তুরস্কের ঐতিহাসিক গণভোট ও কিছু কথা

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান ও তার দল একে পার্টি তুরস্কের সাংবিধানিক সংস্কার সাধণের জন্য যে ‘হ্যাঁ/না”  গণভোট গ্রহণ করেন তা ছিল নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। গত রবিবারে সংগঠিত এই গণভোটে ‘হ্যাঁ’ পক্ষ অর্থাৎ একে দল বিজয় লাভ করেছে।

ব্যালট গণনার পর এটা নিশ্চিত হয়েছে যে সরকার প্রস্তাবিত সংবিধান পরিবর্তনের পক্ষে ৫১.৪১% ভোট পড়েছে। আর অন্যদিকে ‘না’ ভোট পড়েছে ৪৮.৫৯%। ভোটদানের হার ছিল  সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশ।

এই ‘হ্যাঁ’ ভোটে তুর্কি সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশ শাসনে রাষ্ট্রপতির অফিসের ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পাবে। দেশে বিদেশে অনেক বিরোধীতা, বিশেষকরে বিশ্ব মোড়লদের নেতিবাচক ভুমিকা সত্ত্বেও এই গণভোটের মধ্যদিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ‘হ্যাঁ’ বিজয়ী হওয়ায় প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দেশটির জনগণের সিদ্ধান্ত স্পষ্ট হল। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের মতে তুরস্কের মাটিতে গণতন্ত্র যে পরিপক্ষ হয়েছে এটি তার একটি প্রমাণ।

একথা স্বীকার করতে হবে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ এর মাঝে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে।
এই গণভোট নিয়ে দেশটির কুর্দি, পিকেকেসহ কয়েকটি বিরোধীদল ‘না’র পক্ষে তুমুল প্রচারণা চালিয়েছে। এছাড়াও জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসহ ইউরোপীয় কয়েকটি দেশের এর পক্ষে প্রচারণায় বাধা প্রদান করে।

ইতিপূর্বে ‘হ্যাঁ’ ভোটের পক্ষে আয়োজিত এক জনসভায় তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান অভিযোগ তুলেছিলেন যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো তুরস্কের বিরুদ্ধে একটি নতুন ‘ক্রুসেডার জোট’ গঠন করেছে। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘ইইউ দেশগুলোর নেতারা ভ্যাটিকান গিয়ে অত্যন্ত বিনয়ীভঙ্গিতে পোপের বক্তব্য শুনেন। এখনো কি আপনারা বুঝতেছেন না, কেন ৫৪ বছর ধরে তুরস্ককে গ্রহণ করছে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন? অবস্থা বেশ জোড়ালো এবং স্পষ্ট, এটা হচ্ছে একটি ক্রুসেডার জোট। কিন্তু ১৬ এপ্রিল হচ্ছে সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত মূল্যায়নের দিন।’

বিদেশি প্রেক্ষিত সামনে রেখে প্রেসিডেন্ট রিসেপ এরদোগান তাই তুরস্কের আসন্ন গণভোটে ‘হ্যাঁ’র পক্ষে সমর্থন দেয়ার মাধ্যমে নাৎসীবাদের উত্তরাধিকারীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত জবাব দেয়ার জন্য ইউরোপে বসবাসকারী তুর্কি ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এরদোগান বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘তুরস্কের সম্মান ও গৌরব রক্ষার্থে আমরা তিন/চারটি ইউরোপীয় ফ্যাসিস্টকে মেনে নেব না।’

সমাবেশে মুসলিম সংহতি সম্পর্কে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই মুসলিম সংহতিকে পছন্দ করবে না। এসব দেশের নেতারা যা বলে আমি কখনো তার পরোয়া করি না। আমি কেবল আল্লাহ যা বলেছেন তারই পরোয়ানা করি।’
সুত্র;

‘হ্যাঁ’ ভোট জয়লাভ করার ফলে আর্টিকেল-১৮ সাংবিধানিক পরিবর্তন অনুযায়ী, তুরস্কের বর্তমান সংসদীয় পদ্ধতি প্রেসিডেন্টশিয়াল পদ্ধতিতে স্থানান্তরিত হবে। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বাতিল হয়ে যাবে এবং প্রেসিডেন্ট ব্যাপক নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী হবেন।

  • প্রধানমন্ত্রীর ভুমিকা বিলুপ্ত করে দুই বা তিন জন ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ তৈরি করা হবে।
  • প্রেসিডেন্ট হাতে পাবেন নতুন ক্ষমতা। তিনি মন্ত্রীদের নিয়োগ দেবেন, বাজেট তৈরি করবেন, সিনিয়র বিচারপতিদের অধিকাংশকে নিয়োগও দেবেন তিনিই, এবং ডিক্রি জারি করে কিছু বিষয়ে আইনও করতে পারবেন।
  • প্রেসিডেন্ট একাই জরুরি অবস্থা জারি করতে পারবেন, পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে পারবেন।
  • পার্লামেন্ট আর মন্ত্রীদের ব্যাপারে তদন্ত করতে পারবে না।
  • এমপিদের সংখ্যা ৫৫০ থেকে বাড়িয়ে ৬০০ করা হবে।
  • প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন একই দিনে হবে। প্রেসিডেন্ট দু মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না।

তবে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোটে এমপিরা প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবেন। প্রেসিডেন্টের বিচারের জন্য দুই তৃতীয়াংশ এমপির সমর্থন লাগবে।

গণভোটের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

এই গণভোটে জয়ী পক্ষ তুরস্কজুড়ে উল্লাস প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে পরাজিত গ্রুপ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক বিক্ষোভ করছে।

এদিকে গণভোটের ব্যাপারে বিবিসি সহ বিভিন্ন পশ্চিমা মিডিয়ায় ইতিমধ্যে নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হচ্ছে। তাদের মতে গণভোটে একে পার্টি এবং এরদোগান কোনো রকমে জিতলেও, কর্তৃত্ব অব্যাহত রাখা তাদের জন্য কঠিন হবে।

তবে সেই পুরানো অতীত থেকে আজ পর্যন্ত ওয়েন্টার্ন মিডিয়া ও সেক্যুলার আদর্শবাদীদের কাছে তাদের স্বীকৃতি দেয়া অবস্থানের নামই “গণতন্ত্র”! এর বাইরে আর কারও গণতান্ত্রিক কর্ম স্বীকৃত নয়। পরিত্যাজ্য। আর ইসলামের নামে কেউ যতই স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করুক না কেন, সেটা অগণতন্ত্রিক থেকেই যাবে! একে পার্টির বিজয়ের পর পশ্চিমা মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচারণা আবারও তাদের একগোয়েমি মানসিকতা প্রকাশের মাধ্যমে আরেকটি নতুন মাত্রা সংযোগ করল।

Comments are closed.