ধর্ম ও সংস্কৃতিতে পোশাক, প্রতীক ও চিরন্তনতা

ভূমিকা

ধর্ম, সমাজ-সংস্কৃতি ও জীবন প্রণালীতে অনেক ধরনের কাজ, পেশা, আচরণ ও বিধিবিধান থাকে। এগুলোর মধ্যে গুরুত্বের মাত্রা থাকে, মূল্যবোধের ভিন্নতা থাকে এবং অনেক বিষয়ে স্তরের পর স্তর থাকে।  কোরান, হাদিস, কিয়াস ও ইজমার ভিত্তিতে গঠিত ইসলামী শরিয়ায় এইসবের স্থান ও পার্থক্য নির্ধারিত ও নিরূপিত হয়। প্রাথমিকভাবে মুসলিম সমাজে সকল সদস্যের জন্য ইসলামী জ্ঞানের প্রয়োজন। এর অভাব হলে সমাজ সংকটের মুখামুখি হবে। কালের গণ্ডিতে যদি ইসলামের সামাজিক শিক্ষা-ব্যবস্থা ক্রুটিপূর্ণ বা অপর্যাপ্ত হয়ে পড়ে তবে তার সন্তানগণ কোন কর্মের মাত্রাভিত্তিক স্থান কোথায় এবং কোন্‌ বিষয় কতটুকু গুরুত্বের, সেই জ্ঞান পাবে না। তারা ইচ্ছে মোতাবেক কথা বলবে। এতে সমস্যাও হবে। আমাদের মুসলিম সমাজের অবস্থা এখন এই পর্যায়ে। দেখা যেতে পারে যে কোথাও আল্লাহর আইন তোলে দেয়া হচ্ছে কিন্তু তার অনুসারীদের মধ্যে কোনো সাড়া শব্দ নেই, শিক্ষা ব্যবস্থায় কুফুরি নীতি নৈতিকতা বা থিওরি সংযোজিত হচ্ছে কিন্তু এই ব্যবস্থার বিপক্ষে কোনো কালাম/প্রতিবাদ নেই। তারাই আবার এইসব ‘কাণ্ডে’ শরিক হতে দেখা যেতে পারে। সেক্যুলার রাজনীতিতে অনৈসলামী আইন,অনৈসলামী শিক্ষা ঠিক আছে বলে গ্রহণ করে এবং নিজেদের অবস্থানকে “অরাজনৈতিক” ব্যাখ্যায় এনে সেই সেক্যুলার ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ও জারি রাখার সহায়ক হতে পারে। উপরন্তু, কোনো মুসলমান দল বা গ্রুপ যদি সেই সেক্যুলার নীতি-নৈতিকতার ও শিক্ষার বিপক্ষে দাঁড়ায় তবে সেক্যুলার এবং অমুসলমানদের সাথে মিলে কুফুরি আইন, সামাজিক প্রথা ও ব্যবস্থাপনা ঠিকিয়ে রাখতে ওদের পক্ষ হয়ে সেই মুসলমানদের বিপক্ষে উলটা ফতোয়াবাজিতে নিমজ্জিত হতেও দেখা যেতে পারে! ঘটনা আবার অন্যান্য অঙ্গনে নাটকীয় হতে পারে। সমাজের চতুর্দিকে দেখা যাবে নামাজ নেই, রোজা নেই, যুবক যুবতিরা মিলে ক্লাব-সংঘ গড়ে নাচে গানে ও বেহায়াপনায় মাতোয়ারা হচ্ছে কিন্তু কোনো উচ্চ-বাচ্য নেই। কারণ ব্যক্তি তো অরাজনৈতিক! আর সমাজ সেক্যুলার! আবার দেখা যাবে একটি ছেলে হয়ত এই পরিবেশ থেকে উঠে এসে কোনোভাবে নামাজ পড়া শুরু করেছে কিন্তু টুপি মাথায় টুপী নাই! হায়, হায়রে! তাই, তার ঘরে গিয়ে দীনের ‘সঠিক’ দাওয়াত পৌঁছনোর গুরুত্ব বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। অথবা নামাজের ইক্বামত হয়েছে, সবাই দাঁড়িয়ে গিয়েছেন কিন্তু তখন এক ব্যক্তির জামা টেনে বলা হচ্ছে, ‘ভাই, আপনার ট্রাউজারের নিচের সীমা ভাঁজ করে গোড়ালির উপরে তুলুন।’ আজ দ্বীনের তারতীব অনেকের কাছে এভাবেই উলট-পালট। এভাবেই বড় হয়ে চোখে পড়ছে জামা-কাপড়, দাড়ির দৈর্ঘ্য, জামার কাটিং, আতর প্রকৃতিগতভাবে বিশুদ্ধ না ক্যামিকেলি রিফাইন্ড -তা আর এসব নিয়ে কারা খাটি দ্বীনের উপর আছেন আর কারা বিচ্যুত হয়ে পড়েছেন, সেইসব বিষয়ের ফতোয়া। আজ ইসলামের বৃহৎ চিত্র চোখে নেই, আছে এগুলো।

