নিজেকে নিজে চিনতে হবে

ভূমিকা

বলা হয় বুদ্ধা বলতেন, “পৃথিবীতে মানুষ প্রতিনিয়ত কামাগ্নি, দ্বেষাগ্নি ও মোহাগ্নিতে নিত্য প্রজ্বলিত হচ্ছে। এ প্রজ্বলন অবস্থায় তোমাদের কিসের এত হাসি? এত আনন্দ?” তাই বুদ্ধের প্রশ্ন ছিল আর কতদিন মোহান্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে থাকবে? আলোর সন্ধান করবে না? বুদ্ধের এ উক্তিটি অনেকের কাছে বড়ই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা উৎপাদক মনে হবে।
আসলেই তো -এটা একটি ন্যায্য প্রশ্ন কি করে মানুষ অন্ধকার থেকে আলোর সন্ধান পাবে?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজার পূর্বে একটি কথা বলতেই হচ্ছে। বুদ্বার অহিংসতার শিক্ষা ভুলে গিয়ে তার অনুসারীরা আজ যে  “এথনিং ক্লিন্জিং” শুরু করেছে বার্মার মুসলিম নাগরিকদের উপর। নিচের বিবিসি ভিডিও ফুটেজটিতে দেখা যায় বর্মি পুলিশের সামনে থেকে বৌদ্ধ পাদরী সহ উচ্ছৃঙ্খল বৌদ্ধ জনতা মুসলিমদের দোকান, বাড়িঘর ও মসজিদ লুট করে পুড়িয়ে দিচ্ছে, হত্যা করছে অথচ সে দেশের প্রশাসন নীরব এমন কি বিশ্ব বিবেকও নীরব বললে ভুল হবেনা। কেননা আজ পর্যন্ত এ অত্যাচার বন্ধ করতে জোরালো আর্ন্তজাতিক কোন পদক্ষেপ নিতে তেমন দেখা যাচ্ছে না!

প্রিয় পাঠক। দু:খিত বুদ্বার কথা বলতে গিয়ে উপরের ঘটনাগুলো এড়াতে পারছিলাম না।

যাক, আবার ফিরে যাচ্ছি আগের প্রশ্নে: কি করে মানুষ অন্ধকার থেকে আলোর সন্ধান পাবে?

এ প্রশ্নের উত্তর মিলে পবিত্র কোরআনে। কোরআন শিক্ষা দেয় কেউ যদি এক আল্লাহতে বিশ্বাস করে কোরআন অধ্যয়ন করে, নবীকে (স:) অনুসরণ করে এবং তাঁর দেয়া পথনির্দেশে জীবন যাপন করে তাহলে অন্ধকার থেকে আলোর সন্ধান পাবে। আর তখন আল্লাহ সেই বিশ্বাসীর জন্য অভিভাবক হন এবং তাকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখান। “আল্লাহু ওয়ালিয়্যুল লাযীনা আমানু ইউখরিজুহুম মিনাজ্জ যুলুমাতি ইলান নুর” (২:২৫৭)। আর যে তা অস্বীকার করে তার অভিভাবক হবে তাগুত যা তাকে আলোর পথ ছেড়ে অন্ধকারের দিকে নিক্ষেপ করবে (কোরআন সুরা বাকারা ও ইব্রাহিম )।

তাহলে বুঝা গেল আল্লাহর প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা যে কি সে সম্পর্কে মূর্খ থাকলে সে আলোর সন্ধান পাওয়া দুষ্কর।

একজন বিশ্বাসীর পক্ষে আল্লাহকে চিনতে এবং তাঁর পথে অবিচল থাকতে হলে প্রথমে তার নিজেকে নিজে চিনতে হবে। কেউ হয়তবা বলতে পারে আমি তো আমাকে বেশ চিনি। ইমাম গাজ্ঝালী (রা:) বলেন এ ধারণা তোমার নিতান্ত ভুল। তাঁর লিখিত “কিমিয়ায়ে সা’আদাত” গ্রন্থে এর জ্ঞানগর্ভ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন নিজের সম্বন্ধে এরূপ মোটামুটি জ্ঞান লাভ খোদাকে চিনার চাবি বা উপায় হতে পারে না। এরূপ জ্ঞান তো নিজের সম্বন্ধে পশুদেরও আছে, যেরূপ তুমি নিজের বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমুহ যেমন, হাত,পা, মুখ মস্তক, মাংসপেশী ইত্যাদি চিন এবং তোমার আভ্যন্তরীণ অবস্থাও কিছু কিছু উপলব্ধি কর; যেমন ক্ষুধা লাগলে আহার কর, ক্রোধ হইলে অন্যকে আক্রমণ কর পশুরাও তা করে। এ জাতীয় জ্ঞানে সমস্ত পশুই তোমার সমকক্ষ।
ইমাম গাজ্ঝালীর (র:) লিখা পড়লে আসলেই প্রশ্ন জাগে আমি কি আমাকে চিনতে পেরেছি বা আমার এই বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমুহ যেমন, হাত,পা, মুখ মস্তক, মাংসপেশী দিয়ে দেহটা এটাই কি আমি? উত্তরে অনেকেই জবাব দিবেন এ দেহে আত্মা বা রূহ আছে। কিন্তু এ রূহটি কি জিনিস সে সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান মানুষকে দেয়া হয়নি এবং আল্লাহ দিতেও চাননি বলেই মনে হয়। কেননা রূহ সম্পর্কে রাসুল (স:) প্রশ্ন করায় আল্লাহ কি বলেছেন যারা কোরআন পড়েছেন জানার কথা। কিন্তু এ রূহ যে সত্যি মানব দেহে আছে এবং মৃত্যুর সাথে সাথে চলে যায় এটাও আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি। কিন্তু দূর্ভাগ্য হল এই রূহ সম্পর্কে আমরা সব সময়ই উদাসীন অথচ এই আত্মাই হচ্ছে আসল আমি । যে এই আত্মার সঠিক পরিচর্চা করতে পারবে সেই হবে সফলকাম পাবে অনন্ত জীবনের সুখের বাসস্থান জান্নাত।

ইমাম গাজ্ঝালী (র:) আমাদের দেহটাকে একটি রাষ্ট্রের সাথে তুলনা করেছেন। আর এ দুনিয়ায় আত্মার বাসস্থান হচ্ছে আমাদের এই দেহ রাষ্ট্রে এবং এই দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমুহ যেমন, হাত,পা, মুখ, মস্তক ও ব্রেইন,কামনা বাসনা, ক্রোধ ইত্যাদি সবই হচ্ছে রাষ্ট্রের কর্মচারি এবং আত্মা হচ্ছে বাদশা। কিন্তু বাদশাহ ন্যায় পরায়ণ না হলে এই কর্মচারীরা সঠিক কাজ করে না এবং অনেক সময় বিদ্রোহ করে। এ জন্য বাদশাহ সঠিক পথে থাকতে হবে। সে জন্য প্রথম কাজ হল তাকে আন্তরিক হতে হবে।

আমরা যদি শুধু কালচারাল মুসলিম হিসাবে না থেকে ইসলাম সম্পর্কে একটু চিন্তা করি তাহলে বুঝতে পারব ইসলাম এসেছে মানুষের জীবনকে পরিবর্তন (transformation) করতে এবং সমাজে পজেটিব ইমপ্যাক্ট রাখতে। উদ্দেশ্য সমাজের বৃহত্তর স্বার্থ দেখতে শুধু নিজের স্বার্থ দেখতে নয়। আপনি আধুনিক লেখাপড়া করেছেন কর্পোরেট জব করেন, স্বপ্ন দেখেন সেখানে সিড়ি বেয়ে আরো উপরে উঠতে কিংবা ব্যবসা করেন বা অন্য কোন পেশায় আছেন, অনেক অর্থ বিত্তের মালিক হতে চান এ পৃথিবীতে। সবই ঠিক আছে কিন্তু নিজেকে শুধু পেশা আর পরিবারের সাথে ব্যস্ত না করে ইসলামকে জানা ও বুঝার এবং ইসলামের নিয়ামত উপলব্ধি করার মনমানসিকতা গড়তে হবে। একজন সাধারণ মুসলিম হিসাবে আমরা ইসলামের ব্যাপারে অনেক জ্ঞানী না হয় না হলাম কিন্তু সে ব্যাপারে একেবারে মূর্খ যাতে না হই সে কামনা ও প্রচেষ্টা করাই হচ্ছে সময়ের দাবী। তা না হলে “যার শেষ ভাল তার সব ভাল” হবার সৌভাগ্য কপালে জুটবে কিনা সন্দেহ প্রচুর।

এটি এমনিতে আসবে না সে জন্য কিছুটা হলেও সময় ও প্রচেষ্টা দিতে হবে এবং সে পথে হাটতে হবে। আমাদের নিজেদেরকে চিনতে হবে, আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে, আমাদের ভয় ভীতি ,কামনা বাসনা, ক্রোধকে বশে আনতে হবে আমাদের আত্মার মর্যাদা বাড়াতে তাকে সমুন্নত করতে। তখন আমাদের জীবনের প্রতিটি কাজে ইসলামের আদর্শ ফুটে উঠবে সেটাই হবে আসল সফলতা বা অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসা।

আত্মার হিদায়াত (ওয়া মাই উ’মিম বিল্লাহি ইয়াহদি ক্বালবাহু, সুরা তাগাবুন ৬৪:১১)

“যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে সৎপথ প্রদর্শন করেন।” – বিশ্বাসীদের অনেকের জীবনেই আমরা লক্ষ্য করি যে এক সমস্যা শেষ হলে আরেক সমস্যা উপস্থিত হয়, সেটা শেষ হলে আরেক সমস্যার উদয় হয়। এভাবে একের পর এক  সমস্যা জীবনে আসে এবং মনে হয় বর্তমানের সমস্যা থেকে আগেরগুলো সহজ ছিল। মানুষের জীবনে এ জাতীয় সমস্যা আসবেই। তবুও জীবন থেমে যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কতটুকু ধৈর্য্যের সাথে এবং আল্লাহর উপর আশা ভরষা নিয়ে সেগুলো অতিক্রম করতে পেরেছি যাতে আমাদের আত্মাকে আল্লাহর কাছ থেকে আরো হেদায়েত পেতে সৌভাগ্যবান হতে পেরেছি। এ প্রসঙ্গে উস্তাদ নোমান আলীর মাত্র কয়েক সেকেন্ডের এ কথাগুলো শুনেন ভাল লাগবে।

 

আল্লাহর নবী মোহাম্মদ (সা:) এঁর বিভিন্ন হাদিসে দেখা যায় তিনি এ পরিবর্তনের লক্ষ্যে শ্রেষ্ঠ মুসলিমের চরিত্র কি হতে হবে বলেছেন এবং তার প্রতিটিই হচ্ছে মানুষের সাথে মানুষের উত্তম ব্যবহারের সঙ্গে জড়িত। এখানে সে মর্মে দুটি হদিসের উল্লেখ করে আজকের আলোচনার ইতি টানছি।

“The best of people are those that bring most benefit to the rest of mankind.” [Daraqutni, Hasan] –

“The best of people are those who live longest and excel in their deeds, whereas the worst of people are those who live longest and corrupt their deeds.” [Tirmidhi, Sahih]

তাই আজ আমাদের সকলেই নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা করতে হবে সত্যি কি আমরা আমাদের নিজেদেরকে চিনতে পেরেছি?

Comments are closed.