পথ হারিয়েছে ধর্ম না ধার্মিকগণ

সোজা কথা যেখানেই সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে আন্তরিকতা নাই এবং একচেটিয়া কায়েমি স্বার্থের সমর্থন সেখানে না আছে মুসলিম, না আছে ইসলাম!

চিন্তা করেন রাসুল (স:) যদি চাইতেন তাহলে তো নিজেই কায়েমি স্বার্থের এ সব ধান্দার একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে যেতে পারতেন। কাউকে দিয়ে নিজের বিরাট একটি ছবি একে রেখে যেতে পারতেন, নিজের পরিবারের নামে চিরস্থায়ী একটি ব্যবস্থা করে যেতে পারতেন কাফেরদের সাথে যুদ্ধে অর্জিত সকল সম্পদ বণ্টন না করে নিজেই রেখে যেতে পারতেন, নিজের জন্য তখনকার পার্শ্ববর্তী সাম্রাজ্যে প্রধানদের সমান না হলেও ছোটখাটো একটি রাজ প্রাসাদ তৈরি করে যেতে পারতেন। তাঁর নিজের ও পরিবার বা সঙ্গী সাথীদের জন্য করতে পারতেন অন্যায় ও অবৈধ পন্তার কায়েমি স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা।

আবার তিনি চাইলে রাষ্ট্র ও সমাজের নেতৃত্ব তখনকার মদিনার প্রতিষ্ঠিত ইহুদী সম্প্রদায়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজে কেবল ইসলামের আনুষ্ঠানিকতা পালন নিয়ে মসজিদে নববীতে বসে জিকির আসকর করে দিন কাটাতে পারতেন। কিন্তু ইতিহাসের বাস্তবতা আমাদেরকে ভিন্ন পাঠ দেয়। বাস্তবতা হল তিনি এসবের কিছুই করেন নাই এবং তার পক্ষে করা সম্ভবও ছিলনা কেননা তিনি যে মিশনের মেন্ডেট নিয়ে এসেছিলেন সেটির সাথে এসব হচ্ছে পরস্পরবিরোধী। আর রাসুল (স:) কে আল্লাহর দেয়া মিশনের সে হুকুম পরিপূর্ণ করায় যে মর্যাদা ও সম্মানের উচ্চ আসন আল্লাহ তাঁকে দিয়েছেন তার তুলনা হয়না। সে প্রসঙ্গে আল্লাহ কোরআনে বলেন,

(ওয়া রাফা’না লাকা জিকরাক্) আমি তোমার খ্যাতিকে উচ্চ মর্যাদা দান করিয়াছি!

আর আজ সেই নবীর অনুসারী বলে দাবি করা জুব্বা পরা মুসলমানদের বিশেষকরে আরবের “ধার্মিকদের” ও তাদের রাজা বাদশাহদের কি অবস্থা?

তাই একথা বলা যেতে পারে যে এই নামাজ এই রোজা, মক্কা মদিনার এই বিশাল স্থাপনা, সুরালো কণ্ঠের কোরআন তেলায়ত, স্যাটেলাইট টিভির প্রদর্শন, বেদাত শিরক নিয়ে এত আলোচনা এত আওয়াজ এগুলো কোন কাজে আসছেনা বলেই মনে হয়। কারণ মুসলিম উম্মাহ দিনরাত করতে চায় একচেটিয়া কায়েমি স্বার্থের তোয়াজ! কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না! দু:খের বিষয় হল আজ অধিকতর মুসলিমদের মানসিকতা কয়লা সমতুল্য হয়ে গিয়েছে তাই যতই ধর্মের আনুষ্ঠানিকতায় লিপ্ত দেখিনা কেন তাদের কাজে ও কর্মে তথা বাস্তব জীবনে এসবের কোন প্রতিফলন নাই এবং কোন প্রভাব বিস্তার করছে না!

নিজের প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে বা তাদের কল্যাণে অর্থ ব্যয় করতে মন চায় না অথচ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অমুসলিমদের হাতে তুলে দিতে তাদের অস্ত্রের খরিদদার হতে এতটুকু বিবেকে বাধে না। আজ মুসলিমদের নিজেদের মাঝে কোন সমস্যা বা বিরোধী হলে সে জন্য আমাদের নেতারা কখনও দৌড়ে রাশিয়ায়, কখনও দৌড়ে ইউরোপ আমেরিকায়। কোথায় আল্লাহ আর কোথায় নবীর শিক্ষা?

সমস্যার মূল কোথায়?

কোরআনের সেই আয়াতের কথাগুলো লক্ষ্য করলে একথা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
আল্লাহ বলেন,

“যাহারা আমার নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে আমি তাহাদিগকে এমনভাবে ক্রমে ক্রমে ধ্বংসের দিকে লইয়া যাই যে তাহারা জানিতেও পারিবেনা। (সুরা ৭: ১৮২)

এখানে ইবনে কাতির (রা:) আর ইবনে আব্বাস (রা:) বা কোন বড় আলেমের তফসিরের দরকার আছে বলে মনে হয় না। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করুন আজ মুসলিমরা আল্লাহর নিদর্শনা বা নির্দেশকে বাস্তবে মানছে না প্রত্যাখ্যান করছে? আল্লাহর হুকুম না মানলে কেউ অবিশ্বাসী বা বিশ্বাসী বলে কথা নাই তওবা না করলে শাস্তি অবধারিত। শয়তান তো বিশ্বাসী বা ঈমানদারই ছিল এবং তার পুণ্যের পাল্লাও ভারী ছিল কিন্তু আল্লাহর হুকুম না পালনে কি পরিণাম হয়েছে মুসলিমদের অজানা নয়।

যাক আসল কথা হচ্ছে মুসলিম বিশ্বের হারানো গৌরব ও সম্মান ফিরিয়ে আনার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে মুসলিমদের মাঝে ঐক্যের অভাব এবং সঠিক নেতৃত্বের অভাব। অর্থ খরচ করে যেমন অস্ত্র কিনা যায়, আঞ্চলিক উত্তেজনা ও আতঙ্ক বা শত্রুতা সৃষ্টি করা যায় তেমনি অর্থ দিয়ে বন্ধুত্ব, ভালবাসা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠাও করা যায়। সে জন্য প্রয়োজন সত্য, ইনসাফ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে আন্তরিক প্রচেষ্টা।

সাপের মাথা কোথায়?
সেই ৭০ সালের প্রথম দিকে আরব দেশের রাজা বাদশাহ ও শাসকরা তখনও কিছুটা আত্মমর্যাদা সচেতন ও ফিলিস্তিন মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাই আরবর নেতারা ইসরাইলের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর একতরফা অন্যায় সমর্থন ও সহযোগীতা দেখে বিশেষ করে তখনকার সৌদি বাদশাহ ফায়সাল অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হন। যার ফলে পশ্চিমা বিশ্বকে বিশেষকরে আমেরিকাকে শিক্ষা দিতে তাদের জালানি সম্পদের ক্ষমতা ব্যবহার করেন। ফলে আমেরিকায় দেখা দেয় জালানি সংকট, পেট্রল পাম্পে মানুষের লম্বা লাইন, শিল্প কাখানায় জালানির অভাবে বিঘ্নিত হয় উৎপাদন, শুরু হয় বিরাট অর্থনৈতিক সমস্যা! অর্থনৈতিক এ মন্দা অবস্থার কারণ যেহেতু ছিল জালানি সম্পদের নিয়ন্ত্রণ তাই সে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আমেরিকা তাদের পক্ষে চিরস্থায়ী কব্জা করতে কি করা যায় তা নিয়ে আলোচনায় বসে দেশের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের সাথে যাদেরকে বলা হয় “ইকোনমিক হিট ম্যান”। তাদের পরামর্শে আমেরিকা নেয় এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বিশ্বের তৈল সম্পদের প্রধান উৎস যেহেতু হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য তাই তারা বুদ্ধি করে সৌদি রাজপরিবারের সাথে স্বাক্ষর করে আধুনিক এই বিশ্বের সবচেয়ে যুগান্তকারী এক চুক্তি যা নিশ্চিত করে একদিকে তাদের আর্থিক নিশ্চয়তা অন্যদিকে আমেরিকার প্রতি ইসলামের প্রাণ কেন্দ্র মক্কা মদীনার দেশের শাসকগোষ্টির চিরস্থায়ী দাসত্ব। বিনিময়ে রাজপরিবারে হাতে আসে অফুরন্ত অর্থের পাহাড় আর সে পাহাড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় কায়েমি স্বার্থের বিরাট প্রসাদ! যার আড়ালে ঢাকা পড়েছে ইসলামের আসল আদর্শ ও বিশ্ব মুসলিম স্বার্থ।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যখনই মুসলিম সমাজে এই মৌলিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে তখনই মুসলিম সমাজ দুরবস্থায় পতিত হয়েছে। জ্ঞানী মানুষের চরিত্র হনন আর মূর্খ ও ভণ্ডদের সমর্থন অর্থাৎ এক কথায় অন্যায়ের সমর্থন ও ন্যায়ের দমন যখন হয়ে যায় যে সমাজে সাধারণ নিয়ম সেখানে সে সমাজকে মুসলিম ভাবার কি কোন কারণ থাকতে পারে?

চুক্তি করা কোন দুষের নয়, ইসলামের ইতিহাসে এবং রাসুলের সময়েও অনেক চুক্তি হয়েছে অমুসলিমদের সাথে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে চুক্তির সর্ত কি এবং কি হতে পারে এর দীর্ঘমেয়াদী কুফল সেটি বুঝার মত বিচার বুদ্ধি ও দূরদৃষ্টি ছিলনা বলেই আজ এ দুরবস্থা! তাদের হাতে অর্থ থাকলেও সে অর্থ সঠিক ক্ষেত্রে ব্যয় করার ক্ষমতা ও সাহস নাই। আজ মুসলিম বিশ্ব বিশেষকরে প্রচুর অর্থে সমৃদ্ধিশালী ধনী আরব উপ-সাগরীয় দেশগুলোর নেতারা যে চরম নৈতিক দেউলিয়াপনায় ভুগছেন তা যে কোন সচেতন মানুষের দৃষ্টি এড়াতে পারেনা। আর এ সব ঘটছে শুধু এই কায়েমি স্বার্থ রক্ষার তাগিদে।

সৌদিদের প্রতিবেশী মুসলিম ভাইদের দেশ ইয়েমেনের হুতিদের বিদ্রোহ নিষ্পত্তি লক্ষ্য আলোচনার পথে অর্থ ব্যয় না করে যে পরিমান অর্থ ব্যয় করা হয় আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসায়ীদের খুশী রাখতে তার তিন ভাগের এক ভাগ অর্থ যদি আপোষ, নিষ্পত্তি ও রাজনৈতিক সমাধানে পিছনে ব্যয় করা হত তাহলে অনেক আগেই এর সমাধান হয়ে যেত। তা না করে যুদ্ধ ও বোমা বর্ষন করে নিরিহ মানুষ হত্যা করে দেশটিকে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে এনে কার স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে।

আজ সে দেশে কলেরায় মরছে হাজার মানুষ । Who is to blame? আর তারই পাশে ধার্মিকরা আছে এবাদতে মগ্ন পারলে এখনই তারা আল্লাহকে নিয়ে আসবে তাদের কাছে! আবার যখন দেখা যায় সৌদির এক শ্রেণীর দরবারী আলেম উলেমারা এসবের গ্রহণযোগ্যতার পক্ষে কথা বলেন বা কেউ আবার নীরব থাকেন তখন সভাবতই প্রশ্নে জাগে আজ পথ হরিয়েছে ধর্ম না ধার্মিকগণ।

একথা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না যে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম নেতারা কার ইশারায় নাচেন ! এটি বিশ্বের ভুরাজনৈতিক বাস্তবতার চাপে বলুন বা অন্য কোন কারণ বলুন কথা হচ্ছে বিশ্বের সচেতন মানুষেরা আজ যা দেখছে তাতে মুসলিমদের মান সম্মান বা শ্রদ্ধা বলে কিছু অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। তথাকথিত এই বাদশাহ ও আমীরদের আচরণে বিশ্ব দরবারে এরা শুধু হাসি তামাশার প্রাত্র হচ্ছে।

সম্প্রতি সৌদি নেতৃত্বে মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশ মধ্যপ্রাচ্যে ‘অস্থিতিশীলতা’ সৃষ্টির অভিযোগে কাতারের সঙ্গে পররাষ্ট্র সম্পর্কের পাট চুকিয়ে ফেলে। জবাবে ওই … সৌদিসহ সম্পর্কচ্ছেদকারী দেশগুলোর দাবি, কাতার যেসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সমর্থন করছে এবং ইরানের সাথে সহযোগীতার সম্পর্ক রাখছে … তবে বিশ্বের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এ অভিযোগের সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করছেন এবং এ সিদ্ধান্ত যে আমেরিকার অর্থব্যবসায়ীর মুনাফা ছাড়া মুসলিম বিশ্বের কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না তা সবাই একমত। ফলে সৌদি আরবের উপর আজ সবাই ক্ষিপ্ত!

তবে এখানে একটি জিনিষ আমাদেরকে জানা দরকার সৌদি রাজ পরিবেরে আসল শক্তি যাদের হাতে তারা বর্তমান বাদশাহ সালমান বা তার বয়সী সবার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিন্তা চেতনার জেনারেশন। এই প্রজন্মের প্রায় এরা সবাই পশ্চিমা দেশের তথাকথিত লেখাপড়া শিখে ফিরার দল। এদের কাছে মুসলিম বা ইসলামী বিশ্বের স্বার্থ দেখার কোন গুরুত্ব নাই! লেখা পড়ার নামে এরা আমেরিকা ইউরোপের সময় কাটিয়েছে জুয়া, নারী মদ নিয়ে যৌন ব্যভিচারে। আধুনিকতার নামে এরা নিজেদের চরিত্রকে নষ্ট করেছে নিজেদের কাম বাসনার পিছনে। সাম্রাজ্যবাদী চক্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের সাথে তারা গড়তে পারছে নিবিড় সম্পর্ক।

অতএব সৌদি সরকার আমেরিকার প্রভাব থেকে মুক্ত হবার কোন সম্ভাবনা নাই। তাই আগামীতে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগীতা ও আমেরিকার অস্ত্রের খরিদ্দার হওয়া ছাড়া সৌদি আরবের নীতিতে মুসলিম ঐক্যে বা অন্যান্য মুসলিম দেশের উন্নয়নের জন্য খুব একটা কিছু এরা করবে সে আশা করা বোকামী।

তবে ইসলামি আনুষ্ঠানিকতার ধর্ম কর্মে তারা খুব একটা বাধা দেবেনা যতক্ষণ সে সব আচার অনুষ্ঠান কেবল আনুষ্ঠানিকতার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুড বা মুক্ত মিডিয়া বিস্তারে বা “আরব বসন্ত” পুনর্জাগরণবাদী কোন পদক্ষেপে বাধা দিতে তারা সর্ব শক্তি ব্যয় করবে।
তাই আজ প্রশ্ন উঠছে আজ পথ হারিয়েছে ধর্ম না ধার্মিকগণ?

বর্তমান সৌদি রাজ পরিবারে ইঙ্গ পাওয়ার গ্রুপের সাথে তুরস্কের সেই অটোমান খিলাফত পতনের সময়ের “ইঙ্গ টার্ক” দের ভূমিকার কথা মনে পড়ে! তবে ইঙ্গ টার্ক সেকুলার হলেও ওদের মাঝে ছিল বিপ্লবী পরিবর্তনের প্রত্যাশা আর সৌদি এরা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীর স্বার্থ রক্ষা আর নির্যাতিত মানুষের অধিকার হরণের সংকল্পে এক অশুভ শক্তি!

দু:খীত, কথা হচ্ছিল সেই যুগান্তকারী চুক্তির ব্যপারে তা না লিখে আলোচনা দীর্ঘায়িত হয়ে গিয়েছে অন্যভাবে! যাক নিচের ভিডিওটি শুনলে লিখার উপসহার পেয়ে যাবেন।

Comments are closed.