আমার গত আলোচনায় প্রতীক-বিষয়ে সেক্যুলার গোষ্ঠী থেকে আগত কিছু কথা ধর্মীয় অঙ্গনে প্রতিফলিত হয়েছে অনুভব করে বলেছি। কোনো একটি প্রবন্ধে সব কথা বলা যায় না। তাই, এখানে, কেবল পোশাক-আষাক ও সমাজ নিয়ে কিছু কথা বলব, তাও সমাজধর্মীয় (socio-religious) প্রেক্ষিত থেকে। আমার কথা যে কেউ গ্রহণ করতে হবে এমনটি নয়, কেবল পাঠ করলেই চলে।

পোশাক পোশাক পরিচ্ছদ, কাল ও সামাজিক অবস্থা  

প্রাণী জগতের মধ্যে কেবল মানুষই পোশাক-আষাক পরে। তারা যে সমাজ সংস্কৃতি গড়ে তাতে  পোশাক অর্থবহ হয়,এটি তাদের মর্ম জগতের একটি অংশ।

পোশাক পরিচ্ছদ যেমন গোপন অঙ্গ ঢেকে রাখে তেমনি তাদের সৌন্দর্যও বৃদ্ধি করে। শালীন কাপড় পরা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, নিজেদের ছবি-ছুরৎ সুন্দর করে রাখা –এগুলো ভাল জিনিস এবং এই ‘ভালোর’ অনুকূলে যেমন অনেক ধর্মীয় কথা ও বাণী আছে তেমনি সেই কথা ও বাণীর পিছনে আছে অনেক সামাজিক বাস্তবতা, প্রথা ও সংস্কৃতি। আমাদের কোনো কাজ-কর্মই প্রেক্ষিত বহির্ভূত হয় না। সপ্তম শতাব্দীর সামাজিক বাস্তবতা, স্বাস্থ্যগত দিক, যেমন মলমূত্র-নিষ্কাশন ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা, গৃহপালিত জন্তুর উপস্থিতি, এগুলোর বিচরণ, মলমূত্র; হাজার হাজার দাস-দাসী, এ সবের সমন্বয়ে গঠিত সমাজ; আবার কখনো কখনো বিভিন্ন স্থানে সকল প্রাণীর পরিত্যক্ত বর্জ্যের উপস্থিতি, পানির অভাব, অনেকের গায়ে মলিন বস্ত্র, অনেকের চুল-দাড়ি এলোমেলো, বিশ্রী –এইসব বিষয় ইসলামের অনেক রীতিনীতি ও নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে স্থান পায়। ইসলামের শুরুতেই ছিল সামগ্রিকভাবে পবিত্রকরণের আহবান যা বস্তু থেকে আত্মা পর্যন্ত পৌঁছে। নবীর (সা.) উপর অতি প্রথম পর্যায়ের একটি সূরাহ এভাবেই শুরু হয়,  ‘ওহে যিনি চাদরে আবৃত্ত, আপনি উঠুন এবং (মানুষকে) সতর্ক করুন আর আপনার প্রতিপালকের মহিমা কীর্তন করুন। আপনার পোশাক পরিচ্ছদ পবিত্র রাখুন এবং (সকল) অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকুন’(৭৪:১-৫)। লক্ষণীয় যে এখানে শারীরিক, বাহ্যিক (পরিধেয়) ছাড়াও আরেকটি মাত্রা সংযোজিত হয়েছে আর তা ‘পবিত্রতা’  যা অশরীরী আত্মা ছোয়ার অভিপ্রায়ে।

অপরিচ্ছন্নতা ও নানান পরিবেশ দূষণের ফলে সেকালে মাঝে মধ্যে মহামারি দেখা দিত। শহরের মত ঘনবসতির দূষণ থেকে বাচ্চাদেরকে বাঁচাতে সামর্থবানরা মরুর মুক্ত আবাসে ধাত্রী মাতার তত্ত্বাবধায়নে পাঠাতেন। সেদিনও মানুষ বুঝত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা শরীর, সমাজ ও পরিবেশ সুস্থ রাখে। তাই এসব ক্ষেত্রে ধর্মের আলোচনা আসবে এটা স্বাভাবিক। পোশাক ও পরিধেয় বিষয়ে যেমন ধর্মীয় বাণী, পরামর্শ, উপদেশ ইত্যাদি এসেছে তেমনি দৈহিক পরিচ্ছন্নতায়: চুল-দাড়ি কন্ট্রোলে রাখা, নখ কাটা, শরীরের অপরাপর স্থানে যেখানে চুল-টুল গজায় সেই স্থানসমূহ পরিচ্ছন্ন রাখা, খাবার পরিবেশনের আসবাবপত্র পরিষ্কার রাখা, প্রয়োজন শেষ হলে এবং রাতেও এগুলো ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখা, ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই হাত-মুখ ধোওয়া –এসবের ক্ষেত্রেও। এর সাথে আরও বিষয় ছিল। যেমন ফরজ গোসল, নারী ঋতু বতী হলে এবং সন্তান প্রসবের পর পরিচ্ছনতা অবলম্বন, ছেলে সন্তান হলে তার খাৎনা করানো ইত্যাদি। এসবের অনেকটি ছিল সকল নবীদের সুন্নত। ইব্রাহীম (আ.) নবুয়ৎ প্রাপ্তির পর তা নিজ হাতেই খাৎনা করেন। এই প্রথাটি ইয়াহুদী, খৃষ্টীয়ান ও মুসলিম সমাজে আজো বেঁচে আছে, তবে কিছু কিছু খৃষ্টীয়ান তা ছেড়ে দিয়েছে। উপরে যে ফিরিস্তি উল্লেখ করা হল সেগুলোতে ধর্মীয় সমাজের সমঝের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। এগুলো অবলম্বন করা জরুরি। তবে এসব যদিও গুরুত্বপূর্ণ, যদিও জরুরি তবে কোথাও কারো স্খলন ঘটলে সেই ব্যক্তি অমুসলমান হয়ে পড়বে না –এমনটি বলাও যাবে না। ইউরোপে কোনো এক অমুসলমান হয়ত ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হয়েছে কিন্তু আপনি গোটা ইসলাম এক পাশে রেখে তার পুরুষযন্ত্রের অগ্রভাগের খানিক চামড়া কাটতে হবে এই নিয়েই সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন, এটা কী হবে? শুনেছি, আমাদের বার্মিংহামে একটি মেয়ে মুসলমান হয়েছিল কিন্তু পরে তাকে বিভিন্ন গ্রুপের টানাটানি, হিজাব, নিকাব নিয়ে ঝামেলা, মসজিদে না যাওয়ার বয়ান –এসব সহ্য করতে না পেরে সে আবার তার আপন স্থানে ফিরে গিয়েছে! হইছে?

এই অবস্থায় আমরা আছি।

যাক, আগের কথায় যাই। সেদিনের সমাজে রোগ-ব্যাধি হলে সাদিনের (পুরোহিতের) কাছেও যাওয়া হত, তাদের দোয়া, উপদেশ বা ঔষধ যা’ই নির্দেশিত হত তা’ই মেনে চলা হত। এভাবে রেসালাত শুরু হওয়ার পর মানুষ সকল সমস্যায় নবীর কাছেও যেতেন। তিনি যা বলার বলতেন, যা করণীয় তার উপদেশও দিতেন। কিন্তু সবকিছু ধর্মের অংশ ছিল না, ওহীতে প্রাপ্ত ছিল না। নবী এবং মানুষ –এই পার্থক্য বার বার উদাহরণে এসেছে। কোরানের ১৮:১১০ আয়াতেও তা দেখা যায়।

ওহুদ যুদ্ধের সময় কোনো এক স্থানে সৈন্য মোতায়েন করতে রাসূল (সা.) নির্দেশ দিলে এক সাহাবি বলেন, আল্লাহর রাসূল এটা কি ওহীতে প্রাপ্ত ইঙ্গিত ভিত্তিক? তিনি বললেন, না। সাহাবি বললেন, তাহলে স্থানটি কৌশলগত দিয়ে ঠিক নয় আমরা বরং অপর স্থানে মোতায়েন করি। তিনি বললেন, ঠিক আছে। এক সময় রাসূল (সা.) লক্ষ্য করলেন যে মদিনাতে লোকজন খেজুরফুলে পরাগযোজন (pollination) করে। তিনি বললেন, তোমরা এটা না করলেও পারতে। কিন্তু পরে দেখা গেল খেজুরের ফসল ভাল হয় নি। এব্যাপারে তিনি বললেন, দেখ আমি তোমাদের মত একজন মানুষ। তবে আমি যখন ধর্ম নিয়ে তোমাদেরকে আদেশ নিষেধ করি সেটা ভিন্ন।  উল্লেখিত মর্মের আরও হাদিস রয়েছে যেগুলো রাসূলের মানবিক কথাবার্তা ও অভিমতের দিক প্রকাশ করে।   ওহীতে প্রাপ্ত বাণী ভিন্ন বস্তু, তা গায়ের মাতলু হলেও যে ওহীর কথা কোরানে স্থান পায়নি। প্রথম ও দ্বিতীয় ধারণা সম্বলিত অনেক আয়াত কোরানে আছে।

এবারে একান্ত বস্ত্রের কথা। আল্লাহ যখন নবী মুহাম্মাদকে (সা.) তাঁর রেসালতের দায়িত্ব দিয়ে পাঠান তখন আরব সমাজ যে পদ্ধতিতে জীবন যাপন করত সেখানে সেই পদ্ধতির ভিত্তিতে, যুগের পরিক্রমায়, গড়ে উঠেছিল সেই সমাজের সংস্কৃতি, রীতি-নীতি ও মূল্যবোধ। তারা শুধু গোপনাঙ্গ ঢাকার জন্যই কাপড় পড়তেন না। বরং সকল দেশের সকল কালের মত সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যও পরতেন। কাপড়েও আবার আকার-আকৃতি থাকত, স্টাইল থাকত, দামে কম-বেশি হত। শুধু তা’ই নয় তাদের যুগের আরাম আয়েশের ক্ষেত্রে অনেক উপভোগ্য সামগ্রীয়ও ছিল। তারাও অবসর সময় পেলে গল্প করত, কবিতা শুনত, উটের প্রতিযোগিতা করত, ভ্রমণ করত। এসব যে অতি স্বাভাবিক বিষয় তা অনুমেয়। আল্লাহ যখনই কোনো নবী রাসূলকে তাঁর বাণীসহকারে পাঠিয়েছেন তখন তিনি বিশেষ পোশাক-পরিচ্ছদ, জীবন-সামগ্রী, আলাদা কোনো ভাষা ইত্যাদি সহকারে পাঠান নি। তাই মক্কায় রেসালাৎ শুরু হওয়ার পর আমাদের নবী (সা.) ও আমাদের সাহাবীগণ (রা.)তাঁদের পূর্বের কাপড়-চোপড় পরিত্যাগ করে হঠাৎ নতুন কোনো পরিধেয় বস্ত্রে আবির্ভূত হতে হয় নি। বরং তাদের সমাজে যা কিছু ভাল, ভদ্র, সুন্দর এবং শালীন তা’ই অবলম্বন করেছেন।

দ্বীনের সমঝ ও শিক্ষা

সকল দেশে সকল সমাজে বাহ্যিক ও অন্তর্নিহিত বস্তু থাকে।  ইসলাম বুঝার সাথে সাথে সম্পৃক্ত হয় সমাজ, কাল ও ইসলামের চিরন্তনতা বুঝা। জীবন-যাপনের রূপ ও দৃশ্য রয়েছে। কোনো এক যুগে হয়ত পাওয়া যাবে উট, তাঁবু ও ধূসর-মরু কিন্তু ওখানে যে বাহন, প্রক্রিয়া, আবাসন ও পথও নিহিত সেই দৃষ্টি হারালে চলবে না। সমাজ, কাল ও চিরন্তনতা এখানে জড়িত। ইসলাম কালের আকার আকৃতিতে আবদ্ধ হবে না। সপ্তম শতাব্দীতে নাজিল হলেও ইসলামের অর্থ সপ্তম শতাব্দীতে আবদ্ধ নয়, এর ‘অর্থ’ কাল ও সমাজ ভেদী। এই অনুধাবন হচ্ছে ইসলাম বুঝার এক অপরিহার্য শর্ত। এই সমঝের অনুপস্থিতিতে হয়ত ইসলামকে কালের বন্ধনে আটকিয়ে দেয়ার মত হয়ে যেতে পারে।

পোশাকের প্রতীকী (ড্রেসকোড) ও তার অর্থ-প্রকাশক বিবৃতি (স্ট্যাটমেন্ট)  

আমরা সামাজিক প্রাণী। বিশ্বাসী প্রাণীও। আমাদের মধ্যে সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়। আমাদের কর্মে ‘অর্থ’ খুঁজি। পোশাক-আষাকেও প্রতীকীর বিষয় থাকে এবং প্রতীকীতেও ‘অর্থ’ থাকে। একেক ধরণের স্টাইল, কাপড়ের কাটিং, রঙের সমন্বয় ইত্যাদি একেক ধরণের অর্থ প্রকাশ করতে পারে। আবার কাপড় কীভাবে পরা হবে, দেহের কতটুকু কীভাবে ঢাকা হবে অথবা হবে না, তাতেও। প্রতীকীতে ড্রেস-কোড একটি বড় বিষয়। ভাষাতত্ত্ব, সেমিওলোজি (প্রতীক বা চিহ্ন ব্যবহারের বিজ্ঞান) নৃবিজ্ঞান, বিজ্ঞাপন-ইন্ডাস্ট্রি, সংস্কৃতি-বিষয়ক অধ্যয়ন ইত্যাদির ক্ষেত্রে ড্রেসকোড একটি আলোচিত বস্তু। ক্লড লিভাই-স্ট্রাউস (Claude Levi Strauss), রোলাণ্ড বার্থস (Roland Barthes) এবং এমন আরও অনেক রয়েছেন যারা ড্রেস-কোডকে ভাষার মত অধ্যয়ন করেছেন এবং  এই পরিসরটি বুঝতে অবদানও রেখেছেন। কাপড় ছাড়াও মানুষের আচরণ ও অঙ্গভঙ্গিও প্রতীকী অর্থ প্রকাশ করে। এ বিষয়টি বিশদভাবে অনুধাবন করতে কেউ আগ্রহী হলে আরভিং গফম্যানের (Erving Goffman) এর ‘জেন্ডার এডভারটাইজম্যান্ট’ (Gender Advertisement) পাঠ করে দেখতে পারেন। যদিও বইটি পণ্যের বিজ্ঞাপনে লিঙ্গ (gender) বিষয় কীভাবে সামাজিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক ‘অর্থ’ প্রকাশ করে এই বিষয়ের উপর একটি অধ্যয়ন, তথাপি আচরণগত অঙ্গভঙ্গি (behavioural symbol) কীভাবে অর্থ প্রকাশ করে সেই স্থানের  অন্তর্দৃষ্টিও স্থাপন করে।

একথা মনে হয় আর না বাড়ালেও চলবে যে পরিধেয় বস্ত্র প্রতীকীতে অর্থ প্রকাশ করে বা এক ধরণের বিবৃতি (স্ট্যাটমেন্ট) দিয়ে যায়। ইসলাম পরিধেয় বস্ত্রের মাধ্যমে যে স্ট্যাটমেন্ট দিয়ে যেতে চায় তা হচ্ছে ‘শালীনতা’, ‘ভদ্রতা’, এবং তার বিশ্বাস ও নৈতিকতার স্ট্যাটমেন্ট। এতে কোনো বিশেষ দেশের বিশেষ কাপড়ের বা কাটিঙের কথা একান্ত নির্দিষ্ট নয়। বলেছি, ইসলাম যখন নাজিল হচ্ছিল তখন লোকজন সেই কাল ও সমাজের পরিধেয় সংস্কৃতির ভিত্তিতেই তাদের শালীনতা, ভদ্রতা ও সুন্দরকে প্রকাশ করেছিলেন।  এরা ছিলেন আল্লামুখি মানুষ। আর তাদের মোকাবেলায় যারা ছিলেন আল্লাহ-বিমুখ তাদের অবস্থাতেও পার্থক্য ছিল। আমরা এই শেষোক্ত কথাটির তাৎপর্য আরেকটু অনুসন্ধান করতে চাই।

