তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নেয়াই শ্রেয়

এমন বর্বরতা কেউ আর দেখেনি। ৯ বছরের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যিনি গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছিলেন। তিন-তিনবার দেশের মানুষ ভোট দিয়ে যাকে প্রধানমন্ত্রী করেছে। বর্তমান সময়েও দেশের অবিসংবাদিত নেত্রী যিনি। যার মুখের কথা শোনার জন্য দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে আসে হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষ। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হলে আবার যে যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, সে সম্বন্ধে কারো মনে সন্দেহ নেই, এমনকি সরকারের মন্ত্রীদেরও নেই কোনো সন্দেহÑ তাকে থাকতে হয় অবরুদ্ধ হয়ে। সমস্যা হয়েছে সেখানেই। তিনি কেন হবেন এত জনপ্রিয়। এ কথা জেনেই এরা গদি ছাড়তে রাজি নয়। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সরকারের জাতক্রোধের এই হচ্ছে কারণ।
সে জন্যই যাবতীয় দমন-পীড়ন তার বিরুদ্ধে। কিন্তু এরও একটা সীমা থাকা দরকার। ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বরেও খালেদা জিয়া আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। নিজে তিনি মাঠে নেমে নেতাকর্মীদের উদ্বুদ্ধ আর উদ্দীপিত করতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রক্ষমতার জবরদখলকারীরা তাতে প্রমাদ গুনেছিল। বালুভর্তি ট্রাক দিয়ে খালেদা জিয়ার বাড়ি থেকে বেরোনোর পথ বন্ধ করে দিয়েছিল এরা। এবার তিনি বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন। বাড়ি ছেড়ে গুলশানের কার্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পুলিশ বালু ও ইটের ট্রাক, জলকামান আর নিñিদ্র পুলিশি ব্যারিকেড দিয়ে বিএনপি ও ২০ দলের নেত্রীর অফিস ও বাসভবন অবরোধ করে রেখেছে। তাতেও এরা নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। অফিস ভবনের ফটকেও তারা তালা লাগিয়ে দিয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি বি. চৌধুরীসহ সব সাক্ষাৎপ্রার্থীকেও বাধা দিয়েছে পুলিশ। আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত জননেত্রী খালেদা জিয়া একবস্ত্রে রাতের পর রাত কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। মহিলারা এসেছিলেন তার বিরুদ্ধে এই অমানবিক আচরণের প্রতিবাদ জানাতে। তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ ‘পিপার -স্প্রে  (মরিচের গুঁড়ো) ছড়িয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া এবং আরো ১০ জন মহিলা তাতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
সত্য বলার অভ্যেস তাদের নেই
অবশ্যই এই দুই মন্ত্রীর বক্তব্য সত্য নয়। বস্তুত সরকারের মন্ত্রীরা তাদের বিশ্বাস করার জায়গাটুকু অবশেষ রাখেননি। এদের মূলনীতি হচ্ছে, ‘অসত্য বলিয়া পার পাইয়া গেলে কখনো সত্য কথা বলিবে না’। গণতন্ত্র হত্যা দিবসে প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ টেলিভিশন ভাষণ থেকেও সেটাই কি আপনাদেরও মনে হয়নি? আমার তখন ১৯৯১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ নেত্রীর ৪৫ মিনিটের টেলিভাষণের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। সে ভাষণে তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তার পরিবার সম্বন্ধে মিথ্যা ও কুৎসিত গালিগালাজই করেছেন শুধু। জাতীয় ও অন্তর্জাতিকভাবে সে ভাষণ প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছিল। এবারের ভাষণেও তিনি সে ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন, ভাষণে বিভ্রান্তিই ছড়িয়েছেন।
‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির’ (পাশের দেশের দশ কোটি বাঙালিও সেটা স্বীকার করে না) কসম খেয়ে তিনি অনর্গল যেসব কথা বলে গেছেন বাস্তব পরিস্থিতির সাথে তার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটা-দুটো দৃষ্টান্তই যথেষ্ট হবে। শেখ হাসিনা ‘বিএনপি ও জামায়াতের বিরুদ্ধে’ রেললাইন উপড়ে ফেলা, সড়ক অবরোধ ও হত্যার অভিযোগ করেছেন। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে জামায়াতকে সাথে নিয়ে আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ। সে আন্দোলনে দেশের বহু স্থানে রেললাইনের স্লিপার খুলে ফেলা, সড়ক ও অর্থনীতি অবরোধ করা হয়েছিল, বেশ কয়েকজন মানুষ খুন করা হয়েছিল। ২০০৬ সালে সেই তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতির অধীনে নির্বাচন না করার জন্য লগি-লাঠি-বৈঠার আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ। লাগাতার সেই আন্দোলনে প্রায় দুই ডজন মানুষ খুন করা হয়েছিল, বহু স্থানে রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে, বন্দর অবরোধ করা হয়েছে; এমনকি বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন ও পানিসংযোগ বিচ্ছিন্ন করে স্বয়ং রাষ্ট্রপতিকে অসহায় অবস্থায় অবরোধ করে রাখা হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের এসব মনগড়া অভিযোগের প্রতিটির জবাব দেয়ার ধৈর্য ও সময় কারো নেই। শুধু এ কথা বলাই যথেষ্ট হবে : আওয়ামী লীগ নেত্রী যেখানে যেখানে ‘বিএনপি-জামায়াতের’ কথা বলেছেন সেগুলো মুছে ফেলে সেখানে ‘আওয়ামী লীগ’ বসিয়ে দিলেই প্রকৃত পরিস্থিতি ফুটে উঠবে। কোনো মানুষই লক্ষ না করে পারবে না যে ‘রামের বোঝা রহিমের ঘাড়ে চাপানোতে’ এই সরকারের জুড়ি নেই। বস্তুত আওয়ামী লীগ নেত্রী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে গিয়ে কোনো মৌলিকত্বেরও পরিচয় দিতে পারেননি। তার ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯-২০১৫ সময়ের শাসনকালে সরকার ও শাসক দলের দিক থেকে যেসব দুষ্কৃতি করা হয়েছে, সেগুলোই তিনি ‘বিএনপি-জামায়াতের’ ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন।

তারা হাত-পা বেঁধে পেটাচ্ছে
সরকারপ্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নিন্দা-সমালোচনা করে ভাষণ দিলে প্রতিপক্ষকে তার জবাব দেয়ার সুযোগ দিতে হয়। এটা সভ্য সমাজের স্বীকৃত রীতি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিপক্ষ খালেদা জিয়া, বিএনপি ও জামায়াতকে দীর্ঘ সময় ধরে সমালোচনা করেছেন, মিথ্যা অপবাদ দিয়েছেন। তার জবাব দেয়ার সুযোগ কাউকে দেয়া হয়নি। আসলে এটাই হচ্ছে এ সরকার আর শাসক দলের চরিত্র। এরা পিঠমোড়া হাত-পা বেঁধে প্রতিপক্ষকে পেটাবে, তাদের প্রতিবাদ করারও সুযোগ দেয়া হবে না; কেননা তাদের মুখে কাপড় গুঁজে দেয়া হচ্ছে। সারা দেশ এখন জেগে উঠেছে। গণতন্ত্র হত্যা ও মানবতাবিরোধী জঘন্য নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণজাগরণ ঘটেছে। আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ, সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার, দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া ইত্যাদি অজস্র দৃষ্টান্ত আছে এ সরকারের বাকস্বাধীনতা হরণের। এখন আবার তারেক রহমানের বক্তৃতা প্রচারের দায়ে একুশে টেলিভিশনকেও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
এ সরকার আশা করছে, খালেদা জিয়াসহ নেতানেত্রীদের জনসাধারণের কাছ থেকে দূরে দূরে রাখা গেলে আন্দোলন নেতিয়ে যাবে, তাদের দখলদারী স্বত্বের শোষণ বজায় থাকবে। তিন দিন আগে বিএনপির যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় গ্রেফতার করা হয়েছে। বিএনপির নিজেদের কার্যালয়কে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও এখন গ্রেফতার করেছে পুলিশ। নেতানেত্রীদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এখন আবার মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, হত্যার অভিযোগে নাকি খালেদা জিয়াকেও গ্রেফতার করা হতে পারে।
দেশের বাকি অংশের সাথে সড়ক ও নদীপথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে এরা রাজধানীকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। এরা আশা করছিল, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মতো এবারো তারা রাজধানীকে অবরুদ্ধ দুর্গে পরিণত করে আত্মরক্ষা করবে। কিন্তু এখন প্রমাণ হয়ে গেছে যে তাদের সে গুড়ে বালি। বিশেষ করে ৬ জানুয়ারি মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া অবরোধ কর্মসূচিতে রাজধানীর মানুষও পুরোপুরি অংশ নিচ্ছে।

খালেদাকে গ্রেফতার করে লাভ হবে না
নানা বিতর্কে বিতর্কিত সরকার ও তার মন্ত্রীদের উল্লসিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। গণতন্ত্র হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দিনেই দেখা গেছে পুলিশ, র‌্যাব আর বিজিবি দিয়ে আন্দোলন থামানো যায়নি। ছাত্রলীগ আর আওয়ামী লীগের ক্যাডারদেরও মাঠে নামাতে হয়েছে সহায়তার জন্য। গণতন্ত্র হত্যা দিবস ৫ জানুয়ারিতেই তারা চারজনকে হত্যা করেছে, আড়াই শ’ মানুষ জখম করেছে এবং গ্রেফতার করেছে আড়াই হাজার। শুনেছি ওই এক দিনে প্রায় আট হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। কিন্তু জনতার আন্দোলন থেমে যাওয়ার পরিবর্তে আরো উদ্বেল হয়েছে। রাজধানীকে তারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে অবরুদ্ধ দুর্গে বাস করার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু কোনো লাভ হবে না তাতে। সরকারের নির্যাতন যত তীব্র হবে জনতার প্রতিরোধও ততই বেড়ে যাবে। খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ রেখে অথবা জেলে নিয়ে সরকারের কোনো লাভ হবে না।
এ সরকারের পক্ষে এখন একটাই মাত্র পথ খোলা আছে। অবিলম্বে ঘোষণা করতে হবে, তারা তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতিতে নির্বাচন করতে রাজি আছে। এবং সে অনুযায়ী অবিলম্বে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। এর মধ্যে সবার মঙ্গল নিহিত, সে কথা ভুললেই সমূহ বিপদ।
লন্ডন, ০৬.০১.১৫

পুর্ব প্রকাশিত নয়া দিগন্ত

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *