ধর্ষণ প্রতিরোধে সামাজিক মূল্যবোধ ও গণসম্মতির ভূমিকা

গত ১০ অক্টোবর ২০২০ তারিখে সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্রের উদ্যোগে ‌‘ধর্ষণ প্রতিরোধে সামাজিক মূল্যবোধ ও গণসম্মতির ভূমিকা’ শিরোনামে একটি অনলাইন সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কেন্দ্রের পরিচালক জনাব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক। সংযুক্ত ভিডিও থেকে পাঠক তা শুনতে পারবেন। এই নিবন্ধটি সেই বক্তব্যের একটি পরিমার্জিত সংস্করণ।]

রাজনীতি গণসম্মতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, নাকি গণসম্মতি রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে?

এমনও এলাকা আছে যেখানে মাদক আছে, নারীরা পর্দা করে বাংলাদেশের অপরাপর এলাকাগুলোর মতো করে সাধারণভাবে, যেখানে নানা উপলক্ষ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি হয় নিয়মিত, সেসব অনুষ্ঠানে নারীরাও পারফর্ম করে, যেখানে নিয়মিত ওয়াজ মাহফিলে নারীদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করে বক্তব্য দেয়া হয়, স্মার্টফোনে অশ্লীল কন্টেন্ট ব্যবহার যেখানে অন্যান্য এলাকার চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়, যেখানে রাজনীতি আছে পুরোমাত্রায়, আছে রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষ, যেখানে তরুণ প্রজন্মের মাঝে আছে প্রেম-ভালবাসার চর্চা, যেখানে পরকীয়ার ঘটনা নয় বিরল। কিন্তু সেখানে ঘটে না ইভ টিজিংয়ের ঘটনা। এমন এলাকাতে ধর্ষণের মতো দুর্ঘটনার কথা কখনো শোনা যায়নি।

এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, সেখানকার একজন বিদ্যজন লেখকের মতে, সেখানে ‌‘সামাজিক অবয়বে পলিটিক্যাল ক্ষমতাচর্চা খুবই কম। একেবারে নাই বললেই চলে। নারীকেন্দ্রিক কোনো হয়রানিতে এই এলাকার মানুষ কখনোই রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয়নি। এখানে অ-রাজনৈতিক বিষয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সংস্কৃতি গড়ে উঠে নাই। এখানকার নেতা বা ছাত্রনেতারা নিজেদের সর্বেসর্বা ভাবে না। সবাই জানে, সে যদি আজকে ইভ টিজিং করে, যার ছেলেই হোক, কালকে সামাজিকভাবে তার বিচার নিশ্চিত করা হবে।’

এর মানে, উনার মতে, যেখানে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার কম, সেখানে সামাজিক মূল্যবোধ অধিকতর শক্তিশালী।

আমি এই অনুমানের সাথে দ্বিমত পোষণ করি। বরং, আমার মতে, সামাজিক মূল্যবোধ ও ব্যবস্থা শক্তিশালী থাকার কারণে সেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার কম বা নাই বললে চলে। সামাজিক মূল্যবোধ ও ব্যবস্থাকে আমি গণসম্মতি বা কালেকটিভ কনসেন্ট হিসেবে বলছি। প্রতিটি সমাজেরই থাকে একেকটি ইস্যুতে কোনো না কোনো ধরনের গণসম্মতি বা সোশ্যাল এপ্রোভাল অর কম্পালশান। কিংবা গণঅসম্মতি বা সোশ্যাল ডিজএপ্রোভাল অর রেসিস্ট্যান্স।

গণসম্মতি বলতে কী বুঝায়?

কোনো বিষয়ে কতটুক কী করা যাবে অথবা যাবে না, তা এই গণসম্মতি অথবা অসম্মতিতে পূর্ব-নির্ধারিত থাকে। সেখানে খেলার নিয়ম বা রাস্তায় চলাচলের মতো করে থাকে গ্রীন এরিয়া, ইয়েলো কার্ড এবং রেড কার্ড বা রেড লাইন। কেউ যখন তার সীমানা হতে বের হয়ে কোনো হলুদ লাইন ক্রস করে তখন উক্ত সমাজে উক্ত প্রকার কাজের বিরুদ্ধে তৈরি হয় গণপ্রতিবাদ। আর কেউ যদি ক্রস করে কোনো রেড লাইন তখন তার বিরুদ্ধে তৈরি হয় গণপ্রতিরোধ। এ ধরনের গণপ্রতিরোধের ভয়ে প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থাপন ব্যবস্থার মতো করে ক্ষমতার নানা কেন্দ্রগুলো নিজেদের টেরিটরিয়্যাল বাউন্ডারিকে সাধারণত মেনটেইন করে চলে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সব বিষয়ই এ ধরনের সাম্যাবস্থা মেনে চলে। কথাটা অন্যভাবে বললে, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, বন্দুকধারীদের সংস্থা (বা সংস্থাসমূহ), সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, এক কথায় সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল এলিমেন্ট বা এজেন্টই এই ইকোলিব্রিয়াম সিস্টেম মেনে চলে।

প্রত্যেক সমাজেই এই ভারসাম্য নিজের মতো করে বজায় থাকে। বিশেষ কোনো সমাজ ও রাষ্ট্রের এই ক্ষমতার বিলি-বণ্টন ব্যবস্থা, সামাজিক গণসম্মতির এই চিত্র হতে পারে আপনার দৃষ্টিতে অনুচিত বা ভুল। সেইটা আপনার নিজস্ব আদর্শবোধ ও জীবনদৃষ্টির ব্যাপার। ভুল সামাজিক ব্যবস্থাপনাকে সংশোধন করার জন্য আপনি চেষ্টা করবেন। দ্যাটস ফাইন। প্রত্যেক সমাজকর্মীই চায় নিজের মতো সামাজিক ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করতে। এজন্য আপনি সোশ্যাল ওয়ার্ক বা বিপ্লব, যা-ই করতে চান, সেইটা আপনার নিজস্ব বুঝ-জ্ঞানের ব্যাপার। এ নিয়ে আমি এখানে কথা বলতে চাচ্ছি না। বিদ্যমান কোনো সমাজে নানা ধরনের শক্তিসমূহের পারস্পরিক সীমারেখা বা সীমানাকে আপনি কীভাবে রিশেইপ করতে চান, আপনার এই চাওয়ার নরমেটিভ আসপেক্ট কী হতে পারে, এই চাওয়াকে বাস্তবায়ন করতে আপনি যে ধরনের পদ্ধতিতে কাজ করছেন বা করতে চান তার মূল্যায়ন, এগুলোর কোনোটাই এই লেখার বিবেচনার বিষয় নয়।

আমার বক্তব্য হলো, ক্ষমতামাত্রই সদা সম্প্রসারণশীল। এবং সম্প্রসারণশীল যে কোনো কিছুই অন্য কারো জন্য হয়ে উঠতে পারে বিপজ্জনক। দ্বান্দ্বিকতার তৃতীয় সূত্র ‌‘নিগেশন অব নিগেশন’ অনুসারে এটাই বরং স্বাভাবিক। ক্ষমতামাত্রই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। একের প্রতিষ্ঠা প্রতিদ্বন্দ্বী অপরের বিনাশের কারণ। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম।

ক্ষমতাগুলো একটা অপরটাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। কে কাকে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করলে আদর্শ ভারসাম্য কায়েম হবে সেইটা যার যার মেটা-থিওরি বা প্যারাডাইমের ব্যাপার। গণসম্মতি জিনিসটা কী, ক্ষমতার সাথে এর সম্পর্ক কী, তা বুঝানোর জন্য এই কথাগুলো বলা।

ধর্ষণ প্রতিরোধে গণসম্মতির ভূমিকা

যে সমাজে ধর্ষণের প্রাসঙ্গিক কারণসমূহের (secondary causes) সবগুলোই আছে অথচ ধর্ষণ নাই, আমার দৃষ্টিতে এর প্রকৃত কারণ হলো সেখানকার সমাজের গণসম্মতিতে একজন নারীকে যৌনতার দিক থেকে অমর্যাদা করার বিষয়টি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য ও কঠোরভাবে অননুমোদিত।

যে সমাজ বা এলাকার গণমানসে নারীনির্যাতনের বিষয়টির প্যাসিভ অনুমোদন আছে, সেখানে আইন যা-ই হোক না কেন, ধর্ষণের ঘটনা ঘটবেই। যেসব এলাকাতে অধিক হারে ধর্ষণ হয়, খেয়াল করলে দেখবেন, সেখানকার মানুষ এইটা এক প্রকার মেনে নিয়েছে। সমাজের অনুক্ত চুক্তির (tacit agreement) মধ্যে এর ব্যাপারে ‌‘আপত্তিসহকারে অনুমোদনে’র ব্যাপারট রয়ে গেছে। ‌‘আমি এটি পছন্দ করি না’ — এই কথার মানে হতে পারে, ‌‘এটি আমি কোনোক্রমেই হতে দিবো না।’ এর মানে এমনও হতে পারে, ‌‘এটি সংঘটিত হলে আমি প্রতিবাদ জানাবো।’ এর মানে হতে পারে, ‌‘এটি সংঘটিত হলে আমি দুঃখবোধ করবো।’

তো, ধর্ষণের যারা প্রতিবাদ করছেন, এ বিষয়ে তাদের প্রকৃত বা কার্যকর পজিশন কী, তা তাদের ইনভলভমেন্ট দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন। কথায় বলে, deeds are words। মোরাল প্রেফারেন্স এবং মোরাল পজিশন, ঠিক এক নয়। সে জন্য ধর্ষণের বিরুদ্ধে মোরাল প্রেফারেন্স থাকা মানে এই নয়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ধর্ষণ-সংস্কৃতির বিরোধী। ‘identification of the problem is half of the solution’ — এই নীতি অনুসারে এই সমাজের অধিকাংশ ব্যক্তিবর্গ যে সামাজিক সংকটসমূহের ব্যাপারে দ্বিচারিতায় (hypocracy) অভ্যস্ত তা দেখিয়ে দেয়াটা জরুরী। সেখানকার বিদ্যমান সামাজিক গণসম্মতি বা মূল্যবোধ কাঠামোটাকে আগে এক্সপৌজ করতে হবে। আইডেন্টিফাই করতে হবে এখানকার সোর্স অব পাওয়ারসমূহের সত্যিকারের বিন্যাস-ব্যবস্থা। এরপর সেগুলোকে পুনর্বিন্যাসের জন্য ফ্রম উইদিন কাজ করতে হবে।

মননে পরিবর্তন না আসলে আচরণে টেকসই পরিবর্তন আসা অসম্ভব।

মনে রাখতে হবে, আইনের অপব্যবহার রোধ করে আইনের সুষম প্রয়োগ নিশ্চিত করার সাথে সাথে আইনের উৎস বা ভিত্তি যে নৈতিকতা, সেইটাকেও যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। সমাজ-মনন ও সামাজিক নৈতিকতায় উন্নয়ন না ঘটিয়ে আইনী ব্যবস্থার মাধ্যমে ধর্ষণ বা এ জাতীয় অপরাধগুলো বন্ধ করতে চাইলে তাতে করে লং টার্মে হিতে বিপরীত হওয়ার আশংকা থেকে যায়। সমাজমননের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়, এমন দমনমূলক আইনগুলোকে লোকেরা তখন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে থাকবে।

সে যাই হোক।

যেখানে অপরাধ দমনে আইন কঠোর সেখানে দু’টি বিপরীত চিত্র দেখা যায়। কঠোর আইনের কারণে উক্ত অপরাধ সেখানে খুব কমই সংঘটিত হয়। অথবা, সেখানে উক্ত প্রকার কঠোর আইনের সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট অপরাধগুলোও সমান তালে সংঘটিত হতে থাকে। প্রথম ক্ষেত্রে, খোঁজ নিলে দেখবেন, উক্ত অপরাধের বিরুদ্ধে সেখানকার গণমানসে রয়েছে রেড সিগন্যাল পর্যায়ের আপত্তি বা কার্যকর বিরোধিতা। দেখবেন, সেখানে আইনের প্রয়োগ হয় যথাযথভাবে। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, যেখানে কঠোর আইনও আছে, পাশাপাশি ‌‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’র মতো উক্ত প্রকার অপরাধের প্রচলন ও বিস্তৃতিও আছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, সেখানকার সংস্কৃতি হচ্ছে, আইন আছে, প্রয়োগ নাই। অথবা দেখবেন, সংশ্লিষ্ট ওই অপরাধের ব্যাপারে সেখানকার সামাজিক গণমানসে নাই কার্যকর প্রতিরোধের মন-মানসিকতা; একচুয়েল মোরাল পজিশন বলতে যা বোঝায়। একে আপনি সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটিও বলতে পারেন।

ধর্ষণের সংজ্ঞায়ন

ধর্ষণ নিয়ে যখন আমরা কথা বলি, তখন একে সংজ্ঞায়িত করার বিষয়টাকে ততটা গুরুত্ব দেই না। যেন মনে করি, ধর্ষণ তো ধর্ষণই। আমরা রেইপের নানা ধরনকে আলাদা করে বিবেচনা করি না। আইন করার সময়ে নৃশংস গণধর্ষণের মতো ঘটনাগুলোকে যেভাবে বিবেচনায় রাখা হয় আইনের অপপ্রয়োগের বিষয়টিকে সেভাবে বা ততটা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয় না। কঠোর আইন হতে হবে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত সীমিত সংখ্যক অপরাধের ক্ষেত্রে। যাহোক, আমার দৃষ্টিতে ধর্ষণ হলো বাধ্যতামূলক যৌন সম্পর্ক স্থাপন। এই ধরনের সম্মতবিহীন যৌন সম্পর্ক তথা ধর্ষণ হতে পারে নানা প্রকারে। হতে পারে ওয়ার রেইপ। হতে পারে পলিটিক্যাল বা কমিউিনাল রেইপ। হতে পারে সোশ্যাল রেইপ।

রেইপের যত ধরনের কথা বই-পুস্তকে পাওয়া যায় তার সবগুলোকে এই ৩টা ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়। এক ক্যাটাগরির রেইপের বিরুদ্ধে নেয়া ব্যবস্থাগ্রহণের মাধ্যমে অন্য ক্যাটাগরির রেইপ বন্ধ হবে না। কথার কথা, পলিটিক্যাল রেইপ বা পলিটিক্যালি প্রাপ্ত এডমিনিস্ট্রেটিভ পাওয়ার এবিউজের মাধ্যমে সংঘটিত রেইপের বিরুদ্ধে নেয়া ব্যবস্থাগ্রহণ দ্বারা ‌‘ম্যারিটাল রেইপ’ বা ‌‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ ইত্যাদি বন্ধ হবে না। তদুপরি, ‌‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ জাতীয় ‌‘ধর্ষণ’গুলো আদৌ ধর্ষণ হিসেবে বিবেচনাযোগ্য কিনা, সেটাও ভাবতে হবে। তারচেয়ে বড় কথা হলো, সব ধরনের অপরাধ দমনের জন্য আইন লাগবে, বিচারিক প্রক্রিয়াই হলো মূল বা একমাত্র সমাধান, এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করাটা হলো সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্তঃসম্পর্ক বোঝার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের একটা মৌলিক গলদ।

সামাজিক সমস্যাকে মোকাবিলা করার বিষয়টি সমাজ দিয়েই শুরু হতে হবে। সামাজিক ব্যবস্থা যেসব সমস্যাকে সমাধান করতে পারে না, তা সমাধানের জন্য রাষ্ট্র লাগবে। বলাবাহুল্য, রাষ্ট্র একটি আইনী প্রতিষ্ঠান। এবং তা সমাজেরই একটা বর্ধিত রূপ বা এক্সটেন্ডেড ফর্ম। সমাজ হলো ভিত্তি। রাষ্ট্র হলো উপরিকাঠামো। কোনো অপরাধকে দমনের জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে জরুরীভাবে কোনো আইন তৈরি করা হলেও, কোনো ডিপ-রুটেড সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য সমাজের মধ্যে উক্ত আইনকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য এক ধরনের গণভিত্তি বা সমর্থন তৈরি হওয়া জরুরী।

গণসম্মতি তৈরির ক্ষেত্রে রাজনীতি, প্রশাসন, ধর্ম, অর্থনীতি, জলবায়ু ও ভৌগোলিক গঠন, জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বুদ্ধিজীবীদের কার্যক্রম, জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বিনোদন সংস্কৃতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বৈশ্বিক ব্যবস্থা, এক কথায় গুরুত্বপূর্ণ সব কিছুই কন্ট্রিবিউটিং ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। সমাজ মানস বা গণসম্মতি স্থির ও নিশ্চল কিছু নয়। একই সাথে তা অতি দ্রুত পরিবর্তনশীল, এমনও নয়।

ধর্ষণ নিয়ে আর দুয়েকটি কথা বলে এই আলাপ শেষ করছি।

ধর্ষণের অভিযোগ শুধু পুরুষদের বিরুদ্ধে কেন?

এ নিয়ে আমি এখানে কোনো কথা বলবো না। কথা লম্বা হয়ে যাবে, তাই। এই প্রশ্নের উত্তরের মাঝে নিহিত আছে এই অনুমান, নারী আর পুরুষ জৈবিকভাবে স্বতন্ত্র। যদি তাই হয়, তাহলে এই স্বাতন্ত্রের ভিত্তিতে যার যার জন্য বিশেষায়িত সামাজিক ভূমিকা, যাকে আমরা জেন্ডার রোল বলি, তা নিছকই সোশ্যাল কনস্ট্রাক্ট হবে কেন? বায়োলজিক্যালি যাকে সেক্স বলে, সোশ্যাল দিক থেকে তাকেই তো জেন্ডার আইডেন্টিটি বলা হয়। কোনো কিছু সোশ্যাল কনস্ট্রাক্ট হলেই তা মূলত অনুচিত ও খারাপ হবে, এমনটি মনে করা হয় কেন? জেন্ডার আইডেন্টিটিসহ মানব সভ্যতার নৈতিকতা সংশ্লিষ্ট তাবৎ জিনিসই তো আদতে সোশ্যাল কনস্ট্রাক্ট। কেউ কেউ সোশ্যাল কনস্ট্রাক্ট মাত্রকেই আরোপিত ও কৃত্রিম তথা নন-এমপেরিক্যাল বলে মনে করে। কেন তারা এমনটা বলে, তা আমার বুঝে আসে না। সামাজিক বিষয়ে পড়াশোনাকে সোশ্যাল সায়েন্স বলার কারণ হলো, ব্যবহারিক বিজ্ঞানের মতোই সমাজ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোও empirical বিষয়। অতএব, লৈঙ্গিক প্রকারের সাথে সামঞ্জস্যশীল সামাজিক ভূমিকা তথা gender identity-ও নিতান্ত বাস্তব সত্য। তার মানে হলো, gender specificity বা gender difference-কে gender discrimination-এর সাথে গুলিয়ে ফেলাটা বোকামী ও ভুল।

এই কথাটা এখানে বলার মানে হলো, নারী-পুরুষের জেন্ডার স্পেসিফিসিটিকে যথাযথভাবে স্বীকার করে নিতে হবে। নারীদের হতে হবে আত্মমর্যাদাশীল। নারীদের প্রতি পুরুষদের আচরণ হতে হবে মর্যাদাশীল। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‌‘ওয়া লাকাদ কাররামনা বানী আদম’ (আদম সন্তানদেরকে আমি মর্যাদা দান করেছি)। অতএব, যে বনী আদম বা বনী আদমদের যে কমিউনিটি মানবিক সমতার ক্ষেত্রে কোনো ক্ষেত্রে নাজুক অবস্থায় থাকবে বা বঞ্চিত হবে, ন্যায্য বিতরণ (equitable distribution) ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের প্রাপ্যতাকে নিশ্চিত করতে হবে।

নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিগত অমর্যাদার বিষয়টিকে সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়ভাবে মোকাবিলা না করে নিছক আইনের মাধ্যমে নারীর অধিকার আদায় ও নারী নির্যাতন বন্ধ করতে চাওয়া হলো স্থূলবৃত্তির পরিচায়ক। আমি দুঃখিত, এ ধরনের মন্তব্য করার জন্য।

ধর্ষণের অপরাধে যারা ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট চান, তারা চুরি-ডাকাতির ইসলামসম্মত শাস্তির বিরোধিতা করেন কেন?

চোরের হাত কেটে দেয়ার আইনকে যারা অমানবিক মনে করেন, তারাই দেখি ধর্ষকের লিঙ্গ কেটে দেয়ার অথবা কল্লা কেটে দেয়ার আইন করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছেন। অথচ, ‌‘জেনুইন ধর্ষণ’ হলো রীতিমতো ডাকাতি করার মতো অপরাধ। এক অর্থে তা ধর্ষকের দিক থেকে ব্যাভিচার তো বটেই। ইসলাম ধর্মে এই অপরাধের যথোচিত শাস্তির ব্যবস্থা আছে।

রাজনীতির বিরোধিতা নয়, লক্ষ্য হলো রাজনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন

ধর্ষণের জন্য যারা রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারকে দায়ী করছেন তারা বাহ্যত রাজনীতির বিরুদ্ধে বললেও আসলে তারা চাচ্ছেন রাজনৈতিক অপব্যবস্থাকে সঠিক ব্যবস্থাপনায় ফিরিয়ে আনতে। তাদের এই চাওয়াটার লক্ষ্য হলো বিদ্যমান গণসম্মতির উন্নয়ন।

এই দৃষ্টিতে দেখলে দেখবেন, বর্তমানে দেশে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দলকে যেভাবে দায়ী করা হচ্ছে, তা পলিটিক্যাল নয়। বরং, সোশ্যাল। দিনশেষে তা সমাজের গণসম্মতিতে ধর্ষণের প্রতি ‌‘হলুদ কার্ড’ দেখানো টাইপের ব্যাপার। এভাবে প্রতিবাদ অব্যাহত থাকলে এক পর্যায়ে তা হয়তোবা প্রতিরোধের রূপ নিতে পারে। আমিও চাই, ধর্ষণের ঘটনায় ‌‘লাল কার্ড’ দেখানোর ব্যাপারে আমাদের সমাজে প্রবল গণসম্মতি তৈরি হোক।

একটা ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা তৈরি হোক। যাতে সমাজের সবগুলো শক্তি যার যার ক্ষেত্রে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। পরোক্ষভাবে পরস্পর পরস্পরকে কন্ট্রিবিউট ও কন্ট্রোল করবে। সে অবস্থায় সামাজিক অপরাধীদের আর রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা কোনো ধরনের আশ্রয় থাকবে না। সমাজের প্রতিটা সেক্টর ও প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে কাজ করবে। সর্বোপরি চাই, তৈরি হোক সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক। রাষ্ট্রবিহীন সমাজ বা সমাজহীন রাষ্ট্র, এগুলো নিছকই উৎকট ও অবাস্তব কল্পনা। যেখানে সমাজ ও রাষ্ট্র উভয়টাই শক্তিশালী, সেখানেই মানবজীবন হতে পারে সর্বাপেক্ষা সুখময়।

কেন আমি ধর্ষণের অপরাধে ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের বিরোধিতা করি

অপরাপর সব আইনের মতোই, সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন না করে, সোজা কথায়, সমাজ-মননকে প্রস্তুত না করে দণ্ডবিধি চাপিয়ে দেয়াকে আমি অন্যায্য ও অনুচিত কাজ বলে মনে করি। habituality-কে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করার জন্য necessity’র বিষয়গুলোকে আগে মিনিমাম লেভেলে ফুলফিল করতে হবে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য ‌‘ইসলামী শরীয়াহ বাস্তবায়নে ক্রমধারার অপরিহার্যতা’ শিরোনামে আমার লেখাটা পড়তে পারেন।

নারী অধিকার প্রসঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য বা প্যারাডাইম কনফ্লিক্ট

ধর্ষণের বিরুদ্ধে যারা কথা বলছেন, বা মোটাদাগে যারা নারী অধিকারের পক্ষে কথা বলছেন, তারা দৃশ্যত দুইটা বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। পাশ্চাত্য নারীবাদের সমর্থকগণ মনে করেন, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষজনের মধ্যে সম্মতিসাপেক্ষে যে কোনো ধরনের যৌন সম্পর্ক বৈধ ও যথোচিত। অপরদিকে, রক্ষণশীল ও ধার্মিকগণ মনে করেন, পারস্পরিক সম্মতি তো থাকতেই হবে। কিন্তু এটি যথেষ্ট নয়। বরং, বিপরীত লিঙ্গের হওয়া, একই যৌনকর্মে দুইয়ের অধিক যৌনসঙ্গী একসাথে অংশগ্রহণ না করা, ইনসেস্ট না হওয়া, এই সম্পর্কের ব্যাপারে সাধারণ সামাজিক অবগতি সম্পন্ন হওয়া ও সংশ্লিষ্ট পুরুষের পক্ষ থেকে সন্তান প্রতিপালনসহ সংশ্লিষ্ট নারীকে অর্থনৈতিক সমর্থন দেয়া, এগুলো থাকা জরুরী। এই সবকিছু থাকলেই উক্ত প্রকারের যৌন সম্পর্ক বৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

এই ধরনের সম্পর্ককেই বলা হয় বৈবাহিক সম্পর্ক। এই ধরনের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য অনুষ্ঠানাদি যা করা হয় তা সেকেন্ডারি লেভেলে গুরুত্বপূর্ণ। কলেমা পাঠ করে হোক বা মন্ত্র পাঠ করে হোক, কিংবা এগুলোর কোনোটিই না হোক, উপরে উল্লেখিত বিষয়সমূহ মেনটেইন হলেই তা বৈবাহিক সম্পর্ক। বলাবাহুল্য, রক্ষণশীল ও ধার্মিকদের দৃষ্টিতে, বৈবাহিক সম্পর্কই হলো যৌনতার একমাত্র উপায়।

যৌনতার ব্যবস্থাপনা নিয়ে বৈবাহিক সম্পর্কের মতো একটা ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা যারা করেন, তাদের অবস্থানের পক্ষে আমি কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি খুঁজে পাই না। দৃশ্যত তারা পাশ্চাত্যের আদলে যৌন স্বাধীনতা চান। তো, যেখানে এ ধরনের অবাধ যৌন স্বাধীনতা থাকবে সেখানে যৌন সহিংসতাও থাকবে। সমকালীন পাশ্চাত্য সমাজ ও রাষ্ট্রে এমন একটা চিত্রই আমরা দেখতে পাই।

হ্যাঁ, আমাদের সমাজে বৈবাহিক সম্পর্কের যে সরলতা থাকার কথা, তা নাই। এর উদাহরণ হলো, ঘরটার দেয়াল, ছাদ, দরজা, জানালা ইত্যাদিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তো, এই ক্ষেত্রে করণীয় কী হতে পারে? ঘরটা ভেঙ্গে ফেলে উন্মুক্ত স্থানে বসবাস শুরু করা? নাকি, সেই ঘরটা মেরামত করা?

ডিসক্লেইমার

ধর্ষণ নিয়ে সব পয়েন্ট কাভার করে, এটি এমন লেখা নয়। আবার গণসম্মতি নিয়ে এটি একটা পূর্ণাঙ্গ লেখা, ব্যাপারটা এমনও নয়। বরং, শিরোনামে যা বলেছি, ধর্ষণের সাথে গণসম্মতির অন্তঃসম্পর্ক নিয়ে আমি এখানে কিছু প্রয়োজনীয় কথা বলার চেষ্টা করেছি। এবং এই লেখাটি সংযোজিত ভিডিও বক্তব্যটির হুবহু ট্রান্সক্রিপ্ট নয়।

Comments are closed.