ড্রেসকোড ও অহংকার

যেহেতু ড্রেসকোড ও আচরণ ভিত্তিক প্রতীকীতে কিছু স্ট্যাটমেন্ট প্রকাশ পায় তাই এতে নানান অর্থের মধ্যে শান-শওকত, দাম্ভিকতা ও অহংকারের স্ট্যাটমেন্টও প্রকাশ পেতে পারে। প্রাচীন কালের রাজা-বাদশাহরা আড়ম্বরপূর্ণ বস্ত্র পরিধান করতেন। কোনো কোনো বস্ত্র এমন হত যে রাজা বা সম্রাট তা পরিধান করে যখন হেঁটে হেঁটে সিংহাসনের দিকে অগ্রসর হতেন, তখন তার চলনে ‘কায়দা’ (স্টাইল)  থাকত এবং প্রলম্বিত দীর্ঘবস্ত্র গালিচায় হেঁচড়ে চলত। এভাবে সিংহাসনে উপবিষ্ট হওয়ার দৃশ্য ভাব, গাম্ভীর্য এবং ক্ষমতার ‘অর্থ’ প্রকাশ করত। রাণীর কোনো বস্ত্র এতই দীর্ঘ হত যে দাসী-বাদীরা পিছন থেকে সেই বস্ত্রের চলা-পথ নিরাপদ করত। আরব বণিকরা রাজাধিরাজ না  হলেও আজকের পাহাড়সদৃশ বিত্তবানেরা যেমন বলিউড-হলিউড অনুকরণে আড়ম্বর প্রকাশ করেন তেমনি তারাও সেদিন  বস্ত্রে ও চলনে রাজাধিরাজের অনুকরণ করতেন।

ধনী আরবদের অসংখ্য দাস-দাসী, উট-উটনী, খেজুরবাগ থাকত এবং হরেক রকমের বস্ত্রের সমাহারে অনেকে নিজেদের শান-শওকত প্রকাশ করত। দীর্ঘ-বস্ত্র মাটিতে প্রলম্বিত হত। টেনে টেনে হাঁটত। গরীবের দিকে হীন দৃষ্টিতে তাকাত। এই আচরণভিত্তিক প্রতীক (behavioural symbol) ইবাদাত-প্রথায় যাবার মত ছিল না। তাছাড়া লম্বা জোব্বা রাস্তার নোংরা অশুচি ছুঁয়ে শুধু অপবিত্র করার সম্ভাবনা বহন করত না বরং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতি ও ঝুঁকির অনেক সম্ভাবনা বহন করত। মুসলমানগণ কাপড়ের অপবিত্রতা ও অহংকার থেকে দূরে থাকতে পায়ের টাখনুর উপরেই বস্ত্রের নিম্নসীমা টানতেন। তবে খেয়াল করলে প্রেক্ষিতের স্থানও ধরতে পারা যাবে। আবুবকরের (রা.) পরনের বস্ত্র নামাজের সময় ধীরে ধীরে কখনো টাখনুর নীচে চলে যেত। আবু বাকর (রা.) এই কথা রাসূলকে (সা.) জানালে তিনি বললেন, ‘আপনি তো তাদের একজন নন যারা (টাখনুর নীচে) দাম্ভিকতার সাথে (বস্ত্র) পরিধান করে।’ এখানে প্রথার পিছনের সামাজিক মানসিকতা ও উদ্দেশ্য লক্ষণীয়।

মুমিনগণ ইসলামে ‘উবুদিয়্যিতের’ (আল্লাহর দাসত্বের) জীবনে পদার্পণ করেন। তারা আত্মার কালিমা মুছে বিনয়ের পথ ধরতে এই ধর্মে আসেন। গর্ব-অহংকার কেবল সৃষ্টিলোকের মালিকের জন্যই শোভা পায়,  অন্যের জন্য নয়। আল্লাহ মানুষকে যা কিছু দান করেন তা তাঁরই মহৎ বিতরণ। তিনি কাউকে বেশি দেন এবং কাউকে দেন কম। বেশির অধিকারী কমের অধিকারীর উপর নীচ দৃষ্টি প্রক্ষেপণ করবে না, প্রাপ্তিতে দাম্ভিক হয়ে উঠবে না, এটা অন্যায়। এই অন্যায়টি অপর বান্দার হৃদয়-মহলকে মলিন করে দিতে পারে, যে মহল জুড়ে আছেন তার প্রতিপালক। আল্লাহর ধর্মে বান্দার নিজ সত্তা, তার রঙ-রূপ, তার জাতি-ভেদ, ধন-মান কোনো কিছুতেই গর্ব/অহংকার স্থান পেতে পারে না। এই চরিত্র ধ্বংস আনে। ইবলিস এরই উদাহরণ। সে’ই বলেছিল, ‘আমি তার (আদমের) চেয়ে উত্তম’ (কোরান)। আর অমনি সে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

তবে পরিধেয় বস্ত্রের সাথে যেমন স্থান কাল ও পরিবেশের বিষয় থাকে তেমনি সমাজ-শ্রেণী, পেশা এবং সুবিধা-অসুবিধাতেও। রাজমহলে গিয়ে যা দেখতে পাবেন তা ক্ষেতের ময়দানে গিয়ে দেখতে পাবেন না। এস্কিমো জাতিতে যা পাবেন, আরবে গিয়ে তা পাবেন না।

ধর্মীয় অঙ্গন ও কাপড়

কাপড়ের আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে এই যে একান্ত ধর্মীয় অঙ্গনে যেমন মসজিদ, মাদ্রাসা, চার্চ গির্জা মন্দির ইত্যাদিতে পরিহিত বস্ত্র ও সাজ-সজ্জা সবদিনই, সর্বসাধারণ থেকে কিছুটা ভিন্ন হতে দেখা যায়। এক ব্যক্তি তার আপন অঙ্গনে যে পোশাক পরে দৈনন্দিন কাজ-কর্ম সম্পন্ন করেন, অপর ব্যক্তি অন্য অঙ্গনে সেই একই কাপড় পরে ‘বিরাজিত’ হওয়া এবং এক কোনো ‘দৃশ্যে’ নিজেকে ‘জাহির’ করাতে মানানসই অনুভব নাও করতে পারেন। ইসলাম শালীন, সুন্দর, ভদ্র ও মানানসই বস্তুকে অগ্রাহ্য করেনি। কারো উপর অযথা বা অসংগত কোনো বোঝা অর্পণ করে নি। মানুষ তার নিজের বা এলাকার পোশাক পরিচ্ছদ, দৈহিক প্রকাশকে সঠিকভাবেই ‘মানসম্মত’ (acceptable standard) ভেবে থাকতে পারে এবং হয়ত ভেবে থাকতে পারে যে অন্যরা তাদেরটিই  অবলম্বন করে থাকুক। কিন্তু ইসলাম ঠিক এভাবে হয় না। এখানে ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, নফল, মুস্তাহাব, নিছক পছন্দ অপছন্দ ইত্যাদির ব্যাখ্যা-বিবেচনার  স্তর ও মাত্রা রয়েছে। এখানে নিয়মের বাইরে কঠোরতা নেই। জীবনের হাজারো প্রেক্ষিতে হয়ত কোরান হাদিসের টেক্সট পাওয়া যাবে না কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে যা ভালো এবং সুন্দর তা গ্রহণ করাতে কোনো নিষেধ নেই কেননা এতে অরিজিনাল পারমিসিবিলিটি প্রিন্সিপাল (الإباحة الاصلية) কাজ করে থাকে অর্থাৎ যা ভাল, সুন্দর, কল্যাণকর তা আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্ব থেকেই অনুমোদিত। ইসলামী শরিয়ত কোন্‌ কোন্‌ অঙ্গ ছতর (গোপানাঙ্গ) তা নির্ধারণ করেছে। এই ছতর সকল দেশের ভাল বস্ত্রেই ধারণ করা যেতে পারে। শালীনতা অবলম্বন করা যেতে পারে। আর সাজ-সজ্জা, এটাকে তো আল্লাহ হারাম করেন নাই।

তবে সকল ধর্মে, সকল জাতিতে, সকল গোত্রে, কিছু লোক কিছু লোক কোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে শক্ত অবস্থান প্রদর্শন করেন। এক্ষেত্রে ধর্মীয় সমাজ একচ্ছত্র নয়। বিজ্ঞানবাদীদের মধ্যে তা আছে। বিজ্ঞানের নিয়ম-নীতি দিয়ে যেসব সমস্যা বুঝা যাবে না এবং সমাধান দেয়া যাবে না সেসব ক্ষেত্রে তারাও বিজ্ঞানের ‘নাম-ভেঙ্গে’ চিৎকার করতে দেখা যায়। একটি ধর্ম-বিদ্বেষী নাস্তিক মহল প্রায় ৩০০ শো বছর ধরে বিজ্ঞানের নামে এভাবেই চিল্লাচিল্লি করে যাচ্ছে।

শেষ কথা

আজকের মুসলিম সমাজে ঐতিহাসিক কারণে ইসলামী জ্ঞানের অভাব ঘটেছে। ইউরোপের সেক্যুলার শক্তি আমাদের ধর্মকে সমাজের আইন, শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিকতা ও নৈতিকতা থেকে আলাদা করে দিয়েছে। অনেক কাল থেকে ধর্ম ব্যক্তিগত হয়ে পড়েছে। এক হেজেমনিক (hegemonic) শক্তির পরিমণ্ডলে বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্নভাবে ছোট ছোট উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছেন এবং যুগপৎ এভাবে করার ফলে নিজেরা যে কয়টি কাজ করে যাচ্ছেন সেগুলোর উপর এমনভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন যে নিজেদের ক্ষুদ্র পরিমণ্ডলকে জেদ ও ফতোয়ায় পরিপূর্ণ ইসলাম হিসেবে জাহির করছেন। আজ সকল দল সেই জেদি ভাব ত্যাগ করে সকল উদ্যোগকে, ক্ষুদ্র হোক অথবা বৃহৎ, পারস্পারিক ঐক্যে ও স্বীকৃতিতে আনার প্রয়োজন। সবাই দ্বীনের কাজ করছেন –এই এহসাসে আসতে হবে, এমনকি যারা সপ্তাহে একদিন জিকিরের মাহফিল করে যাচ্ছেন, তারাও। তারপর মিলিতভাবে শিক্ষা ব্যবস্থায় ও সমাজ ব্যবস্থায় সার্বিক পরিবর্তন আনতে হবে। কেউই যে অরাজনৈতিক নয় এবং ইসলাম যে ব্যক্তিগত নয় এই কথা বুঝতে হবে।তারপর কারা দোস্ত ও কারা দুশমন এই কথাও বুঝতে হবে। এই পথে মাত্র দুই দশক কাজ করতে পারলে ইনশাল্লাহ ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে। তারপর সকলের যৌথ প্রচেষ্টায় যুগের স্তূপীকৃত উলট-পালট পরিবর্তিত হবে, কোথায় কোন কাজের কোনো গুরুত্ব রাখে তা প্রতিষ্ঠিত হবে। মনে রাখতে হবে ধর্মে অবয়ব আছে বটে কিন্তু কেবল অবয়ব দিয়ে ধর্ম হয় না। ঈমান ও আমল সব চেয়ে বড়।

আজ এখানে সেখানে ধর্মে পরিবর্তন (সংশোধন) আনার যেসব সুর দেখা যায় তা ভুল। আমাদের সমস্যার স্থান ‘ধর্মে’ নয়, আমাদের মধ্যে। সুস্থ ব্যক্তিকে ঔষধ খাওয়াতে গেলে যেমন স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে তেমনি ঐক্যবিহীন সামাজিক-সত্তায় অযথা ঔষধ খাইয়ে দিলে ক্ষতিরও সম্ভাবনা হতে পারে। আমেরিকানরা বলে থাকেন, if it ain’t broke, don’t fix it -যদি কিছু বিকল না হয়ে পড়ে পড়ে তবে মেরামত করতে যাবেন না। অধর্মের প্লাবিত বন্যায় বৈক্তিক ধর্মের গায়ে মলম লেপে কাজ হবে না।

ইসলামের রঙ যে কোনো কাল ও সমাজ-সংস্কৃতিতে প্রবেশ করতে পারে। তারপর সেই কাল ও সংস্কৃতি ভেদ করে তার যাত্রা অব্যাহত রাখতে পারে। এখানেই ইসলামের মানবতা বিশ্বজনীনতায় রূপান্তরিত হয়; মানব কর্মের কল্যাণকর দিকসমুহ ইসলামেই ‘সংরক্ষিত’ হয়। ইসলামের ইতিহাস এই সাক্ষর বহন করে। এই স্থানের সমঝ গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সমাজ ইসলামে প্রবেশ করার কারণে তাদের সংস্কৃতির মহানুভবতা ও চিরন্তন বৈশিষ্ট্য সংরক্ষিত হয়েছে, যেমন সপ্তম শতাব্দীর আরবের মৌলিক ও মহৎ সার্বজনীনতা।  তাদের ভাল আচরণ, সুন্দর সংস্কৃতি, শালীনতার চর্চা ইসলামে বেঁচে গিয়েছে। শুধু তাদেরই নয়, আরও অনেকের।  ইসলামে জাতি-বিদ্বেষ নেই, কোনো ভাল বস্তু এ জন্যই পরিত্যাজ্য নয় যে তা অমুসলিম সমাজ থেকে উৎসারিত।

Loading

About এম_আহমদ

প্রাবন্ধিক, গবেষক (সমাজ বিজ্ঞান), ভাষাতত্ত্ব, ধর্ম, দর্শন ও ইতিহাসের পাঠক।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *