয়ে কিছুই বলা ছিল না। কিন্তু, ১৯৭৩ সালে, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি সিরিয়ায় মাটির নিচে একটি শহরের সন্ধান পায়। এই শহরটি ছিল আদ জাতির শহর। সেই শহরে পাওয়া যায়, সুপ্রাচীন উঁচু উঁচু দালান। এমনকি, এই শহরে আবিষ্কার হয় তখনকার একটি লাইব্রেরি । এই লাইব্রেরিতে একটি তালিকা পাওয়া যায়। এই তালিকায় তারা যে-সকল শহরের সাথে বাণিজ্য করত, সেসব শহরের নাম উল্লেখ ছিল। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই যে, সেই তালিকায় ইরাম নামের একটি শহরের নামও পাওয়া যায়, যেটা আদ জাতিদেরই একটি শহর ছিল। শহরটি ছিল একটি পাহাড়ের মধ্যে। এতেও ছিল সুউচ্চ দালান। চিন্তা করুন, যে ইরাম’ শব্দের সঠিক ব্যাখ্যা এর পূর্বে তাফসিরকারকগণও করতে পারেনি-কেউ এটাকে বীরের নাম, কেউ এটাকে আদ জাতির শারীরিক বৈশিষ্ট্যের নাম বলে ব্যাখ্যা করেছে-১৯৭৩ সালের আগে যে-ইরাম শহরের সন্ধান পৃথিবীর তাবৎ ইতিহাসে ছিল না কোনাে ভূগােলবিদ, ইতিহাসবিদই এই শহর সম্পর্কে কিছুই জানত না-প্রায় ৪৩ শত বছর আগের আদ জাতিদের সেই শহরের নাম কীভাবে কোরআন উল্লেখ করল? যেটা আমরা জেনেছি ১৯৭৩ সালে, সেটা। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কীভাবে আরবের মরুভূমিতে বসে ১৪০০ বছর আগে জানল? হাউ পসিবল? তিনি তাে অশিক্ষিত ছিলেন। কোনােদিন ইতিহাস বা ভূগােল পড়েননি। কীভাবে জানলেন, খালু? আমি খেয়াল করলাম, লােকটার চেহারা থেকে মােগলাই ভাবটা সরে যেতে শুরু করেছে। পুত্রতুল্য ছেলের কাছ থেকে তিনি এতটা শক খাবেন; হয়তাে আশা করেননি। সাজিদ আবার বলতে লাগল-খালু, আর-রহমান নামে কোরআনে একটি সূরা আছে। এই সূরার ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছে-‘হে জিন ও মানুষ জাতি! তােমরা যদি আসমান ও জমিনের সীমানায় প্রবেশ করতে পারাে, তবে করাে। যদিও তােমরা তা পারবে না প্রবল শক্তি ছাড়া। মজার ব্যাপার হলাে, এই আয়াতটি মহাকাশ ভ্রমণ নিয়ে। চিন্তা করুন, আজ থেকে ১৪০০ বছর আগের আরবের লােক, যাদের কাছে যানবাহন বলতে ছিল কেবল উট আর গাধা, ঠিক সেই সময়ে বসে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহাকাশ ভ্রমণ নিয়ে কথা বলছেন, ভাবা যায়? ‘সে যাহােক; আয়াতটিতে বলা হলাে, যদি পারাে আসমান ও জমিনের সীমানায় প্রবেশ করতে, তবে করাে; এটি একটি কন্ডিশনাল (শর্তবাচক বাক্য। এই বাক্যে শর্ত দেওয়ার জন্য If (যদি) ব্যবহার করা হয়েছে। ‘খালু, আপনি যদি অ্যারাবিক ডিকশনারি দেখেন, তাহলে দেখবেন, আরবিতে যদি শব্দের জন্য দুটি শব্দ আছে। একটি হলাে লাও’, অন্যটি হলাে ‘ইন। দুটোর অর্থই যদি। কিন্তু, এই দুটোর মধ্যে একটি পার্থক্য আছে। আরবিতে শর্তবাচক বাক্যে লাও’ তখনই ব্যবহার করা হয়, যখন সেই শর্ত কোনােভাবেই পূরণ সম্ভব হবে না। কিন্তু, শৰ্তবাচক বাক্যে যদি শব্দের জন্য যখন ‘ইন ব্যবহার করা হয়, তখন সেই শর্ত পূরণ হতেও পারে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার, কোরআনে সূরা আর-রহমানের ৩৩ নম্বর আয়াতটিতে লাও ব্যবহার না করে ইন ব্যবহার করা হয়েছে। মানে, কোনাে একদিন জিন ও মানুষেরা মহাকাশ ভ্রমণে সফল হবে। আজকে কি মানুষ মহাকাশ জয় করেনি? মানুষ চাঁদে যায়নি? মঙ্গলে যাচ্ছে না? দেখুন, ১৪০০ বছর আগে যখন মানুষের ধারণা ছিল একটি ষাঁড় তার দুই শিঙের মধ্যে পৃথিবীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক তখন কোরআন ঘােষণা করছে, মহাকাশ ভ্রমণের কথা। সাথে বলেও দিচ্ছে, একদিন তা আমরা পারব। আরবের নিরক্ষর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কীভাবে এই কথা বলতে পারেন? এম. এম, আলি ওরফে মােহাম্মদ মহব্বত আলি নামের এই ভদ্রলােকের চেহারা থেকে আমি নাস্তিক, আমি একেবারে নির্ভুল টাইপ ভাবটা একেবারে উধাও হয়ে গেল। এখন তাকে যুদ্ধাহত এক ক্লান্ত সৈনিকের মতাে দেখাচ্ছে। সাজিদ বলল-খালু, খুব অল্প পরিমাণ বললাম। এরকম আরও শ খানেক যুক্তি দিতে পারব, যা দিয়ে প্রমাণ করে দেওয়া যায়, কোরআন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর লেখা কোনাে কিতাব নয়, এটি স্রষ্টার পক্ষ থেকে আসা একটি ঐশী গ্রন্থ। যদি বলেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য এই কিতাব লিখেছেন, আপনাকে বলতে হয়, এই কিতাবের জন্যই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বরণ করতে হয়েছে অবর্ণনীয় কষ্ট ও যন্ত্রণা। এই কিতাবের বাণী প্রচার করতে গিয়েই তিনি স্বদেশ ছাড়া হয়েছিলেন। তাকে বলা হয়েছিল, তিনি যা প্রচার করছেন তা থেকে বিরত হলে তাকে মক্কার রাজত্ব দেওয়া হবে। তিনি তা গ্রহণ করেননি। খালু, নিজের ভালাে তাে পাগলও বােঝে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বুঝল না কেন? এসবই কি প্রমাণ করে না কোরআনের ঐশী সত্যতা? লােকটা কোনাে কথাই বলছে না। সিগারেটের প্যাকেটে আর কোনাে সিগারেট নেই। আমরা উঠে দাঁড়ালাম। বের হতে যাব, অমনি সাজিদ ঘাড় ফিরিয়ে লােকটাকে বলল-খালু, একটি ছােট প্রশ্ন ছিল। -বলাে। -“আপনার বাগানে লাল রঙের কোনাে ফুল গাছ নেই কেন? লােকটি বলল-“আমি রেড কালার ব্লাইন্ড। লাল রঙ দেখি না। সাজিদ আমার দিকে ফিরল। অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল-বাবা আরিফ, ইউ আর কারেক্ট!

⭐ রিলেটিভিটির গল্পবুধবার।

মফিজুর রহমান স্যার পুরাে একঘণ্টা ধরে আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি’ বােঝালেন ক্লাসে। যদিও ফিজিক্স সাজিদের সাবজেক্ট নয়, তবে মাঝেমাঝেই স্যার এসব নিয়ে কথা বলেন। আজ যেমন বলেছেন থিওরি অব রিলেটিভিটি নিয়ে। এই থিওরি কী, কখন আবিষ্কৃত হয়, কীভাবে কাজ করে এসব একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বােঝানাের পরে তিনি পুরাে দুই গ্লাস পানি পান করলেন। পানি পান শেষে বললেন, এখন আমি পরীক্ষা করব কে কী রকম বুঝেছ। এখানে। একজন একজন এসে বুঝিয়ে যাও। বুধবারে মফিজ স্যারের ক্লাসের এই এক জ্বালা । টানা একঘণ্টা ক্লাস নেওয়ার পরে আরও টানা একঘণ্টা নেবেন সেটার প্রেজেন্টেশান। অনুপস্থিত থাকারও সুযােগ নেই। ডিপার্টমেন্টে এই একজনই আছেন যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এখনাে বেঞ্চের উপরে তুলে দাঁড় করিয়ে রেখে ক্লাস মিস করার শাস্তি দেন। কি বিদঘুটে ব্যাপার! মফিজ স্যারের টানা একঘণ্টার লেকচার থেকে যে যতটুকু গলাধঃকরণ করতে পেরেছে, সেটা একে একে সবাই আবার উগরে দিয়ে আসতে লাগল। কেউ ৫ মিনিট, কেউ ৭ মিনিট, কেউবা ৮ মিনিট করে লেকচারটার পুনরাবৃত্তি করতে লাগল। সবাই ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’র বিভিন্ন দিক নিয়ে বলতে লাগল । সবার শেষে এল সাজিদের পালা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাজিদকে চার-পাঁচ মিনিটের একটি লেকচার ঝেড়ে আসতে হবে এখন। সাজিদ উঠে এল। মফিজ স্যার উনার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মুচকি হেসে বললেন, সমাপ্তি পর্বে এবার মহামতি আইনস্টাইনের কাছ থেকে আমরা সবচেয়ে চমকপ্রদ কিছু শুনব। You may start Sir Mr. Einstein… মফিজ স্যারের বিদ্রুপাত্মক বাক্য ব্যয় অন্যদের জন্য সবসময় হাসির খােরাক। ক্লাসের সবাই হাে হাে হাে করে হেসে উঠল। ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়, তাই সাজিদ এখন আর এসব গায়ে মাখে না। সাজিদ হাসি হাসি মুখে শুরু করলবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটি একদম পানির মতাে সােজা । এটা এতই সােজা যে, ক্লাস এইটের একটা বাচ্চাও এটাকে খুব সহজে বুঝে নিতে পারে।এতটুকু শুনে সবাই সাজিদের দিকে বড় বড় চোখে হাঁ করে তাকাল। মফিজ স্যার চেয়ারে হেলান দেওয়া অবস্থাতে ছিলেন। সাজিদের কথা শুনে উনি একটু নড়েচড়ে বসলেন। উনার মােটা কালাে ফ্রেমের চশমাটিকে ঠিকঠাক করে নিয়ে বললেন, ‘Come to the point…’। সাজিদ বলল-“স্যার, আমি তাে পয়েন্টেই আছি। আমি কি বলব নাকি বসে। পড়ব? ‘No no, carry on’, মফিজ স্যারের প্রতিউত্তর। সাজিদ আবার শুরু করল‘এই সােজা থিওরিটিকেই একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের সবচে বড় আবিষ্কার এবং এর আবিষ্কারক মহামতি আইনস্টাইনকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী মনে করা হয়। ‘এতক্ষণ আমাদের সবার প্রিয়, শ্রদ্ধেয় মফিজুর রহমান স্যার আমাদের খুব সুন্দর করে বােঝালেন জিনিসটা। এরপর আমার বন্ধুরাও এই থিওরির নানান দিক খুব সুন্দর করে বর্ণনা করে গেল। যেহেতু আমাকেও কিছু বলতে হবে, তাই আমি এই থিওরির সবচে মজার দিক, ‘Time Dilation’ নিয়েই বলব। এই থিওরিটি সময় নিয়ে আমাদের যেভাবে ভাবাতে পেরেছে, বিজ্ঞানের অন্য কোনাে আবিষ্কার তা পারেনি। সময় নিয়ে আগেকার মানুষদের ধারণা ছিল অন্যরকম। তারা ভাবত, সময় সবখানে সমান। অর্থাৎ, আমার কাছে যেটা একঘন্টা , সেটা অন্য কোনাে গ্রহের, অন্য কোনাে প্রাণীর কাছেও একঘণ্টা। আমার কাছে যেটা একদিন, সেটা অন্য সবার কাছেও একদিন। অর্থাৎ, মাত্রাভেদে সময়ের কোনােই পরিবর্তন হয় না। ‘১৯০০ সাল পর্যন্ত সময় নিয়ে পৃথিবীর মানুষের ধারণা ছিল এরকম। উনিশ শ সালের কিছু আগে বিখ্যাত বিজ্ঞান লেখক এইচ.জি. ওয়েলস সময় নিয়ে কিছু ব্যতিক্রম লেখাজোখা করেন। তিনি তাঁর কিছু সাইন্স ফিকশানে দেখান যে, তাঁর সষ্ট কিছু চরিত্র বর্তমান’কে পাশ কাটিয়ে ভবিষ্যতের সময়ে চলে যাচ্ছে। অতীতে চলে যাচ্ছে। এইচ.জি. ওয়েলস তাঁর এই কথাগুলােকে সাইন্স ফিকশনে ঠাঁই দিলেও, তখনাে মানুষের মনে প্রশ্ন ছিল-“সত্যিই কি মানুষ কোনােদিন ভবিষ্যতে যেতে পারবে? অতীতে যেতে পারবে? ‘আইনস্টাইনের আগ পর্যন্ত এটা সাইন্স ফিকশনে থাকলেও, আইনস্টাইন এসে প্রমাণ করে দেখালেন যে, হ্যাঁ, মানুষ চাইলেই ভবিষ্যৎ ভ্রমণ করতে পারে। ‘কিন্তু কীভাবে? মজাটা এখানেই। আগেকার দিনে মানুষ ভাবত, সময় সর্বস্থানে, সর্বাবস্থায়, সর্বমাত্রায় একই রকম। ঐ যে একটু আগে বললাম, আমার কাছে যেটা একদিন, পৃথিবীর অন্য কোথাও বা অন্য কোনাে গ্রহে অন্য কারও কাছেও সেটা একদিন। ‘কিন্তু আইনস্টাইন এসে বললেন, ‘না, সময় ঠিক এরকম নয়। মাত্রাভেদে সময় পাল্টে যায়। ‘কিন্তু কীভাবে? আইনস্টাইন বলেছেন, কম গতিশীল কোনাে বস্তুতে সময় অধিক পরিমাণ দ্রুত চলে। আর যে-বস্তু অধিক গতিতে চলে, তার সময়ও তুলনামূলক কম গতিসম্পন্ন বস্তুর চেয়ে কম দ্রুত চলে। আর এটাকেই বলা হয় ‘Time Dilation.’ ‘অর্থাৎ, যে-বস্তুর গতি কম, তার সময় চলবে দ্রুত। আর, যে বস্তুর গতি বেশি, তার সময় চলবে আস্তে। ব্যাপারটি কেমন জগাখিচুড়ি জগাখিচুড়ি মনে হচ্ছে, তাই না? ‘কিন্তু আইনস্টাইন এটাকে ম্যাথম্যাটিক্যালি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। ‘ব্যাপারটিকে বােঝানাের জন্য ১৯৮০ সালে বৈজ্ঞানিক লেখক কার্ল সেগান তাঁর বিখ্যাত কসমস’ সিরিজে পুরাে একটি পর্ব করেছেন। কার্ল সেগান তার সেই সিরিজে এই পর্বের নাম রেখেছেন ‘টুইন প্যারাডক্স’ বা যমজ বিভ্রান্তি।’ শুধু কার্ল সেগান নয়, Time Dilation-এর উপর ভিত্তি করে হলিউডে ব্লকবাস্টার মুভিও তৈরি হয়েছে ২০১৪ সালেঃ Interstellar. ‘ধরা যাক, আমি আর আমার এক জমজ ভাই। আমাদের দুজনের বয়স এখন ১৮ করে। হঠাৎ করে আমার মাথায় ভূত চাপল যে, আমি স্পেসশিপে করে মহাবিশ্ব ভ্রমণে বের হব। পৃথিবী থেকে পাঁচহাজার আলােকবর্ষের মধ্যে যা কিছু আছে, তা আমি দেখে আসব। কিন্তু সেটা মাত্র তিন বছরের মধ্যে। অর্থাৎ, স্পেসশিপ নিয়ে আমি মহাবিশ্ব ভ্রমণে বের হলে তিন বছরের মধ্যে পাঁচ হাজার আলােকবর্ষ ভ্রমণ করে আসব। ‘এখন, কথা হচ্ছে, তিন বছরের মধ্যে আমি যদি তিনশত আলােকবর্ষ ভ্রমণ করে পৃথিবীতে ফিরতে চাই, আমার স্পেসশিপটাকে তাে আলাের গতির (সেকেন্ডে একলক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল) কাছাকাছি গতিতে ছুটতে হবে। তা না হলে এটা কোনােদিনও সম্ভব নয়। কিন্তু আইনস্টাইন এটিও বলেছেন, কোনাে বস্তু কোনােদিনও আলাের গতির কাছাকাছি গতিতে ছুটতে পারবে না। এটা অসম্ভব। ধরে নিলাম, আইনস্টাইনকে বুড়াে আঙুল দেখিয়ে আমি আর আমার ভাই। সেরকম একটি স্পেসশিপ তৈরি করে ফেললাম যা ছুটবে প্রতি সেকেন্ডে ১ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার মাইল। আমি আমার ভাইয়ের কাছ থেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় নিলাম। ২০১৬ সালের ২৫শে নভেম্বর আমি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্পেসশিপে করে রওনা হলাম মহাশূন্যের পথে। যখন বিদায় নিচ্ছি, তখন দুজনেরই বয়স ঠিক কাটায় কাটায় ১৮ করে। এতটুকু বলার পরে সাজিদ একটু থামল। কারও মুখে কোনাে কথা নেই। সবাই মনােযােগ দিয়ে শুনছে। মফিজ স্যারও। তাদের কাছে ব্যাপারটা জানা থাকলেও এভাবে হয়তাে ইন্টারেস্টিং লাগছে। সাজিদ আবার বলতে শুরু করল‘এখানেই থিওরির মজা। আইনস্টাইন বলেছেন, যেহেতু আমার ভাই পৃথিবীতে আছে আর আমি আলাের কাছাকাছি গতির একটি স্পেসশিপে, সেহেতু আমার গতি (মানে স্পেসশিপের গতি) আমার ভাইয়ের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। ‘এখন থিওরি মতে, গতিশীল বস্তুতে সময় কম দ্রুত চলে। তাহলে আমার সময় চলবে আস্তে। থিওরি আবার বলেছে, কম গতিশীল বস্তুতে সময় অত্যন্ত দ্রুত চলে। তাহলে, আমার ভাইয়ের সময়গুলাে চলবে দ্রুত। ‘এখন আরও ধরি, স্পেসশিপে যাবার সময় আমার হাতে যে-ঘড়ি ছিল, সেই ঘড়ির সময় অনুযায়ী আমি ঠিক কাঁটায় কাঁটায় তিন বছর পরে তিনশত আলােকবর্ষ ভ্রমণ করে পৃথিবীতে এলাম। ‘তাহলে তখন আমার বয়স কত? ১৮+৩ = ২১। ‘পথিবীতে এসে যখন আমি আমার ভাইয়ের সামনে যাব, তখন তার বয়স কত হবে? তাঁর বয়সও কি ২১ হবে? ‘হা হা হা হা হা। একদম না। আলাের কাছাকাছি গতির স্পেসশিপ নিয়ে আমি যে-তিন বছর মহাশূন্যে কাটিয়ে এসেছি, সে-তিন বছরে পৃথিবীতে পার হয়ে যাবে প্রায় ৫০ বছর। কেন এমনটা হলাে? কীভাবে? মাত্রায় আর গতিতে আমার আর আমার ভাইয়ের সময়ের মধ্যে একটা তারতম্য ঘটে গেছে। আমি দ্রুত গতির স্পেসশিপে থাকার কারণে আমার সময় যেখানে (সেটা আমার গতি বিবেচনায় পারফেক্ট) চলেছে, আমার ভাইয়ের সময় সেখানে চলেছে দ্রুত (তার গতির তুলনায় সেটা তাঁর জন্য পারফেক্ট)। ‘আমার যমজ ভাই, যাওয়ার সময় যার বয়স ছিল আমার মতােই ১৮, আমি এসে দেখব, সে তখন ৬৮ বছরের একটা বৃদ্ধ। তাঁর হাতে একটা লাঠি। কোমড় নুয়ে গেছে। স্ত্রীর ভেঙে পড়েছে। ‘এটাকে রূপকথার গল্পের মতাে মনে হলেও এটাই সত্যি। এইজন্য কার্ল সেগান এটাকে টুইন প্যারাডক্স বা যমজ বিভ্রান্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ‘এভাবে ২০১৬ সালে এরকম দ্রুত গতির যান নিয়ে মহাবিশ্ব ভ্রমণে বের হয়ে তিন বছর পর এসে আমি চাইলেই ২০৬৬ সালের পৃথিবীকে দেখে ফেলতে পারি মাত্র তিন বছর বয়স বাড়িয়ে। এটাই ভবিষ্যৎ ভ্রমণ। আমার সমবয়সীরা যখন কেউ কবরে, কেউ মৃত্যুশয্যায়, তখনাে আমি থাকতে পারি ২১ বছরের টগবগে তরুণ। ব্যাপারটা এরকম। এটাই ‘Time Dilation স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটির সবচেয়ে মজার অংশ। সাজিদের প্রেজেন্টেশন শেষ। সবাই জোরে জোরে হাততালি দিতে লাগল। মফিজুর রহমান দাঁড়ালেন। তারপর ব্যঙ্গাত্মকভাবে সাজিদের দিকে তাকিয়ে বললেন-“তােমাদের কোরআনে এই থিওরির ব্যাপারে কি কিছু আছে? সাজিদ বুঝতে পারল যে, স্যার তাকে নিয়ে বিদ্রুপ করতে চাচ্ছেন। সে মাথা নিচু করে ফেলল। মফিজ স্যার বললেন, না, তােমরাই তাে বলাে তােমাদের কোরআন আধুনিক বিজ্ঞান নিয়ে নাকি কত কথাই বলেছে সেই ১৪০০ বছর আগে। তাই জানতে চাচ্ছিলাম আর কি এরকম কিছুও বলেছে কি না। হা হা হা হা। স্যারের সাথে তাল মিলিয়ে ক্লাসের আরও কয়েকজন হেসে উঠল। এরা তারা, যারা সাজিদকে একদম সহ্য করতে পারে না। সাজিদ বলল-“স্যার, With due respect, আল-কোরআন বিজ্ঞানের কোনাে থিওরিটিক্যাল বই নয় যে এখানে বিজ্ঞানের সবকিছু, সব সাইড নিয়ে বলা থাকবে। এটা মানুষকে বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে আসেনি। এটার মেইন পারপাস: মানুষ যেন জাগতিক জীবনে সৎ, ন্যায় এবং সুন্দর জীবনযাপন করে, তাকওয়াবান হয়ে পরকালে জান্নাত লাভ করতে পারে। যে-রিক্সাওয়ালা থিওরি অফ রিলেটিভিটি বােঝে না বা কখনাে বুঝবে না, সে যদি সৎ হয়, ঈমানদার হয়, তাকওয়াবান হয় তাহলে পরকালে সেও জান্নাতে যাবে। মফিজ স্যার বললেন, ‘ও, তার মানে কোরআনে এরকম কিছুই বলা নেই? আফসােস! আমি ভাবলাম হয়তাে থাকবে। সাজিদ মাথা তুলে বলল-“জ্বি না স্যার; কোরআনে এরকম কিছু আছে। ‘সাজিদের কথা শুনে পুরাে ক্লাস থ হয়ে রইল। সাজিদ বলল-“স্যার, আমি এতক্ষণ স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটির যে অংশটি নিয়ে বললাম, সেটার সারমর্ম হলাে: সময় দুটি মাত্রায়, দুটি অবস্থায় দুই রকম আচারণ করে। কেন করে সেটাও বললাম। সময়ের ব্যাপারে এত চমকপ্রদ তথ্য আমাদের জানিয়েছেন মহামতি আইনস্টাইন। ১৯০৫ সালে। এর আগে তা আমরা জানতাম না। আমরা জানতাম, সময় সবখানে, সব অবস্থায় সমান। ‘শুধু আমরাই নই, সুপ্রাচীনকাল থেকে তাবৎ পৃথিবীর মানুষের ধারণাই ছিল এটা। আল-কোরআন যখন নাজিল হচ্ছে, তখনাে আরবের মানুষদের এটাই ধারণা ছিল। তারা কল্পনাও করতে পারত না যে, দুইটা অবস্থানে সময় দুই রকম হতে পারে। ‘আমার কাছে যেটা ৩ বছর, আমার ভাইয়ের কাছে সেটা যে ৫০ বছর হতে পারে, তারা সেটা ভাবতেও পারে নি । কিন্তু আল-কোরআন এসে তাদের অন্যরকম কিছু জানাল। আল-কোরআন জানাচ্ছে: হ্যাঁ, এটা সম্ভব। ‘আল কোরআন বলছে‘ফেরেশতা এবং রূহ আল্লাহর দিকে আরােহণ করে এমন এক দিনে, যার পরিমাণ (তােমাদের হিসাব মতে) পঞ্চাশ হাজার বছর।, সূরা আল মাআরিজ: ০৪ ‘The angels and the Spirit will ascend to Him during a Day the extent of which is fifty thousand years’ ‘দেখুন, আল্লাহ্ বলছেন যে, ফেরেশতারা এমন একটি দিনে আল্লাহর কাছে যায় । যেটা আমাদের হিসাব মতে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। ‘তাদের ১ দিন = আমাদের ৫০,০০০ বছর। ‘তারা মানে কারা? ফেরেশতারা। ফেরেশতারা কীসের তৈরি? নূর, অর্থাৎ আলাের। আলাের গতি কী রকম? সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। ‘এই আলাের তৈরি ফেরেশতারা এমন একদিনে আল্লাহর কাছে পৌঁছায়, যেটা আমাদের গণনায় ৫০,০০০ বছরের সমান। ‘এটার সাথে স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটির ‘টুইন প্যারাডক্সের ব্যাপারটা মেলান তাে। ‘আমি এমন তিন বছরে তিনশত আলােকবর্ষ ভ্রমণ করে এলাম যা আমার যমজ ভাইয়ের হিসাব মতে ৫০ বছরের সমান। ‘আমার তিনবছর = আমার যমজ ভাইয়ের ৫০ বছর। ‘ফেরেশতাদের একদিন = আমাদের ৫০,০০০ হাজার বছর। ‘এটাই হলাে আইনস্টাইনের থিওরির বিশেষ অংশ। এটার নাম Time Dilation.’ ‘১৫০০ বছর আগে কি করে কেউ ভাবতে পারে যে, সময়ের এরকম পার্থক্য হতে পারে? ইম্পসিবল। ‘এটা সেই স্রষ্টা থেকে আসা, যিনি সবকিছুর মতাে সময়েরও সৃষ্টিকর্তা। সৃষ্টিকর্তাই তাে তার সৃষ্ট সময়ের ব্যাপারে জানবেন, তাই না? সময়ের যে-পার্থক্যের ব্যাপারে আমাদের আইনস্টাইন জানালেন ১৯০৫ সালে, সেটা ১৫০০ বছর আগে নিরক্ষর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কীভাবে জানবেন, যদি না সময়ের সৃষ্টিকর্তাই উনাকে না জানান? ‘আপনি বলতে পারেন, আল-কোরআন কি তাহলে এখানে থিওরি অফ রিলেটিভিটি শেখাচ্ছে? একদম না। আমি আগেও বলেছি, কোরআন বিজ্ঞানের কোনাে থিওরিটিক্যাল বই নয়। এটা Science এর বই নয়, এটা Sign এর বই। এটা একটা চিরন্তন সত্য; স্রষ্টার কাছ থেকে আসা । তাই এটাতে বিভিন্ন উপমায়, উদাহরণে, ভঙ্গিতে এমন কিছু থাকবে, যা সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞানের সাথেও মিলে যাবে। এতে অবিশ্বাসীদের কাছে এটার গ্রহণযােগ্যতা, এটার বিশ্বাসযােগ্যতা, এটার অথেনটিসিটি বেড়ে যাবে। এই বই তাঁর এসব Sign দিয়ে অবিশ্বাসীদের মনে দাগ কাটবে। যেমন দাগ কেটেছে ড. গ্যারি মিলারের মনে, বিজ্ঞানী ড. মরিস বুকাইলির মনে, বিজ্ঞানী কিথ মুরদের মনে। যেমন দাগ কাটছে পশ্চিমের হাজার হাজার খ্রিষ্টানদের মনে। এইসব Sign দেখে প্রতিদিন পৃথিবীর আনাচে কানাচে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে শত শত মানুষ। ক্লাস পিরিয়ড শেষের দিকে। মফিজুর রহমান স্যার উনার চোখের মােটা কালাে ফ্রেমের চশমাটা খুলে চশমার কাঁচ পরিষ্কার করতে করতে হাঁটা ধরলেন। দরজার কাছে গিয়ে তিনি মুখ ফিরিয়ে সাজিদের দিকে তাকালেন। সাজিদ বলল-“আস্সালামু আলাইকুম স্যার।⭐ A Letter to David: Jessus Wasn’t Myth & He Existedকম্পিউটারের সামনে উবু হয়ে সাজিদ খুব মনােযােগ সহকারে কী যেন লিখছে। জানি না কী লিখছে। তবে যা লিখছে তা খুব যত্ন আর সাবধানে লিখছে তা বােঝা যাচ্ছে। মনে হয় খুব সিরিয়াস কিছু। আমি জিজ্ঞেস করলাম-“কী লিখছিস? -একটা মেইল পাঠাচ্ছি।’ -মেইল? কাকে? -“ডেভিডকে। -“ডেভিডকে? বেড়াতে আসার জন্য বলবি নাকি? সাজিদ কিছু না বলে ডেভিডের পাঠানাে মেইলটা আমার সামনে ওপেন করল। ডেভিড সম্পর্কে আগে কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার। ডেভিড হলাে সাজিদের বিদেশি বন্ধু। তাদের দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ হয় যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায়। সেখানকার একটা বিজ্ঞান মেলায় একবার সাজিদ গিয়েছিল তার বাবার সাথে। তখন সাজিদ মাত্রই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। বিজ্ঞান মেলায় ডেভিড এবং তার বন্ধুরা একটি অদ্ভুত যন্ত্র প্রদর্শন করেছিল। যন্ত্রটা অনেকটাই ড্রোনের মতাে। যন্ত্রটি প্রদর্শনের সময় ডেভিড যখন এটাকে চালু করতে যাচ্ছিল, সেটা কোনােভাবেই চালু হচ্ছিল না। অনেক চেষ্টা করেও ডেভিড এবং তার টিম সেটাকে চালু করতে পারছিল না। তখন সাজিদ ডেভিডের দিকে তাকিয়ে বলেছিল-‘Can I help you?’ ডেভিড সাজিদের দিকে তাকিয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষণ। এরপর বলল-‘Sure.’। সাজিদ টুকটাক করে কিছু কাজ করে দিয়েছিল। ডেভিড, তার টিম, সাজিদের বাবা এবং প্রদর্শনী দেখতে আসা অনেক লােক সাজিদের কাজের দিকে তাকিয়ে আছে। কাজ শেষ করে সাজিদ বলেছিল-‘Try now.’। ডেভিড তখনাে ভ্যাবলা মার্কা চেহারায় সাজিদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। সাজিদ আবার বলল-‘Hello, you can try now, dear.’ ডেভিড আলাভােলা চেহারায় আবারও বলল-‘Sure.’এবার ডেভিডদের যন্ত্রটি চালু হলাে। ভোঁ ভোঁ শব্দ করতে করতে সেটা চোখের পলকেই আকাশে উড়াল দিল। ডেভিডের হাতে একটি রিমােট। রিমােট টিপে যন্ত্রটিকে ডাইরেকশান দিয়ে উপরে-নিচে নামানাে হচ্ছে। এপাশ-ওপাশে সরানাে হচ্ছে। ডেভিড সাজিদের দিকে ফিরে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল-‘Hi, I’m David, David Anderson, you?’ সাজিদ মুচকি হেসে বলল-‘I’m Sajid. -‘From?’ -‘Bangladesh -“Great! Can we be friend, Sajid?’ সাজিদ হাসিমুখে বলল-‘Sure, Why not?’ সেই থেকে দুজনের বন্ধুত্ব। ডেভিড ইতােমধ্যে একবার বাংলাদেশে দুই সপ্তাহের জন্য বেড়াতেও এসেছিল। সেবার সে যাবার আগে অনেক কষ্টে একটি বাংলা বাক্য শিখে গিয়েছিল। বাক্যটি ছিল-“আমি তােমাকে ভালােবাসি। ইংরেজি ভাষাভাষীরা বাংলা ‘ত’ উচ্চারণ করতে পারে না ঠিকমতাে। তারা ত’ কে ‘ট উচ্চারণ করে। সেবার ডেভিড ‘আমি তােমাকে ভালােবাসি’ বাক্যটাকে বলছিল এরকম-“আমমি টোমাকে বালাে-বাসি।’ শুনে মজা পাচ্ছিলাম আমরা। ডেভিডের মেইলটা পড়লাম। মেইলে লেখা ছিল’Hi Sajid, It has been a while since we last spoke. I hope you are well. I have been good. I am writing this letter to you because I would like to discuss something. I am a devoted Christian and I respect my religion. I am sure you can relate. A few days back, I met with some of my friends, all of whom were atheists. I was not bothered by the fact that they did not believe in God or Jesus, but something they said hurt me immensely. They said that Jesus was a creation of Egyptian mythology and he had never existed. I remember you telling me that Islam also honors Jesus and respects him as one of the Prophets. I was wondering, could you send me some accounts of Jesus Christ’s existence from some (Non-Christians and Non-Muslims) credible sources that will provide evidence that Jesus really did exist in history? You would be happy to learn that I have become more fluent in Bangla now; one of my classmates has been helping me out with it. I am eagerly waiting for your reply. ভেবেছিলাম বাংলাদেশে এসে তােমাকে চমকে দেবাে, কিন্তু লিখতে বসে আর লােভ সামলাতে পারলাম না। তুমি আর আরিফ বেড়াতে এসাে। তােমাদের আমি খুব মিস করি। ভালাে থেকো।Yours,David…’ ডেভিডের মেইলটা পড়ে আমিও চমকে গেলাম। কী রকম ঝরঝরে হাতে বাংলা লিখল সে। সাজিদ বলল-“তাকে এই ব্যাপারে মেইল করছি।’ সাজিদের মেইল লেখা শেষ। কিন্তু মেইলটা দেখার আমারও খুব লােভ হচ্ছিল। তাই আমি সাজিদকে বললাম-সরে দাঁড়া একটু। আমি দেখি। -কী দেখবি?’, সাজিদ জানতে চাইল। -কেন? যা লিখেছিস, তা-ই।’ -কেন দেখবি? আমি কটাক্ষ করে বললাম-“স্যার, আপনার লিখার হাত খুব কাঁচা। আপনি যে-বানানে লিখেন, তা পড়ে সদ্য বাংলা শেখা ডেভিডও হাসতে হাসতে খুন হবে। তাই, অ্যাজ ইওর ফ্রেন্ড, লেখাটার প্রুফ রিডিং করে দেওয়া আমার কর্তব্য। আমার প্রিয় বন্ধুর ভুল বানান দেখে সুদূর আমেরিকায় কেউ হাসাহাসি করবে, ব্যাপারটা আমি মেনে নিতে পারব না। অনেকটা মনমরা, কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম। সাজিদ আমার দিকে তাকিয়ে, মুখ ভেংচিয়ে উঠে পড়ল। আমি ধপাস করে বসে পড়লাম তার চেয়ারে। এরপর লেখাটি ওপেন করলাম। সে যেভাবে লিখেছে, ঠিক সেভাবে পড়া শুরু করলাম – ডেভিড, আজ প্রথম তােমায় বাংলাতে লিখছি। কখনাে তােমায় বাংলায় লিখব, এটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। তুমি বাংলা শিখেছ, এটা আমার জন্য সত্যিই অনেক বড় সারপ্রাইজ। রিয়েলি, আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ ডিয়ার।যাহােক, ধর্মের প্রতি তােমার আগ্রহ আরাে একবার আমাকে বিমুগ্ধ করেছে বন্ধু। তুমি আমার কাছে যিশু (যিনি আমাদের ধর্মে ঈসা আলাইহিস-সালাম নামে পরিচিত) সম্পর্কে জানতে চেয়েছ। জানতে চেয়েছ তাঁর অস্তিত্বের ঐতিহাসিক সত্যতা। কেবল তােমার ধর্মের নয়, আমার ধর্মেরও অন্যতম রাসূল হিসেবে আমারও উচিত এই বিষয়টা পরিষ্কার করা। তবে তার আগে তােমাকে আমার ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপারে দুটো কথা বলে নিই। উনার ব্যাপারে তােমার ধর্মের বিশ্বাস হলােএক: যিশু খ্রিষ্ট ঈশ্বরের পুত্র এবং তিনি নিজে ‘তিন ঈশ্বর’-এর একজন। দুই: উনাকে ইহুদিরা ক্রুশবিদ্ধ করে মেরে ফেলেছে এবং তিনি মৃত অবস্থা থেকে আবার জীবিত হন। আমার ধর্মবিশ্বাস তােমার এই দুটো বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিপরীত। আমার ধর্মবিশ্বাস হলােএক: উনি আল্লাহর পুত্র নন। আল্লাহর না কোনাে সন্তান আছে, না কেউ আল্লাহকে জন্ম দিয়েছে। দুই: উনাকে মােটেও ক্রুশবিদ্ধ করা হয়নি। যখনি ক্রুশবিদ্ধ করার জন্য জনৈক ইহুদি উনার ঘরে প্রবেশ করে, তখন আল্লাহ তাঁর কুদরতে উনাকে চতুর্থ আসমানে তুলে নেন এবং যে-লােক উনাকে ক্রুশবিদ্ধ করতে ঘরে প্রবেশ করে, আল্লাহ ঐ লােকের চেহারাকে অবিকল ঈসা (আঃ)-এর মতাে করে দেন। ফলে, উনাকে হত্যা করতে আসা ইহুদিরা বিভ্রান্ত হয়ে যায় এবং তারা তাদেরই লােককে ঈসা (আঃ) ভেবে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করে। কাজেই ঈসা (আঃ) ক্রুশবিদ্ধ হননি। এটা আমাদের কোরআনের সাক্ষ্য; আর এটাই আমাদের বিশ্বাস। সে যাহােক, তােমাকে যিশু খ্রিষ্ট, আই মিন ঈসা (আঃ)-এর ঐতিহাসিক সত্যতা সম্পর্কে ননক্রিস্টিয়ান সাের্স থেকে বলতে গেলে আমাকে উনার ক্রুশবিদ্ধ হওয়া ব্যাপারটাকেও সামনে আনতে হবে। অর্থাৎ, আমার বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে গিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তােমার এবং ইহুদিদের বিশ্বাসের সাথে মিলিয়ে আমাকে দেখাতে হবে যে, যিশু খ্রিষ্ট ক্রুশবিদ্ধ হয়েছেন। এটা আমি করব কেবল উনার অস্তিত্বের ঐতিহাসিক সত্যতা নির্ণয়ে। জেনে রেখাে: এটা আমার বিশ্বাস নয়। এবার প্রসঙ্গে আসি। ইসলামিক সাের্স এবং ক্রিস্টিয়ান সাের্সের বাইরে গিয়েও আসলে ঈসা (আঃ)-এর অস্তিত্ব নির্ণয় করা যায়। ঈসা (আঃ)-এর জন্মের পর থেকে একটি নতুন নামে ক্যালেন্ডার ইয়ারের সময় হিসাব করা হয়। উনার জন্মের আগের সময়কে ধরা হয় ‘B.C’ হিসেবে। ‘B.C’ মানে ‘Before Christ’। উনার জন্মের আগের সময়টাকে ‘Before Christ’ নামে ধরা হতাে। উনার জন্মের পরে ‘Before Christ’ বা ‘B.C’ এর বদলে চালু হয় ‘A.D’ বা ‘Anno Domini’। এই ‘Anno Domini’ শব্দদ্বয় ‘Medieval Latin’ থেকে এসেছে যার অর্থ-‘In the time of our Lord’। এটার সােজা বাংলা হলাে ‘ঈসা আঃ-এর সময়কাল হতে। অর্থাৎ, উনার জন্মের পর থেকে সময়টা ‘In the time of our Lord’ বা ‘Medieval Latin’ অনুযায়ী ‘A.D’ হিসেবে ধরা হয়। এখন আমাদের দেখতে হবে, এই ‘A.D’ টাইম স্কেলের শুরুর দিকের এমন কোনাে সাের্স আছে কিনা যা ঈসা (আঃ)-এর অস্তিত্বের ব্যাপারে আমাদের কোনাে ইঙ্গিত দিতে পারে? হ্যাঁ, ইঙ্গিত আছে। ইতিহাস থেকে আমরা রােমান সম্রাট ‘নিরাে’-র ব্যাপারে জানতে পারি। নিরাে ছিলেন পঞ্চম রােমান সম্রাট। উনার রাজত্বকাল স্থায়ী হয়েছিল ৫৪ ‘A.D’ থেকে ৬৮ ‘A.D’ পর্যন্ত। তাহলে বুঝাই যাচ্ছে উনি যিশুর জন্মের ৫৪-৬৮ বছরের মধ্যকার সময়ে রােমান সাম্রাজ্যের সম্রাট ছিলেন। উনার সময়ে একবার রােম শহরে ভয়ঙ্কর আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এই আগুনে রােম শহরের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই আগুনের খবর ইতিহাস বিখ্যাত। তখন খ্রিষ্ট ধর্ম একেবারে শুরুর পর্যায়ে এবং রােমে তখন ছিল ইহুদিদের বসবাস। তথাপি, রােমে ছন্নছাড়া। অবস্থায় কিছু খ্রিষ্টান বসবাস করত বলে জানা যায়। খ্রিষ্টানরা তখন রােমে একেবারে নগণ্য হলেও তাদের ব্যাপারে ইহুদিরা সম্পূর্ণ জ্ঞাত ছিল। অর্থাৎ, খ্রিষ্টানরা কোনাে ইশ্বরের পূজো করে, তাদের ধর্ম কোথায়, কীভাবে উৎপত্তি লাভ করে ইত্যাদি ব্যাপারে ইহুদিরা ওয়াকিবহাল ছিল। রােমের সেই ঐতিহাসিক দাবানলের জন্য তখন রােমবাসীরা সম্রাট নিরােকেই দোষারােপ করে। কিন্তু সম্রাট নিরাে নিজের ঘাড়ে দোষ না নিয়ে এই দোষ রােমের সংখ্যালঘু খ্রিষ্টানদের উপর চাপিয়ে দেয়। সম্রাট নিরাের সময়কালের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ছিলেন Senator Tacitus। তিনি তার সবচেয়ে সফল বই ‘Annals’-এ এই আগুন এবং নিরাের প্রতি অভিযােগের চিত্র তুলে ধরেন এভাবেNero fastened the guilt… on a class hated for their abominations, called Christians by the populace. Christus, from whom the name had its origin, suffered the extreme penalty during the reign of Tiberius at the hands of… Pontius Pilatus…’ Tacitus এই মন্তব্য করেছিল যিশুর জন্মের ৫০ বছরের মধ্যেই এবং তিনি সম্পষ্টরূপে তিনটি ব্যাপার এখানে তুলে ধরেছেনএকঃ নিরাে তার উপর আরােপিত দোষ এমন কিছু লােকের উপর চাপিয়ে দিল যারা ‘Christian’ নামে পরিচিত। দইঃ এই ‘Christian’ নামটি এসেছে ‘Christus’ নামক কোনাে এক ব্যক্তি থেকে। ‘Christus’ একটি ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ ‘Christ’। তিনঃ এই Christ নামের ব্যক্তিকে ‘Extrme Penalty’ বা ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়। চারঃ এই ব্যক্তিকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয় রাজা Tiberius-এর সময়কালে যা। বাইবেলে উল্লিখিত যিশু খ্রিষ্টের জন্ম সালের সাথে ম্যাচ করে। Tacitus কোনাে খ্রিষ্টান ছিলেন না। তিনি ছিলেন Jews বা ইহুদি। তিনি তার এই ঐতিহাসিক বইতে রােমান সম্রাট নিরাের সময়কালের আগুন লাগার ব্যাপারটা তুলে ধরতে গিয়ে যিশু তথা ঈসা (আঃ) এবং তাঁর নামানুসারে প্রচলিত হওয়া ধর্মের ব্যাপারে ইঙ্গিত করেছেন। এখান থেকেই আমরা সুস্পষ্টরূপে বলতে পারি যে, যিশু তথা ঈসা (আঃ) কোনাে Mythical Figure নন, তিনি Historical Figure. খ্রিষ্টান ইতিহাসবিদ ‘Edwin Yamauchi’ Tacitus এর এই উদ্ধৃতিকে যিশু খ্রিষ্টের অস্তিত্বের ব্যাপারে সবচেয়ে গ্রহণযােগ্য, নির্ভরশীল নন-ক্রিস্টিয়ান সাের্স বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন এভাবে-‘Probably the most important reference to Jesus outside the New Testaments.’ আরও একজন রােমান সম্রাটের সময়কাল থেকে যিশু খ্রিষ্টের অস্তিত্বের ব্যাপারে জানা যায়। তিনি হলেন Pliny the Younger! বর্তমান তুরস্ক তখন রােমান সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। সেখানকার (বর্তমান তুরস্কের) রাজ্য পরিচালনা করছিলেন তখন Pliny the Younger. সময় তখন ১১২ A.D। তখন মূল রােমান সম্রাট ছিল সম্রাট Trajan। ম্রাট Trajan-কে সম্রাট Pliny একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে খ্রিষ্টান এবং যিশু খ্রিষ্টের ব্যাপারে উল্লেখ পাওয়া যায়। চিঠিতে তিনি লিখেন”They were in the habit of meeting on a certain fixed day before it was light, when they sang in alternate verses a hymn to Christ, as to a god, and bound themselves by a solemn oath, not to any wicked deeds, but never to commit any fraud, theft or adultery, never to falsify their word, nor deny a trust when they should be called upon to deliver it up; after which it was their custom to separate, and then reassemble to partake of food – but food of an ordinary and innocent kind.’ Pliny-র চিঠি থেকে কিছু স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় খ্রিষ্টানদের ব্যাপারে। এক: খ্রিষ্টানরা নির্দিষ্ট একটা দিনে প্রার্থনার জন্য একত্রিত হতাে। দুই: লক্ষণীয় ব্যাপার, বলা হচ্ছে তারা Christ নামের এক ব্যক্তির প্রার্থনা করে যাকে ইন্ডিকেট করা হচ্ছে ‘As to God’ হিসেবে। এখান থেকে স্পষ্ট, Christ এমন একজন, যিনি মানুষ ছিলেন, একই সাথে ঈশ্বরও (যেহেতু খ্রিষ্টানরা যিশুকে ঈশ্বর জ্ঞান করত)। Pliny-র এই চিঠি থেকে ১১২ A.D এর দিকে আমরা যিশু খ্রিষ্টের অস্তিত্বের ব্যাপারে জানতে পারি, যা যিশু খ্রিষ্টের জন্মের ১০০ বছরের মধ্যে লেখা হয়। তাছাড়াও, খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে Josephus নামের এক ইহুদির লেখা ‘Jewish Antiquities’ নামের বইতেও যিশু খ্রিষ্টের ব্যাপারে উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি তাঁর বই ‘Jewish Antiquities’ এ লিখেছেন-‘About this time, there lived Jessus, a wise man.’ খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে, Lucian নামের একজন খ্রিষ্ট ধর্মের সমালােচক, যিনি একজন Jewish ছিলেন, তিনি খ্রিষ্টানদের সমালােচনা করতে গিয়ে লিখেন’The Christians… worship a man to this day-the distinguished personage who introduced their novel rites, and was crucified on that account… [lt] was impressed on them by their original lawgiver that they are all brothers, from the moment that they are converted, and deny the gods of Greece, and worship the crucified sage, and live after his laws.’ Lucian স্পষ্টই বলেছেন, খ্রিষ্টানরা এমন একজনকে ঈশ্বর জ্ঞান করছে যে কিছু মহৎ বাক্য দিয়ে তাদের মােহিত করেছে এবং পরে ক্রুশবিদ্ধ হয়েছে। এখান থেকেই আমরা খ্রিষ্টীয় শতকের প্রথম দিক থেকেই যিশু খ্রিষ্ট তথা ঈসা (আঃ)-এরঅস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারি। তিনি যে কোনাে কাল্পনিক’ ফিগার নন-বরং ‘ঐতিহাসিক ফিগার, তা প্রমাণের জন্য এসবই যথেষ্ট। যারা বলে যিশু তথা ঈসা (আঃ) একজন ‘Mythical Figure’, তাদের কাছে দাবির সপক্ষে কিছু গালগল্প ছাড়া আর কোনাে প্রমাণ নেই। ও হ্যাঁ, ডেভিড, যারা তােমাকে বলেছে যিশু একজন ‘Mythical Figure’, আই মিন তােমার এথেইস্ট বন্ধুরা, তারা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলােচিত এথেইস্ট রিচার্ড ডকিন্সের কথাকে দৈববাণীর মতাে বিশ্বাস করে, তাই না?মজার ব্যাপার কি জানাে? এই রিচার্ড ডকিন্সও John Lennox-এর সাথে এক বিতর্কে স্বীকার করেছে যিশু খ্রিষ্ট একজন Historical Figure. তিনি বলেন-‘I think, Jessus existed’ আমি মনে করি, নাস্তিকদের যিশু তথা ঈসা (আঃ)-এর অস্তিত্বের ব্যাপারে নাস্তিকদের জবাব দেওয়ার জন্য রিচার্ড ডকিন্সের এই উদ্ধৃতিটিই এনাফ। আমাকে নিয়মিত লিখবে। আর, তুমিও আবার বেরাতে এসাে। আর হ্যাঁ, বাংলা রপ্ত করার জন্য আবারও তােমায় অভিনন্দন বন্ধু। ভালাে থেকো। তােমার প্রিয় সাজিদমেইল পুরােটা পড়লাম। ইতােমধ্যেই স্লাজিদ গােসল শেষ করে এসে গেছে। আমার পাশে এসে বলল: কি রে, আমেরিকায় বেড়াতে যাবি? আমি কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে বলল: কী হলাে তাের? আমি আমতা আমতা করে বললাম, ডেভিড কি এখনাে তােমাকে বলে নাকি ‘টোমাকে বলে জানিস? সাজিদ হা হা হা করে হেসে উঠল। অনেকদিন পর তাকে আমি এভাবে হাসতে দেখলাম।রেফারেন্স :Edwin Yamauchi, quoted in Lee Strobel, The Case for Christ (Grand Rapids, Michigan: Zondervan Publishing House, 1998) Tacitus, Annals 15.44, cited in Strobel, The Case for Christ, N.D. Anderson, Christianity: The Witness of History (London: Tyndale, 1969), 19, cited in Gary R. Habermas The Historical Jesus (Joplin, Missouri: College Press Publishing Company, 1996, 189N190. Edwin Yamauchi, cited in Strobel, The Case for Christ, 82. Pliny, Epistles x. 96, cited in Bruce,Christian Origins, 25; Habermas, The Historical Jesus 198. Pliny, Letters, transl. by William Melmoth, rev. by W.MI. Hutchinson (Cambridge: Harvard Univ. Press, 1935). vol. I X:96, cited in Habermas The Historical Jesus, Page 199 M. Harris, “References to Jesus in Early Classical Authors, in Gospel Perspectives V, 354-55, cited in E. Yamauchi, ‘Jesus Outside the New Testament: What is the Evidence?, in Jesus Under Fire, ed. by Michael J. Wilkins and J.P. Moreland (Grand Rapids, Michigan: Zondervan Publishing House, 1995), p. 227, note 66. Habermas, The Historical Jesus, 199. Bruce, Christian Origins, 28. Josephus, Antiquities xx. 200 , Cited in Bruce, Christian Origins, 36. Yamauchi-Jesus Outside the New Testament’ Page 212. ‘Josephus, Antiquities 18.63-64, cited in YamauchiJesus Outside the New Testament’, Page 212.

⭐ কোরআন, আকাশ, ছাদ এবং একজন ব্যক্তির মিথ্যাচার।

মফিজুর রহমান স্যার সাজিদের দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাকানাের ভঙ্গি এরকম-বাছা! আজকে তােমাকে পেয়েছি! আজ তােমার বারােটাবাজাতে পারলে আমার নামও মফিজ না।’ সাজিদ মাথা নিচু করে ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বিশ মিনিট দেরি করে ফেলেছে ক্লাসে আসতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ মিনিট দেরি করে ক্লাসে আসা এমন কোনাে গুরুতর পাপ কাজ নয় যে এর জন্য তার দিকে এভাবে তাকাতে হবে। সাজিদ সবিনয়ে বলল- স্যার, আসব? মফিজুর রহমান স্যার অত্যন্ত গুরু গম্ভীর গলায় বললেন-হু। এমনভাবে বললেন, যেন সাজিদকে দু-চার কথা শুনিয়ে দরজা থেকে খেদিয়ে পাঠিয়ে দিতে পারলেই উনার গা জুড়ােয়।। সাজিদ ক্লাসরুমে এসে বসল । লেকচারের বেশ অর্ধেকটা শেষ হয়ে গেছে। মফিজুর রহমান স্যার আর পাঁচ মিনিট লেকচার দিয়ে ক্লাস সমাপ্ত করলেন। সাজিদের কপালে যে আজ খুবই খারাপ কিছু আছে সেটা সে প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছে। মফিজুর রহমান স্যার সাজিদকে দাঁড় করালেন। খুব স্বাভাবিক চেহারায়, হাসি হাসি মুখ করে বললেন-সাজিদ, কেমন আছাে? সাজিদ প্রায় ভূত দেখার মতাে চমকে উঠল। এই মুহূর্তে সে যদি সত্যি সত্যিই ডুমুরের ফুল অথবা ঘােড়ার ডিম জাতীয় কিছু দেখত, হয়তাে এতটা চমকাত না। মিরাকল জিনিসটায় তার বিশ্বাস আছে, তবে মফিজুর রহমান স্যারের এই আচরণ তার কাছে তার চেয়েও বেশি কিছু মনে হচ্ছে। এই ভদ্রলােক এত সুন্দর করে, এরকম হাসিমুখ নিয়ে কারও সাথে কথা বলতে পারে, এটাই এতদিন একটা রহস্য ছিল। সাজিদ নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে বলল-“জ্বি স্যার, ভালাে আছি আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি কেমন আছেন? তিনি আবারও একটি মুচকি হাসি দিলেন। সাজিদ পুনরায় অবাক হলাে। মনে হচ্ছে সে কোনাে দিবাস্বপ্নে বিভাের আছে। স্বপ্নের একটা ক্রাইটেরিয়া হচ্ছে, স্বপ্নে বেশিরভাগ সময় নেগেটিভ জিনিসকে পজিটিভ আর পজিটিভ জিনিসকে নেগেটিভ ভাবে দেখা যায়। মফিজুর রহমান স্যারকে নিয়ে তার মাত্রাতিরিক্ত নেগেটিভ চিন্তা থেকেই হয়তাে এরকম হচ্ছে। একটু পরে সে হয়তাে দেখবে, এই ভদ্রলােক তার দিকে রাগিরাগি চেহারায় তাকিয়ে আছে এবং বলছে-অ্যাই ছেলে? এত দেরি করে ক্লাসে কেন এসেছ? তুমি জানাে আমি তােমার নামে ডিন স্যারের কাছে কমপ্লেইন করে দিতে পারি? আর কোনােদিন যদি দেরি করেছ…’ সাজিদের চিন্তায় ছেদ পড়ল। তার সামনে দাঁড়ানাে হালকা-পাতলা গড়নের মফিজুর রহমান নামের ভদ্রলােকটি বললেন-“আমিও খুব ভালাে আছি। ভদ্রলােকের মুখে হাসির রেখাটা তখনও স্পষ্ট। মফিজুর রহমান স্যার সাজিদকে বললেন-“আচ্ছা বাবা আইনস্টাইন, তুমি কি বিশ্বাস করাে আকাশ বলে কিছু আছে? সাজিদ এবার নিশ্চিত হলাে যে, এটা কোনাে স্বপ্নদৃশ্য নয়। মফিজুর রহমান স্যার তাচ্ছিল্যভরে সাজিদকে আইনস্টাইন’ বলে ডাকে। সাজিদকে যখন আইনস্টাইন বলে, তখন ক্লাসের অনেকে খিলখিল করে হেসে উঠে । এই মুহূর্তে সাজিদ একটি চাপা হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছে। তাহলে এটা কোনাে স্বপ্নদৃশ্য নয়। বাস্তব। সাজিদ বলল-“জ্বি স্যার, বিশ্বাস করি।’ ভদ্রলােক আরেকটি মুচকি হাসি দিলেন। উনি আজকে হাসতে হাসতে দিন কেটে পার করে দেওয়ার পণ করেছেন কিনা কে জানে। তিনি বললেন-“বাবা আইনস্টাইন, আদতে আকাশ বলে কিছুই নেই। আমরা যেটাকে আকাশ বলি, সেটা হচ্ছে আমাদের দৃষ্টির প্রান্তসীমা। মাথার উপরে নীলরঙা যে-জিনিস দেখতে পাও, সেটাকে মূলত বায়ুমণ্ডলের কারণেই নীল দেখায়। চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই বলে চাঁদে আকাশকে কালাে দেখায়। বুঝতে পেরেছেন মহামতি আইনস্টাইন? স্যারের কথা শুনে ক্লাসের কিছু অংশ আবার হাসাহাসি শুরু করল। স্যার আবার বললেন-“তাহলে বুঝলে তাে আকাশ বলে যে কিছুই নেই? সাজিদ কিছুই বলল না। চুপ করে আছে। স্যার বললেন-“গতরাতে হয়েছে কি জাননা? নেট সার্চ দিয়ে একটি ব্লগ সাইটের ঠিকানা পেলাম। মুক্তমনা ব্লগ নামে। রবিজিৎ নামে এক ব্লগারের লেখা পেলাম সেখানে। খুব ভালাে লেখে দেখলাম। যাহােক, রবিজিৎ নামের এই লােকটা কোরআনের কিছু বাণী উদ্ধৃত করে দেখাল কত উদ্ভট এসব জিনিস। সেখানে আকাশ নিয়ে কী বলা আছে শুনতে চাও?সাজিদ এবারও কিছু বলল না। চুপ করে আছে। স্যার বললেন, কোরআনে বলা আছে“আর আমরা আকাশকে করেছি সুরক্ষিত ছাদ। অথচ, তারা আমাদের নিদর্শনাবলি থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। ‘And we made the sky a protected ceiling, but they, from its signs, are turning away. Al-Ambia: 32′ দেখলে তাে বাবা আইনস্টাইন, তােমাদের আল্লাহ বলেছে, আকাশ নাকি সুরক্ষিত ছাদ। তা বাবা, এই ছাদে যাবার কোনাে সিঁড়ির সন্ধান কোরআনে আছে। কি? হা হা হা হা।’ চুপ করে থাকতে পারলে বেশ হতাে। কিন্তু লােকটির মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়িতে সাজিদ মুখ খুলতে বাধ্য হলাে। সে বলল- স্যার, আপনার সেই ব্লগার রবিজিৎ আর আপনার প্রথম ভুল হচ্ছে, আকাশ নিয়ে আপনাদের দুজনের ধারণা মােটেও পরিষ্কার নয়। -ও, তাই নাকি? তা আকাশ নিয়ে পরিষ্কার ধারণাটি কি বলাে শুনি?’, অবজ্ঞা ভরে লােকটির প্রশ্ন। সাজিদ বলল-স্যার, আকাশ নিয়ে ইংরেজি অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে বলা আছে, ‘The region of the atmosphere and outer space seen from the earth’, অর্থাৎ, পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে বায়ুণ্ডলের এবং তার বাইরে যা কিছু দেখা যায়, সেটাই আকাশ। আকাশ নিয়ে আরও পরিষ্কার বলা আছে উইকিপিডিয়াতে; যদিও উইকপিডিয়ার তথ্য মূল সসার্স নয়। আপনি নেট ঘেঁটে মুক্তমনা ব্লগ অবধি যেতে পেরেছেন, আরেকটু এগিয়ে উইকিপিডিয়া অবধি গেলেই পারতেন। যাহােক, আকাশ নিয়ে উইকিপিডিয়াতে বলা আছে-“The sky (or celestial dome) is everything that lies above the surface of the Earth, including the atmosphere and outer space’ অর্থাৎ, পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের উপরে যা কিছু আছে, তার সবই আকাশের অন্তর্গত। এর মধ্যে বায়ুমণ্ডল এবং তার বাইরের সবকিছুও আকাশের মধ্যে পড়ে। -হু, তাে? -এটা হচ্ছে আকাশের সাধারণ ধারণা। এখন আপনার সেই আয়াতে ফিরে আসি। ‘আপনি কোরআন থেকে উল্লেখ করেছেনআর আমরা আকাশকে করেছি সুরক্ষিত ছাদ। অথচ, তারা আমাদের নিদর্শনাবলি থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। ‘আপনি বলেছেন, আকাশ কীভাবে ছাদ হয়, তাই না? স্যার, বিংশ শতাব্দীতে বসে বিজ্ঞান জানা কিছু লােক যদি এরকম প্রশ্ন করে, তাহলে আমাদের উচিত বিজ্ঞান চর্চা বাদ দিয়ে গুহার জীবনযাপনে ফিরে যাওয়া। -‘What do you mean?’ -বলছি স্যার। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর উপরিভাগে যে-বায়ুমণ্ডল আছে, তাতে কিছু স্তরের সন্ধান পেয়েছেন। আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এসব পুরু স্তর দ্বারা গঠিত। এই স্তরগুলাে হচ্ছে: এক: ট্রপােস্ফিয়ার দুই: স্ট্রাটোস্ফিয়ার তিন: মেসােস্ফিয়ার চার: থার্মোস্ফিয়ার পাঁচ: এক্সোস্ফিয়ার। ‘এই প্রত্যেকটি স্তরের আলাদা আলাদা কাজ রয়েছে। আপনি কি জানেন, বিজ্ঞানী Sir Venn Allen প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, আমাদের পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের চারদিকে একটি শক্তিশালী Magnetic Field আছে। এই ম্যাগনেটিক ফিল্ড আমাদের পৃথিবীপৃষ্ঠের চারদিকে একটি বেল্টের মতাে বলয় সৃষ্টি করে রেখেছে। বিজ্ঞানী স্যার Venn Allen-এর নামে এ জিনিসটার নাম রাখা হয় Venn Allen Belt. ‘এই বেল্ট চারপাশে ঘিরে রেখেছে আমাদের বায়ুমণ্ডলকে। আমাদের বায়ুমন্ডলের দ্বিতীয় স্তরটির নাম হচ্ছে স্ট্রাটোস্ফিয়ার।’ এই স্তরের মধ্যে আছে এক জাদুকরি উপস্তর। এই উপস্তরের নাম হলাে ওজোন স্তর। ‘এই ওজোন স্তরের কাজের কথায় পরে আসছি। আগে একটু সূর্যের কথা বলি। সূর্যে প্রতি সেকেন্ডে যে-বিস্ফোরণগুলাে হয়, তা আমাদের চিন্তা-কল্পনারও বাইরে। এই বিস্ফোরণগুলাের ক্ষুদ্র একটি বিস্ফোরণের তেজস্ক্রিয়তা এমন যে, তা জাপানের হিরােশিমায় যে-অ্যাটমিক বােমা ফেলা হয়েছিল, সেরকম দশ হাজার বিলিয়ন অ্যাটমিক বােমার সমান। চিন্তা করুন স্যার, সেই বিস্ফোরণগুলাের একটু আচ যদি পৃথিবীতে লাগে, পৃথিবীর কী অবস্থা হতে পারে? ‘এখানেই শেষ নয়। মহাকাশে প্রতি সেকেন্ডে নিক্ষিপ্ত হয় মারাত্মক তেজস্ক্রিয় উল্কাপিণ্ড। এগুলাের একটি আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে পৃথিবী।‘আপনি জানেন আমাদের এই পৃথিবীকে এরকম বিপদের হাত থেকে কোনাে জিনিসটা রক্ষা করে? সেটা হচ্ছে আমাদের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল। আরও স্পেসিফিকলি বলতে গেলে বলতে হয়, ওজোন স্তর। ‘শুধু তাই নয়, সূর্য থেকে যে-ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি আর গামা রশ্মি পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে, সেগুলাে যদি পৃথিবীতে প্রবেশ করতে পারত, তাহলে পৃথিবীতে কোনাে প্রাণীই বেঁচে থাকতে পারত না। এই অতিবেগুনি রশ্মির ফলে মানুষের শরীরে দেখা দিত চর্ম ক্যান্সার। উদ্ভিদের সালােকসংশ্লেষণ হতাে না। আপনি জানেন, সূর্য থেকে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা এসব ক্ষতিকর জিনিসকে কোন জিনিসটা আটকে দেয়? পৃথিবীতে ঢুকতে দেয় না? সেটা হলাে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর। এই ওজোন স্তর এসব ক্ষতিকর উপাদানকে স্ক্যানিং করে পৃথিবীতে প্রবেশে বাধা দেয়। মজার ব্যাপার কি জানেন? এই ওজোন স্তর সূর্য থেকে আসা কেবল সেসব উপাদানকেই পৃথিবীতে প্রবেশ করতে দেয়, যেগুলাে পৃথিবীতে প্রাণের জন্য সহায়ক। যেমন, বেতার তরঙ্গ আর সূর্যের উপকারী রশ্মি। এখানেই শেষ নয়। পৃথিবীর অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় যে-তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়, তার সবটাই যদি মহাকাশে বিলীন হয়ে যেত, তাহলে রাতের বেলা পুরাে পৃথিবী ঠাণ্ডা বরফে পরিণত হয়ে যেত। মানুষ আর উদ্ভিদ বাঁচতেই পারত না। কিন্তু, ওজোন স্তর সব কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে মহাকাশে ফিরে যেতে দেয় না। কিছু কার্বন-ডাইঅক্সাইডকে সে ধরে রাখে যাতে পৃথিবী তাপ হারিয়ে একেবারে ঠাণ্ডা বরফ শীতলহয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা এটাকে গ্রিন হাউজ বলে। স্যার, বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরের এই যে ফর্মুলা, কাজ, এটা কি আমাদের পৃথিবীকে সূর্যের বিস্ফোরিত গ্যাস, সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি, মহাকাশীয় উল্কাপিণ্ড থেকে ‘ছাদ’-এর মতাে রক্ষা করছে না? আপনার বাসায় বৃষ্টির পানি প্রবেশ করতে পারে না আপনার বাসার ছাদের জন্য। বিভিন্ন দুর্যোগে আপনার বাসার ছাদ যেমন আপনাকে রক্ষা করছে, ঠিক সেভাবে বায়ুমণ্ডলের এই ওজোন স্তর কি আমাদের পৃথিবীকে রক্ষা করছে না? ‘আমরা আকাশের সংজ্ঞা থেকে জানলাম যে, পৃথিবীপৃষ্ঠ হতে উপরের সবকিছুই আকাশের মধ্যে পড়ে। বায়ুমণ্ডলও তাে তাহলে আকাশের মধ্যে পড়ে এবং আকাশের সংজ্ঞায় বায়ুমণ্ডলের কথা আলাদা করেই বলা আছে। ‘তাহলে বায়ুমণ্ডলের এই যে আশ্চর্য রকম প্রটেক্টিং পাওয়ার, এটার উল্লেখ করে যদি আল্লাহ বলেনআর আমরা আকাশকে করেছি সুরক্ষিত ছাদ। অথচ, তারা আমাদের নিদর্শনাবলি থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে।‘তাহলে স্যার ভুলটা কোথায় বলেছে? বিজ্ঞান তাে নিজেই বলছে, বায়ুমণ্ডল, স্পেশালি বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর একটি ছাদের ন্যায় পৃথিবীকে রক্ষা করছে। তাহলে আল্লাহ্ও যদি একই কথা বলে, তাহলে সেটা অবৈজ্ঞানিক হবে কেন? ‘আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, আপনার সেই রবিজিৎ রায় বিজ্ঞান কম বুঝেন সম্ভবত। উনাদের কাজ সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরও মনগড়া কথা লিখে কোরআনের ভুল ধরা। কথাগুলাে বলে সাজিদ থামল। পুরাে ক্লাসে সে এতক্ষণ ধরে একটা লেকচার দিয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে। তাকে আইনস্টাইন বলায় যারা খলখল করে হাসত, তাদের চেহারাগুলাে হয়েছে দেখার মতাে। মফিজুর রহমান স্যার কিছুই বললেন না। ‘See you next’ বলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন সেদিন।

⭐ আয়িশা (রাঃ) ও মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর বিয়েএবং কথিত নাস্তিকদের কানাঘুষা।

আমরা চারজন বসে টিএসসি তে আড্ডা দিচ্ছিলাম। রাকিব, শাহরিয়ার, সাজিদ আর আমি। আমাদের মধ্যে শাহরিয়ার হলাে খেলাপ্রেমিক। ফুটবল ক্লাব বার্সেলােনার চরম ভক্ত। কেউ পুরাে সপ্তাহে কোনাে ম্যাচ না দেখে শাহরিয়ারের কাছে আধঘণ্টা বসলেই হবে। শাহরিয়ার পুরাে সপ্তাহের খেলার আদ্যোপান্ত তাকে কাগজেকলমে বুঝিয়ে দেবে। ইপিএলে কোন দল টপে আছে, ম্যানচেস্টার সিটির দায়িত্ব নিয়ে পেপ গার্দিওলা কী রকম দলটাকে পাল্টে দিল, সিরি আ-তে জুভের অবস্থান কোথায়, ইব্রাকে ছেড়ে দিয়ে ফ্রেঞ্চলিগে পিএসজির অবস্থা কেমন, বুন্দেসলিগাতে বায়ার্ন আর ডর্টমুন্ড কী করছে, লা লিগাতে বার্সা-রিয়ালের দৌড়ে কে এগিয়ে, রােনালদোর ফর্ম নেই কেন, মেসিকে ছাড়া বার্সা সামনের ম্যাচগুলা উতরে যেতে পারবে কি না, নেইমার সেরা না বেল, সুয়ারেজ নাকি বেনজেমা ইত্যাদি ইত্যাদি বিশ্লেষণের জন্য শাহরিয়ারের জুড়ি নেই। এত কঠিন কঠিন স্প্যানিশ, জার্মেইন, ফ্রেঞ্চ আর ইতালির নামগুলাে সে কীভাবে যে মনে রাখে আল্লাহ মালুম। খেলার খবর বলতে শুরু করলে তার আর থামাথামি নেই। ননস্টপ বলে যেতে পারে। এজন্যে আমাদের বন্ধুমহলে শাহরিয়ার স্পাের্টস চ্যানেল নামে পরিচিত। রাকিব হলাে আগাগােড়া পলিটিক্স স্পেশালিস্ট। দুনিয়ার রাজনীতি কখন কোথায় কীভাবে মােড় নিচ্ছে তার সমস্ত রকম আপডেট থাকে রাকিবের কাছে। গুলির মুখ থেকে ট্রাম্পের বেঁচে আসা থেকে শুরু করে হিলারির ম্যালেরিয়া পর্যন্ত সব খবর তার নখদর্পণে। তবে, ইদানিং সে ব্যস্ত ‘পাক-ভারত যুদ্ধ নিয়ে। কাশ্মীরের উরিতে হামলা নিয়ে পাক-ভারতের মধ্যে যে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব বিরাজ করছে, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই যাচ্ছে সে। রাকিব মনে করছে, উরির হামলাটা আসলে ভারতের একটি ব্লাইন্ড গেম’। এটা নিয়ে চলমান ব্রিফিঙের মাঝখানে হঠাৎ নিলয়দার আগমন। নিলয়দা আমাদের চেয়ে সিনিয়র মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র। আমাদের চেয়ে ঢের সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সাথে তার বন্ধুত্বসুলভ আচরণ দেখে বােঝার উপায় নেই যে, নিলয়দা এত সিনিয়র লেভেলের কেউ।তার হাতে একটি পত্রিকা। পত্রিকা হাতে নিলয়দা আমাদের পাশে এসে বেঞ্চে বসল। নিলয়দাকে দেখে সাজিদ আরেক কাপ রঙ চা-র অর্ডার করল। চা চলে এলে নিলয়দা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল-বাকস্বাধীনতার মূল্য পৃথিবীর কোথাও নেই, বুঝলি? কোত্থাও নেই। কথাগুলাে এমনভাবে বলল যে, নিলয়দাকে খুব মর্মাহত দেখাল। নিলয়দা কোন পয়েন্ট থেকে কথাগুলাে বলল তা আমাদের কারও মাথাতে আসেনি তখনও। রাকিব বলে উঠল-নিলয়দা কি পশ্চিমবঙ্গের ধর্মীয় কটুক্তির দায়ে গ্রেফতার হওয়া জনৈক ব্যক্তির কথা বললেন? নিলয়দা রাকিবের কথার প্রত্যুত্তরে কোনকিছু বলল না। তার মানে রাকিবের ধারণা ঠিক। অন্য সময় হলে রাকিবের এরকম উপস্থিত বুদ্ধির বহর দেখে নিলয়দা তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলত সাবাশ। কিন্তু আজ খুব ফ্রাস্টেটেড থাকায় নিলয়দা খুব অফ মুডে আছে বলে মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা খুব শর্টলি ব্যাখ্যা করল রাকিব। পশ্চিমবঙ্গের এক নাস্তিক তরুণ, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে নিয়ে কটুক্তি করার ফলে সাইবার আইনে গ্রেফতার হয়েছে পরশু দিন। এটাকে নিলয়দা বলছে বাকস্বাধীনতার উপর আঘাত। সাজিদ তার চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে বলল-এতে দোষের তাে কিছু দেখছি না দাদা। ছেলেটা দোষ করেছে, সে তার শাস্তি পাচ্ছে। What’s wrong?’ নিলয়দা মুখের রং পরিবর্তন করে বড় বড় চোখে সাজিদের দিকে তাকাল। বলল-একজন পঞ্চাশাের্ধ বুড়া লােক ৯ বছর বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করলে দোষ নেই, তা নিয়ে কথা বললেই দোষ হয়ে যায়, না?’ সাজিদ বলল-কথা বললে তাে দোষ নেই দাদা, কিন্তু অশ্লীল ভাষায় কটুক্তি করাটা দোষের। একটি ধর্মের পবিত্র নবীকে নিয়ে এরকম খিস্তি করাটা মূল্যবােধ বিরােধী তাে বটেই, এটা সংবিধান বিরােধীও। -“গােষ্ঠী কিলাই তােমার এরকম মূল্যবােধ আর সংবিধানের। সাজিদ বুঝল নিলয়দা খুব ক্ষেপে আছে। তাকে সহজে বােঝানাে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। সাজিদ বলল-দাদা, মনে আছে তােমার? আমি তখন সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তােমার সাথেও প্রথম পরিচয় হয় তখন। এক সন্ধ্যায় হুমায়ূন আহমেদের মেয়ের বয়সী শাওনকে বিয়ে করার ব্যাপারটা নিয়ে যখন আপত্তি উঠেছিল, তখন তুমি কি বলেছিলে? তুমি বলেছিলে যে, বিয়ে একটি বৈধ সামাজিক বন্ধন। যখন তাতে দুটি পক্ষের সম্মতি থাকে, তখন সেখানে বয়স, সামাজিক স্ট্যাটাস কোনােকিছুই ম্যাটার করে না। আমি হুমায়ুন আহমেদের বিয়ের ব্যাপারটি নিয়ে কনভিন্স। হুমায়ুন আহমেদ শরিয়া ও রাষ্ট্রীয় আইনসম্মত একটি বৈধ কাজ করেছেন। হুমায়ুন আহমেদের বেলায় যে-কথাগুলাে প্রযােজ্য, সে-কথাগুলাে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বেলায় কেন প্রযােজ্য হবে না? এটা ডাবল স্টান্ডার্ড নয়? নিলয়দা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। এরপর বলল-“তাই বলে বলতে চাচ্ছিস, ৯ বছরের অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে বিয়ে করা বৈধ হয়ে যাবে? সাজিদ হাসল। বলল-দাদা, আমি মােটেও তা বলছি না। আমি প্রথমত বােঝাতে চাইলাম যে, বিয়ে একটা সামাজিক বন্ধন। -তাে? সামাজিক বন্ধন ধরে রাখতে ৯ বছরের কিশােরী বিয়ে করতে হবে নাকি? সাজিদ উঠে দাঁড়াল। আমি জানি এখন সে লেকচার শুরু করবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আয়িশা (রাঃ)-এর বিয়ে নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ লেকচার দেওয়ার জন্য সে মেন্টালি প্রস্তুতি নিচ্ছে। যা ভাবলাম তাই। সাজিদ বলতে শুরু করল‘দাদা, প্রথমে বলে রাখি, যারাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর আয়িশা (রাঃ)-এর বিয়ে নিয়ে আপত্তি তুলে, তাদের প্রথম দাবি: মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নাকি যৌন লালসায় কাতর ছিলেন। সেজন্যে তিনি নাকি কিশােরী আয়িশা (রাঃ)-কে বিয়ে করেছিলেন।। তাদের এই দাবি যে কতটা বাতুলতা আর ভিত্তিহীন, তা ইতিহাস থেকে আমরা দেখব। আমরা জানি, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিয়ে করেছিলেন। ২৫ বছর বয়সে হজরত খাদিজা (রাঃ)-কে। বলাবাহুল্য, যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ২৫ বছরের একজন টগবগে তরুণ, ঠিক সেই সময়ে তিনি বিয়ে করলেন চল্লিশাের্ধ একজন মহিলাকে, যিনি কিনা আবার একজন বিধবা ছিলেন। খাদিজা (রাঃ) যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর কোনাে বিয়ে করেননি। খাদিজা (রাঃ)-এর গর্ভেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিকাংশ সন্তান-সন্তনি জন্মগ্রহণ করেছিল। বলাে তাে দাদা, তােমাদের ভাষায় যিনি একজন। যৌনকাতর মানুষ, তিনি কেন তার পুরাে যৌবনকাল একজন বয়স্ক, বয়ােবৃদ্ধা মহিলার সাথে কাটিয়ে দিলেন?‘তুমি হয়তাে বলবে, খাদিজা (রাঃ)-এর প্রচুর ধন-সম্পত্তি ছিল, পাছে এগুলাে হারানাের ভয়ে হয়তাে তিনি আর বিয়ে করেননি। তােমার জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, এটা ইতিহাস সম্মত যে, সম্পদশালী খাদিজা (রাঃ) নিজেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন; মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম না। তার উপর , খাদিজা (রাঃ) নিজেই যেখানে একজন বিধবা ছিলেন, সেখানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ও যদি সেই অবস্থায় আরেকটি বিয়ে করতে চাইতেন, তাতে বাধা দেওয়ার অধিকার খাদিজা (রাঃ)-এর থাকার কথা নয়। তাহলে এখান থেকে আমরা কী বুঝলাম? আমরা বুঝলাম যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) যৌনকাতরতা থেকে কিশােরী আয়িশা (রাঃ) কে বিয়ে করেননি। নিলয়দা সাজিদের কথার মাঝে প্রশ্ন করল-“তাহলে কিশােরী আয়েশাকে বিয়ে করার হেতু কি? সাজিদ বলল-‘Let me finish please’ । আয়িশা (রাঃ)-কে বিয়ে করার একটা হুকুম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কাছ থেকে পেয়েছিলেন। কারণ জ্ঞানে-গুণে আয়িশা (রাঃ) ছিলেন তৎকালীন আরব কন্যাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তার সেই প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও বিচক্ষণতা যাতে পুরােপুরিভাবে ইসলামের কল্যাণার্থে ব্যবহার করা যায়, সেজন্য হয়তাে এই হুকুম।। স্পাের্টস চ্যানেল শাহরিয়ার এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার সে বলল-“সাজিদ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশা (রাঃ)-কে বিয়ে করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে হুকুমপ্রাপ্ত; এই কথার ভিত্তি কী? সাজিদ শাহরিয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল-নবীদের স্বপ্নও একপ্রকার ওহি, এটা জানিস তাে? -হ্যাঁ।-বুখারির হাদিসে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত আয়িশা (রাঃ)-কে একবার বললেন-“(হে আয়িশা)! আমি তােমাকে দুইবার স্বপ্নে দেখেছিলাম। একটি রেশমের উপরে কার যেন মুখচিহ্ন। আমি যখন রেশমের উপর থেকে আবরণ সরালাম, আমি দেখলাম সেটা তােমার মুখাবয়ব। তখন কেড একজন আমাকে বলল, “(হে মুহাম্মাদ) এটা তােমার স্ত্রী। আমি বললাম, যাদ এটা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নির্ধারিত হয়, তাহলে এটাই হবে। বুখারির এই হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, আয়িশা (রাঃ) যে ন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্ত্রী হবেন, সেটা আল্লাহর থেকেই হুকুমপ্রাপ্ত।শাহরিয়ার আবার বলল-“কিন্তু তুই যে বললি, তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা ইসলামের কল্যাণার্থে ব্যবহারের জন্যই এই হুকুম, তার দলিল কী? সাজিদ বলল-এটা তাে সর্বজনবিদিত সত্য কথা। সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর পর সবচেয়ে বেশি যিনি হাদিস মুখস্থ করেছিলেন, তিনি হজরত আয়িশা (রাঃ)। শুধু তাই নয়, আয়িশা (রাঃ)-এর ছিল কোরআনের অগাধ পাণ্ডিত্য ।। এমনকি বড় বড় সাহাবিরা পর্যন্ত তাঁর কাছে ফতােয়ার জন্য আসতেন। তাঁর ফিকহি জ্ঞান অনেক বেশি ছিল। আবু মূসা আল আশআরি (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন-এমন কখনাে হয়নি (ফিকহি বিষয়ে) আমরা কোনােকিছুর সমাধানের জন্য আয়িশা (রাঃ)-এর কাছে গেলাম কিন্তু সন্তোষজনক উত্তর পাইনি।’ অর্থাৎ, আয়িশা (রাঃ)-এর এই যে জ্ঞান, প্রজ্ঞা-এর জন্য তিনি আল্লাহ কর্তৃক উম্মুল মুমিনীন হিসেবে সিলেক্টেড হয়ে যান। ‘এছাড়াও, তৎকালীন আরবে অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। তখনকার প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। এটা ঠিক, যুগের সাথে সাথে সেটা পাল্টিয়েছে। এখন মেয়েদের অনেক চিন্তাঃ ক্যারিয়ার গড়াে, পড়াশােনা করাে, বিদেশ যাও, উচ্চ ডিগ্রির সার্টিফিকেট নাও।। ‘তখন আরবের মেয়েদের চাকরি করার দরকার হয়নি, বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়ার রীতিও তখন ছিল না। ঘরােয়া পরিবেশে তারা ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করত। এর জন্য, কম বয়সেই তাদের বিয়ের রীতি ছিল। ‘তখন মেয়েদের কম বয়সেই যে বিয়ের রীতি ছিল, তা আয়িশা (রাঃ)-এর জীবনের আরেকটি ঘটনা থেকেই বােঝা যায়। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে বিয়ের আগে আয়িশা (রাঃ)-এর আরেকজনের সাথে বিয়ে ঠিক হয়। তার নাম ছিল জুবায়ের। কিন্তু, আবু বকর (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করায় বিয়েটা ভেঙে যায়। এর থেকে কী প্রমাণ হয় না, তখন মেয়েদের কম বয়সেই বিয়ের প্রচলন ছিল? তাছাড়া, তখনকার মক্কার কোনাে বিধর্মীরা। এই বিয়ে নিয়ে আপত্তি তােলেনি। তারাও জানত, এটা খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। অথচ ইসলাম আর নবীর বিরুদ্ধে ওদের যে-শত্রুতা ছিল, তাতে ওদেরই কিন্তু এটা নিয়ে আগে ঝাপিয়ে পড়ার কথা ছিল। নিলয়দা বলল-মুহাম্মদ তাে এসেছিলেন রীতি ভেঙে রীতি গড়ার জন্য। তিনি এই অদ্ভুত রীতি ভাঙলেন না কেন? সাজিদ বলল-“দাদা, ঠিক বলেছ। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম এসেছিলেন রীতি ভেঙে রীতি গড়ার জন্য। কিন্তু তিনি সেসব রীতি ভাঙার জন্যএসেছিলেন, যা অনৈতিক, যেমন কন্যা শিশুকে জীবন্ত দাফন। তিনি আরবের সেসব কালচার পাল্টে দিয়েছেন, যা জাহেলিয়াতের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু, অল্প বয়সে বিয়ে সেরকম কোনাে ব্যাপার নয়। বিজ্ঞান আমাদের বলে, মেয়েরা পুরুষের চেয়ে দশগুণ তাড়াতাড়ি ম্যাচিউরড হয়। সেটা ফিজিক্যালি এবং মেন্টালি দুভাবেই। তাছাড়া, তখনকার আরবে কম বয়সে বিয়ে হওয়ার পরও মেয়েরা খুব নরমালিই সন্তান জন্ম দিত। এটা কোনাে সমস্যা ছিল না। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এটা চেঞ্জ করার তাে দরকার ছিলই না। যা দরকার ছিল, তা তিনি করেছেন। তুমি কি আশা করছ যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন তৎকালীন আরবদের উটের ব্যবসা তুলে দিয়ে তাদের শেয়ার ব্যবসা শেখালেন না, কেন তিনি খেজুরের ব্যবসা তুলে দিয়ে সেখানে চকোলেট আর রসমালাইয়ের ব্যবসার প্রচলন করলেন না? তুমি হয়তাে ভাবছ, তঙ্কালীন আরবের বালকদের উট চরানাে থেকে মুক্তি দিয়ে কেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের হাতে একটি করে কম্পিউটার এবং একটি করে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিলেন না? সাজিদের কথা শুনে আমি, রাকিব আর শাহরিয়ার হা হা হা হা করে হাসতে লাগলাম। সাজিদ বলল-“মানুষ মাত্রই তাঁর সমাজের সুষ্ঠু নিয়মগুলাের সাথে মিলিয়ে চলতে বাধ্য। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না দাদা। তাছাড়া, এত অল্প বয়সে বিয়ে কেবল ১৪০০ বছর আগে ছিল তা নয়, শিল্পবিপ্লবের পরেও অনেক উন্নত দেশে বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েদের সর্বনিম্ন বয়সসীমা ১০-এর নিচে ছিল।তাছাড়া, ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আরও ৫০০ বছর পরে, ইংল্যান্ডের রাজা জন ৪৪ বছর বয়সে ১২ বছর বয়সী রানী ইসাবেলাকে বিয়ে করেছিলেন। এ ব্যাপারগুলাে তখনকার সমাজে, যুগে খুব স্বাভাবিক ছিল, যেমন স্বাভাবিক সঙ্গম করে সন্তান জন্ম দেওয়া। তাছাড়া, উপমহাদেশেও যে খুব ছােট বয়সে বিয়ের একটি রীতি ছিল, তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছােটগল্প হৈমন্তি থেকেই আমরা দেখতে পাই। লেখক সেখানে দেখিয়েছেন, তখনকার সময়ে ৮ থেকে ১১ বছরের মধ্যে মেয়েদের বিয়ে হতাে। হৈমন্তির বিয়ের স্বাভাবিক বয়স পেরিয়ে যাওয়ায়, অর্থাৎ, ১৭ হয়ে যাওয়ায় তার শাশুড়ি সেটা সবার কাছ থেকে লুকোতে চাইছিলেন। হৈমন্তিকেও মিথ্যে বলার জন্য শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এখান থেকেই বােঝা যায়, রবীন্দ্রনাথের সময়েও ৮ থেকে ১১ বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে ছিল একটি স্বাভাবিক ঘটনা। ‘সেই গল্পে আমরা ‘পণপ্রথা’র কুফল সম্পর্কে একটি আভাস পেলেও, কোথাও কিন্তু বিয়ের বয়স নিয়ে উচ্চবাক্য দেখিনি। বরং, হৈমন্তির বয়স বেশি হয়ে যাওয়াতেইকিছুটা আপত্তি দেখা গেছে। এখান থেকে বুঝতে পারি, রবীন্দ্র আমলেও কম বয়সে বিয়ের একটি প্রচলন ভারতবর্ষেই মজুদ ছিল।’ সাজিদের এই লেকচারে নিলয়দা সন্তুষ্ট হলাে না। যতই ত্যানা প্যাঁচাও, একজন বয়ােবৃদ্ধ লােক একজন ৯ বছর বয়সী কিশােরীকে বিয়ে করেছে, এটাকে তুমি কোনােভাবেই ডিফেন্ড করতে পারাে না। সে প্রফেট হােক আর যাই-ই হােক’- নিলয়দা বলল। আমি ভাবলাম, এইবার সাজিদ পরাজিত হবে। হাল ছেড়ে দিয়ে হতাশ গলায় বলবে-নাহ! আর পারলাম না দাদা। কিন্তু না। সাজিদের মধ্যে আমি তেমন কিছুই দেখলাম না। সে খুব স্বাভাবিক। মুচকি একটি হাসির রেখা তার ঠোঁটে। সে আরেক কাপ চায়ের অর্ডার করল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল-“দাদা, নতুন কমিটিতে পদ পেয়েছ শুনলাম। নিলয়দা বলল-“হুম, সাহিত্য সম্পাদক। সাজিদ বলল-“হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী সম্পর্কে নিশ্চয় অনেক কিছু জাননা। -হ্যাঁ। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানি এবং সকলেরই জানা উচিত। -একদম ঠিক। বঙ্গবন্ধু আমাদের আইডল। নিলয়দা বলল-“শুধু কি আমাদের আইডল? বঙ্গবন্ধু পুরাে বাঙালি জাতির আইডল। “জ্বি, সেটাই দাদা। আমি হৃদয়ের গহীন থেকেই বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসি ও শ্রদ্ধা করি। আচ্ছা দাদা, তুমি জাননা বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীর নাম কী ছিল? নিলয়দা অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বলল-“কি সব বলছিস তুই? জানব না কেন? বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা বেগম। সাজিদ বলল-“দাদা, তুমি জাননা, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসার জন্ম কোন সালে? নিলয়দা কিছুক্ষণ ভাবলেন। বললেন-“ভুলে গেছি রে! বিসিএসের জন্য যখন প্রিপারেশান নিচ্ছিলাম, তখন পড়েছিলাম।’ সাজিদ তার ফোন বের করে সেখান থেকে গুগলে ‘বেগম ফজিলাতুন্নেসা লিখে সার্চ দিল। রেজাল্ট দেখাল বেগম ফজিলাতুন্নেসার জন্ম ১৯৩০ সালে। সাজিদ সেটা নিলয়দাকে দেখাল।নিলয়দা বলল-“হুম, মনে পড়েছে। কিন্তু তাতে কী হয়েছে? হঠাৎ এই ব্যাপারে। চলে গেলি কেন? সাজিদ বলল-“দাদা, তুমি জানাে, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসার সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কত সালে বিয়ে হয়? নিলয়দা ‘না’-সূচক মাথা নাড়ল। সাজিদ আবার উইকি থেকে দেখাল। বঙ্গবন্ধুর সাথে বঙ্গমাতার বিয়ে হয় ১৯৩৮ সালে । সাজিদ বলল-“দাদা, ১৯৩৮ থেকে ১৯৩০ বাদ দিলে কত থাকে? নিলয়দা বলল-‘৮…’ সাজিদ বলল-“জুি দাদা, একদম ঠিক বলেছ। ১৯৩৮ থেকে ১৯৩০ বাদ দিলে। থাকে ৮। ঠিক ৮ বছর বয়সের বেগম ফজিলাতুন্নেসার সাথে বঙ্গবন্ধুর বিয়ে হয়। আচ্ছা দাদা, আমি কি এটাকে বাল্যবিবাহ বলতে পারব? এই শরীয়াসম্মত বিয়ের জন্য কি বঙ্গবন্ধুকে ব্লেম করা নৈতিকভাবে ঠিক হবে? নাহ । মােটেই ঠিক হবে । না। ‘এখন বলাে তাে, বিংশ শতাব্দীর বঙ্গবন্ধু যেটা পেরেছেন, ১৪০০ বছর আগের মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন পারবে না? কেন তাকে ধর্ষক, যৌনকাতর, যৌন লিলু ডাকা হবে? তাঁকে এবং আয়িশা (রাঃ)-কে নিয়ে অশ্লীল কথা লিখে কেউ আইনের হাতে ধরা পড়লে তাঁর জন্য কেন তােমার মন কাঁদবে? আকাশ থেকে পড়লে যা হয়, নিলয়দার অবস্থাও তখন তেমন। নিলয়দা এরকম একটা জবাব পাবেন তা হয়তাে কল্পনাও করেনি। চায়ের বিল দেওয়ার জন্য সাজিদ এগিয়ে গেল। গম্ভীর, রাজনীতিপ্রিয় রাকিব। এসে বলল-“দোস্ত, পরানটা ঠাণ্ডা করে দিয়েছিস একদম। বিলটা আমাকে দিতে দে, প্লিজ? সাজিদ মুচকি হাসল।

রেফারেন্স :Jala-Ul Afhaam by Imam Ibnul Qaiyum Sahih Al bukhari, Volume 5, Book 58, Hadith 234
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, শেখ মুজিবুর রহমান।
চলবে…

Comments are closed.