দয়া করে কাহিনী ফাঁদা বন্ধ করুন

ফারাজ হোসেন জঙ্গী কি জঙ্গী নয় এই তর্ক এখন হবেই। আর ফারাজ হোসেনকে হিরো বানাতে গিয়ে সেটা উসকে দিয়েছে প্রথম আলো।

গুলশানে হলি আর্টিজানের ঘটনা ঘটবার পরে যারা এখনও ভাবছেন বাগদাদ, আলেপ্পো, ত্রিপোলি, ফালুজ্জা ইত্যাদি শহরের মানচিত্র ঢাকার গুলশানের ভূগোল থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন তারা এখনও স্বপ্নে বাস করছেন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুদ্ধ সম্প্রসারিত হোল কেবল। যুদ্ধের আঁচ সবে আমাদের লাগতে শুরু করেছে। ‘Welcome to the Desert of the Real’। সূর্যের উত্তাপে জ্বলন্ত মরুভূমির আঁচের বাস্তবতার মধ্যে আসুন, আপনাদের নরম পা গুলো অগ্নিকুণ্ডে পড়ুক। বারুদের আগুনের উত্তাপটুকু টের পেতে থাকুন।

ওয়েল কাম টু দ্য ডেজার্ট অফ দি রিয়েল! ‘দ্য মেট্রিক্স’(১৯৯) ছবির মরফিউসের মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়েছি বলতে পারেন, কিম্বা এন্টারটেইনার স্লাভো জিজেক (Slavo Zizek)-এর ব্যাখ্যা না মানলেও তার বইয়ের শিরোনাম থেকে – কিছুই আসে যায় না। সত্য হোল এই যে আমাদের খাতায় লাশের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। হলি আর্টিজানের সঙ্গে যোগ করুন গুম খুন, আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, পুলিশী হেফাজতে হত্যা, ইত্যাদি। আপানাদের লিস্টি পূর্ণ করুন, যেসব লাশ আপনাদের তালিকা থেকে আপনারা নিয়মিত বাদ দিয়ে থাকেন, তাদের লাশ কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন?

দুনিয়াব্যাপী একটা যুদ্ধ চলছে, আর এই যুদ্ধে বাংলাদেশকে যুদ্ধক্ষেত্র বানাবার জন্য যে দুটি পত্রিকা দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা লতিফুর রহমানের প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার। নানার জন্য নাতিকে মূল্য দিতে হবে এটা কোন নীতি কিম্বা যুক্তি হতে পারে না, কিন্তু, ‘কোলেটেরাল ডেমেজ’ – এই ধারণাটি আমাদের আবিষ্কার নয়, প্রথম আলো-স্টার গ্রুপ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের যে যুদ্ধবাজদের সেবা করে এটা তাদেরই আবিষ্কার। এরাই মধ্যপ্রাচ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে, ড্রোন হামলা করে নিরীহ নারীপুরুষ সহ লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে দ্বিধা করে নি এবং এখনও করছে না। কে নির্দোষ আর কে নির্দোষ নয় এই ফারাক তারা করে নি, এখনও করে না।

আত্মমর্যাদা বোধ না থাকতে পারে, কিন্তু আনিসুল হককে আরও ইন্টেলিজেন্ট হওয়া দরকার ছিল। লতিফুর রহমানের চাকরি করি বলে ফারাজ হোসেনকে হিরো বানাবার কোন দরকার ছিল না। ‘পৃথিবী জেনে রাখো, ফারাজই বাংলাদেশ’! তাই কি? নিব্রাস ইসলাম, রোহান ইমতিয়াজ, মীর সানি মোবাশির, খায়রুল ইসলাম –এরা ‘জঙ্গি’ বলে কি বাংলাদেশ নয়? দয়া করে এই বাংলাদেশকেও চিনতে চেষ্টা করুন। প্যালেস্টাইন আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ার জনগণের সঙ্গে এই বাংলাদেশের সম্পর্ক গভীর। তাকে অস্বীকার করবেন না। বাংলাদেশের জনগণের ক্ষতস্থানগুলো বোঝার চেষ্টা করুন।

এই ছেলেগুলোর বাবা মায়েদের অভিযোগ তাদের ‘ব্রেইন ওয়াশ’ করা হয়েছে, ভুল পথে গিয়েছে বলে কি অস্বীকার করা যাবে তারা এই দেশে ধনীর ঘরে ধনীদের জন্য বানানো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ‘আধুনিক শিক্ষা’ লাভ করেছে? তাহলে আধুনিক শিক্ষাকেই আগে প্রশ্ন করতে শিখুন। তথাকথিত আধুনিক শিক্ষা কি ক্রমাগত ধর্মের বিরুদ্ধে, গরিব ও মজলুমদের বিরুদ্ধে রাতদিন নিরন্তর ‘ব্রেইন ওয়াশ’ করছে না? এতোদিন একতরফা মাদ্রাসার গরিব ছেলেদের গুলি আর বন্দুকের মুখে ঠেলে দিয়েছেন, এখন ধনীর ঘরের ছেলেদের দেখে আপনারা বিস্মিত! ফারাজকে নিব্রাস, রোহান ইমতিয়াজ, মোবাশিরের কাছ থেকে আলাদা করতে চান কেন? একপক্ষকে বানাতে চান দেবতা, অপর পক্ষকে দানব?

এটা অন্যায় । সো, ওয়েলকাম টু দ্য ডেজার্ট অফ দ্য রিয়েল।

আনিসুল হক শোনা কথার ভিত্তিতে ‘শুনেছি’ বলে গল্প ফেঁদেছেন।‘শুনেছি’ কথাটা তিনি নিজেই লিখেছেন। ফারাজকে হিরো বানাবার জন্য তার শোনা কথার বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে এখন যে সকল অভিযোগ উঠেছে তার সঠিক উত্তর দিলেই লাশ আর রক্ত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শেষ হয়। অথচ সত্য সত্যই যদি আমরা সকলের জন্য শোককাতর হই, যদি আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা ও ট্রাজেডিকে সামগ্রিক ভাবে বিশ্লেষণ ও বোঝার ক্ষেত্রে আমরা আন্তরিক হই, তাহলে মনিবকে সন্তুষ্ট করবার জন্য গল্প ফাঁদলে ক্ষতি ছাড়া লাভ নাই। ধরা খেতে হয়।

তবে ফারাজের গল্পের উৎস খুঁজলে জুলফিকার আলি মানিকের নাম আসবে। গীতা আকন্দ আর এলেন বারির সঙ্গে লেখা যে প্রতিবেদন নিউ ইয়র্ক টাইমসে ছাপা হয়েছে সেখানে তাঁরা লিখেছেন, ফারাজকে অস্ত্রধারীরা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু ফারাজ তার দুই বান্ধবীকে ছাড়া যেতে চায় নি। কিন্তু এই তথ্যের উৎস কি? উৎস হচ্ছে ফারাজের একজন নিকটাত্মীয় হিশাম হোসেন। তিনি কোথা থেকে এই তথ্য পেলেন? তিনি ‘ছাড়া পাওয়া এক জিম্মির কাছে থেকে ঘটনাটি শুনেছেন’। কে সেই ছাড়া পাওয়া জিম্মি? নাম নাই। আমরা জানি না। (দেখুন,Bangladesh Attack Is New Evidence That ISIS Has Shifted Its Focus Beyond the Mideast, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ২ জুলাই)। এই হোল নামহীন উৎসহীন সাংবাদিকতার নমুনা।

জুলফিকার আলী মানিক ডেইলি স্টারে কাজ করতেন। এখন সম্ভবত ঢাকা ট্রিবিওনে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে ইন্দো-মার্কিন স্বার্থে যেসকল সাংবাদিক কাজ করেন তাদের মধ্যে তিনি সামনের সারির সাংবাদিক হিসাবে পরিচিত।

ফারাজকে ছোট করা বা বড় করা কোনটাই আমার উদ্দেশ্য নয়। এটাও আমি আন্দাজ করতে চাই না যে শিল্পপতি লতিফুর রহমান আনিসুল হক বা জুলফিকার আলী মানিককে তাঁর নাতি সম্পর্কে এই ভাবে গল্প ফাঁদতে বলেছেন বা হুকুম দিয়েছেন। কিন্তু যখন আপনি স্বাধীন ভাবে চিন্তা ও বিচার করতে অক্ষম তখন মনিবকে সন্তুষ্ট করাই আপনার জীবনের পরম আরাধ্য হয়ে ওঠে।

কিন্তু এ কথা বলে আনিসুল হক বা জুলফিকার আলী মানিককে নিন্দা করাও আমার উদ্দেশ্য নয়। এতদিনে আমরাতো জানি আমরা কে কোথায় সমাজে অবস্থান করি। যারা এতদিন টুপি পরা মাদ্রাসায় পড়া গরিব ঘরের ছেলেদের ‘জঙ্গী’ বানিয়ে সুনাম কিনেছেন, বাংলাদেশকে একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে রূপান্তরের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদেরকে শুধু এতোটুকুই বলতে চাই, ব্রাদার্স এন্ড সিস্টার্স, দয়া করে কাহিনী ফাঁদা বন্ধ করুন, ওয়েলকাম টু দি ডেসার্ট অফ দ্য রিয়েল। আমরা কোলেটারাল ডেমেজে রক্তে ও লাশের স্তুপে পাহাড় হয়ে ওঠা বাস্তবের মরুভূমিতে আছি। একে স্বীকার করে নিন।

এবং আসুন, ঠাণ্ডা মাথায় ভাবি কিভাবে এই পরিস্থিতি আমরা সকলে মিলে মোকাবিলা করতে পারি।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *