নির্যাতনের বীভৎস রুপঃ রডনি কিং থেকে জর্জ ফ্লয়েড, রণেশ ঠাকুর থেকে নিখিল তালুকদার।

একঃ ১৯৯২ সালের জানুয়ারী মাস, কন কনে ঠান্ডায় ল্যান্ড করলাম জে এফ কে এয়ারপোর্ট। বাক স্বাধীনতা, মানবতা, অসাম্প্রদায়ীকতা আ্রর বিশ্ব গনতন্ত্রের সূতিকাগার স্বপ্নপুরী আমেরিকার ছবি মানষপটে নিয়ে যাত্রা শুরু হল নিউইয়র্ক শহরে। অথচ মাত্র এক বছর আগে ১৯৯১ সালের মার্চ মাসে রডনি কিং নামের একজন আফ্রিকান আমেরিকান লস এঞ্জেলস পুলিশের হাতে নির্মমভাবে প্রহৃত হন (On March 3, 1991, King was violently beaten by LAPD officers) যা ছিল সভ্যতার গালে চরম চপেটাঘাত, অসাম্প্রদায়ীকতার পিঠে নির্লজ্জ ছুরিকাঘাত। এক বছর পর এপ্রিল ১৯৯২ রডনি কিং মামলার রায় হয়, জুরি ৩ অফিসারকে নির্দোষ এবং এক অফিসারের রায়ে এক মত হতে পারেনি। রায়ের প্রতিবাদে লস এঞ্জেলসে শুরু হয় রায়ট। ৬ দিনের এই রায়টে ৬৩ জন আফ্রিকান আমেরিকান প্রান হারায়। সমগ্র আমেরিকা তখন উত্তাল। নিউইয়র্কের রাস্থায় রাস্থায় কালোদের মিছিল আর মিছিল । আমার বয়স তখন ২২/২৩ হবে। রক্তে তখনও প্রতিরোধের প্রচন্ড প্রবাহ। এক সন্ধ্যায় সেকেন্ড এভিন্যূ র বিরাট মিছিলে নেমে গেলাম। হাজার হাজার কালোদের মিছিলে বাদামী এক যুবক আমাকে একটু যেন বেমানান লাগছিল-অনেকেই তাকাচ্ছিল আমার দিকে। আজ প্রায় ৩ দশক পর যখন পুলিশের হাটুর নিচে জর্জ ফ্লয়েডের পাশবিক মৃত্যূর ভিডিও দেখি তখন অবাক লাগে-অবাক লাগে এই ভেবে যে রডনি কিং এর অত্যাচারের-বিচারের প্রতিবাদে ৬৩ জন মানুষ প্রান দিয়েছিল কেন? ৬৩ জন প্রতিবাদীর মৃত্যূ কি শধুই মৃত্যু ছিল । ৩ দশকেও সভ্যতার দাবীদার আমেরিকা ইকুয়েল হিউমেন রাইটস অ্যান্ড রেসপেক্ট বিন্দু মাত্রও প্রতিস্টা করতে পারে নাই। ১৯৯১ থেকে ২০২০ সিস্টেমেটিক রেসিজম কি একটু খানিও থেমে ছিল ? এরই মধ্যে অসংখ্য কালো আর হিস্পানিক সংখ্যালঘূদের উপর হয়েছে পাশবিক নির্যাতন, মানষিক নির্যাতন আর বর্ন বইষ্ম্যমুলক আচরন। এই racial discrimination হয়ত কোন দিন ও শেষ হয়ে যাবে না, পৃথিবীর সকল সংখ্যালঘূরা নির্যাতিত হতে থাকবে অনন্ত কাল । আরো রডনি কিং-জর্জ ফ্লয়েড জীবন দিয়ে সময়ে সময়ে বিশ্ববাসীকে জানান দিয়ে যাবে মানবতা মরছে –মরবে, মানবতা “ Cannot Breath” . বিনিময়ে প্রতিবাদী মানুষের হূংকার আসবে-Social reform এর দাবী আসবে তারপর একদিন তা থেমে গেলে রেসিজম আবার মাথাচাড়া দিয়ে ঊঠবে । জর্জ ফ্লয়েডের প্রানের বিনিময়ে-ফিরে আসুক মানবতা, এক অসাম্প্রদায়ীক বিশ্বের হউক সূচনা এই কামনা করার অধিকার আমাদের আছে এবং থাকবে।

দুইঃ ষাট বা সত্তর এর দশকে যারা মফস্বল শহরে বা গ্রামে বড় হয়েছেন তাদের কাছে পালাগান (যাকে সিলেট অঞ্চলে মালজোরা বলাহয়) খুবই পরিচিত। সেই সময়ে বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে তার জুরি ছিল না।১৯৭৭ বা ৭৮ সালের কথা, আমাদের থানা সদরে ( বালাগঞ্জ সিলেট) বদর শাহের মাজারে উরস হবে, আয়োজনে মুক্তিযোদ্ধা ছতই মিয়া আর মুক্তিযোদ্ধা দয়াময় দাস। বাউল শিল্পী রুহি ঠাকুর গান করবেন। সারা রাত গান চলবে। সুতরাং পরের দিন স্কুল ফাকি দিতে হবে। রাতভর রুহি ঠাকুরের গান শুনলাম । রুহি ঠাকুরের উস্থাদ ছিলেন আব্দুল করিম তাই আব্দুল করিমের গানই তিনি বেশী করতেন, নিজের গান ছাড়াও তিনি আমীর উদ্দিনের গান করতেন। সেই দিনের গাওয়া একটি গানের লাইন মনে পড়ে “ এ বিশাল সংসার সকলই অসার , একদিন হইবে গো নিরাশার জলে জলাময় “ গানটি কার লিখা তা আমার জানা হয় নাই। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে এবং দেশে বিদেশে আবদুল করিমের মাটির গান পউছে দিয়ে যে ক জন আব্দুল করিমের গান কে বিশ্ব বাংগালীর কাছে পরিচিত করিয়ে ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন রুহি ঠাকুর। সেই রুহি ঠাকুরের ছেলে রণেশ ঠাকুর ও একজন বাউল। দীর্ঘ দিন প্রবাসে থাকায় রমেশ ঠাকুরের নাম জানতাম না। রমেশ ঠাকুরের ভিটায় আগুন দিয়ে তার ৪ দশকের গানের খাতা, গানের সরঞ্জাম ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। খবরের পাতায় , ফেইস বুক থেকে জানলাম উনি রুহি ঠাকুরের ছেলে। তার আবেগ ভরা অন্তরের আর্তনাদ “ আমার ৪ দশকের গানের খাতা-সকলি পুড়িয়া ছাই, ও ভাইরে মনের দুঃখ কার কাছে জানাই” শুনে নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হল। হাসন রাজা, রাধা রমন আর আব্দুল করিমের অবিনাশী গান নিয়ে যারা রানারের মত হন্যে হয়ে ছুটে চলেছে দেশ বিদেশে, বিদেশী সংস্কৃতির হাত থেকে বাংগালীর কৃষ্টি-ঐতিহ্য রক্ষায় যারা আমরন করে চলেছে জীবনপণ তাদের ঘরে আগুন লাগবে কেন? বাউলের ঘরে আগুন , বাউলের গানের খাতায় আগুন আর সমাজের দেহে আগুন দেওয়ায় পার্থক্য আছে কি? এরা তো আমাদের মাটির সম্পদ , আমাদের সংস্কৃতির বাহক, এরা আমাদের বাঙ্গালিপনা । এরাই যুগ যুগান্তর ধরে আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় আমাদের স্বকীয়তা, আমাদের উন্নত জীবন চরিত, আমাদের সামাজিক বন্ধন , আমাদের সামাজিক আচার, আমাদের কুলিনতা, আমাদের হাজার বছরের বীরত্বের ইতিহাস আর আমাদের নিবিড় সাম্প্রদায়ীক বন্ধনের ইতিহাস। সুতরাং ওদের গানের উপর আঘাত মুলতঃ আমাদের সংস্কৃতির উপর আঘাত, আমাদের ইতিহাসের উপর আঘাত, আমাদের সাম্প্রদায়ীক বন্ধনের উপর আঘাত। সেই আঘাতকারীদের প্রতিঘাতের মাধ্যমে নিঃশ্বেষ করা ছাড়া উপায় আছে কি? দেশে বিদেশে রমেশ ঠাকুরকে নিয়ে কনসার্ট হয়েছে, তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছে সমাজের বি্বেক – হে এটাই চাই আমরা। রমেশ ঠাকুরদের উপর আঘাত বন্ধ হবে না জানি-যুগে যুগে আঘাত আসবেই কিন্তু সমাজের বিবেক যেন শেষ হয়ে না যায় । রমেশ ঠাকুরদেরকেও বাচতে হবে , এ ভাবেই বেহালার তারে ঝংকার তুলে প্রতিবাদে-প্রতিঘাত করে এগিয়ে যেতে হবে ।
তিনঃ প্রথম আলোর ৪ জুন সংখ্যায় প্রকাশিত একটি সংবাদ “ গোপাল গঞ্জে এ এসাইয়ের পিটুনিতে যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ” শিরোনামে নিখিল তালুকদার নামে এক কৃষককে তাস খেলার অভিযোগে হাটু দিয়ে আঘাত করে মেরুদন্ড ভেংগে ফেলেন পুলিশ অফিসার। পরে যুবকের মৃত্যু হয়। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা নিয়ে বিশ্ব যখন তোলপাড় তখন সোনার বাংলার সোনার পুলিশের এই আমেরিকান স্টাইলে যুবক হত্যা দেশে বিদেশের মানুষকে ব্যাথিত ও স্থম্ভিত করছে । বাংলাদেশের পুলিশের বর্বরতার ইতিহাস নতুন কিছু নয়। ক্রস ফায়ার ( Planned killing) তো আছেই । সমগ্র বাংলাদেশ যখন ব্যঙ্গের ছাতার মত ক্যসিনোতে ভরে গিয়েছিল তখনও কাউকে হত্যা করতে পুলিশের একশন দেখা যায় নাই অথচ সামান্য তাস খেলার অভিযোগে আমেরিকান স্টাইলে হাটুর ব্যাবহার করে মেরুদন্ড তিন টুকরো করলেন পুলিশ অফিসার। বাংলাদেশের পুলিশ সাধারনতঃ বাহ্যিক ভাবে পেট মোটা গোড়া চিকন , তাই হয় বন্দুক নয়ত লাঠি দিয়ে পিঠিয়ে মানুষ হত্যা করেন। কিন্তু নিখিল হত্যায় আমেরিকান স্টাইল ব্যবহার বাংলাদেশের পুলিশের নির্যাতনের নতুন কালচার কি না তা নিয়ে দেশবিদেশের মানুষ উদ্ভিগ্ন। সামান্য তাস খেলার অভিযোগে একজন কৃষককে পিটিয়ে হত্যার অধিকার সেই বর্বর পুলিশকে কে দিয়েছে? এই কৃষক ই হয়তো এই পরিবারের এক মাত্র উপার্জন কারী – এই পরিবারটির দায় দায়ীত্ব কে নেবে ? এই বর্বর পুলিশ অফিসারকে আইনের আওতায় এনে হত্যা মামলার আসামি করা হউক, নিহত পরিবারের দায়ীত্ব রাষ্ট্র কে নিতেই হবে । পুলিশ আইন রিফোর্ম করে বর্বরতা বন্ধ করতে হবে। দেশ ও প্রবাসের প্রতিটি বাংগালীর আওয়াজই নিখিল হত্যার বিচার সম্পন্ন করতে , নিখিলের পরিবারকে ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা সাহায্য করবে ।

ফয়জুল হক

About ফয়জুল হক

লেখক কানাডা প্রবাসী এবং ক্যানাডাবিডিনিউজ ডটকম’র সম্পাদক।

Comments are closed.